#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu
৩৪.
গাড়ি চলছে মাঝারি গতিতে।ফ্রন্ট সিটে বসে অন্ত একটার পর একটা কথা বলছে আর আরাফ চুপচাপ শুনছে।মাঝেমাঝে হু হা করছে।অন্ত জানালার কাচ নামিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘এসি বন্ধ কর,আজকে বাইরে অনেক বাতাস।’
আরাফ এসি বন্ধ করে দিল।অন্ত আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার কি মন খারাপ?কথা বলছো না কেন?জানো আমাদের বাসায় নির্ভীক ভাইয়া সাতটা হাসপাখি নিয়ে এসেছে।চলন বিলের হাস।তুমি কখনও চলনবিলে গিয়েছো?’
আরাফ মৃূদু হাসলো।সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না।’
অন্তর আর আরাফের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।আরাফের কি হয়েছে বুঝতেও পারছেনা।অন্ত জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।ব্যস্ত রাস্তা,বাতাসে পেট্রলের গন্ধ,চারপাশে যানবাহনের পিক পিক আওয়াজ।আরাফ শান্ত চোখে একনজর অন্তর দিকে তাকালো।তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।কিছুক্ষণ আগেও সে এই মেয়েটিকে খুব করে কামনা করতো।ভাবতো এই মেয়েটি তাকে সারাজীবন গভীর ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে কিন্তু বিয়ের পর আজ প্রথম নির্ভীকদের বাসার সামনে অন্তকে দেখে তার সব ভাবনা কেমন পাল্টে গেল।যেই মেয়েটিকে নিজের ভাবছে সে এখন অন্য কারো বিয়ে করা বউ।সে যাকে ভালোবাসে সেই মেয়েটি এখন অন্যকারো সাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।তার সমস্ত অঙ্গ জুড়ে অন্য কারো পবিত্র স্পর্শ।আরাফ চেয়েও অন্তকে স্পর্শ করতে পারছেনা।বার বার মনে হচ্ছে তার সামান্য স্পর্শে অন্ত অপবিত্র হয়ে যাবে।তার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকালেও নিজের কাছে নিজেকে অপমানিত লাগছে।
শপিং মলের সামনে গাড়ি পার্ক করে দুজন গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো।অন্ত আরাফের হাত ধরে বলল,
‘এত ভীর কেন!’
অন্ত হাত ধরায় আরাফের অস্বস্তি হতে লাগলো।অন্তর প্রতি তার যেই ফিলিংস আছে সেগুলো তো মিথ্যে নয় কিংবা চাইলেও সেগুলোকে পরিবর্তন করা যাবেনা।আবার হাত ছাড়ার কথা অন্তকে বলতেও পারবেনা।আরাফ নিজের উপর অবাক হচ্ছে।সবকিছু নিজের অনুকূলে আছে তাও সে কেন পারছেনা অন্তকে নিয়ে যেতে?কিছুক্ষণ আগেও আরাফ ভেবেছিল আজ অন্তকে নিয়ে দূরে চলে যাবে।তার ধারণা ছিল নির্ভীক কিছুতেই অন্তকে তার সাথে ছাড়বেনা।তাহলে কেন ছাড়লো?আরাফ নিজের এতটা পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হচ্ছে।
শপিং শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।অন্ত বার বার নির্ভীকের কথা বললেও নির্ভীক একবারও অন্তকে ফোন দেয়নি।আরাফই ফোন দিয়ে বলেছে তাদের বাসায় যেতে আরও কিছুক্ষণ দেরি হবে।উত্তরে নির্ভীক বলেছে সাবধানে এসো।আরাফ অন্তকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে।চিকেন নুডুলস খেতে খেতে অন্ত হঠাৎ শপিং ব্যাগ খুঁজে ঘড়ির বক্স বের করে আরাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা তুমি পকেটে রাখো।’
আরাফ ভ্রু কুচকে বলল,
‘কেন?’
অন্ত মুচকি হেসে বলল,
‘এটা নিপা আপুকে দিবা।এটা আপুর জন্যই চয়েস করেছি ।আপুর হাত কত সুন্দর।গোলগাল,নাদুসনুদুস হাতে এমন মোটা চেইনের ঘড়ি বেশ মানাবে আর তুমি নিজের হাতে দিলে খুব খুশিও হবে।’
আরাফ মলিন হেসে বলল,
‘এসবের দরকার নেই।’
অন্ত সবগুলো ব্যাগ আরাফের দিকে ঠেলে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘তাহলে এসবেরও দরকার নেই।’
আরাফ মুচকি হেসে বলল,
‘ওকে ওকে দিব।খাওয়া শেষ কর তাড়াতাড়ি,বাসায় ফিরতে হবে তো।’
সন্ধ্যা তখন রাত্রির কোলে ঢলে পরেছে।শহরের আলোগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।আরাফ অন্তকে নিয়ে বাসার প্রায় কাছেই চলে এসেছে।এমন সময় হুট করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।উল্টো দিকে কিছুটা পথ যেতেই গাড়ি থামিয়ে স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে জোরে বারি দিয়ে অসহায় মুখ করে অন্তর দিকে তাকালো।অন্ত চোখ বন্ধ করে আছে,মনে হয় ঘুমোচ্ছে।আরাফ অন্তকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু নিয়ে যেতে পারছেনা।অন্তকে নিয়ে গেলে ওর মান সম্মান শেষ হয়ে যাবে,সমাজ তাকে ভাল চোখে দেখবেনা আর সব থেকে বড় কথা অন্ত আরাফকে চাইবেনা।আগের বার জোর করে নিয়ে যাওয়ার ফল অন্তকে এখনও ভুগতে হচ্ছে এবারও তেমন কিছু হবে না কে বলতে পারে?আর অন্ত কি ঘৃণা করবেনা তাকে?অবশ্যই করবে।এমন হাজারো পিছুটানে আরাফের মত পাল্টে গেল।দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে নির্ভীকদের বাসার সামনে এসে অন্তকে নামিয়ে দিল।
নির্ভীক তখন উঠোনেই ছিল।হাসগুলো সব কাটা হয়েছে কমলা আর শেফালি সেগুলো পরিষ্কার করছে আর নির্ভীক প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে।গাড়ির শব্দ পেয়েই নির্ভীক গিয়ে দরজা খুলে দিল।অন্ত চলে এসেছে।আরাফ নির্ভীককে ডেকে অন্তকে ভেতরে যেতে বলল।অন্ত মাথা নাড়িয়ে শপিং ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল।আরাফ গাড়ি থেকে নামেনি,ড্রাইভিং সিটে বসে আছে।নির্ভীক গাড়ির খোলা জানালার উপর দুই হাত রেখে ভেতর দিকে উকি দিয়ে বলল,
‘বল কি বলবা?’
আরাফ সামনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল।তারপর নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে বলল,
‘হুয়াই ডিড ইউ লেট হার গো উইথ মি?আফটার সো মেনি থিংকস?হুয়াই?’
নির্ভীক মুচকি হেসে বলল,
‘ইট ওয়াজ নিডেড।’
আরাফ নির্ভীকের কথা শুনে হাসলো।পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘সব কিছু এভাবে হাতের বাইরে চলে যাবে বুঝতে পারিনি।পারতাম ওকে জোর করে বিয়ে করতে।কত সুযোগ!অথচ পারছিনা।নিজেই নিজের কাছে হেরে যাচ্ছি।’
নির্ভীক সোজা হয়ে দাঁড়ালো।কয়েকসেকেন্ড ধরে খেয়াল করছে অন্ত ভেতরে কাঁদছে।সেই চিকন কান্নার সুর নির্ভীকের বুকে এসে লাগছে।এখন বুঝতে পারছে হাসগুলো কিনা তার ভুল হয়েছে আর সেগুলো কেটে ফেলা মস্ত বড় ভুল হয়েছে।আরাফ আর কিছু বলল না,গাড়ি নিয়ে চলে গেল।অথচ সে নির্ভীককে বলতে চেয়েছিল তুই সরে যা না,তুই সরে গেলেই আমি অন্তকে পাবো।বলার সুযোগ ছিল কিন্তু বলতে পারলোনা অবশ্য বললেও নির্ভীক সরতো না।
—
রাত বারোটা।নির্ভীক ল্যাপটপ অফ করে ঘাড় নাড়ালো।হাত-পা টান টান করে একটা হাই তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো।অন্ত বিছানায় ঘুমোচ্ছে।টেবিল ল্যাম্প অফ করে চেয়ার থেকে উঠে নির্ভীকও বিছানায় আসলো।বিছানার মাঝ বরাবর কোলবালিশ আর কুশন দিয়ে বর্ডার দেওয়া আছে।নির্ভীক কুশন গুলো সোফায় ছুড়ে ফেলল আর কোলবালিশ অন্তর অন্যপাশে রাখলো।কনুইয়ে ভর দিয়ে অন্তর দিকে ঝুকে গালে চুমু দিতেই অন্ত ফট করে চোখ খুললো।নির্ভীকও চট করে উল্টো দিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।অন্ত উঠে বসে গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীক জেগে আছে অন্ত খুব ভাল করে জানে কারন অন্তও এতক্ষণ ধরে জেগেই আছে।
কোলবালিশ আর কুশন ঠিক জায়গায় নেই দেখে অন্ত রেগে বিছানা থেকে নেমে সোফায় গিয়ে বসলো।কুশন মাথায় দিয়ে সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরলো।নির্ভীক এক চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করছে অন্ত এখন কোথায়।অন্তকে সোফায় শুতে দেখেই নির্ভীক উঠে বসলো।চোখমুখ শক্ত করে অন্তকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে নিজের ভর অন্তর উপর ছেড়ে দিল।অন্ত এতক্ষণ ধীরে ধীরে ছাড়ুন ছাড়ুন করছিল এবার চিৎকার করা শুরু করে দিয়েছে।নির্ভীক অন্তর মুখ চেপে ধরে বলল,
‘চুপ!!চেঁচাচ্ছ কেন?’
অন্ত মুখ থেকে নির্ভীকের হাত সরানোর চেষ্টা করছে।নির্ভীক নিজের হাত সরাতেই অন্ত রেগে বলল,
‘আপনার সাথে কথা বলব না,আপনি একটা খুনি।আমার সব হাসপাখি খুন করেছেন এ্যা এ্যা এ্যা….’
অন্ত আবার কাঁদতে শুরু করল।সেই শপিং করে আসার পর থেকে কাঁদছে।নির্ভীক উঠে বসলো।অন্তর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ!কান্না থামাও।’
‘আমার হাস………’
এরপর কান্নার জন্য আর কিছু বুঝা যাচ্ছে না।নির্ভীক বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করলো।প্রসঙ্গ পাল্টাতে অন্তর পাশে এসে বলল,
‘দেখো বারোটা বেজে গিয়েছে,ইচ্ছেমতিকে বার্থডে উইস করবা না?’
অন্ত চোখ মুছে নাক টেনে টেবিলে রাখা ফোনের দিকে হাত বারাতেই নির্ভীক অন্তর হাত ধরে মুচকি হেসে বলল,
‘এভাবে নয়।’
অন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
‘তাহলে কিভাবে?’
নির্ভীক অন্তকে কোলে নিতে নিতে বলল,
‘চলো ব্যালকনিতে যাই।’
গিটারের সামনে এসে অন্তকে বলল,
‘ওটা তুলে নাউ।’
অন্ত একহাতে গিটার তুলে নিল।নির্ভীক ব্যালকনিতে এসে অন্তকে কোলে নিয়েই বেতের চেয়ারে বসলো।অন্তর কোলের উপর গিটার নিয়ে অন্তর ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হ্যাপি বার্থডে টিউন বাজানোর চেষ্টা করতে লাগলো।অন্ত কৌতূহলি হয়ে দেখছে।কিছুক্ষণ চেষ্টার পর নির্ভীক বার্থডে টিউন বাজাতে সক্ষম হল।
ইচ্ছেমতি বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল গিটারের আওয়াজ পেয়েই দৌঁড়ে ব্যালকনিতে আসলো।সামনের ব্যালকনিতে নির্ভীক আর অন্তকে দেখেই খুশিতে উপর দিকে লাফাতে শুরু করে দিল।নির্ভীক গিটার বাজাচ্ছিল আর চোখবন্ধ করে অন্তর চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিল তাও অন্ত বাম হাত নির্ভীকের চোখের উপর রেখে ইচ্ছেমতির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘নির্লজ্জ মেয়ে কি পরেছিস ওটা?দূর হ চোখের সামনে থেকে।’
ইচ্ছেমতি ডানাকাটা জামা পরে ছিল অন্তর কথা শুনেই ওড়না নিতে দৌঁড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।অন্ত নির্ভীকের চোখ থেকে হাত সরিয়ে রেগে বলল,
‘আপনি কিছু দেখেছেন?’
নির্ভীক ইনোসেন্ট মুখ করে মাথা নাড়ালো।অন্ত নির্ভীকের কোল থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘সত্যি তো?’
নির্ভীক গিটার নিয়ে ঘরে যেতে যেতে বলল,
‘ইয়াহ।’
অন্ত নিশ্চিন্ত হল।তাছাড়াও অন্ত দেখেছে নির্ভীক চোখবন্ধ করে ছিল।অন্ত মুচকি হেসে নির্ভীকের আগেই ঘরে ঢুৃকে নির্ভীকের সামনে দাঁড়ালো।মাথা নিচু করে বলল,
‘কাল আমাদের বাসায় যাব?’
নির্ভীক অন্তর গাল টেনে মুচকি হেসে বলল,
‘আমার উপর থেকে খুনের কেস উইথদ্রো করলে যেতে পারো নো প্রবলেম।’
অন্ত গাল থেকে নির্ভীকের হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘নেভার।’
নির্ভীক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গিটার রেখে লাইট অফ করে দিল।অন্তকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কাল সবার আগে তোমার হাতের সেলাই কাঁটা হবে তারপর ওই বাসায় গেলে যেতে পারো।’
অন্ত বিস্ফোরিত চোখে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীক অন্তর গালে গাল ঠেকিয়ে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ডোন্ট ওরি,একটুও ব্যথা লাগবেনা।ঘুমাও।’
অন্ত হাতের কাঁটা জায়গায় টিপ টাপ করে দেখছে ব্যথা ট্যথা আছে কিনা।হালকা ব্যথা অনুভূত হওয়ায় অন্ত বেশ ভয় পাচ্ছে।আবেগের বশে এমন একটা ভুল করে সবার সামনে নিজেকে কেমন ছোট লাগে তাছাড়া কাঁটা দাগ নিয়েও খুব চিন্তিত।চিন্তায় অন্তর ঘুম আসছেনা অথচ রাত জাগা তার জন্য একেবারে নিষিদ্ধ।
চলবে……………
(ব্যস্ত আছি খুব।দুদিন গল্প দিবনা।আজকের পার্ট খুবই বাজে হয়েছে জানি।ফ্রি হলে এই পার্ট নতুন করে লিখতে পারি।দেখা যাক।দুদিন গল্প দিবনা জন্য মন খারাপ করবেননা প্লিজ।আমি সিউর না,গল্প দিতেও পারি।)