চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ০৫

0
1361

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৫
_____________

মিতুল প্যাসেজওয়েতে পা রাখতেই দেখতে পেল ক্যামিলা জোহানের ঘরে ছুটছে ব্যস্ত ভাবে। কালকে রাতে যে ওটা জোহান ছিল একশ ভাগ নিশ্চিত মিতুল।
কালকে জোহান অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পর মিতুল বারান্দায় বসেছিল। জোহান কখন জঙ্গল থেকে বের হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু জোহান বের হয়নি। মিতুল অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায় বারান্দায়। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ভোরের আভা দেখা দেয়নি আকাশে। মিতুল বারান্দা ছেড়ে নিজের রুমে যাওয়া দেয়। কিন্তু এক রুম পর, জোহানের কক্ষের দিকে নজর পড়তে দাঁড়ায় আবার। জোহান ফিরেছে কি না প্রশ্ন উদয় হয় মনে। মিতুল জোহানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। না, জোহান রুমে ছিল না। দরজা বাইরে থেকেই লক ছিল।
জোহান ওই ঘন অন্ধকার জঙ্গলে রাতে একা একা কী করতে গেল, সেটা এখনও ভেবে পায় না মিতুল। কালকে রাতে গিটার বাজাতে দেখে দুঃখী ছেলে মনে হয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর সেই মনোভাব কেটে গিয়েছিল ওর। দুঃখী ছেলে মনে হচ্ছিল না তখন আর। অন্যকিছু মনে হচ্ছিল। কিন্তু অন্য কিছুটা ঠিক কী, সেটাই ভেবে উঠতে পারছে না এখনও।
তবে এখন এই ভাবনার থেকেও বড়ো ভাবনা হলো, ক্যামিলা এভাবে ছুটছে কেন জোহানের রুমে? ক্যামিলাকে অনুসরণ করে মিতুলও দ্রুত পায়ে ছুটলো জোহানের রুমে।
জোহানের রুমে পা রেখেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল মিতুলের। জোহান সারা রুম বমি করে মেখেছে। ওর ক্লান্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। মুখ কাত হয়ে আছে, তাই ফর্সা বাচ্চা মতন মুখটির একপাশ দেখা যাচ্ছে। দু চোখ বন্ধ, মুখে কীসব বলে চলেছে বিড়বিড় করে। অস্পষ্ট, জড়ানো কণ্ঠ। একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছে না। অবচেতন অবস্থায়ও হাতের ওয়াইন শূন্য বোতলটা শক্ত করে ধরে আছে। এক বোতল পান করলে এত বমি করার কথা নয়। রুমে শুধু একটা বোতলই দেখা যাচ্ছে। হয়তো আরও বেশি পরিমাণ পান করেছে, কিন্তু বোতলগুলো এখানে নেই। জোহানকে দেখে আধমরা মনে হচ্ছে!

জোহানের রুমের অবস্থার জন্য মিতুলের শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। বিষয়টা জায়িনের চোখ এড়ালো না। জোহানের রুমে সবাই উপস্থিত। রেশমী আন্টি, সাদাত আঙ্কেল, জায়িন, বাসার দুই মেইড। ক্যামিলা অনবরত জোহানকে ডেকে যাচ্ছে, আর ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাদাত আঙ্কেল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। জায়িনও নিশ্চুপই দাঁড়ানো। তবে সাদাত আঙ্কেলের নিশ্চুপতা একটু অন্যরকম। যেন নিশ্চুপতার থেকেও অধিক নিশ্চুপ।
রেশমী আন্টি মুখ বুজে নেই, সে একের পর এক বকা ঝকা করেই চলেছে জোহানকে।
জোহান এখন যেই অবস্থায় আছে, তাতে সেই বকা ঝকা জোহানের মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারছে বলে মনে হয় না। বাসার দ্বিতীয় মেইডটি জোহানের রুম পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। প্রথমেই জোহানের কাছের জায়গাটা পরিষ্কার করলো সে। কিন্তু পরিষ্কার করেও লাভ হলো না। জোহান সেই জায়গায় আবারও বমি করে দিলো।
মিতুল মুখ বিকৃত করে চোখ সরিয়ে নিলো।

রেশমী মিতুলের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,
“মিতুল, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ভয় পেয়ো না। এই পরিবেশে থাকার দরকার নেই তোমার। তুমি তোমার রুমে যাও।”

মিতুল নিশ্চুপ বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ওর পক্ষে আর ওখানে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। গা গুলিয়ে উঠছিল। কাউকে বমি করতে দেখলে ওর নিজেরও বমি পায়। তবে মিতুল আরও একটা বিষয় খেয়াল করেছে। জোহানের ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে ছিল। চোখের পার্শ্ব স্থানেও ছিল লাল বর্ণের প্রতিক্রিয়া। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ মেরেছে। কিন্তু মারলো কে?
হঠাৎ রেশমী আন্টির জোহানকে বলা একটি কথা মনে পড়লো। রেশমী আন্টি বলেছিলেন,
‘নিষেধ করেছিলাম তোমাকে ওদের সাথে ঝামেলা না পাকাতে। আবার মার খেলে তুমি! আজকেও যদি ঘটনাটা পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত যেত, তাহলে তোমাকে একেবারে মেরেই ফেলতাম!’

রেশমী আন্টি কাদের কথা বুঝিয়েছেন? জোহান কি এর আগেও মার খেয়েছে? পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার কথা কেন বললেন? মারামারির জন্য?
মিতুল নিজের রুমে গেল না। এসব ভাবতে ভাবতে লনে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ছোট্ট গেটটি পেরিয়ে একেবারে বাইরে পা রাখলো। বাইরে শীতল হাওয়া বইছে। আজকে বেশ শীত পড়েছে। মিতুল সাদা ফুল হাতার গেঞ্জির উপর একটা ব্লু সোয়েটার পরেছে। মেইন শহর থেকে রেশমী আন্টিদের বাড়ি কিছুটা দূরে। এই এলাকাটা অনেক শান্ত। পরিষ্কার পিচ ঢালা রাস্তার দুই পাশেই সুন্দর সজ্জিত বাড়ি। বিদেশি বাড়িগুলো দেখতেই অন্য রকম হয়। ভালো লাগে ওর।
রেশমী আন্টিদের এক নেইবরহুডের বাড়ি থেকে একটা নীল পোরশে কার বের হতে দেখা গেল। গাড়িটা মিতুলকে অতিক্রম করে ধীর গতিতে সামনে এগিয়ে গেল। গাড়িটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিতুল তাকিয়ে রইল। গাড়িটা অদৃশ্য হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
মিতুলের হঠাৎ চোখ পড়লো জায়িনের উপর। জায়িন ঠিক ওর পাশ থেকেই চলে যাচ্ছে সামনের দিকে।
জায়িন মিতুলের থেকে বেশ কিছু দূরত্বে গিয়ে হঠাৎ থামলো। অতিক্রম করে যাওয়া পথ হেঁটে আবার মিতুলের কাছে এসে বললো,
“তুমি কি মর্নিং ওয়াকে আমার সাথে জয়েন করতে চাও?”

জায়িনের অফার ফিরিয়ে দেবে কি না বুঝতে পারছে না। একটু আগে তো একেবারে অগ্রাহ্য করে চলে গেল, দেখেও কিছু বললো না! তাহলে এখন আবার ফিরে এসে এই অফার দেওয়ার মানে কী? মিতুল জায়িনের অফারটা ওর মুখের উপর ফিরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু শেষমেশ সেটা পারলো না। জায়িনের কথায় সায় দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”

মিতুল জায়িনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা এক ঝলক দেখে নিচ্ছে। গাড়িতে করে গেলে কিছুই ভালো মতো দেখা যায় না। যেমন এখন খুব ভালো করেই সব কিছু দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা গাড়িতে বসে হয় না। আজকে ছুটির দিন। তাই অনেককেই দেখা যাচ্ছে। অনেকে জায়িনকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মিতুলকে খুব একটা পাত্তা দিলো না কেউ। যেটা সোজা আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে মিতুলের।

দূরে ঘাস ঘন খোলা ফিল্ডে কয়েকটা কিশোর ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। একটা ছেলে নিজের সাইকেলে ব্রেক কষে জায়িনের উদ্দেশ্যে দূর থেকেই উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“হেই ব্রো, তুমি কি আমাদের সাথে এটেন্ড করবে?”

জায়িনও কিশোরটির মতো উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“এখন নয়।”

“ঠিক আছে। বিকেল বেলা দেখা হবে।”
ছেলেটা একটু বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“তোমার সাথের মেয়েটি কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?”

ছেলেটার কথা শুনে মিতুল বেশ লজ্জা পেল। যদিও এখানে ওর লজ্জার থেকে বেশি রাগ হওয়া উচিত, ছেলেটার এমন না জেনে না শুনে কথা বলার জন্য। কিন্তু মিতুলের রাগ হলো না। ও পেল লজ্জা। এত লজ্জা পাওয়ার কারণ ও নিজেই বুঝতে পারলো না।

মিতুলকে জায়িনের গার্লফ্রেন্ড ভেবে ছেলেটা উৎসুক হয়ে মিতুলকে দেখতে ওদের কাছে এগিয়ে এলো।
জায়িন ছেলেটার ভুল ভাঙ্গিয়ে বললো,
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। ও একজন অতিথি। কানাডা ঘুরতে এসেছে। আমাদের বাড়িতে আছে। আমাদের রিলেটিভ।”

“ওহ, আই সি…” বিজ্ঞের মতো হালকা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো ছেলেটি।
তারপর করমর্দনের জন্য মিতুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
“হাই, নাইস টু মিট ইউ। আই অ্যাম লর্স। হোয়াট ইউর গুড নেম?”

মিতুল করমর্দন করে বললো,
“নাইস টু মিট ইউ টু। আই অ্যাম মিতুল।”

“হোয়াট? মি…মিইইটুল?”

“নো, মিতুল।”

“ওহ, একটু কঠিন। মিটুল!”

মিতুল মুখে হাসলো, কিন্তু মন থেকে হাসতে পারলো না। বিদেশের মাটিতে পা রাখলে যে নিজের নাম হ্যান ত্যান হয়ে যাবে, সেটা আগে থেকেই জানতো। নাম ঠিকঠাক ভাবে উচ্চারণ করতে না পারা তো বিদেশিদের মুদ্রা দোষ। তবুও ভালো, ছেলেটা তো মিটুল বলে সম্মোধন করেছে। অন্যদিকে জোহান তো ওর এত সুন্দর নামটাকে ‘তুলতুল’ বলে ব্যঙ্গ করেছে।

জায়িন লর্সকে বিদায় জানিয়ে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“এখানের বাচ্চাদের সাথে আমার খুব ভাব। ছুটির দিনে ওদের সাথে ভালোই টাইমপাস হয়।”

মিতুল ছোট করে বললো,
“ওহ।”

কিছু সময় নীরবতা গেল। প্রথমে নীরবতা ভেঙ্গে জায়িন বললো,
“ওয়েদার নিউজে জানলাম আজকে রাতে তুষারপাত হতে চলেছে। তুমি জানো সেটা?”

মিতুলের জানা ছিল না। তুষারপাতের কথা শুনে মিতুলের দু চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠলো। এই রঙিন বসন্তের মাঝে তুষারপাত ব্যাপারটা কেমন হবে? মিতুলের এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। সেই সাথে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ধূসর চোখের মায়াবী মানুষটাকে।
মিতুল ভাবছে, কোনো এক তুষারপাতে যদি সেই মানুষটার হাতে হাত রেখে তুষার জমা পথে হেঁটে বেড়ানো যেত, তাহলে কেমন হতো? মিতুল নিজের বাম হাত দেখলো একবার। হাতে শোভা পাচ্ছে কালো চিকন একটা হেয়ার রাবার। যেটা হাত থেকে খুলতে ভীষণ অনিচ্ছা ওর।

_______________

মিতুল এখন গার্ডেনের পাইন গাছের ডালের সাথে ঝুলে থাকা এক টুকরো কাঠের সেই দোলনাতে বসে আছে। বাগানে মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসের সাথে। অনেক ফুলের সুবাস এক সাথে মিলিত হয়ে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মিতুলের দৃষ্টি জঙ্গলের ভিতর। যদিও গাছের ফাঁক ফোকর পেরিয়ে চোখ জঙ্গলের অন্তরালে একেবারে প্রবেশ করতে পারছে না বললেই চলে। এডমন্টনে কেবল অন্ধকারের কিঞ্চিৎ আভা দেখা দিলেও, জঙ্গলের ভিতর তা এখন গভীর রাতের সমান। জঙ্গলের ভিতরটা এখন অন্ধকার রাজ্যের মতো। যেখানে কখনো কোনো আলো প্রবেশ করতে পারেনি বলে মনে হয়। জঙ্গলের ভিতর কয়েকটা পাখি এক সঙ্গে দল বেঁধে ডাকছে। ওই পাখির ডাক এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে না মিতুলের কাছে। মনে হচ্ছে পাখিগুলোও যেন ওই অন্ধকার রাজ্যের অন্ধকার প্রাণী। যা কেবল ভয়ংকর। মিতুলের মনে নানান প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। অতো রাতে জঙ্গলে কী কাজ জোহানের? দিনের বেলা জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই তো বোধহয় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে! সেখানে রাতের বেলা…
মিতুলের মনে ভয় হলেও, ওর কৌতূহল ওর ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ওর ইচ্ছা করছে একবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দেখে, আসলে কী আছে জঙ্গলে যার জন্য জোহান অত রাতে জঙ্গলে গিয়েছিল। মিতুলের কৌতূহল ওকে সম্পূর্ন নিজেদের বশে এনে ফেললো।
মিতুল কৌতূহলে বশীভূত হয়ে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জঙ্গলের ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের চোখ আটকে ধীরে ধীরে এগোয় জঙ্গলের ভিতর চলে যাওয়া সরু রাস্তার দিকে। এগিয়ে এসে যখন সেই রাস্তায় পা রাখলো, তখন পিছন থেকে শুনতে পেল,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়্যার?”

মিতুলের পা থমকে যায়। আঁতকে ওঠে হৃদপিণ্ড। সারা শরীর বেয়ে নেমে যায় ভয়ের স্রোত। কৌতূহলের ফাঁদে পা দেওয়া কি ভুল হয়েছে? মিতুল শুকনো ঢোক গিললো।
ধীরে ধীরে পিছন ফিরলো।
দেখতে পেল ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে জোহান দাঁড়ানো। হঠাৎ আগমনে আর ঝাপসা আঁধারে জোহানকে দেখে ভয়ংকর মনে হচ্ছে মিতুলের!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here