কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা
২৫.
” কত বেলা বেলা হয়েছে, এখনো ঘুমাচ্ছো?এই মেয়ে ওঠো, এই মেয়ে?” সোফার কাছে এসে অনবরত ডাকতে থাকে চয়ন। সুরলা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চারদিকের খবর নেই তার কাছে। চয়ন খানিক ঝুকে কাধ সুরলার ঝাকায় এবার।
“এই ওঠো? এই? ” কয়েকবার ডাকার পর সুরলা নড়ে ওঠে। নিজের কাধে রাখা চয়নের হাত ধরে মাথায় রাখে। ঘুমজড়ানো গলায় বলে,
“আরও ঘুমাব মা, মাথায় বিলি কেটে দাও।”
বাসায় থাকাকালীন সময়ে সকালে সুরলাকে ওঠাতে গেলে সুরলা সাবিনার হাত মাথায় নিয়ে বিলি কেটে দিতে বলতো। সাবিনা বিলি কাটতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ত সুরলা। শেষে আলতো করে ডেকে ওঠাতেন মেয়েকে। মেয়ের আহ্লাদীপনা ভালো লাগে সাবিনার তাই বকেন না। সুরলা ঘুমের ঘোরে নিত্যকার নিয়মে আজো আহ্লাদ করছে।
তার আহ্লাদে হাসি কান্নার গোলকধাঁধায় পড়ে যায় চয়ন। ভ্রু কুঁচকে হাত নাড়ায় সুরলার মাথায়। এতক্ষণ অন্যদিকে ফিরে ঘুমাচ্ছিল, যেই না চয়ন চুলে হাত রেখেছে অমনি নড়ে ওঠে চয়নের দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘড়িতে সময় দেখে চয়ন। অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। সুরলাকে এখুনি জাগাতে হবে। এই তাড়ানায় সুরলার দিকে আরো খানিক ঝুকে। বিরক্তিতে তার চেহারা আকার পরিবর্তন হয়েছে যেন, সদ্য গোসল করে আসা ভেজা মাথার চুলগুলো ঝাকায় সুরলার মুখের উপর।
শাওয়ার নিয়ে এসে মাথা মুছেনি চয়ন। মাথাভর্তি ঘন কালো চুলে পানির সমাহার। সব গিয়ে পড়ে সুরলার চোখে মুখে। ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকায় সুরলার। চয়ন বলে,
“সেই কখন থেকে ডাকছি, কথা কানে যাচ্ছে না? ওঠতে বলছি তোমাকে। ওঠো? ” মুখভর্তি পানি নিয়ে হু হা করতে করতে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে সুরলা। বিরক্তি আর রাগ যেন ঘিরে ধরে চয়নকে। একটা মানুষ এতটা কুম্ভকর্ণ-এর মত কিভাবে ঘুমাতে পারে! একে বাসায় কিভাবে জাগায় কে জানে! মুখে পানি দিলেও ওঠে না।
খানিক ভেবে চয়ন রুমে যায়, এবং ফিরে আসে মিনিট খানেটের মাঝে। সুরলার মাথার পাশে থাকা সিঙ্গেল সোফায় বসে। হাতে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। এক টান মেরে ধোঁয়া ছাড়ে সুরলার মুখের উপর। এই কাজটা পরপর কয়েকবার করে। নাকে নিকোটিনের ধোঁয়া যেতেই সুরলার চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায় । কাশতে শুরু করে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। কাশতে কাশতে এক হাত মুখে চেপে অন্য হাত সামনের দিকে ধোঁয়া তাড়ানোর জন্য নাড়ায়। খানিক ধোঁয়া বিলীন হতেই নতুন ধোঁয়ার আগমন ঘটে। সুরলা ধোঁয়ার উৎস খুঁজতে চারপাশে চোখ বুলায়। তার মাথার কাছে বসে মনের সুখে সিগারেট ফুকতে দেখে চয়নকে। চয়নকে দেখে চমকায় সে, গতরাতের কথা মনে পড়ে। বিরক্তিচোখে বলে,
“সকাল সকাল এসব কী শুরু করেছেন?”
জবাবে চয়ন গম্ভীরমুখে বলে,
“আমার অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাও নাস্তা বানাও।”
“এর জন্য ঘুম থেকে তুলেছেন?” ক্ষিপ্ত গলায় সুরলার। যেন চয়ন তাকে ডেকে ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে। চয়ন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“হ্যাঁ, নয়তো কী তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্য ডেকেছি?”
“পারব না আমি।”
কড়া উত্তর সুরলার। চয়নের গম্ভীরতা রাগে পরিণত হয়। ওঠে সুরলার দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বলে,
“এমনিতেই সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করেছো। জলহস্তির মতো ঘুম তোমার। তোমাকে জাগাতে গিয়ে আমার অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। আর কোন সময় নষ্ট যেন না হয়। যাও আমার জন্য নাস্তা বানাও। ”
“আমি আপনার নাস্তা বানাব কেন? আমাকে কী হোম মেইড পেয়েছেন? নিজের নাস্তা নিজে বানিয়ে খান নয়তো না খেয়ে অফিস চলে যান।”
” ভালোয় ভালোয় আমার কথা শোনো নয় পরে পস্তাবে বলে দিচ্ছি। খারাপ মানুষদের বিশ্বাস নেই।”
বলে বাঁকা হাসে চয়ন। সুরলা ভ্রু কুঁচকে বলে,
” পাস্তাব কেন? আপনি কী করবেন?”
“এই ধরো, তুমি আমার কথা শুনলে না। তাতে আমাকে না খেয়ে অফিস যেতে হলো। আমার রাগের মাত্রা বাড়ল, অফিস যাবার আগে বাসার বিদ্যুৎ, ওয়াই-ফাই, গ্যাস সব বিচ্ছিন্ন করে গেলাম, তোমার ফোন ও নিয়ে নিলাম। দরজা জানালা ও এমন ভাবে মেরে গেলাম যাতে তুমি খুলতে না পারো। বেরিয়ে হয়তোবা তেলাপোকা ও কয়েকটা ছেড়ে দিতে পারি ফ্ল্যাটে। আমার এক বন্ধুর এনিমেল হাউজ আছে, সেখান থাকে একটা কুকুর ও এনে দিতে পারি। তখন কুকুর আর তেলাপোকার সাথে অন্ধকার ঘরে থাকতে হবে তোমাকে। কুকুর আঁচড় দিলেও বাঁচার জন্য কারো কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারবে না। আমি ফিরব সন্ধ্যা কিংবা রাতে। এই সময়টার মাঝে তুমি পস্তাবে না?”
সুরলা চোখ বড় বড় করে তাকায় চয়নের দিকে। ঢোক গিলে। কুকুর আর তেলাপোকাকে ভীষণ ভয় পায় সে, দূর থেকে ও এদের দেখলে ভয়ে মরে। সেখানে একসাথে থাকার কথা ভাবতেই কলিজা কেঁপে ওঠে তার। চয়নের বিশ্বাস নেই, সে যা বলেছে তা করতে পারে। এর চেয়ে ভালো হবে চয়নের কথা শোনা। কুকুর আর তেলাপোকা থেকে বাঁচতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কী নাস্তা বানাতে হবে?”
চয়ন শব্দযোগ হেসে বলে,
“মিসেস এবার লাইনে এসেছে । তোমাকে টাইট করার পথ পেয়ে গেছি। শুনো, বেশি কিছু না, শুধু এক মগ কফি আর দুটো টোস্ট বানাবে। ”
চয়নের রগড়ে গা লাগায় না সুরলা। ওঠে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
“কিচেন কোনদিকে?”
ডান দিকে ইশারা করে চয়ন। সুরলা সেদিকে পা বাড়ায়। চয়ন পেছন থেকে হেসে বলে,
“কিচেনে যাবার আগে দেখে নিও, আবার না ওটা ওয়াশরুম বের হয়!” কাল রাতের কথা নিয়ে মজা করছে চয়ন। সুরলার বিরক্তি লাগে। সে রেগে তাকায়। চয়ন হাসে জবাবে। সুরলা বলে,
“আমি কিন্তু রান্নার ‘র’ পারি না। আগেই বলে দিচ্ছি, পরে আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।”
চয়ন বেডরুমের দিকে যায়। যেতে যেতে বলে,
” একটু কমনসেন্স খাটিয়ে বানাও। আমি না খেতে পারলে তুমি খাবে। ব্যাপার না।”
সুরলা বন্ধ দরজা খুলে কিচেনে প্রবেশ করে। ছোট খাটো একটা কিচেন, এতে রান্নার সমগ্রীতে ঠাসা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে বৈয়াম আর পাতিল চোখে পড়ে। সবটা সুন্দরভাবে গুছানো। নিজের রান্না নিজে করে সম্ভবত, নাহয় অন্য কেউ এতসুন্দর করে গুছিয়ে দেয়ার কথা না। তাছাড়া চয়ন তো একাই থাকে ফ্ল্যাটে। ব্যাপারটা অবাক করে সুরলাকে। সে বিড়বিড় করে বলে,
” এত দিন নিজে রান্না করে খেয়েছে, আমি আসতেই আমাকে দিয়ে খাটাচ্ছে। আমার তো মনে হয় আমাকে খাটানোর জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে। বদলোক একটা। সকাল সকাল আরামের ঘুম রেখে এখন আমাকে রান্না করতে হচ্ছে ওই বদলোকের জন্য। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, ব্যাটা তুই বউ পাবি না। ”
সুরলা এক মনে চয়নকে মন্দ বলে যাচ্ছে। এদিকে চয়ন যে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে সব শুনছে তা খেয়াল নেই তার। চয়ন সুরলার কানের কাছে গিয়ে বলে, “ব্যাটার বউ পাওয়ার প্রয়োজন নেই, ব্যাটা অলরেডি বউ পেয়ে গেছে। ”
আচমকা চয়নের কথায় ভয় পায় সুরলা। দূরে সরে গিয়ে বুকে ফু দেয়। সব শুনে গিয়েছে, এবার নিশ্চয়ই রাগ দেখাবে। সেই সুযোগ দিবে না সুরলা। তাই সে কথা এড়িয়ে বলে,
” কফি পাউডার, মগ, পাতিল, টোস্টার কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছেন?’
” ভালো করে খুঁজো পেয়ে যাবে।” দায়সারা জবাব দেয় চয়ন। সুরলা ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“আমি এসব কিছুই চিনি না। আপনি খুঁজে দিন। না হয় আমি চললাম ঘুমোতে। আপনার খান বা না খান সেদিকে তাকিয়ে থাকার জন্য বসে নেই আমি।”
“দশ মিনিট পর আমি অফিসের জন্য তৈরি হয়ে টেবিলে আসব। আমি এসে যেন টোস্ট আর কফি রেড়ি দেখি। কিভাবে বানাবে সেটা তোমার ব্যাপার। নাস্তা তৈরি না হলে কী হবে তা আগেই বলে দিয়েছি, আশা করি আর বলা লাগবে না।” গম্ভীর কন্ঠে কথা গুলো বলে চলে যায় চয়ন। সুরলা কিছু বলার সুযোগ পায় না। চয়নকে বকতে বকতে পুরো কিচেন তন্ন তন্ন করে খুঁজে সব উপকরণ পায়। ইতিপূর্বে সে কখনো পানিও সিদ্ধ করেনি। তাই রান্নার হাত একবারেই কাচা। কফি কিভাবে বানায় সেটা জানে দে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ইউটিউব দেখে দেখে টোস্টারে টোস্ট করে নেয়। যা পুড়ে ছাই হতে হতে বেঁচেছে। এবার কফি বানানোর পালা। ইউটিউব দেখে কফি বানিয়ে নিল। তবে কফির রঙ দেখে তার নিজেরই হাসি পাচ্ছে। বিকট এক রঙ হয়েছে। তার হাতে বানানো কফি মুখে দিতেই খুক করে কেশে ওঠে চয়ন। চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় সুরলার দিকে। বলে,
“এটা কী বানিয়েছো?”
সুরলার তড়িৎ উত্তর,
“আমি আগেই বলেছি, খারাপ হবে। এর আগে আমি কখনো রান্না করিনি। আমার সতর্ক করার পর ও ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে কফি বানিয়েছেন। এখন খান।”
টোস্ট আর কুকিজ টেবিলে রেখে সোফার দিকে পা বাড়ায় সুরলা। চয়নের জন্য তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে। সেই ঘুম এখন কাভার করবে। আকস্মিক চয়ন তার সামনে পথ আটকে দাঁড়ায়। সুরলা ভ্রু কুঁচকায়। চয়ন কফি মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি এতটাও নিষ্ঠুর নই যে, বউকে রেখে একাই খাব। স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। সুখ দুখ একে অপরের সাথে ভাগ করে। এই কথাগুলো মাথায় রেখে আমি আমার দুখ অর্থ্যাৎ এই কফি তোমার সাথে ভাগ করব। আমি আমার ভাগ খেয়েছি। এবার তোমার পালা, এক টানে খেয়ে শেষ করো। ”
সুরলার ঘোর আপত্তি। কফি দেখেই যে বুঝে গেছে অতি জঘন্য হবে তাই টেস্ট করেনি। এই জঘন্য কফি সে কিভাবে খাবে। সে খাবে না বলে জানায়। চয়ন এক প্রকার জোর করেই খাইয়ে দেয়। মুখে নিয়ে গিলতে পারে না। গাল ঝলসে যাবার উপক্রম। চিনির পরিবর্তন লবন দিয়েছে, দুধের গুড়োর পরিবর্তে আটা ময়দা জাতীয় কিছু একটা দিয়েছে। সব মিলিয়ে স্বাদটা জঘন্য। সুরলা মুখ চেপে বেসিনে চলে যায়। বমিই করে দিয়েছে। চয়ন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়। যাবার আগে সুরলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” আমি ডিনার বাসায় করি। আমি আসার আগে যেন খাবার রেড়ি থাকে। আর হ্যাঁ, খাবার বিস্বাদ হলে তোমাকে খাওয়াব পুরোটা। ”
বাইরে দিয়ে দরজা লক করে চয়ন অফিসে চলে যায়। সুরলা সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। জোহরের আযান শুনে ঘুম ভাঙে তার। ওঠে পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখে। তিনটি বেড, ড্রয়িং ডাউনিং এক স্পেচ, কিচেন আর দুটো ওয়াশরুমের সমন্বয়ে এই ফ্ল্যাট। তিন বেডের একটা মাস্টার বেড আর একটা গেস্ট রুম আর একটা এক্সট্রা বেড রুম। মাস্টার বেডরুমটায় চয়ন থাকে। সেই রুমের চয়নের স্মৃতির সমাহার, ড্রেসিংটেবিল, খাট, কাভার্ড, আর একটা বুকসেল্ফ। সাথে খোলা মেলা বারান্দা। বারান্দায় বসার জন্য একটা বিন ব্যাগ আর ল্যাপটপ রাখার মিনি টেবিল। সব কিছুই বেশ পরিপাটি। বাদ বাকি সব রুম ও বেশ গুছানো। চয়নের এই গোছানো স্বভাব অবাক করে সুরলাকে। অফিস, ব্যাচলর সংসার ভালোই সামলায় তবে! ফ্ল্যাটের ডান পাশের প্রথম রুমটা চয়নের। তারপর কিচেন, তারপাশে অন্য এক্সট্রা বেডরুম, মাঝে ওয়াশরুম যেটায় কাল রাতে ভুলে চলে গিয়েছে সে। একবারে বাম পাশে গেস্ট রুম। রুমগুলোর সামনে ড্রয়িং ডাইনিং স্পেচ একসাথে। এর পরেই সদর দরজা পড়ে। এক্সট্রা বেডরুমটায় ব্যাগপত্র নিয়ে যায় সুরলা। এই রুমে থাকবে সে। এই রুমটা একবারেই সিম্পল। উইন্ডো সাইডে খাট, একটা ওয়াল ওয়ারড্রব, একটা সিঙ্গেল বুকসেল্ফ আর বসার জন্য একটা লেদার ডিভান। দেয়ালের এক পাশে টাঙানো একটা হ্যাঙিং মিরর। আর অন্য পাশে কয়েকটা ফটোফ্রেম। সব মিলিয়ে ভালোই লেগেছে রুমটা। লাগেজ খুলে বাথরোব নিয়ে শাওয়ারে যায়। এত লম্বা সময় শাওয়া না নেয়ায় শরীর ম্যাজম্যাজ করছে যেন। শাওয়ার নিয়ে এসে বাথরোব ছেড়ে হলুদ টি-শার্ট আর সাদা প্লাজো গায়ে জড়ায় । বেশ পুরপুরে লাগছে তার। হঠাৎ ফোন বাজার শব্দ কানে আসে। ফোনটা কিচেনে ফেলে এসেছে। ফোনের উদ্দেশ্যে কিচেনের দিকে এগোয়। কিচেনে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে মায়ের নাম্বার থেকে কল। মনটা ভারী হয়ে আসে সুরলার। তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়াতে মা খালাদের প্রতি প্রচুর রাগ জমে আছে। কারো সাথে কথা বলবে না সে। দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে, দূরেই থাকবে। কোন যোগাযোগ করবেনা। কপট রাগ নিয়ে ফোন বন্ধ করে রেখে দেয়।
কিচেন থেকে বেরুতে গিয়ে অনুভব করে ক্ষুধার্ত ভাবটা। ক্ষুধায় পেটে টান পড়েছে যেন। কিচেনে ফিরে আসে ক্ষুধার তাড়নায়। ফ্রিজ আর কিচেন কেবিনেট খুঁজে ফলমূল, কুকিজ আর ড্রাইফুট ছাড়া কিছুই পায় না খাওয়ার মতো। ক্ষুধার মাত্রা ভীষণ, সেই জন্য এইসব হালকা খাবার খাওয়া যাবে না। ভারী খাবার খেতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে সুরলা সিদ্ধান্ত নেয় নুডলস রান্না করে খাবে। কেবিনেটে মি.নুডলস দেখেছে সে। নিতুর নিয়মে বানাবে নুডলস। ভাবনা মত একটা পাতিলে পানি দেয় এক গ্লাস। তারপর একটা মিনি প্যাকেট নুডলস এবং নুডলসের সাথে থাকা মসলার দিয়ে দেয়। চুলোর আঁচ কমিয়ে দেয়। মসলাময় পানিতে নুডলস সিদ্ধ হয়ে রান্না হয়ে যাবে। পানি একবার কমে এলে নামিয়ে নেয়। ব্যস হয়ে গেছে নুডলস রান্না। নিতুকে দেখেছে অনেকবার এভাবে নুডলস রান্না করতে তাই আজ সেভাবেই রান্না করল।
নুডলস রান্না পর্যন্ত ঠিক ছিল, তারপর গরম নুডলস পাতিল থেকে বাটিতে ওঠাতে গিয়ে অসাবধানতা বশত পাতিল লেগে যায় ডান হাতের কব্জিতে। সাথে সাথে ফোস্কা পড়ে যায়। জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে রীতিমতো। সুরলা পাতিল রেখে হাত চেপে বসে পড়ে। যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল তিনটা। নিজের বাসায় হলে এতক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা ওঠিয়ে ফেলতো। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ত। এখানে সে একা। ব্যস্ত হওয়া তো দূর তাকে এক পলক দেখার ও কেউ নেই। ফ্রিজে বরফ ট্রে নেই, অয়েন্টমেন্ট কোথায় সেটাএ জানে না।ব্যাথা নিরাশনের কোন পদ্ধতি মাথায় আসে না। অগত্যা রুমে ফিরে হাত চেপে কাঁদতে থাকে।
★
চয়ন ফেরে সন্ধ্যায়। চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটে ডুকে দেখে পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার। সুরলার কোন সাড়াশব্দ নেয়। আবার পালিয়ে গেল না তো! কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে ড্রয়িংরুমের বাতি জ্বালায়। সব রুম দেখে সুরলাকে পায় গেস্ট রুমে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। চয়ন কিছু বলতে গিয়েও বলে না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। চয়ন নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ড্রয়িংরুমে এসে টিভির ছেড়ে সোফায় বসে। বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলছে। চয়ন সম্পূর্ণ মনোযোগ সেখানে। ধ্যান জ্ঞান মেলে একমনে টিভি দেখছে। ম্যাচ শেষ হয় রাত ন’টায়। বাংলাদেশ জয় দেখে ফুরফুরে মনে টিভি বন্ধ করে ওঠে দাঁড়ায়। গেস্ট রুমে গিয়ে সুরলাকে জাগায় ডিনার রেড়ি করার জন্য। হাত চেপে ওঠে বসে সুরলা। চয়নের চোখ যায় না সেদিকে। সে সুরলাকে ডিনার তৈরি তাগাদা দেয়। মনে করিয়ে দেয়, তার শাস্তির কথা। এবারো সুরলা কিছু বলার সুযোগ পায় না। হাত চেপে ধরে কিচেনে যায়। নিজের জন্য রান্না করা নুডলস গরম করে। ডান হাত পেছনে নিয়ে বাঁতে সার্ভ করে। ডিনারে নুডলস দেখে চয়ন কথা শোনায় সুরলাকে। মনের বিষন্নতা আর শারীরিক অসুস্থতা তাকে প্রতিবাদ করতে দেয় না। না খেয়ে আবারও শুয়ে পড়ে। শোয়ার ঘন্টা খানেক পর চয়ন আসে রুমে।
চলবে…