কাজল নদীর জলে পর্ব-১২

0
1374

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১২.
রাত নয়টা। পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে গুনগুন করে গান গাইছে সুরলা। খানিক পর পর সামনে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে লাজুক হাসছে। স্ক্রিনে চয়নের একটা হাস্যজ্বল ছবি ভাসছে। সাবিনা রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়ের কার্যকালাপ দেখেন। তার জায়গা থেকে ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখা যায় না। মাইগ্রেনের কারণে সুরলার চোখে পরা চশমার গ্লাসে একটা ছেলের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পান। ভ্রু কুঁচকান। মেয়ে একটা ছেলের ছবি দেখে লাজুক হাসছে! কারণ কী!
গত কয়েকদিন মেয়ের পরিবর্তন তার চোখে লাগছে। গুনগুন করে গান গাইছে, কখনো আবার গান ছেড়ে নাচছে, কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে কথা বলছে, লাজুক হাসছে, খেতে বসে ভাবুক হয়ে যায়, আরো কত কী! সাবিনার কেন যেন মনে হয় মেয়ে প্রেমে পড়েছে। তার জানা মতে, এর আগে সুরলা জীবনে প্রেম ভালোবাসার মানুষ ছিল। যার অর্থ প্রথম প্রেমই এসেছে। তাই এই পরিবর্তন।

কৈশোরে প্রেম এসেছিল সাবিনার জীবনে। তাই লক্ষণ গুলো তিনি ধরতে পারেন। ‘প্রেম’ জিনিসটা মানুষের জীবনের অ-মূল পরিবর্তন করে দেয়। বিশেষ করে প্রথম প্রেমে। প্রথম প্রেম প্রথম অনুভূতি। মনে গহীনে ভালোবাসা নামক সিংহাসনে যখন কাউ নিজের জায়গা করে নেয়। তখন আসনে বসে মানুষটা নিজের অজান্তেই মন মনিবের মাঝে পরিবর্তন আনে। তার মাঝে বারোমাস বিরাজ করে বসন্ত ঋতু, হাওয়ায় দুলে সে। বিনা কারণে হাসে, আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে, সারা প্রহর কল্পনায় ভালোবাসার মানুষটিকে ঠায় দেয়, চোখের আড়াল হলে তার আকৃতি ধারণ করা ছবির দিকে তাকিয়ে কথা বলে, হাসে, কত গল্প করে।কিশোর বয়সের ছেলেমেয়ে যখন প্রেমে পড়ে তখন তারা দিন দুনিয়া ভুলে আবেগে ভাসে। প্রেম ভালোবাসা, এবং ভালোবাসার মানুষটাই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়। না বুঝে কত কী করে বসে তার ইয়াত্তা নেই! নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যায়। মন যা বলে তাই করে। সুরলা কৈশোর পার করে এলেও তার মাঝে এখনো কিশোরীর ভাব দেখা যায়। প্রেমে পড়ে সে যেন কৈশোরে চলে গেছে।

সাবিনা পা বাড়ান মেয়ের দিকে। উদ্দেশ্য, মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে জানার চেষ্টা করবেন ছেলেটার ব্যাপারে। কেমন না কেমন ছেলে! পরে না আবার মেয়ের সর্বনাশ করে বসে। আজকালকার সময় বেশিরভাগ প্রেম মানেই বিছানায় নেয়ার ফন্দি আর গর্ভবতী হওয়ার পর বাচ্চাকে অস্বীকার করে ব্রেকাপ টানা। অ্যাবরশন, স্বাস্থ্য অবনতি, প্রেশার, ডিপ্রেশন এসব যেন প্রায় সব মেয়েদের জীবনে ঘটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনা। প্রতি একশো জন মেয়ের ৫০-৭০জন মেয়ে এই ঘটনার ভুক্তভোগী। তার মেয়েটা বড্ড সহজ সরল। যে কারো ফাঁদে পা দিতে দু’বার ভাবে না। এখন ছেলেটার যদি খারাপ কোন উদ্দেশ্য থাকে, তবে সর্বনাশ ডেকে আনবে। তাই মা হিসেবে মেয়েকে সতর্ক করা তার কর্তব্য। সাবিনা মৃদু কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। সুরলা কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে সাথে সাথে ল্যাপটপ বন্ধ করে পেছু ফিরে। মাকে দেখে হেসে বলে,
“ওহ,মা তুমি! আসো। ”

সাবিনা বিছানায় বসেন। পুরো রুমটায় চোখ বুলান। দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংয়ে চোখ যায়। সুরলার জগিং সুট পরা একটা পেইন্টিং। সে দিকে ইশারা করে বলেন,
“সরু, এই পেইন্টিং কবে নিলি? এর আগে দেখেনি। এমন কি, আজ সকালেও যখন তোকে ঘুম থেকে ডাকতে এসেছি তখনও এটা ছিল না।”

সুরলা তাকায় দেয়ালে। বলে,
“বিকেলেই এনেছি।”
“কোথা থেকে নিলি?”
সুরলা আমতা আমতা করে। কী বলবে ভেবে পায় না। সাবিনার খটকা লাগে। তাড়া দেন। সুরলা বলে,
“রাশনা দিয়েছে।”

সুরলার বন্ধু বান্ধবদের বেশ ভালো করে জানেন সাবিনা। তার জানা মতে, রাশনা পেইন্টিং জানে না। তিনি ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“রাশনা পেইন্টিং জানে! কখনো বলিস নি তো?”

আবার ভটকায় সুরলা। বলে,
“রাশনা বোন আছে না? রাবশা? ও পেইন্টিং করে। রাশনা ওর বোনকে দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে এটা। ”

সাবিনা পেইন্টিংয়ের কাছে যান। ভালো করে পরখ করে দেখেন। পেইন্টিংয়ের এক কোণায় বাংলায় ‘জুবায়ের’ লেখা চোখ পড়ে। মেয়ের মিথ্যা বুঝতে পারেন। পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ছেলেটা কী করে?”

“কক্কোওন চ্ছেয়েলে?” তোতলায় সুরলা। এই রে ধরা পড়ে গেলাম! মা কীভাবে বুঝল? সে তো বলেই নি। সাবিনা পিছু ফিরে দেখেন মেয়ের ফ্যাকাসে মুখ। মৃদু হেসে বলেন,
” রাবশার নামে যাকে চালাচ্ছিস, সেই ছেলে। কবে থেকে চলছে এসব?”

সুরলা ঢোক গিলে। মা কী এবার তাকে বকবে? প্রেমে বাধা দিবে? নানান ভাবনা এসে ভীড় জমায় সুরলার মনে। সাবিনা মেয়ের কাছে গিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান। মেয়ের কাধে হাত দিয়ে বলেন,
“আমি আশি দশকের মনোভাবী কোন মা নয় যে মেয়ের প্রেমে শত্রু হবো। ছেলে ভালো হলে, সব ঠিকঠাক থাকলে চার হাত এক করার মতপক্ষী আমি। এবার বল, ছেলে কেমন? কী করে? বাসা কোথায়?”

সুরলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যা তার প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। তবুও মায়ের কাছে প্রেমিকের ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা করতে দ্বিধা হয় সুরলা। লাজুক হেসে বলে,
“সব ঠিকঠাক হলে একদিন পরিচয় করিয়ে দিব, তখন দেখে নিও। এখন এত কিছু বলতে পারব না। ”

“ছেলের ব্যাপারে জানিস ভালো করে? খোঁজখবর নিয়েছিস?দেখিস আবার না মন্দ লোকের ফাঁদে পড়িস!” সর্তক করেন সাবিলা। সুরলা মুখ ফসকে বলে,
“পরিচিত মানুষ, খোঁজ নেয়ার কী আছে?” সাবিনা চমকান। জেরা করতে চান। সুরলা সুযোগ দেয় না। ল্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ডিনার টাইম হয়ে যাওয়ায় সাবিনাও কথা বাড়ান না। ডাইনিং রুমে চলে যান খাবার সাজাতে। রাতের খাবারটা একটু তাড়াতাড়িই খান তারা।

সাবিনা চলে গেলে সুরলা রুমে আসে। দরজা বন্ধ করে হাফ ছাড়ে। বিরক্তি ভঙ্গিতে বলে,
“দুনিয়ার মানুষ বছরের পর বছর প্রেম করে যায়, কাক পক্ষীও টের পায় না। অথচ আমি প্রেমে পড়লাম, প্রেম হলো ও না। তার আগেই আশেপাশের সবাই জেনে গেল। না জানি কোন দিন আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ফোন দিয়ে বলে, ‘ সুরলা তুমি নাকি আজকাল প্রেম করছো?’ আমার জীবনটাই ঢাকঢোল পেটানো কথাবার্তায় পরিপূর্ণ। কোথায় ভেবেছি, চুপিচুপি প্রেম করব দুই এক বছর তারপর বাসায় জানিয়ে বিয়ে করব এখন হলো কী! প্রেম হওয়ার আগেই বাসায় জেনে গেল। ধ্যাৎ ভালো লাগে না!” অভিযোগে মনটা ত্যক্ত হয় বিরশ মনে বিছানায় বসে। ম্যাসেজ টোন বেজে উঠে। ফোন পড়ে আছে টেবিলের উপর। সুরলা হেলেদুলে টেবিলের উপর থেকে ফোন আনে। স্ক্রিন অন করতেই চেহারায় থাকা বিরক্তির দলেরা উধাও হয়। তার পরিবর্তে খেলে যায় ঠোঁটের কোণে হাসি। চয়নের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। সন্ধ্যার দিকে সুরলা নক দিয়েছিল নাম্বারে। এখন রিপ্লাই এসেছে। এই মুহুর্তে সুরলার টাইপ করতে মন চাচ্ছে না। চয়নের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করতে, চয়নের গলা শুনতে ইচ্ছে করতে। সুরলা কল দিয়ে বসে। ফোন হাতে থাকায় প্রথম বারেই রিসিভ করে চয়ন। সুরলা চাঞ্চল্যমনে বলে,
“হ্যালো, কেমন আছেন?”
“ভালো, তুমি?”
“একটু আগে খারাপ ছিলাম, এখন ভালো হয়ে গেছি।”
“কিট্টিদের ও মন খারাপ হয় নাকি!” রগড় করে চয়ন। সুরলা ও রগড় করে,
“কিট্টিরা তো আর আপনার মত অনুভূতিহীন রোবট নয় যে তাদের অনুভূতি হবে না।”
চয়ন হাসে। বলে,
” অনুভূতিহীন রোবট! ভালো বলেছো। কাজের প্রেশারে আজকাল রোবটই হয়ে যাচ্ছি। ”
“ঢাকা কবে আসবেন?”
“মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তো গেলাম। এখন আর আসবো না।”
“ওহ আচ্ছা।” মলিন করে বলে সুরলা। থেমে বলে,
“চিবার জন্মদিনে ও আসবেন না?” সন্ধ্যার দিকে মিতু ফোন দিয়েছে। কথায় কথায় বলেছে, চিবার জন্মদিন মাসখানেক পর। চিবার জন্মদিনে নিতু চিবাকে কী দিবে সেটাই জিজ্ঞেস করে। সুরলাও অনেক কিছু সাজেস্ট করে। নিতুর সবকিছুই অগ্রীম ভাবতে পছন্দ করে। আগে থেকে ভেবে রাখলে নাকি পরে হিমসিম খেতে হয় না। এমন ভাবনাই তার। চয়ন খানিক ভাবে। কপাল চাপড়ে বলে,
” খুকির জন্মদিনের কথা আমার মাথা থেকেই সরে গিয়েছে। তুমি জানো কিভাবে?”
“নিতু বলেছে। ও তো চিবার জন্মদিন নিয়ে কত কী প্ল্যানিং করে ফেলেছে! আপনার কোন প্ল্যান নেই?”
“আছে, ঢাকায় গিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয় বলো তো?”
“চমৎকার হবে। সারপ্রাইজ ভালো লাগে আমার।”
“তুমি আবার বলো না কাউকে। এটা সিক্রেট থাক।”
“ঠিক আছে, তা কবে আসবেন?”
“ওর জন্মদিনেই আসব। ”

আরো টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দেয়। সুরলা খুশিতে লাফিয়ে উঠে। চয়ন আসছে, দেখা হবে আবার। মনে মনে ভেবে নেয় এবার দেখা হলে মনের কথা বলেই দিবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here