বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :২২

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২২

সেদিনের পর সেহের পুরোপুরি পাল্টে গেছে।আরহামের জিদের কাছে তাকে নত হতে হয়।এ বাড়ি থেকে আর যাওয়া হল না। মানুসিক অশান্তি নিয়ে উদাসীন দিন পাড় করতে লাগে।একদম ঘরকুনো সেহের বন্ধুবান্ধব ভার্সিটি সকল কিছু থেকে নিজেকে ধীরেধীরে বিচ্ছিন্ন করছে।আজ কাল ঠিক মত ক্লাস এটেন্ড করছে না। আগের মত হাসছে না । কারো সাথে কথা বলছে না। সারাক্ষণ নিজেকে ঘরবন্ধী করে রাখছে।যে যা বলছে শব্দহীন ভাবে সবার সব কথা মানছে ।মানুষ না যেন যন্ত্রচালিত কোন বস্তু।আরহাম সেহেরের মাঝে গড়ে উঠা বন্ধন কোথাও যেন কোন অদৃশ্য দেয়ালে বাঁধা পড়েছে। সেহের বরাবরের মত আরহামেকে এড়িয়ে চলে।আরহাম বার কয়েক বার সেহেরের সাথে কথা বলে আব কিছু সমাধান করতে চেয়েছে ।কিন্তু সেহের কোন কিছু শুনতে নারাজ।আরহামের উপস্থিতি যেন তাকে পীড়া দেয়। সেহেরের এই পরিবর্তনে আরহামের ভীষণ রাগ হয়। এই উদাসীন সেহেরকে তার চাই না। আরহাম তার আগের সেই হাসি উজ্জ্বল প্রাণবন্ত সেহেরকে চাই।
সময় তার তার নিজ গতিতে চলছে ।অনেকটা সময় পাড় হয়েছে।ঋতু তার রঙ পাল্টেছে।প্রকৃতি বর্ষার আগমনে তাথৈ তাথৈ নাচছে।এর মাঝে অনেক মন্ত্রী বাড়ির ফ্যামিলি বিজনেসে অনেক পরিবর্তন এসেছে।কম্পানিতে দিশার শেয়ার গুলো নিয়ে নেওয়া হয়েছে।রাজনৈতিক দিক থেকেও দিশা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছে।আশরাফ খাঁন কোন প্রকার সহযোগিতা করবেন না। এর পেছনে যে আরহামের হাত রয়েছে তার বুঝতে দিশার খুব একটা সময় লাগেনি।সেহেরেকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি স্বরূপ এসব তার প্রাপ্য তা তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন।সেহের তার মাকে বরাবরের মত এড়িয়ে চলছে। মুখোমুখি হলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায় যা দিশাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মত শাস্তি দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই । মালিহা সেহেরের মনে আরহামের প্রতি ভালোবাসা জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তা বিফলে যাচ্ছে।সেহের তার মনকে শিলা পাথরের মত শক্ত করে রেখেছে ।

শ্রাবণ মাস শেষদিকে।বর্ষার হুটহাট বৃষ্টিতে প্রকৃতি মেতে।সেই ভোর সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। শীতল আবহাওয়া।জানালার কাঁচে বৃষ্টির বড়বড় মোহর লেগে। সেহেরের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে।নিদ্রালস ভাব কাটিয়ে তৈরি হয়ে নিচের দিকে পা বাড়ায়।আরহাম অনেক আগেই বেরিয়েছে ।হয়তো অফিসের উদ্দেশ্য রওনা ও হয়ে গেছে।সেহের বাড়ির সাজগোজ দেখে বেশ চমকায়।টেবিলের উপর অনেক গুলো ফুলে বুকে কেক রাখা। অনেকরকম গিফট। বাগানের দিকটায় অনেক ভিড় দেখা যাচ্ছে ।এসব দেখে সেহের বিস্মিত চোখে আশেপাশে তাকায়। বাড়ির সদস্য থেকে শুরু করে কাজের লোক পর্যন্ত সবাই যে যার যার মত ব্যস্ত । শুধু সেহেরই ড্যাবডেবে তাকিয়ে । সবকিছু যেন তার মাথা উপর দিয়ে যাচ্ছে।কি হচ্ছে সেহের ছাড়া বাড়ির সবাই সবটা জানে । সবার মুখ দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে।ঘটনা জানার জন্য সেহের বাড়ির বৃদ্ধা কাজের লোকের কাছে জিগ্যেস করলে।বৃদ্ধা ভূত দেখার মত করে বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তাকিয়ে রইল।বিস্মিত ভাব কাটিয়ে লতা খালা বলল,”কি কন আম্মা আফনে জানেন না , কি হইতাছে ? আইজকা আরহাম বাবার জন্মদিবস।”
লতা খালার কথা শুনে সেহের অবাক হলো সেই সাথে লজ্জাও পেল। সত্যি তো এই বাড়ি সদস্য হওয়ায় অন্তত এতটুকু জানাটা আবশ্যক ছিল।নামমাত্রই হোক আরহাম তার স্বামী তো! মনে মনে সেহেরের ভীষণ অনুশোচনা হলো।

দুপুর বারটার দিকে আরহাম প্রেস মিটিং শেষ করে রুমে পৌঁছায় ।সেহের তখন নিজেকে প্রস্তুত করছিল। আরহামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে বলে।কিন্তু সেই সুযোগ আর মিলল না।আরহাম রুমে প্রবেশ করে সেহেরকে তাড়া দিয়ে বলল,”দ্রুত রেডি হয়ে নেও আমরা বের হবো! ”
সেহের ভ্রু কুঞ্চিত করে আরহামের দিকে চাইল ।আরহাম সেহেরের দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে আবার বলল,”দ্রুত তৈরি হও ,উই আর গেটিং লেট ”
সেহের আরহামকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করল না।বিছানা ছেড়ে কাবার্ড থেকে শাড়ী বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।আরহাম রেডি হয়ে নিচে চলে গেল।সকাল থেকে একটার পর একটা ফোন কল রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত সে।ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে শত শত নোটিফিকেশন ।আরহাম হল রুমের মাঝবরাবর সোফায় সেহেরের অপেক্ষায় বসে।মাথাটা ধরে আসছে।তা কাটানোর জন্য স্ট্রং করে বানানো কফির মগ হাতে ।এতে যদি সামান্য কমে!
কফির মগে চুমুক দিয়ে আনমনে সিড়ির দিকে তাকাতে আরহাম থমকে যায়।চোখ গুলো সিড়ির দিকে আটকে যায়।কালো শাড়ীতে তার হৃদরানী দাড়িয়ে।দুধেআলতা গায়ের রঙের সাথে কালো রঙটা ফুটে আছে।স্মোকি আইজ।গোলাপি ঠোঁট । কোমর পর্যন্ত লতানো চুল গুলো বাতাসে দুলছে । কানে সাদা পাথরের দুলগুলো চিকচিক করছে ।চেহারায় অন্যরকম এক মায়া ।মুহূর্তেই আরহাম অগোছালো হয়ে পড়ে।বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাড়ায়।কফির মগটা অনেক আগেই হাত থেকে ছিটকে পড়েছে। বুকে হাজার দফা ছুরি চলছে ।প্রণয় আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আরহাম।এতোদিন শুনে এসেছে শোকের রঙ কালো ,আজ মনে হচ্ছে প্রেমের রঙটাও কালো হলে মন্দ হয় না!
সেহের আরহামের সামনে দাড়িয়ে নত স্বরে বলল ,”আমি রেডি ”
সেহেরের গলার স্বরে আরহামের ধ্যান ফিরে।ছোট এক নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে বলল,”হুম ,চলো ”

গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে।ইট পাথরের শহর মাড়িয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় নেমেছে ।চারদিকে সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছায়া।দূর থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। সেহের সিটে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ।পুরোপুরি প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুবে ।আরহাম গাড়ি চালানোর ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে সেহেরকে দেখছে ।আজ অনেক দিন পর সেহেরের চেহারায় সেই আগের মত হাসি উজ্জ্বল চমক ।গাড়ি বড় ধবধবে সাদা বাড়ির সামনে থামল।উপরের সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখা “শান্তির নীড়”।সেহের ভ্রু কুঁচকে আরহামকে জিগ্যেস করে,”এটা কার বাড়ী? ”
আরহাম সামনের দিকে তাকিয়ে বলল ,”ভেতরে চলো জানতে পারবে ”
গাড়ী গেটের ভেতর ঢুকতে সেহের আরেকটা বড় গাড়ী দেখতে পেল। সেহের অবাক চোখে সবকিছু দেখছে। তাদের গাড়ী থেকে নামতে দেখে এক বয়স্ক জুটি তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো ।আরহামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল।আরহাম হাসি মুখে ধন্যবাদ জানাল।বৃদ্ধা মহিলা আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,”বাবা বউমা নাকি ?”
আরহাম মুচকি হেসে বলল,”জি খালা”
বৃদ্ধার মুখে হাসি আরো প্রসারিত হলো। প্রফুল্ল স্বরে বলল,”মাশাল্লা মাশাল্লা ,একদম পরীগো লাহান”
সেহের এক চিলতে হাসল।আরহাম ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জিগ্যেস করল,”বাচ্চারা কোথায়? ”
“পিছনের বাগানে তোমার লাইগা অফেক্ষা করতাছে। ”
আরহাম সেহেরের দিকে তাকিয়ে হালকা আওয়াজে বলল,”চলো ”
সেহের আরহামকে অনুসরণ করে তার পিছু চলল ।পিছনের বাগানে আসলেই দুজন চমকায়।পুরো বাগান রঙিন কাগজে সাজানো।সামনে সাদা কাপড় ফেলান বড় টেবিল টেবিলের উপর স্পঞ্জ কেক রাখা।কেকের উপর চকোচকো দিয়ে “হ্যাপি বার্থডে আরহাম ভাই ” লিখা। কেকটা দেখে মনে হচ্ছে হোম মেইড।হয়তো বাচ্চারা তৈরি করেছে।বাচ্চারা আরহামকে দেখতে জয়ের উল্লাসের আওয়াজ করে তার দিকে ছুটে আসে।আরহাম বাচ্চাদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আরহামের চেহারা খুশিতে চকচক করছে। সেহের দূর থেকে পলকহীন ভাবে আরহামকে দেখছে।বৃদ্ধার আওয়াজে সেহেরের ধ্যান ফিরে।বৃদ্ধা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানি মা তুমি হয়তো ভাবতাছ এরা কে ,কারা! এরা আরহাম বাবার আরেকটা পরিবার। এই শান্তির নীড় আরহাম বাবার তৈরি।এই বাচ্ছা গুলারে দেখতাছ এগো মধ্যে কেউ কেই কোন না কোন রোগে আক্রান্ত । দুই দিনের মেহমান। কেউ কেউ হয়তো কালকের সূর্যটা দেহার নসিব মিলবো না।এরা সবাই পথ শিশু । এই সবাইরে আরহাম বাবা তার এই শান্তির নীড়ে জায়গা দিছে।তাগো ভরন পোষণের দায়িত্ব নিছে।প্রত্যেকেরে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে সব সুযোগ সুবিধা দিছে।আরহাম বাবা প্রায়ই এহানে আসে। নিজের বিশেষ বিশেষ দিন গুলা এই বাচ্চা গুলার সাথে থাকে।প্রতিবছর জন্মদিনে সারাদিন ওগো লগে কাটায়।এই বাচ্চাগো লাইগা আরহাম বাবা মানুষ না ফেরেশতা! ”
সেহের বৃদ্ধা খালার কথা শুনে ছলছল চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।আজ সেহেরের চোখে আরহামের প্রতি সম্মান কয়েক শত গুন বেড়ে গেছে।মনের মাঝে কালো মেঘের ছায়া অনেক আগে কেটে গেছে।নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে।সেহের কোনপ্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে । ছয় নয় না ভেবে আরহামের দিকে ছুটে যায়।হুট করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে লাগে।সেহেরের এমন কাজে আরহাম থমকে যায়। সেহের বুকের জমে থাকা সুপ্ত অভিমান গুলো অশ্রুধারা হয়ে গলে পড়ছে। আরহাম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করে ,”কি হয়েছে কাঁদছ কেন? এনিথিং রং? ”
সেহের নাক টানতে টানতে না সূচক মাথা নাড়ায়।আরহাম সেহেরের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”তাহলে কাঁদছ কেন? ”
সেহের যথাসাধ্য কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে,”হ্যাপি বার্থডে ”
সেহেরের এমন বোকামিতে আরহাম সহ বাচ্চারা ফিক করে হেসে দেয়।সবাই গাঁ কাঁপিয়ে হাসছে।সেহের লজ্জায় আরহামের বুকে মুখ লুকায়।

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here