#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৩৩
পদ্মা নদীর তীরে একটা বিশাল শান বাধাঁনো বটবৃক্ষের শীতল ছায়াতলে পা ঝুলিয়ে বসে থেকে দুচোখ কুচকে ছোট ছোট করে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে আছি।সূর্যের আলো পরে নদীর পানি রুপোলী বর্ণ ধারন করেছে যার জন্য চোখে ঝিলিক লাগছে।মাঝ নদীতে কিছু জেলে নৌকায় চড়ে জাল দিয়ে মাছ ধরছে।ইলিশ মাছের জন্যই পদ্মা আমাদের কাছে অতি পরিচিত এক নদী। মাতশোনা ধলিওয়েও বলেছেন,
“একটি নদী তার মাছের জন্য সম্মানিত হয় তার আকারের জন্য নয়।”
ঠিক একারনেই হয়তো পদ্মা বাংলাদেশের ৩য় বৃহত্তম নদী হওয়া শর্তেও গুরুত্বের দিক দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে বসে আছে।
মৃদু উষ্ণ বাতাসে নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর বটবৃক্ষের পাতার ঝিরি ঝিরি শব্দ শুনতে খুব শ্রুতিমধুর লাগছে।পাতার ফাক ফোকর দিয়ে রোদ এসে আমার জামায় আলোছায়া খেলছে।আমি মুচকি হেসে রোদ ধরার চেষ্টা করছি।তখনই নির্ভীক ভাইয়া বললেন,
নির্ভীক:ওই হ্যালো পিচ্চি?কোথায় হারিয়ে গেলে, তোমার পাশে যে কেউ আছে সে খেয়াল আছে?(চোখ সামান্য ছোট করে)
অবশ্যই খেয়াল আছে।আপনি পাশে আছেন সেজন্যই তো এই আকাশ,বাতাস,নদী,রোদ এত সুন্দর লাগছে।আগে কখনও এসব ফিলই করিনি, আপনি আমাকে শিখিয়েছেন।থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।(উনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে)
নির্ভীক:কি হয়েছে বলোতো তোমার?এখানে আসার পর থেকে শুধু দেখেই যাচ্ছো কথা বলছোনা।(ভ্রু কুচকে)
আমি:না কিছু না,জায়গাটা খুব সুন্দর। (মুচকি হেসে)
নির্ভীক:হুম আমার পছন্দের একটা জায়গা,মাঝে মাঝেই এখানে আসি।(সামনে নদীর দিকে তাকিয়ে)
আমি কিছু না বলে উনার দিকে তাকিয়ে আছি,বলা চলে লুকিয়ে দেখছি উনাকে।কেন জানি না উনার মুখমন্ডল ঠিক ঠাক মনে থাকছেনা আবার এটা ভেবে খুব অবাক হচ্ছি যে উনাকে চিনতে উনার মুখমন্ডলের দরকারই পরছেনা উনার উপস্তিতিতেই টের পেয়ে যাচ্ছি যে উনি আছেন।ব্যাপার টা আমার কাছে বেশ গোলমেলে লাগছে।শুধু উনার ক্ষেত্রেই এমন টা হচ্ছে।উনাকে এত দেখছি তাও দেখা শেষ হচ্ছে না,ইচ্ছে করছে উনাকে সামনে বসিয়ে রেখে পলকহীন চোখে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি।
নির্ভীক:অ..ন..তো?(আমার দিকে এগিয়ে এসে গা ঘেষে বসে)
আমি:হুম বলুন।(নড়ে চড়ে বসে)
নির্ভীক:আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে।(ইনোসেন্ট মুখ করে)
আমি:এখন বাসায় যাবো না,প্লিজ।(উনার দিকে তাকিয়ে)
নির্ভীক:আরে না বাসায় যেতে কে চেয়েছে,আমি তো এখানেই ঘুমোবো।(মুচকি হেসে)
বলেই উনি আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলেন।আমি মহা অসস্তিতে পরে গেলাম,এটা এক অদ্ভূত ভাল লাগা অসস্তি। কিন্তু পা দুটোতে শুরশুরি অনুভব করছি তাই নড়াচড়া শুরু করে দিলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
নির্ভীক:এত নড়ছো কেন?চুপচাপ বসে থাকো।
আমি:আপনি.. সত্যি ঘুমাবেন?(আটকা আটকা স্বরে)
নির্ভীক:হুম,আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও তো।(আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে)
আমি কি করে ঘুম পাড়িয়ে দিব?(মনে মনে)
নির্ভীক:আমার পিচ্চির হাতও দেখছি খুব পিচ্চি,একদম পিচ্চি বিড়াল ছানা।(আমার হাতের তালুতে আকিবুকি করে)
আমি: আমি বিড়াল ছানা?আপনি তাহলে ডাইনোসর,হুহ্।(হালকা রেগে)
নির্ভীক:হোয়াট,আমি ডাইনোসর?কিন্তু ডাইনোসররা তো ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।(হু হা করে হেসে দিয়ে)
উনার হাসি দেখে আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বসে থাকলাম।উনি হাসি থামিয়ে আমার নাক টেনে বললেন,
নির্ভীক:আমি তাহলে ডাইনোসর 2.0 ওকে?একদম আপডেট ডাইনোসর।
আমি:ওকে।(মুচকি হেসে)
উনিও মুচকি হেসে আমার হাত বুকের উপর নিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।এদিকে যে আমার কাঁপাকাপিঁ অবস্থা সেটা কি উনি বুঝতে পারছেন না,থাক না বুঝায় ভাল।বুঝলে আমার লজ্জা লাগবে।(মনে মনে)
অনেকক্ষণ ধরে উনি চোখ বন্ধ করে আছেন।মনে হয় ঘুমিয়ে গিয়েছেন কারন উনি আমার হাত একদম আলগা করে ধরে আছেন।আমি সেই তখন থেকে উনার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।বাতাসে উনার কপালে পরে থাকা চুলগুলো নড়ছে।ইচ্ছে করছে ছুঁয়ে দিই কিন্তু উনি যদি জেগে যান সেই ভয়ে হাত দিচ্ছিনা।উনার এই পাতলা গোলাপি ঠোঁট দিয়েই উনি ওমন মনপুরা হাসি দেন?আর এই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,এগুলো বড় হয়না কেন?সেই প্রথম থেকে এগুলো এত ছোটই আছে।উনার নাকের দিকে তাকালেই একটা কিসি দিতে ইচ্ছে করছে,ইশ কি গ্লো করছে নাকটা।উনি তো ঘুমিয়ে আছেন,একটা কিসি দিলে কি উনার ঘুম ভেঙ্গে যাবে?ঘুম ভেঙ্গে যদি দেখেন আমি উনাকে কিসি দিয়েছি তাহলে ব্যাপারটা খুব বাজে হয়ে যাবে, থাক কিসি ক্যান্সেল।(ঠোঁট উল্টিয়ে মনে মনে)
এসবই ভাবছিলাম হঠাৎ উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে আমার পেটের মধ্যে মুখ গুজে দিলেন।এমনি তেই এতক্ষণ হাটবির্ট দ্রুত হচ্ছিলো এখন মনে হয় ঢোল পিটাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি শেষ হয়ে যাবো।তাই কাঁপা কাঁপা হাতে উনার মুখ ঘুরানোর চেষ্টা করলাম।উনার মাথায় হাত রাখতেই আমি যেন কোমলতার মাঝে হারিয়ে গেলাম।ওয়াও উনার চুলগুলো কি সফট্,কমল!নিজের অজান্তেই উনার মাথায় বিলি কেটে দিতে থাকলাম।
প্রায় দুঘন্টা পর উনি চোখ খুললেন।আমি উনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে উঠে বসলেন।হঠাৎ এমনটা হওয়ায় আমিও অনেক চমকে গিয়েছি। উনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,
নির্ভীক:সরি আমি জাস্ট একটু রেস্ট নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু…তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে না?(অসহায় ফেস করে)
আমি:ইটস্ ওকে।(মুচকি হেসে)
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।একটানা এতক্ষণ এভাবে বসে থেকে পা লেগে গিয়েছে।উনি মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
নির্ভীক:এত ভাল ঘুম আমি কোন দিন ঘুমায় নি।
আমি:কিন্তু এত শক্ত শানের উপর বালিশ ছাড়া ভাল ঘুম কি করে হবে?
নির্ভীক:তুমি ছিলে সেজন্য।(আমার কানে ফিসফিস করে)
আমি মুখে হাসি টেনে তাকিয়ে থাকলাম উনার দিকে।হঠাৎ দুটো ছোট ছেলে মেয়ে কিছু ব্যাগ হাতে নিয়ে দৌঁড়ে আমাদের সামনে আসলো।এরা মনে হয় দূরের ওই গ্রামটাতে থাকে।নির্ভীক ভাইয়া উনাদের সামনে যেয়ে হাঁটু গেরে বসে বললেন,
নির্ভীক:সোনা,মোনা তোমরা চলে এসেছো?জানো তোমাদের কত মিস করছিলাম?(ওদের গালে হাত দিয়ে)
ওরা গাল থেকে হাত সরিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,”মিস করছিলে না ছাই,এতদিন আসোনি ক্যান?তুমি জানো?বাবা একটা ইয়া বড় ইলশা পাইছিল।”
নির্ভীক:ইয়া বড়?(অবাক হয়ে দুই হাত দিয়ে ইশারা করে)
ওরা দুজনে একসাথে মাথা নেড়ে হুম বলল।ছোট ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,”ওই তো পিচ্চি পরী আপু আইছে, এই চল ম্যাজিক দ্যাখবো।”(মেয়েটার দিকে তাকিয়ে)
আমি চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকালাম।ওরা দুজন এসে আমার দুহাত ধরে শানের উপর নিয়ে গিয়ে বসে বলল,
“ম্যাজিক দেখাও।”(উৎসাহ নিয়ে)
আমি নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি শব্দহীন হেসে আমার সামনে এসে বললেন,
নির্ভীক:পরীটা তো এখন ম্যাজিক দেখাতে পারবেনা,সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বাসায় ফেলে চলে এসেছে।(ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে)
ওরা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকালো।তারপর মেয়েটা বলল,”তুমি কি সুন্দর!”
ছেলেটা বলল,”আরে বোকা পরীরা সুন্দরই হয় জানোস না?”
আমি:তোমরা আমাকে চিনো?(মুচকি হেসে)
মেয়ে:হুম চিনি তো ভাইয়ার কাছে তোমার ছবি দেখছি,তোমার নাম তো পিচ্চি পরী,তুমি তো অনেক ম্যাজিক জানো আর খালি ঘুমাও।
আমি নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম,উনি থতমত খেয়ে বললেন,
নির্ভীক:আব,এই তোমরা আম্মুকে বলে এসেছো?যাও তোমাদের আম্মু খুঁজছে হয়তো।
ছেলে:এই যা ভুইলা গেছিলাম, মাই তো কইছিল এই গুলা নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে।(মেয়েটির দিকে তাকিয়ে)
মেয়ে:হ চল,চল।আইচ্ছা তোমরা থাকো।(আমাদের দিকে তাকিয়ে)
ওরা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে দূরে গ্রামের দিকে যেতে লাগলো। আমি নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
আমি:আমি পিচ্চি পরী?ম্যাজিক দেখায় আর ঘুমাই?আপনার কাছে আমার ছবি আছে?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক:রিল্যাক্স,রিল্যাক্স।এক সাথে এত কোয়েশ্চেন করছো কেন,আমি তো আছি ধীরে ধীরে বল।(মুচকি হেসে)
আমি:আপনি আমাকে খালি পিচ্চি বলেন।(মুখ ফুলিয়ে)
নির্ভীক:আরে বাবা তুমি তো পিচ্চি তাই পিচ্চি বলি।(আমার দিকে এগিয়ে এসে)
আমি:এই যে দেখুন,আপনার থেকে আমি মাত্র ৭-৮ ইঞ্চি খাটো হবো তাও আপনি লম্বা বেশি সেজন্য।(উনার উচ্চতার সাথে মাপ দিয়ে)
নির্ভীক:কই দেখি।হুম একদম পারফেক্ট পিচ্চি।(আমার সামনে এসে আমাকে উনার বুক বরাবর মেপে)
আমি মুখ ফুলিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
আমি:আপনিও তাহলে পারফেক্ট ডাইনোসর।
নির্ভীক:ওকে টাইনি বিড়াল ছানা।(আমার গাল টেনে)
আমি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিক ঘুরে দাঁড়ালাম।উনি বাসা থেকে আনা খাবার গুলো বের করলেন।তারপর দুজন একসাথে এইরকম নিরিবিলি পরিবেশে বসে লান্চ সেরে ফেললাম।খাওয়া শেষে খেয়াল করলাম রোদ আর নেই তাই ঠিক করলাম নদীর পানিতে পা ভিজাবো।নির্ভীক ভাইয়াকে বলে সামনে এগুতেই উনি পেছন থেকেই আমার হাত টেনে অস্তির হয়ে বললেন,
নির্ভীক:অন্ত চলো,আমাদের এখনই বাসায় যেতে হবে।আকাশে প্রচুরমেঘ করেছে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি পশ্চিম আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে,চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আছে।ছোটবেলায় বিভূতিভুষন বন্দোপাধ্যায়ের লিখা ‘পরে পাওয়া’ গল্প পরে জেনেছিলাম পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ জমা মানেই ভয়ঙ্কর ঝড়-বৃষ্টি হবে এটা সিউর।আমি মেঘ করা দেখলেই ভয় পাই আর ঝড় হলে তো কথায় নেই তাই নির্ভীক ভাইয়াকে বললাম,
আমি:তাড়াতাড়ি চলুন,আমার ঝড় ভয় লাগে। মনে হচ্ছে এখনই ঝড় আসবে।(ভীত চোখে চারদিকে তাকিয়ে)
উনি আমার হাত ধরে হাঁটা দিলেন।আমরা বাইক নিয়ে এখানে এসেছি কিন্তু বাইক অনেক দূরে আছে হেঁটে যেতে ১০মিনিট লাগবে।আমরা ধানী জমির আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে জোড়ে জোড়ে হাঁটতে লাগলাম।অনেকটা পথ হেঁটে অবশেষে বাইকের কাছে আসলাম কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা।ধুলোঝড় শুরু হয়ে গেল,এখানে আশেপাশে কোন ঘরবাড়িও নেই শুধু আঁকাবাঁকা রাস্তা,গাছ আর ফসলি জমি।আমরা তাড়াতাড়ি বাইকে উঠলাম।ঝড়ের মধ্যেই নির্ভীক ভাইয়া ড্রাইভ করতে লাগলেন কিন্তু আমাদের চোখ, মুখ,নাক,কান দিয়ে ধুলো ঢুকছে।উনি তো তাকাতেই পারছেননা তাই বাইক থামিয়ে আমাকে নিয়ে একটা গাছের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।ঝড়ের কারনে গাছের ডাল পালা সব এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে মনে হচ্ছে এখনই গাছটা আমাদের মাথায় ভেঙ্গে পরবে।আমি আগে কখনও এমন ঝড় দেখিনি।এতদিন বাসার ভেতর থেকে ঝড় দেখে ভয় পেয়েছি আর আজ একদম ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি ব্যাপারটা আমার জন্য ভয়ঙ্করের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
নির্ভীক ভাইয়া উনার শার্ট খুলে আমার মাথার উপর দিয়ে আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমি শুধু গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে আছি,ওগুলো যেকোন সময় ভেঙ্গে পরবে।হঠাৎ ঝড় কমে গেল কিন্তু বজ্রপাত সহ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো।এইবার আমি শেষ,বজ্রপাতের এত সাউন্ড আর লাইটিং এ আমি চোখ খিচে বন্ধ করে নির্ভীক ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম।উনি আমাকে জোড়ে জোড়ে বললেন,
নির্ভীক:অন্ত চলো,আমাদের খোলা মাঠে যেতে হবে।বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা একদম উচিত নয়।
আমি:নাআআ,আমি কোথাও যাবোনা। (কান্না করে)
নির্ভীক:চলো।(আমাকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে)
আমি উনাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। উনি না পেরে আমাকে নিয়ে গাছের গোড়ায় বসলেন।বৃষ্টির বড় বড় ফোটায় আমরা খুব তাড়াতাড়ি ভিজে চুপসে গেলাম।হঠাৎ আমার খেয়াল হলো আমি তো উনার শার্ট মাথায় দিয়ে আছি আর উনি খোলা মাথায় আছেন,উনার নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে।তাই আমি শার্ট টার কিছু অংশ উনাকেও দিলাম। উনি দুইহাত দিয়ে আমাদের দুজনের মাথাতেই শার্ট ধরে রাখলেন।যদিও আমাদের মাথা আগেই ভিজে গেছে তাও শার্ট ধরে থাকার কারন হলো বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ত্বকে লাগলে যেই কষ্ট হয় সেই কষ্টটা যেন না হয়।
প্রায় আধঘন্টা পর আকাশ পরিষ্কার হলো।আমি এখনও নির্ভীক ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি।উনি মাথার উপর থেকে শার্ট তুলে নিলেন তারপর আমাকে নিয়ে দাঁড়ালেন।আমার এখন আর ভয় করছেনা তাই উনাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়ালাম।উনি শার্টের পানি ঝরাতে ঝরাতে বললেন,
নির্ভীক:আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবেনা,শীত করছে।
আমি উনার দিকে তাকালাম।উনার চুল গুলো সব চোখের উপর চলে এসেছে,চুলের আগা দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে।বৃষ্টিতে ভিজে মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে,গোলাপি ঠোঁট কালছে বর্ণ ধারন করেছে।আর সাদা স্যান্ডো গেন্জি ভিজে যাওয়ার জন্য উনার বুক পেট সবই দেখা যাচ্ছে।হঠাৎ নিজের জামার কথা খেয়াল হতেই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি কিছু দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু সব গায়ের সাথে লেপ্টে আছে,একদম বাজে লাগছে।নির্ভীক ভাইয়া উনার শার্ট চিপে ঝারা দিয়ে আমার গায়ে পড়িয়ে দিলেন তারপর নিজের গেন্জি খুলে চিপে ঝারা দিয়ে আবার পরে নিলেন।আমি প্রথম বারের মতো উনার উন্মুক্ত দেহ দেখলাম কিন্তু মনে মনে খুব গিলটি ফিল করছি কারন উনি আমাকে নিজের জামা খুলে ঢেকে দিলেন,একটাবার আমার দিকে তাকালেনও না আর সেই আমিই উনার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকে উনার শরীর দেখলাম।ছিঃ অন্ত,শেম অন ইউ।(মনে মনে)
বাইকে উঠে ভিজে শরীরে বাতাস লাগায় আরও বেশি ঠান্ডা লাগছে।ইতিমধ্যে আমার হাঁচি পরা শুরু হয়ে গিয়েছে।নির্ভীক ভাইয়া রেগে গিয়ে বলছেন,
নির্ভীক:সব আমার জন্য হয়েছে,আই ক্যান্ট ফরগিভ মি।(ড্রাইভ করতে করতে)
আমি:আপনি নিজেকে এভাবে দোষারোপ করছেন কেন?(পেছন থেকে উনার ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে)
নির্ভীক:আমার তোমাকে এতদূর নিয়ে আসায় ঠিক হয়নি, কতক্ষণ ধরে ভিজলে এখন শরীর খারাপ করবে।(মন খারাপ করে)
আমি:শরীর খারাপ করবেনা,আমি বাসায় যেয়েই মেডিসিন নিয়ে নিবো আর আমার এখানে এসে খুবই ভাল লেগেছে।
পুরো রাস্তা উনাকে বোঝাতে বোঝাতে বিকেলের আগেই বাসায় চলে আসলাম।বাসায় এসেই আগে চেন্জ করে মেডিসিন নিলাম।নির্ভীক ভাইয়াও বাসায় চলে গিয়েছেন।আমার থেকে উনার বেশি ঠান্ডা লেগেছে।পুরো বিকেল ইচ্ছের সাথে গল্প করে কাটালাম।
রাত ১০টা,
মাথাটা খুব ভার ভার লাগছে আর সর্দিও লেগেছে। ধোয়া উঠা কফির মগ নিয়ে বেলকুনিতে গিয়ে বসলাম।নির্ভীক ভাইয়ার বেলকুনিতে তাকিয়ে দেখি উনি বেলকুনিতে বসে ল্যাপটপে কিছু করছেন।আমি এক ধ্যানে উনার দিকেই তাকিয়ে আছি।এই গরমেও উনি মোটা ফুল স্লিভ টিশার্ট পরে আছেন তবে কি উনার জ্বর এসেছে?ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ পর উনি ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে ঘাড় নড়া চড়া করতে লাগলেন দেখে মনে হচ্ছে উনার ঘাড় লেগে গিয়েছে।
হঠাৎ উনি আমার বেলকুনি তে তাকিয়ে আমাকে দেখে ল্যাপটপের স্ক্রিন নামিয়ে ফেললেন।মুখে হাসি টেনে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।আমিও মুচকি হেসে উনার দিকেই তাকিয়ে আছি।উনি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন,”আর ইউ অলরাইট?” আমি মুচকি হেসে মাথা উপর নিচ করে হ্যা সূচক জবাব দিলাম।উনি বুকে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর মুচকি হেসে এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।আমিও হাবলার মতো হেসেই যাচ্ছি কোন কারন ছাড়ায়।ইচ্ছে আমার পাশে কখন থেকে বসে আছে জানিইনা।ওর গান শুনে আমার ধ্যান ভাঙ্গলো,
আও শুনাউ পেয়ার কি এক কাহানী….
একথা লাড়কা একথি লাড়কি দিওয়ানী
ওভি হাসনে লাগাথা এভি হাসনে লাগিথি
দোনো সামঝে নাহি থা
ও জো হোনে লাগা থা….
ইচ্ছে:কি হচ্ছে রে এখানে?(গান থামিয়ে ভ্রু কুচকে)
আমি:আব,কই কিছু না।(থতমত করে)
ইচ্ছে:দেখ আমার কাছে কিছু লুকাতে আসিস না,ভালই ভালই বলে দে বলছি।(হালকা রেগে)
আমি:কি বলবো?
ইচ্ছে:কয়েকদিন ধরে তোকে দেখছি তুই কেমন অদ্ভূত আচরন করছিস,এই দেখ কফির মগ খালি তাও মুখে দিয়ে চুমুক দিচ্ছিস,কারনে ওকারনে হাসছিস।
আমি:আমি একা হাসছি নাকি?ওইতো নির্ভীক ভাইয়াও হাসছে দেখ।(উনার বেলকুনির দিকে ইশারা করে)
ইচ্ছে:হুম হাসছিলেন,পাঁচমিনিট আগে।উনি পাঁচমিনিট আগে বেলকুনি থেকে চলে গিয়েছেন,কেন জানিস?কারন উনি তোকে ইশারা করে ভেতরে যেতে বলছিল কিন্তু তুই তো শুধু হেসেই যাচ্ছিস তাই উনি রেগে নিজেই চলে গেলেন। উনি যাওয়ার পর আমি তোর ধ্যান ভাঙ্গার জন্য গান ধরলাম।আর তুই এখনও উনাকে ওখানে কি করে দেখছিস?
ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে নির্ভীক ভাইয়ার বেলকুনিতে তাকালাম,ঠিকই তো উনি নেই ওখানে।আমার সাথে কি হচ্ছে এসব,সারাক্ষণ উনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি।আমি খালি কফি মগের দিকে তাকিয়েও অবাক হয়ে গেলাম।একমগ গরম কফি আমি কখন খেয়ে নিলাম?আমি দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম।ইচ্ছে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
ইচ্ছে:কি হয়েছে তোর?বলবি না আমাকে?(শান্ত কন্ঠে)
আমি ছলছল চোখে ওকে জড়িয়ে ধরলাম তারপর বলতে লাগলাম,
আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি হয়েছে।কোথায় আছি,কি করছি, কার সাথে কথা বলছি এসব কিছু ম্যাটার করছেনা আমার কাছে।সব সময় ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি।বাস্তব,কল্পনা সব এক হয়ে যাচ্ছে।কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিনা।সবসময় নির্ভীক ভাইয়ার কন্ঠ কানে বাজছে,চোখ বন্ধ করলে উনার হাসিমাখা মুখ ভেসে উঠছে আর চোখ খুললে উনার চেহারাটায় ভাল করে মনে পরছেনা তখন খুব অসস্তি হচ্ছে উনাকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।সব সময় উনাকে মিস করছি আবার উনি কাছে আসলে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি।অকারনেই উনার উপর রেগে যাচ্ছি আবার অকারনেই উনার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছি।উনি বেলকুনি থেকে চলে গিয়েছেন আমি বিন্দু মাত্র বুঝতে পারিনি আমার মনে হচ্ছিলো উনি আছেন, আমার সাথে হেসে কথা বলছেন।এই যে দেখ এত গরমেও আমাকে গরম লাগছেনা,এসির ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছিনা।আমার কি হয়েছে বলতে পারবি?বলনা..
বলেই ইচ্ছেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।কিছুক্ষণ কেঁদে হালকা হয়ে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে দেখি ও হাসছে।আমি রেগে ওকে বললাম,
আমি:আমার এত কষ্ট হচ্ছে আর তুই হাসছিস?
ইচ্ছে:তোর তো একটা ভয়ানক অসুখ হয়েছে রে।(হেসে)
আমি:এ্যা এ্যা এ্যা আমি আর বাঁচবোনা।(কেঁদে)
ইচ্ছে:আরে বাঁচবি কিন্তু কয়লা হয়ে বাঁচবি।(মুচকি হেসে)
আমি:মানে?
ইচ্ছে আমার কানে কানে কিছু বলল।সেটা শুনার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।ওর কথা শুনে আমি হাসছিও আবার কাঁদছিও।ইচ্ছে তো আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেই যাচ্ছে।একসময় নিজের সাথে না পেরে আমি ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে হাসি আর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে ওকে বললাম,”ইয়েস আই ডু”।
চলবে………..