বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৫৭
ভিডিও অন হতে সেহের একটা রুম দেখতে পেল। যেখানে এক কোণে দেয়াল ঘেষে আরহাম নির্জীব প্রাণহীন বসে আছে । মাথার চুল কাঁধ ছুঁয়েছে । দাড়িগোঁফ বড় হয়েছে।হাত পায়ে আবারো শিকল বাঁধা।চোখের নিচে গাঢ় কালি জমেছে।না জানি কত রাত নিদ্রাহীনতায় কাটিয়েছে? কেউ এক জন খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল তা দেখে আরহাম বাচ্চাদের চিৎকার শুরু করল।ভয়ে জড়সড় হয়ে দেয়ালের এক কোণে বসে থাকল।লোকটা খারাব নিয়ে কাছে যেতেই আরহাম আবারো জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে থাকল।
সেহের এতটুকু দেখে ধপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করল। মুখ চেপে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে ।অশ্রুধারা গাল বেয়ে পড়ছে ।মিহি তা দেখে বলল ,”এতোটুকু দেখে তোমার এই হাল? তাহলে ভাবো আরহাম কতটা সহ্য করেছে? ”
সেহের কান্না জড়িত স্বরে বলল, “আরহামের খুনি রূপ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম , ভেবেছি আরহাম আমাদের সন্তানের ও ক্ষতি করবে ”
“সিরিয়াসলি সেহের? যেই আরহাম পরিবারের অভাবে সারাজীবন জ্বলেছে সে তার নিজের সন্তানের ক্ষতি করবে? আশনূহা আরহামের অংশ তোমার অংশ । আর যাই হোক আরহাম তোমাকে আর তোমার অংশকে ক্ষতি করবে না!
সেই অগ্নিকাণ্ডের পর আরহাম পুরোপুরিভাবে মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।ছোট বাচ্চায় পরিনত হয়।বাল্যকালের সেই স্মৃতিতে হারিয়ে যায়। কিন্তু মিরাকল বলো বা ম্যাজিক সব কিছু মাঝেও আরহাম তোমাকে ভুলেনি ।সব মুছে গেলেও তোমার স্মৃতি মুছেনি । অনবরত ক্লান্তিহীন তোমার ছবি এঁকে গেছে। ঘুমে জাগ্রত অচেতন অবস্থায় শুধু তোমাকে খুঁজে গেছে। প্রথম দুবছর আরহাম পুরোপুরি বন্দি ছিল। আমি খবর পেয়ে বিয়ের পর রবার্টের সাথে বাংলাদেশে ফিরি।এখানে নিজের ফ্লাটে এনে বাবা সাথে মিলে আরহামের চিকিৎসা করি। প্রথম দিকে আরহাম রেসপন্স না করলেও পরবর্তীতে করে। আরহামের ভালোবাসা এতো টাই স্ট্রং ছিল যে তাকে সুস্থ করতে আমরা সেই ট্রিক কাজে লাগিয়েছি। এরপর আরো দুবছর ট্রিটমেন্ট করা হয়।চারবছরের মাথায় আরহাম পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়। সুস্থ হবার পর দিন রাত এক করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তোমাকে খুঁজে গেছে। আর তুমি কিনা তাকে ছেড়ে দিব্যি সুন্দর দিন কাটাচ্ছিলে! সেহের মানছি তোমার সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে কিন্তু আরহামের সাথেও কম অন্যায় হয়নি! every davil was once an angle
আরহামের ভালো থাকা তোমার উপর । তুমি পারো আরহামকে স্বাভাবিক রাখতে।তার ভেতরের সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ”
সেহের অনুতাপের আগুনে দাউদাউ পুড়ছে।এতো বড় অন্যায়? আরহাম আড়ালে থেকে রক্ষা করে গেছে তাকেই খুনি ভেবে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । সেহের চুল চেপে চিৎকার করে কাঁদছে। ভেতরের অনুতাপ যন্ত্রণা রূপে বেরিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে এই যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু শ্রেয়!
রাত গভীর। সেহের আরহামের রুমে এসেছে । আশনূহা আরহামের সাথে ঘুমিয়ে। অন্ধকার ঘরটায় সামান্যতম দ্যুতির ছিটাফোঁটা নেই। সেহের ফ্লোরে আরহামের পায়ের কাছে বসে। নিশ্চুপ কাঁদছে । বুকটা এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় হাহাকার করছে। ভিতরের অপরাধবোধ ঘুণের মত ফালাফালা করছে।আরহাম সবসময় আড়ালে থেকে সাহায্য করে গেছে।কোন কিছু বলার পূর্বেই সবটা বুঝে গেছে কিন্তু সেহের? সেহের কি করল? যখন আরহামের তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। তখন তাকে ফেলে চলে এলো? নিজের ভয়ে এতোটা নিষ্ঠুর কি করে হলো সে?
সেহেরের চোখের জল আরহামের হাতের উপর পড়তে আরহাম নড়েচড়ে উঠে।ঘুমঘুম চোখে তাকায়।পায়ের কাছে কারো অবয় দেখা যাচ্ছে। ছিটকে উঠে বসে। মোবাইল হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশ অন করে পায়ের কাছে ধরে। সেহেরকে দেখে নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলে। বলল,
“এতো রাতে তুমি এখানে? কি হয়েছে কাঁদছ কেন? ইজ এ্যানিথিং রং? ”
সেহের উত্তর দিলো না। নিশ্চুপ কান্না ফুলে ফেঁপে উপচে উঠল।কান্নার ধাঁচ বাড়ল , কোন শব্দ না করে ডুকরে কাঁদতে লাগল । আরহাম অনুভূতিহীন চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে। কিছু বুঝে উঠার আগে সেহের ধপ করে আরহামের বুকে এসে পরে।শব্দ করে কাঁদছে।অনবরত বলছে ,” সরি আমাকে ক্ষমা করে দেন , আমি ভুল করেছি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি! ”
অনবরত বলে যাচ্ছে। আরহাম কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া করছে না। সবটা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।কিছু সময় এভাবে অতিক্রম হলো।সেহের তখনো আরহামকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।আরহাম কিছু একটা ভেবে বলল, “কাঁদছ কেন? সত্যি ,আমাদের সাথে নিয়ে যাবো ।স্টপ ক্রাইং। নূহা জেগে যাবে! ”
সেহের শুনল না।আগেরমত অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। এদিকে কান্নার আওয়াজে আশনূহার নড়েচড়ে উঠে। আধো আধো চোখ খুলে সেহেরের দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে যাওয়া স্বরে বলল,”মাম্মাম তুমি কাঁদছ কেন? তুমিও চকলেট খাবে? তাই কাঁদছ? ”
মেয়ের কথায় আরহাম সেহের হতভম্ব। সেহেরের কান্না থেমে গেছে।দুজন দুজনার দিকে তাকাচ্ছে । কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আরহাম কথা কাটাতে বলল, “হ্যাঁ মাম্মাম ,তোমার মাম্মাম চকলেট খাবে বলে কাঁদছে! ”
আশনূহা মায়ের দিকে তাকিয়ে আঙুল না সূচক নাড়াতে নাড়াতে বলল”মাম্মাম দ্যিস ইস নট রাইট ,বেড হেভিট! ”
“আমিও তাই বলছি ,কিন্তু তোমার মাম্মাম শুনছেই না! ”
আশনূহা বলল ,” মাম্মাম তুমি আশুর আসকাআসো ,আশু তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে”
সেহের আশনূহার কাছে শুতেই আশনূহা মাকে জড়িয়ে ধরে । বলে, “এবার তোমার ঘুম চলে আসবে মাম্মাম! ”
সেহের আশনূহার কপালে চুমু এঁকে দেয়। আরহাম দুজন কে দেখে মুচকি হেসে উঠে যেতে নিলে সেহের হাত আটকে নেয়।অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুতির ভরা স্বরে বলে ,”বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।মন বড্ড অশান্ত ,একটু জড়িয়ে ধরবেন? প্লিজ? ”
এই আকুতিকে অমান্য করার আরহামের সাধ্যি কই? বাড়িয়ে দেওয়া পা বিছানায় তুলে সেহেরের পাশে শুয়ে পরে।আশনূহা ঘুমিয়ে যেতে সেহের আরহামের দিকে ফিরে বুকে মুখ ডুবিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।ফিসফিস স্বরে বলে ,”আর কোনদিন ছেড়ে যাচ্ছিনা! কোনদিন নাহ ! ”
আরহাম কি শুনল? কে জানে!
সকালের সেহেরের ঘুম কাটলো দেরীতে।তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলে চোখ যায় গায়ে জড়িয়ে থাকা চাদরের দিকে। নিশ্চয় আরহাম দিয়েছে।সেহের মুচকি হাসল।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো । আরহাম আশনূহা অনেক আগেই রেডি হয়ে লাগেজ নিয়ে সেহেরের অপেক্ষা করছে।সেহের অনেক ভেবে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ায়।অনুতাপ জিনিসটা জ্বলন্ত আগুনে কয়লার মত।যত সময় অতিবাহিত হয় সময়ের সাথে কয়লাটা পুড়ে গাঢ় হয়। সামান্য আঁচ লাগতে- ই পুড়ে যায়।অনুতাপটাও এমন সময়ের সাথে সাথে গাঢ় হয় যত দেরীতে তা অনুভব করে তত বেশি পুড়ে । আফসোস সেই পোড়া যন্ত্রণা কারো চোখে পড়েনা।
এতো দিন আরহামের সামনে যেতে ঘৃণা হতো। আজ অনুতাপের যন্ত্রণায় আরহামের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস হচ্ছে না। এ জীবনে আরহাম কি ক্ষমা করবে? এই যে কাল রাতে একবার বলায় পাশে ছিল ,কেন ছিল? শুধু তার সন্তানের মা বলেই কি ?
ভাবনাচিন্তা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে আরহামের মুখোমুখি হলো। আরহাম এক পল্ক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো । সেহেরের বাবা এসেছে মেয়েকে বিদায় জানাতে। নিউ ইয়ার হওয়ায় সব ফ্লাইট আগে থেকে বুকড ।নেক্সট উইক দেশে ফিরবে।সেহেরের গালে হাত ছুঁয়ে মমতায় ভেজা স্বরে বলে,” তুই ঠিক আছিস মা? ”
সেহের হাসির রেখা বড় করে টেনে বলল, “একদম ঠিক বাবা , তুমি চিন্তা করো না । যা হচ্ছে ভালোর জন্য হচ্ছে
। এতো বছরের ভুল বুঝাবুঝি মিটেছে আমি এখন নিজ নীড়ে ফিরে এলোমেলো সংসার গোছাতে চাই ”
“তুই যা ভালো বুঝিস ,তোর খুশির থেকে বড় কিছু আমার কাছে অন্যকিছু না।
সেহের টলটল চোখে মুচকি হাসল।মিহি রবার্ট থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মিহি সেহেরকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কানের কাছে বলল,” বোকামি ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়েছ! এবার ভালোবাসার দুনিয়া গড়ো । আরহামকে তার ফিডব্যাক দেও । ”
সেহের মুচকি হেসে বলল,”নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।ভুল বোঝাবুঝি বোকামি আর ছোঁবে না। আসি এখন ,ভালো থেকো ”
মিহি চমৎকার এক হাসি দিলো । সেহের আরহাম আশনূহার সাথে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
ফ্লাইট টেকঅফ করতে আর মাত্র কয়েক মিনিট । সেহের আরহাম আশনূহার মাঝে বসে । সেহের ভীতু মুখ করে আশনূহাকে বলল,”আশু তোমার কি ভয় করছে? মাম্মামের কাছে আসো মাম্মাম জড়িয়ে ধরি! ”
আশনূহা ফিক করে হেসে বলল, “ভয় পাবো কেন মাম্মাম ? এটা তো প্লেন! তোমার ভয় করছে? ”
“নাহ, একদম না! আমি কেন ভয় পাবো? আমি ভয় পাই না ”
সেহের জোর পূর্বক হেসে তড়িঘড়ি করে উত্তর দিলো । আরহাম হাসল। সে জানে সেহের ভীষণ ভয় পাচ্ছে শুধু আশনূহার সামনে সাহসী হওয়ার অভিনয় করছে।ফ্লাইট টেকঅফের সময় সেহের চোখ মুখ খিঁচে আরহামের হাত খামচে ধরল।আরহাম আলতো করে সেহেরের হাতের উপর আশ্বস্ত হত রাখল । ফ্লাইট উঠতেই সেহের হাত ছেড়ে স্বাভাবিক ভাবে বসল।আশনূহা জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, “মাম্মাম তুমি এতো বড় হয়েও ভয় পাও! এই দেখ আশু ভয় পায় না! ”
আরহাম মিটমিট করে হাসছে।সেহের দুজনকে দেখে ফিসফিস করে বলে , ” ভয় পাবে কি করে? বাপের মত বাঘের কলিজা যে! ”
আশনূহা শুনল । বলল,” মাম্মাম কি বললা? ”
সেহের দুদিক মাথা নাড়িয়ে ফিক করে হেসে উত্তর দিলো , “নাহ! কিছুনা । আমি কি বলবো সেই সাধ্যি আমার কই! ”
মনে মনে বলল , “কিছু বলেও শান্তি নেই। দুনিয়াতে এক আরহাম- ই যথেষ্ট ছিলোনা কি ?”
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊