0
924

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৬
_____________

জোহান এগিয়ে এলো মিতুলের কাছে। প্রায় এক হাতের মতো দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“এখানে কী করছো? একটু পর রাত নামবে, এখানে কী কাজ তোমার?”

মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে চাওয়া ছিল বড়োসড়ো একটা বোকামি। এখন এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কী করতো ও? নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে সারা রাত জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতো! বোকা মেয়ে! দিনের বেলায় ঢুকতে চাইলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু এই রাত্রি নামার ক্ষণে…
মিতুল চোখ তুলে জোহানের দিকে তাকালো। একটু আগে জোহানকে খানিক ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না। তবুও কেন যেন একটু ভয় লাগছে অবশ্য। জোহানের মুখে রাগের প্রলেপ নেই কোনো। গাম্ভীর্যের ছায়া দেখা যাচ্ছে একটু।
মিতুল মুহূর্তেই একটা কথা বানিয়ে বলে দিলো,
“আমি বনের ভিতরের গাছ গুলো দেখছিলাম। আর কিছুই নয়।”

“গাছ কেন দেখছিলে? যেকোনো একটা গাছ চূজ করে তার সাথে প্রেম করতে চাইছিলে বুঝি?” কথাটা বলে গাম্ভীর্য মুখে ফিচেল হাসি ফোঁটায় জোহান।

মিতুল খানিক রেগে বললো,
“কীসব বলছো? গাছের সাথে আবার প্রেম করে কীভাবে?”

জোহান হাসি থামিয়ে মিতুলের আরেকটু নিকটে এসে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে ছোট্ট(খাটো) মিতুলের সমানা হওয়ার চেষ্টা করে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“শোনো বেঙ্গলি মেয়ে! এই জঙ্গলে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। যাদের দেহ লোম দ্বারা আবৃত। যাদের আছে ধারালো বড়ো বড়ো দাঁত, বড়ো বড়ো নখ। যারা এক থাবায় তোমার বুক থেকে তোমার হৃদপিণ্ড বের করে আনতে পারে। বুঝেছো? তোমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকেছে আমার কথাগুলো?”

মিতুলের আত্মা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। হিংস্র প্রাণীতে ওর ভয় লাগছে কি না জানে না, তবে জোহান যেভাবে বললো, তাতে ভয়ের তীব্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে ছিল। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। জোহানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জোহানকে এড়িয়ে দ্রুত পদে এগোতে লাগলো ঘরের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্যও নিজের গতি থামালো না।
এতটা দ্রুতই নিজের রুমে দিকে ছুটছিল যে, প্যাসেজ ওয়েতে বেখেয়ালে জায়িনের সাথে ধাক্কা লাগলো।
জায়িনের হাতে কিছু ফাইল পত্র ছিল, যা পড়ে যায় ফ্লোরে। মিতুল তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।
জায়িন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হয়তো এত দ্রুত পদে ওর ছোটার কারণ ভাবছে সে। মিতুল জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত ফ্লোর থেকে ফাইলগুলো উঠিয়ে দিলো। স্যরি বললো জায়িনকে।

জায়িন কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে, নিজের ফাইল নিয়ে নিচে নেমে গেল।
মিতুল পিছন থেকে মুখ বাঁকালো। ইশ, এমন একটা ভাব করে যেন, রাজার ছেলে রাজপুত্র এসে গেছে। মিতুল আবারও একবার ভেংচি কেটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

_____________

রাত নামার কিছুক্ষণ পরেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। উড়ে উড়ে পড়ছে শত সহস্র কুচি কুচি বরফদানা। কৃত্রিম আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করা এই রাত এবং শান্ত, ধীর গতিতে উড়ে উড়ে পড়া তুষারপাত, দুই মিলে পরিবেশ করছে এক অনন্য রাজ্য।
বসন্তের তুষারপাত উপভোগ করতে মানুষ এখন নিজেদের ঘর ছেড়ে বাইরে পদার্পন করেছে। গায়ে জড়িয়েছে পুরু উষ্ণ কাপড়।
রাস্তায় কিছু বাচ্চা ছেলে, মেয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। রাস্তায় অল্প অল্প করে জমতে থাকা বরফে বাচ্চাগুলো পা আটকে পড়ে যাবে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা হয় না। তারা দিব্যি দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে।
মিতুল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মন হারাচ্ছে অজানা, অচেনা মুগ্ধতায়। জীবনে এই প্রথম কাছ থেকে স্নো ফল দেখা। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে তুষার ছুঁয়ে দেখছে নীরবে। তুষারের ঠান্ডা পরশে একটু আধটু শিহরণ আঁকছে মনে।

জোহান দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুটা দূরত্বে। সেলফি, ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। একটা ছেলে জোহানকে ছবি তুলতে সাহায্য করছে।
মিতুল অবশ্য এ কাজটা আগেই শেষ করেছে।

জায়িন বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবার ভাব মূর্তি লক্ষ্য করছে সে। কিন্তু তার দিকে কারো বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।

রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে গিয়েছেন। আর একটু হেঁটে বামে বাঁক নিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবেন দুজনে।

সবাই যখন নিজ নিজ ভাবে ব্যস্ত, তখন মিতুল মনে মনে একজনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে। চোখের পর্দায় আলতো করে ভেসে উঠছে এক জোড়া ধূসর চোখ। যে চোখের গভীরতায় সাঁতার কেটে বেড়াতে ইচ্ছা করে মিতুলের। মিতুল কল্পনা করছে, ও এবং ওর প্রিয় ধূসর চোখের মানুষটি একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে। পাড়ি দিচ্ছে তুষার জমা পথ। আশপাশ জনমানবহীন। কেবল ওদের অনুভূতির সাক্ষী হয়ে ঝরছে মিহিদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কণিকা।

তুষার মানব তৈরি করার কাজে হাত লাগিয়েছে জোহান। ওকে ছবি তুলতে সাহায্য করা ছেলেটাও তুষার মানব তৈরিতে সহায়তা করছে।
বড়ো আকারের একটা গোলাকৃতির তুষারখন্ড এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে জোহান। বড়ো খন্ডটার উপর আরেকটা ছোট গোলাকৃতির খন্ড বসাতে হবে এরপর। সেটা তৈরিতে এখন জোরদার কাজ চালাচ্ছে। একের পর এক বরফ কণিকার আস্তরণ উল্টে-পাল্টে মেখে ছোট খন্ডটি তৈরি করে ফেললো। তারপর সেটাকে বড়ো খন্ডটির উপরে বসিয়ে দিলো।
ছোট খাটো একটা তুষার মানব তৈরি হয়েছে। সাফল্যের হাসি হাসলো জোহান। এরই মধ্যে ওর চোখ গেল কল্পনা বিমোহিত অন্যমনস্ক মিতুলের উপর। মিতুলকে দেখে জোহানের মনে দুষ্টুমির ভাবনা উদয় হলো। দুই হাতে রাস্তা থেকে কিছু তুষার তুলে নিলো, এবং তা ছুঁড়ে মারলো মিতুলের মুখ বরাবর।
আকস্মিক এমন ঘটনায় মিতুল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। বেরিয়ে আসলো ওর কল্পনা জয়ী রাজ্য থেকে।
মিতুলের অবস্থা দেখে জোহান হাসতে হাসতে শেষ। পারলে এই বরফ জমা রাস্তাতেই লুটোপুটি খায় অবস্থা। এমন ভাবে হাসছে যেন এরকম মজা সে আগে কখনো পায়নি।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের প্রতিটা শিরা উপশিরায় রাগের তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজন থাকায় মিতুল মুখে কিছু বললো না। মনে মনে হাজারও কথা শুনিয়ে নিজের তুষ্টি মেটালো।
জোহান রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতুলের রাগে ফুলো নাকটা লক্ষ্য করলো। যা দেখে ওর হাসি আরও বেড়ে গেল।

জোহানের উপর কিছুটা রাগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জায়িনের মাঝে।
মিতুলের মুখে জোহানের তুষার ছুঁড়ে মারাটা একদমই ভালো লাগেনি জায়িনের। কেন এত খারাপ লাগলো ঠিক জানে না! কিন্তু এতটাই খারাপ লেগেছে যে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে ও। জায়িন সত্যি সত্যি আর এখানে দাঁড়ালো না। তুষার জমা রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যেতে লাগলো। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে এখন। ফ্রেডি অনেক আগেই ফোন করে ডেকেছিল ওকে। ‘এখনই আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়েও কেন যেন তখনই নিজের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি জায়িন। কিছুক্ষণ বাড়ির সামনেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছিল।

_______________

মিতুল বেড রুমের বিশাল আকৃতির উইন্ডোটি মেলে দিলো। উইন্ডোর গ্লাসে কুচি কুচি বরফ জমে আছে। বাইরে এখন নীরব পরিবেশ। স্নো ফল থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মোবাইলে মায়ের মিসড কল উঠে আছে। মিতুলের কল ব্যাক করতে ইচ্ছা করছে না। মিতুল কল ব্যাক করলো না। পরে মা ফোন দিলে, ফোন ধরতে না পারার কোনো একটা কারণ দাঁড় করিয়ে দেবে। মিতুল গায়ের জ্যাকেটটা খুলে রেখে বিছানার নরম তুলতুলে কোলে গা ভাসালো।
মিতুলের মনে একটা জেদ চাপলো। কালকে যে করেই হোক সেই রেস্টুরেন্টে যাবে ও। না, রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। খাওয়ার ছুতো দিয়ে সেই ধূসর চোখ জোড়াকে একবার দেখতে যাবে। একা যাওয়া যায়। কিন্তু একা গেলে ব্যাপারটা কেমন হবে? না, একা যাবে না। রেশমী আন্টির সাথে…না রেশমী আন্টির সাথে যাবে না। জোহানের সাথে যাবে। ওর সাথেই তো গিয়েছিল আগের বার। ওর সাথে আরেক বার ওখানে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না ও। জোহান অহংকারী, বদমাইশ হলেও, তার পাশাপাশি একটু আহাম্মকও আছে।
হ্যাঁ, কালকে জোহানের সাথেই যাবে সেই রেস্টুরেন্টে।
মিতুলের হঠাৎ খুশি খুশি লাগছে। লজ্জাও লাগছে একটু। প্রথম কাউকে মনে ধরেছে ওর। আর এমন একজনকে মনে ধরেছে যাকে চেনেই না। সামান্য নামটা পর্যন্তও জানা নেই। ইশ, কে ভেবেছিল যে এমন করে কারো প্রেমে পড়বে! মিতুল লজ্জায় নিজের মুখ লুকালো দু হাতে। শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভেবে গেল কেবল ধূসর চোখ জোড়াকে।
এরপর উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগছে। মিতুলের মনে হচ্ছে, ও আগের চেয়ে একটু সুন্দর হয়েছে। আসলেই কি সুন্দর হয়েছে? না কি মনে তৈরি হওয়া সদ্য রঙিন অনুভূতির জন্য সবকিছু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছে? কোনটা?
মিতুল কাঁধ বেয়ে একটু নিচ ছুঁয়ে যাওয়া অদীর্ঘ চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। শুকনো ঠোঁট লিপ জেলে ভেজালো। কণ্ঠে তুললো গুনগুন করে বাংলা গানের সুর। বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খুলে চুলগুলো বেঁধে নিলো সযতনে। তারপর দরজা টেনে রুম থেকে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আপন মনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সিঁড়ির প্রান্তে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে জোহানের কক্ষ থেকে মিষ্টি গিটারের সুর ওর চলন থামিয়ে দিলো। গিটারের সুর বরাবরই ভালো লাগে ওর। মিতুলের মনে পড়লো কালকে রাতের কথা। কালকে রাতে জোহানকে গার্ডেনে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাতে দেখেছিল।
জোহান যে গিটার বাজানোয় দক্ষ, সেটা বুঝতে পেরেছে মিতুল। আচ্ছা, জোহান কি গান টান করে না কি?
জোহানের রুমের দরজা একটুখানি ফাঁকা। মিতুল উঁকি দিলো। রুমের ভিতর সোনালী আলোক রশ্মিতে জোহানকে দেখা যাচ্ছে। একমনে অনবরত গিটার বাজাচ্ছে ও। খুবই শান্ত একটি সুর বাজছে ওর গিটারে। একটুখানি ফাঁকা জায়গা দিয়ে মিতুল তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।

জোহানের গিটারে চালিত হাত দুটো হঠাৎ থেমে যায়। কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে,
“লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গিটার বাজানো দেখছো কেন?”

মিতুল চমকে গেল। কী করে বুঝলো যে এখানে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে? মিতুল প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“কী করে বুঝলে যে আমি এখানে আছি?”

জোহান গিটার রেখে উঠে আসে। একটুখানি ফাঁকা থাকা দরজাটা খুলে ফেলে সম্পূর্ণ।
গাম্ভীর্যের সাথে বললো,
“চুপিচুপি আমাকে লক্ষ্য করা ব্যাপারটা আমি খুব অপছন্দ করি। কখনো করবে না আর।”
বলে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

মিতুল তাড়াতাড়ি পিছন থেকে বললো,
“একটা কথা ছিল তোমার সাথে।”
আর মনে মনে বললো,
“এই অহংকারী ছেলে, নিজেকে কি রাজপুত্র ভাবো তুমি? চুপি চুপি না হয় একটু তাকিয়ে থেকে তোমার গিটার বাজানোই দেখছিলাম। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে?”

জোহান বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার সাথে? কী কথা আমার সাথে?”

মিতুল ভাবছে কালকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথাটা এখনই বলে দেবে।
মিতুল খানিক ইতস্তত করে বললো,
“কালকে আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here