#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sonani_Simu
৬.
বিকেলে নির্ভীক ভাইয়ার সাথে ছাদে বসে আছি।উনি কফি খাচ্ছেন আর আমি চিপস খাচ্ছি।ইচ্ছে সেই তিনটের সময় মাথাব্যথার মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়েছে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাও উঠার নাম গন্ধ নেই।নির্ভীক ভাইয়া এক চুমুক কফি নিয়ে মগটা ফ্লোরে রেখে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকালেন।কিছুক্ষণ পর বললেন,
—শীট!!এটা আজই হওয়ার ছিল?
আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
–কি হয়েছে?
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বললেন,
—নাথিং।
উনি কাউকে ফোন দিলেন।ফোন রিসিভ করতেই উনি বললেন,
নির্ভীক:তুই আমাকে আগে বললিনা কেন আজকে সি.টি. ছিল?
ওপাশ:…..
নির্ভীক:ওকে গুড,কোথায় আছিস?(মুচকি হেসে)
ওপাশ:….
নির্ভীক:ওয়েট আম কামিং।
কল কেটে উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
—চলো বাহিরে যাই।
–কেন?(চিপস খেতে খেতে)
–এমনি ঘুরতে,কতদিন বাহিরে যাইনা।মিস মাই ওল্ড মি।(দুই হাত টান টান করে আড় মোড়া ভেঙ্গে)
–বাহিরে যাননা কেন?(ভ্রু কুচকে)
–কেন যেন কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা।চলো না আজকে একটু ঘুরে আসি,প্লিজজজ।(বাচ্চাদের মতো মুখ করে)
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
–আপনার যেতে ইচ্ছে করছে আপনি যান,আমি যাবনা।
বলেই উঠে দাঁড়ালাম।উনি আমার হাত ধরে বললেন,
–যাবেনা মানে?যেতেই হবে।তিন দিন ধরে বাহিরে যাইনি ভাবা যায়!!হাত-পায়ে জং ধরে গেছে।
আমি উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
–কোথাও যাব না আমি,আপনি যান জং সারিয়ে আনুন।
উনি ল্যাপটপ,মগ আর ফোন হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার সাথে একটাও কথা না বলে নিচে চলে গেলেন।আমিও ঠোঁট উল্টে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।একটু পর নিচে গেলাম।ড্রইং রুমে গিয়ে টিভির রিমোট হাতে নিতেই কোথায় থেকে নির্ভীক ভাইয়া এসে আমার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে সোফায় ফেলে দিলেন। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন।আমি পিছুটান নিয়ে বললাম,
—-আরে কি করছেন?যাব না আমি।
উনি খালাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
–খালা আমরা বাহিরে যাচ্ছি,তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো ডোন্ট ওরি।
খালা কিছু বলল না শুধু মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।উনি আমাকে নিয়ে বাহিরে আসলেন।গাড়ির দরজা খুলে উনি আমাকে পেছনের সিটে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।লুকিং গ্লাসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—এই পিচ্চি!
আমি মুখ ফুলিয়ে উনার দিকে তাকালাম।গ্লাসে উনাকে দেখেই আমি অন্যদিকে তাকালাম।কিছু কিছু সময় উনার দিকে তাকাতে পারিনা,কেন এমন হয় জানিও না।উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন।আমি জানালার পাশে এগিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকলাম।সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে,ল্যাম্পপোস্ট গুলো জ্বলে উঠেছে।ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে চলছে শত শত যানবাহন।হঠাৎ রাস্তার পাশে গাড়ি থেমে গেল।আশেপাশে খেয়াল করে দেখলাম আমরা রুয়েটের সামনে এসেছি।আমি নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি লুকিং গ্লাসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–একটু ওয়েট করো আমি এখনই আসছি।
উনি প্রায় দশমিনিট পর ফিরে আসলেন।উনার সাথে প্রান্ত ভাইয়া আছেন।গাড়িতে উঠেই প্রান্ত ভাইয়া আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
—কেমন আছো অন্ত?
–ভাল আপনি?
–আমিও ভাল আছি।
নির্ভীক ভাইয়া ড্রাইভ করছেন আর প্রান্ত ভাইয়া উনার পাশে বসে কথা বলছেন।উনারা পড়াশুনা নিয়ে ডিসকাশন করছেন।একটু পর প্রান্ত ভাইয়া পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে নির্ভীক ভাইয়াকে দিলেন তারপর আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
–তাহলে তুমিই সেই পিচ্চি?আই মিন ছোটপাখি?(মুচকি হেসে)
আমি কিছু বলার আগেই নির্ভীক ভাইয়া লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বললেন,
–শুধু ছোটপাখি নয় আরও অনেক কিছু।একটা পিচ্চির এত গুলো নাম মাই গড।সবাই ওকে একটা করে নাম দেই।
প্রান্ত ভাইয়া হাসতে হাসতে নির্ভীক ভাইয়াকে বললেন,
—তুই সবগুলো জানিস তো?
নির্ভীক ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
–হুম সব,এ টু জেড।
আমি ভ্রু কুচকে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—কিসের এ টু জেড?আমার অতগুলো নাম নেই।
প্রান্ত ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
—আছে আছে তুমি জানো না তাই বলছো।নির্ভীকের কাছেই তোমার হাজারটা নাম আছে তাইনা নির্ভীক?
নির্ভীক ভাইয়া উনাকে ধমক দিয়ে বললেন,
—শাট আপ।
ধমক খেয়ে প্রান্ত ভাইয়া হা হা করে হেসে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকালেন।প্রান্ত ভাইয়া পেছনে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—আমার কথা তোমার কিছু মনে আছে?
—হ্যা সেদিন নির্ভীক ভাইয়া যখন আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন আপনি একবার নিষেধ করেছিলেন তাইনা?ওটাই আপনি না?
–হুম কিন্তু নিষেধ করে কাজ হলো নাতো,পাগলটা তোমাকে ভিজিয়েই ছাড়লো তারপর অপরাধী হয়ে গেল।(মুচকি হেসে)
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
–কেন?অপরাধী হওয়ার কি আছে।আমারই দোষ ছিল।
নির্ভীক ভাইয়া প্রান্ত ভাইয়াকে বলতে নিষেধ করছেন কিন্তু প্রান্ত ভাইয়া কিছু বলার জন্য উসখোস করছিলেন একসময় বললেন,
—আসলে নির্ভীক তো রাগ করে তোমাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল।তুমি ওর টাইগারকে ভিজিয়ে দিয়েছো সেজন্য আর ওতো বাহিরে বড় মুখ করে বলেছিল যে ওর টাইগারকে ভিজিয়ে দিয়েছে তাকে ও বরফে চোবাবে।আমরা ভেবেছিলাম কোন ছেলে কিন্তু ভেতরে যেয়ে দেখলাম তুমি।নিজের ইগোকে প্রায়োরিটি দিয়ে শেষমেশ তোমাকে ভিজিয়েই দিল।তারপর নিজের উপর রাগ করে বাসায় যেয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে…………
নির্ভীক ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে বললেন,
—-তারপর নিজেও ঠান্ঠা পানি দিয়ে গোসল দিয়েছি তাই তো?….তোর ক্রিয়েটিভ চিন্তাধরা দেখে আমি হতবাক।
প্রান্ত ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
—কি বলবো তুই তো সত্যি কথা বলতে দিচ্ছিস না।
নির্ভীক ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে গড় গড় করে বললেন,
—তোমাকে দেখে আমি আমার পিচ্চিকে ভুলে গিয়েছিলাম তাই তোমার উপর রাগ করে তোমাকে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম,ওসব ইগো-প্রায়োরিটি আমার কাছে কিছু নয়।আমার প্রিয়তাই আমার কাছে সব।তোমার জায়গায় তুমি ছিলে দেখেই তোমাকে ভিজিয়েছি অন্যকোন মেয়ে থাকলে কিছুই বলতাম ন।এটাই সত্যি।
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
—মানে?
উনারা গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।আমিও গাড়ি থেকে নেমে নির্ভীক ভাইয়াকে বললাম,
–কি বললেন কিছুই তো বুঝলাম না।কেন ভিজিয়ে দিয়েছিলেন?
উনি মুচকি হেসে বললেন,
–বুঝতে চাও?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।উনি আমার হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বললেন,
—আমি কে জানো?আমাকে তো একদম ভুলেই গিয়েছ।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—ভুলে গেছি মানে?(ভ্রু কুচকে)
উনি আমাকে নিয়ে লিফটে উঠলেন।প্রান্ত ভাইয়াকে তিনতলায় রেস্টুরেন্টে ওয়েট করতে বলে উনি আমাকে নিয়ে একদম ছাদে চলে আসলেন।অনেক বড় ছাদ।ছাদে কয়েকটা বাল্ব জ্বলছে,এক সাইডে কয়েকটা পানির ট্যাংক আছে আর অন্যসাইডে একটা টাওয়ার আছে।আমরা টাওয়ার নিচে সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম।শীতের দিনে সন্ধ্যা সাতটা মানেই রাত।চারপাশে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে,মৃদু ঠান্ডা বাতাসে আমাদের চুল হালকা দুলছে।কান দিয়ে বাতাস ঢুকছে দেখে আমি জ্যাকেটের সাথে লাগানো টুপি মাথায় দিয়ে বললাম,
–আমরা এখানে কেন আসলাম?
নির্ভীক ভাইয়া পকেট থেকে ফোন নিয়ে একটা ছবি বের করে ফোন আমাকে দিলেন।আমি ফোন হাতে নিয়ে ছবি দেখলাম।একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে আমাকে কোলে নিয়ে রাগী মুখ করে সামনে তাকিয়ে আছে।আমার তখন চার-পাঁচ বছর বয়স।আমি একটা লাল ফ্রক পরে মাথার উপর দুটো ঝুটি করে ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে হাসছি। কি কিউট ছবি!!নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–এটাতো আমার ছোটবেলার ছবি কিন্তু এই ছেলেটা কে?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক ভাইয়া একটা দম ছেড়ে বললেন,
—ওটা আমি।
—আপনি?ছোটবেলার কথা আপনার মনে আছে?(অবাক হয়ে)
নির্ভীক ভাইয়া আমাকে আরও অনেকগুলো ছবি দেখালেন।সবগুলোই ছোটবেলার।এগুলো আমাদের বাসায় নেই,নির্ভীক ভাইয়ার সাথে কোন ছবিই আমাদের বাসায় নেই।জারিফ ভাইয়ার সাথেও আমার আর উনার ছবি আছে।ছবি দেখা শেষে উনি আমার কাছে থেকে ফোন নিয়ে বললেন,
–তোমার যখন তিনমাস বয়স তখন তোমরা এখানে এসেছিলে।সাড়ে পাঁচবছরের মতো থেকে আবার ঢাকায় চলে গেয়েছিলে।ঢাকায় যেয়ে তো আমাকে পুরো ভুলে গেলে অথচ এখানে থাকতে সব সময় আমার সাথে থাকতে,আমাকে স্কুলেও যেতে দিতা না।একবার তো একা একা আমার খোঁজে রাস্তায় বেড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছিলে।বাই দ্যা ওয়ে আমি তোমাকে এসব কেন বলছি বুঝতে পারছো?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝালাম।উনি মৃদু হেসে বললেন,
–আমরা ছোটবেলার ফ্রেন্ড আর আজ এই মুহূর্ত থেকে আমরা সারাজীবনের জন্য ফ্রেন্ড বুঝেছো তুমি?উই আর ফ্রেন্ডস বাট মোর দ্যান ফ্রেন্ডস।
উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–ফ্রেন্ডস??(মুচকি হেসে)
আমি সেই তখন থেকে উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি।রাজশাহী আসার আগে আম্মু আর ভাইয়া চাঁদ ভাইয়া সম্পর্কে বলেছিল আমাকে।আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্পও শুনেছি।আমি উনাকে অনেক জ্বালিয়েছি।আমি উনার কাছে যাওয়ার জন্য প্রায়ই একা একা বেড়িয়ে যেতাম সেজন্যই তো বাবা ঢাকায় চলে গিয়েছিল।আমার অবশ্য কিছুই মনে নেই,আম্মুর কাছে শুনেছিলাম এসব গল্প। উনার সব কথা শুনে আমি মুচকি হেসে উনার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললাম,
—ফ্রেন্ডস।
উনি মুচকি হাসলেন আর বললেন,
–তোমার হাত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।এখানে খুব ঠান্ডা চলো নিচে যাই।
নিচে এসে দেখি প্রান্ত ভাইয়া টেবিল ভর্তি খাবার অর্ডার দিয়ে বসে বসে খাচ্ছেন।আমরাও উনার সাথে খেতে বসে গেলাম।নির্ভীক ভাইয়া কাটা চামচ হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
—অন্ত জানো প্রান্ত আমার বেস্টফ্রেন্ড।ছোটবেলায় বাবা বলতো মৃত্যুর পর বাবা-মা,ভাই-বোন কারও সাথে জান্নাতে দেখা হয়না শুধু ভাল বন্ধুদের সাথে দেখা হয় কারন আল্লাহ্ বন্ধুত্ব পছন্দ করেন।তখন থেকে আমরা ফ্রেন্ড।বাবা-হানিফ অ্যাঙ্কেল,জারিফ ভাইয়া-আরাফ ভাইয়া যেরকম নাম করা ফ্রেন্ড আই থিংক আমি আর প্রান্তও ওদের মতো নামকরা ফ্রেন্ড।আমি আশা করি জন্নাতে আমাদের দেখা হবে,আমি কিন্তু তোমাকেও সেখানে দেখতে চাই।
উনার কথা শুনে আমি বুঝতে পারছি বন্ধুত্বকে উনি কি চোখে দেখেন।উনার কাছে বন্ধুত্ব কোনো হেলা ফেলা জিনিস নয়।প্রান্ত ভাইয়া খেতে খেতে বললেন,
—শালা নড়কেও জায়গা হবে কিনা সন্দেহ আছে আর তুই জান্নাতে যেয়ে কাদের নিয়ে থাকবি সেই স্বপ্ন দেখিস?
নির্ভীক ভাইয়া খেতে খেতে বললেন,
–স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে।
বলেই উনি আমার দিকে তাকালেন।আমি মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলাম।মনে মনে বললাম যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ নয়,শুধু রাগটা একটু বেশি।
চলবে………..