কাজল নদীর জলে পর্ব-২৬

0
915

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

২৬.
সময়ের সাথে সাথে হাতের জ্বালাটা যেন বাড়ছে। সুরলা নিজের দুঃখের কথা পরিবারকে বলতে পারে না। রাশনাকে কল দিয়ে একে একে সব কথা বলে। গত কয়েকদিন রাশনা এক কাজিনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিধায় যোগাযোগ হয় নি, সুরলার সাথে ঘটা ঘটনা ও তার জানা হয় নি। আজ সব জানার পর রাগে ফেটে পড়ছে, সুরলাকে বলছে তার পরিবারকে জানিয়ে ঢাকা চলে আসতে। সুরলা না পারলে সে নিজে জানাবে তাও সুরলাকে কষ্ট পেতে দিবে না। মনের ব্যাথা আর হাতের ব্যাথা এক হয়ে সুরলার কান্নার মাত্রা বাড়ছে। রাশনা একাধারে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে, হাতে এটা ওটা লাগাতে বলছে। সে সব কথা কানে যায় না সুরলার। ফোন রেখে দেয় সে। দুঃখে ভাসছে সুরলা, নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় তার। মনে হয় এই জগতে তার কেউ নেই যে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।

বালিশে মুখ গুজে বেশ শব্দ করে কাঁদতে থাকে, হাতের জ্বালাটা অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। সুরলার কান্নার মাঝে চয়ন সুরলার রুমে প্রবেশ করে। সুরলার কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকায়। কান্নার কারণ খুঁজে, পায় না। এই মেয়েটা কাঁদছে কেন? কী হয়েছে তার? কারণ জানতে সামনে আগায় চয়ন। গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়,
“মিসেস জুবায়ের?”

চয়নের কন্ঠ শুনে কান্না থামায় সুরলা। চোখ মুখ মুছে উঠে বসে। থমথমে গলায় বলে,
“আপনার কিছু লাগবে? কী করতে হবে আমাকে?”

সুরলার আচরণ চয়নের কাছে ভালো ঠেকেনা। একটু আগে কাঁদছিল, সে আসায় আবার স্বাভাবিক থাকার ভান করছে! চয়নের ইচ্ছে করে সুরলার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে কিন্তু ইগোর কারণে জিজ্ঞেস করতে পারে না। সুরলা না আবার ভেবে বসে, তার প্রতি চয়নের অনুভূতি জেগে ওঠছে। চয়ন সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করে না। সেটা পরে জেনে নিবে। এখন যেই উদ্দেশ্যে এসেছে সেটা জেনে নিক। গমগমে গলায় চয়ন বলে,
“কিছু লাগবে না আমার। তোমার ফোন অফ কেন? তোমার পুরো খানদান আমাকে কল দিয়ে পাগল বানাচ্ছে, তুমি নাকি তাদের ফোন ওঠাচ্ছো না। কারণটা কী? আমি তাদের কী জবাব দেব?”

“আপনি বলে দিন, আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না।” ভেজা গলায় বলে সুরলা। কান্না গুলোকে দমিয়ে রাখছে কোনভাবে। চয়ন বিরক্তিময় চাহনি দিয়ে বলে,
“আমি এটা বলি, তারপর তোমার খানদান আমাকে চেপে ধরুক এই ভেবে যে আমি তোমাকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে বাধ্য করছি, এটাই চাচ্ছো তুমি?”

সুরলা এক পলক তাকায় চয়নের দিকে তারপর উত্তর না দিয়ে খাট থেকে নেমে যায়। হাতের জ্বালা আর সহ্য করা যাচ্ছে না, এবার কিছু একটা দিতেই হবে। তাই কিচেনে যাচ্ছে, ফ্রিজ থেকে বরফ তুলে লাগাতে। চয়ন ভাবে সুরলা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে তাই সে সুরলার ডান হাত চেপে ধরে আটকায়। বলে,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দাও।”

চয়ন সুরলার হাতের কব্জির দিকটাতে ধরায় ফোস্কা গুলো চাপ লেগে গলে যায়। সুরলা হাতের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। সুরলার কান্না দেখে চয়ন ভটকে যায়। হাত ছেড়ে দেয়। সুরলা হাতে ফু দিচ্ছে, যাতে একটু জ্বালা কমে।

চয়নের চোখ যায় সুরলার হাতে। ক্ষতস্থান দেখে আঁতকে ওঠে। এতটুকু পুড়ে গেল কিভাবে! ফোস্কা গলে দুরবস্থা হয়েছে। মানুষ হিসেবে খারাপ নয় চয়ন। মানব দরদী বলা যায়। শুধু মাত্র জেদ আর অতীতের কালো অধ্যায়ের প্রভাবে সুরলার সাথে খারাপ বিহেভ করে সে। সুরলার আর্তনাদ দেখে নিজের জেদ ভুলে যায়। সুরলাকে ধরে বেসিনে নিয়ে যায়। ট্যাফ ছেড়ে সুরলার ডান হাত রাখে। ক্ষতস্থানে পানি লাগায় জ্বলে ওঠে। মুখ কুঁকড়ে অন্যদিকে ফিরে যায়। চয়ন প্রশ্ন করে,
“হাতে কিছু লাগাও নি?”

সুরলা মাথা নাড়ে। চয়ন ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমে যায়। ফাস্টএইড বক্স আর টাওয়াল হাতে ফিরে আসে। সুরলাকে সোফায় বসিয়ে নিজে মেঝেতে বসে তারপর সুরলার হাত মুছে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করে। সুরলা বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকে চয়নের দিকে। তার বিশ্বাস হয় না, চয়ন তার কেয়ার করছে। চয়নের অস্থিরতা তার চোখে বাড়ি খাচ্ছে যেন। এই ছেলেটা না তাকে ঘৃণা করে? তবে এখন তার কথা ভাবছে কেন। যে ব্যাথা পেলে ওর কী? না তাকিয়ে ও সুরলার তাকানোর আন্দাজ করে চয়ন। তার অস্বস্তি হচ্ছে। ব্যান্ডেজ করতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সুরলার ভাবনাও আন্দাজ করে, সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করতে সুরলার হাতে ব্যান্ডেজ রোল ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“রাস্তায় কোন বিড়াল কুকুরকে পড়ে থাকতে দেখলে আমার খারাপ লাগে। মানবতাবোধ থেকে অস্থিরতা আসে। কেউ এই অস্থিরতাকে অন্য নাম দিলে, তা বেমানান লাগবে।”

সুরলার বুঝতে বাকি নেই চয়ন কথাটা তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করতেই বলেছে। সে চয়নের উপর থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। চয়ন চোখ তুলে তাকায় সুরলার দিকে। নিজের ফর্মে ফিরে আসে। বাঁকা হেসে বলে,
“তা গরিলা বেগম, এত বেখেয়ালি হয়ে কী এমন করছিলে যে হাত পুড়ে গেল?”

নামের ব্যাঙ্গ করায় সুরলা তেতে ওঠে বলে,
“সুরলা আমার নাম, সু র লা। এইসব অদ্ভুত নামে ডাকবেন না। আর হাত পুড়েছে আপনার জন্য।”

ব্যান্ডেজ করার শেষ। ফ্লোর থেকে ওঠে পকেটে হাত গুজে আয়েশ করে দাঁড়ায় চয়ন। দুষ্ট হেসে বলে,
“আজকাল তোমার ভাবনায় আমার বিচরণ ও হয় তবে! ভাবতেই অবাক লাগছে। তোমার মতো ভালো মানুষের ভাবনায় আমার মতো জঘন্য মানুষের ঠায় পাওয়ার সাইন্সটা ঠিক বুঝে ওঠতে পারছিনা। ভাবনার গভীরতাটার মাত্রা এত বেশি যে দিন দুনিয়া ভুলে হাত পুড়ে বসে আছো অথচ টের অবধি পাওনি! স্ট্রেইঞ্জ!”

সুরলা প্রতিবাদী সুরে বলে,
“আপনার কথা ভাবার সময় নেই আমার।”
“তাহলে হাত পুড়ল কিভাবে?”
” নুডলস রান্না করতে গিয়ে।”

এবার এক রাশ অপরাধ এসে ঘিরে ধরে চয়নকে। তার জন্য নুডলস বানাতে গিয়ে মেয়েটা হাত পুড়েছে। অথচ সেই নুডলস খেতে গিয়েও চয়ন মেয়েটাকে কথা শুনিয়েছে। মেয়েটা আগেই বলেছে রান্না পারে না। তাও সে ভয় দেখিয়ে করিয়েছে, যার ফলাফল এই অগ্নিদহন। বিয়ে থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম আনা অবধি চয়নের ইন্টেনশন ছিল সুরলাকে মানষিক কষ্ট দেয়া, শারীরিক কষ্ট দেয়ার মনোবাসনা ছিল না তার। তাই অপরাধবোধের মাত্রাটা বাড়ছে। চয়ন আর কোন কথা না বলে রুমে চলে যায়। সুরলা চয়নের চলে যাওয়া বুঝতে পারে না। হতভম্ব হয়ে সোফায় বসে থাকে। এখন আর ঘুম আসবে না। আজ সারাদিন ঘুমের মাঝেই গেছে। ধ্যান অন্যদিকে নিলে ব্যাথাও কম লাগবে, এই ভেবে টিভি ছাড়ে। ওয়াই-ফাই কানেক্ট আছে টিভিতে। সুরলা সার্চ দিয়ে টি-সিরিজ চ্যানেল দেয়। একের পর এক গান বাজছে। সুরলা তাকিয়ে আছে সেদিকে।

চয়ন রুম থেকে বের হয়। সুরলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ফ্রিজে ফ্রুটস রাখা আছে, ঘুমানোর আগে খেয়ে নিবে। হাত থেকে ব্যান্ডেজ খুলবে না আজ। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো, ব্যাথা টের পাবে না।”

চয়ন থামে। টিভি থেকে চোখ সরিয়ে সুরলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে চয়নের দিকে। চয়ন আবার বলা শুরু করে,
” কাল সকালে মা বাবা ভিডিও কল দিবে, তোমার চেহারা দেখে আমাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। আমি তা চাচ্ছিনা। এর আগে তোমার চেহারা ঠিক করো। ”
এতক্ষণে চয়নের বাড়তি কেয়ারের কারণ বুঝে সুরলা। ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।


প্রচন্ড শব্দে লাগাতার কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে সুরলার। চারদিক চোখ বুলিয়ে নিজেকে ড্রয়িংরুমের ডিভানে আবিস্কার করে। রাতে টিভি দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে গেছে টের অবধি পায় নি। আবার কলিংবেল বাজে। সুরলা চয়নের রুমের দিকে তাকায়। দরজা বন্ধ। বিড়বিড় করে বলে,
“আমি নাকি কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাই, সে নিজে কী? এত শব্দের মাঝে কেউ ঘুমাতে পারে? ”

কলিংবেল বাজছে লাগাতার। একবার বাজালে হয়, এতবার বাজানো লাগে? কে এসেছে কে জানে?এই বাসায় আসার পর তো কাউকেই আসতে দেখলাম না। এইসব ভাবনার মাঝে উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় সদর দরজার দিকে। দরজার খোলার আগে জিজ্ঞেস করে,
“কে?”
অপাশ থেকে শব্দ আসে না। আবার কলিংবেল বাজে। সুরলা দরজা খুলতে গিয়ে দরজা বাইরে থেকে মারা। ভ্রু কুঁচকে তাকায় দরজার দিকে। দরজা বাইরে থেকে মারল কে? তারা দুজন তো ভেতরে! এই প্রশ্নে নিজেকে গুলিয়ে ফেলার মাঝে খট করে দরজা খুলে যায়। দরজার অপাশের মানুষটার দিকে তাকায় সুরলা। নেভি ব্লু জগিং সুট পরিধেয় এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। মুখে দুষ্টু হাসি। সে সুরলার দিকে তাকিয়ে থেকেই আরেকবার চাপে কলিংবেল। সুরলার বুঝতে বাকি নেই এই মানুষটা তাকে জাগানোর জন্যই এতসব করেছে। ক্ষিপ্ত চোখে এক পলক তাকিয়ে আবার সোফায় ফেরে। চয়নের রুমের দরজার দিকে ভালো করে পরখ করে, দরজা ভেতর থেকে নয় বাইরে থেকে মারা। এটা আগে খেয়াল করলে সে চয়নের মতিগতি বুঝে যেত। সোফার কুশন ঠিকঠাক করে রুমের দিকে পা বাড়ায় সুরলার। হাতের জ্বালা কমে এসেছে। চোখে লেগে থাকা ঘুমকে সায় দিবে। রুমের দরজায় যেতেই চয়ন ডেকে ওঠে,
” করলা বেগম শুনো?”

নাম ব্যাঙ্গ করা পছন্দ নয় সুরলার। সে এটা শুনতে পারে না। তাই পেছু ফিরে প্রতিবাদী সুরে টেড়ে আসে চয়নের দিকে।
” আমার নাম সুরলা তাবাসসুম। নিকনেম সুরলা, করলা গরিলা নয়। নামকে ব্যাঙ্গ করবেন না। না হলে কিন্তু…
সুরলার কথা থামিয়ে চয়ন বলে “নাহলে কী? কী করবে আমায়?” বলে সুরলার দিকে এগিয়ে আসে। চয়নের আগানো দেখে সুরলা পেছিয়ে যায়। কলিজা কেঁপে ওঠে তার, ওই লোকটা আগাচ্ছে কেন? খারাপ টারাপ মতলব নেই তো? চোখে মুখে বখাটে ভাব আবার! সুরলা পেছাতে পেছাতে তোতলিয়ে বলে,
“আয়ায়াপনিইই আয়াগাচ্ছেয়েন ক্কেন? ”
“তুমি পেছাচ্ছো কেন?” দুষ্টু হেসে বলে চয়ন। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সুরলার। আগাতে আগাতে চয়ন তার সামনে চলে এসেছে। চোখ ভর্তি আতঙ্ক নিয়ে সুরলা তাকিয়ে আছে চয়নের পানে। চয়ন ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি চেপে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“দশ লক্ষ টাকা দেনমোহরে আইন এবং শরীয়তগত ভাবে তোমার আমার বিয়ে হয়েছে। সে হিসেবে আমরা তো এখন স্বামী স্ত্রী, তাই না?”

চয়নের থেকে অনেক খানি খাটো সুরলা। চয়নের হাইট ছয় আর সুরলার হাইট চার আট। সুরলার মুখোমুখি হতে গেলে চয়নকে অনেক ঝুঁকতে হয় আর চয়নের দিকে তাকাতে হলে সুরলাকে মাথাটা বেশ কাত করে দৃষ্টি উঁচু করে দেখতে হয়। সুরলা মাথা তুলে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,
“তো?”
” স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অনেক দায়দায়িত্ব থাকে। স্বামী কখন খেল না খেল, বাসায় ফিরল কী ফিরল না, বাসায় ফিরলে তার কী লাগবে, ডিনারে সে কী খাবে এসবের খোঁজ রাখতে হয়। তুমি কোন খোঁজই রাখো না আমার, উলটো আমাকে ভয় পাও। এটা কী ঠিক বলো?” অভিযোগের সুর চয়নের। সুরলা মনে মনে বলে, ভালোভাবে বিয়ে করলে এসব আমি নিজ থেকেই করতাম, প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করেছেন এখন আমার কোন দায়দায়িত্ব নেই। থাকলেও আমি পালন করব না। আমি আপনার কোন কথা ভুলে যাইনি।

সুরলাকে চুপ থাকতে দেখে চয়ন ফিরতি প্রশ্ন করে,
” তুমি আমাকে ভয় পাও কেন?”
“আমি আপনাকে ভয় পাই না।” দৃষ্টি নিচের দিকে ফিরিয়ে বলে সুরলা। চয়ন সুরলার দুই পাশে দেয়ালে হাত রাখে। সুরলার দিকে ঝুকে মুখটা সুরলার কানের কাছে নিয়ে যায়। সুরলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। চয়ন ফিসফিসিয়ে বলে,
“সত্যিই কী তাই? আমি চাইলে কিন্তু সত্য মিথ্যা প্রমাণ করতে পারি।”

সুরলা কেঁপে ওঠে, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এর আগে চয়ন এত কাছে আসেনি কখনো। চোখ তুলে তাকায়। চয়নের এক ভয়ানক দৃষ্টি এসে লাগে চোখে। ঠোঁটের কোণের হাসিটা তাকে আরও ভয় পাইয়ে দেয়। চয়নের মতিগতি ভালো ঠেকে না তার। এখান থেকে পালাতে হবে। চয়নের হাতবাধনের নিচ দিয়ে বেরুতে চায়। চয়ন ধরে ফেলে। শব্দযোগে হেসে বলে,
“তোমার ভয় পাওয়া না পাওয়ার অধ্যায় দেখা হয়ে গেছে আমার। ভীতু করলা বেগম।”

” সুরলা, আমার নাম।” দৃষ্টি মেঝেতে ফেলে নিজের নাম মনে করিয়ে দেয় সুরলা। চয়ন হেসে বলে,
” আমার জীবনে করলার স্বাদ এনে দেয়া মানুষটাকে করলা ছাড়া সুন্দর নামে ডাকতে যে ইচ্ছে করে না। তবে তুমি যদি চাও আর বাকিসবার মত আমি ও তোমাকে জানু,বেব,বাবু ডাকতে পারি। ডাকব করলা বেগম?”

সুরলা বুঝে গেছে চয়ন তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় মগ্ন। সে এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায়। সেই উদ্দেশ্যেই বলে,
” সরুন আমি ঘুমাব।”

“তুমি চাইলে আমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমাতে পারো। আফটার অল, আমি তোমার এক্স লাভ আর প্রেজেন্ট ডিজলাইক হাজবেন্ড । তাছাড়া, স্ত্রীদের স্থান স্বামীদের বুকেই হয়। ইচ্ছে হলে নির্দ্বিধায় মাথা রাখতে পারো। ট্রাস্ট মি, আমি মাইন্ড করব না।”

চয়নের বাঁকা হাসির সাথে বলা একেক কথায় সুরলার অস্বস্তি বেড়ে যায়। না এখানে থাকতে পারছে আর না পালাতে পারছে। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে নিশ্চিত। এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে হবে। সুরলা অনুনয়ের সাথে বলে,
“সরুন না প্লিইজ! আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, আমি রুমে গিয়ে ঘুমাব।”

“ভীতু করলা।” কথাটা বলে আবারও শব্দযোগে হাসে চয়ন। হাসি থামিয়ে বলে,
“পনেরো মিনিট সময় দিলাম, ফ্রেশ হয়ে চোখ মুখ মুছে টেবিলে এসো। আমি ও ফ্রেশ হয়ে আসছি। বাবা মা ভিডিও কল দিবে। বাবা মাকে কলে রেখে একসাথে নাস্তা করব। বাবা মায়ের সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বলা বা করা থেকে বিরত থাকবে। নাহলে তোমার ভয় দেখানোর কোন ট্রিকস এপ্লাই করতে আমি বাদ রাখব না। এখনকার ভয়টা কিন্তু সামান্য ছিল। তোমাকে ভয় দেখাতে আমার মজা লাগে। আমার মজাটা তোমার সাজা হিসেবে যদি না চাও তবে চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মত আমি যা বলেছি তা করো। ”

হাতের বাধন শিথিল করে দেয় চয়ন। সুরলা সায় জানিয়ে কোনমতে পালিয়ে বাঁচে।

ব্রেকফাস্ট করে জোবায়েদা ছেলেকে ভিডিও কল দিলেন। তখন বাইরে থেকে আনা নাস্তা সার্ভ করছে চয়ন। সুরলা তার পাশের চেয়ার বড় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। এই বড় ঘোমটা দেয়ার অবদানও চয়নের। সেই বলেছে সুরলাকে ঘোমটা দিতে, নতুন বউদের নাকি শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে ঘোমটা দিয়ে থাকতে হয়। মায়ের কল দেখে আরেকবার সুরলাকে সতর্ক করে। তারপর সুরলার পাশের চেয়ারে বলে কল রিসিভ করে। ফোনের ওপাশে মা বাবা ভাই বোন সবাইকে দেখতে পায়। চেহারায় হাসি মাখিয়ে কথা বলে। জোবায়েদা ছেলের আগে বউয়ের খোঁজ নেন। সুরলা স্মিত হেসে সালাম দেয়। চিবা আর চরণ যখন তাকে ভাবি ভাবি বলছিল তখন সুরলার লজ্জা লাগে। জোবায়েদা আর বখতিয়ার আরেফিন এ কোমল কন্ঠে পেশ আসেন সুরলার সাথে। সুরলার একটা হাত টেবিলের নিচে। তার পোড়া জায়গা যাতে কারো চোখে না পড়ে তাই লুকিয়ে রাখতে বলে চয়ন। পুরোটা সময় লুকিয়ে রাখলেও শেষ সময় ভুলে গিয়ে টেবিলের উপর হাত রাখে। ফলাফল, সবাই সুরলার হাতের ব্যান্ডেজ দেখে ফেলে। জোবায়েদা কিভাবে পুড়ছে জিজ্ঞেস করছে বারবার। সুরলা চয়নের দিকে তাকাচ্ছে। সে কী বলবে খুঁজে পায় না। ঘটনা সামাল দেয় চয়ন।
“আর বলোনা মা, এখানে আসার পর পইপই করে বলেছি রান্নাঘরে না যেতে। বুয়া এসে সব কাজ করে দিয়ে যাবে। কিন্তু সে আমার কথা শুনলে তো! আমার চোখের আড়ালে কিচেনে গিয়ে রান্নায় করতে গেছে। রান্নায় দক্ষ না হওয়ায় অসাবধানতা বশত পুড়ে গেছে।”

“আহহারে! বেশি পুড়েছে?” আফসোসের সুরে বলেন জোবায়েদা। চয়ন বলে,
“বেশি পুড়েনি, হালকা লেগেছে। আমি খেয়াল রাখছি ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।”
” একটু সাবধানে থেকো মা, কাজ টাজ করার দরকার নেই তোমার। বুয়া এসে করে দিয়ে যাবে সব।” শ্বাশুড়ির কথা শুনে সুরলা মনে মনে বলে, ” আপনার গুনধর ছেলে আমাকে খাটাবে বলে এনেছে, বুয়ার আর কী কাজ? ” মুখে বলে,
“জ্বী আন্টি।”

ফোন রাখার পর সুরলা চয়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আন্টির কথা শুনে বুঝলাম, বুয়াই আপনার বাসার সব কাজ করে দিয়ে যায়। আমি আসার পর থেকে বুয়া এল না কেন? আপনি বুয়াকে আসতে নিষেধ করেছেন, শুধুমাত্র আমাকে দিয়ে কাজ করাবেন বলে?”
“সংসার সামলানোর জন্য বউ আছে। এখানে বুয়ার কোন প্রয়োজন নেই বলে নিষেধ করেছি। ” নাস্তা খেতে খেতে জবাব দেয় চয়ন। সকালে অনলাইনে অর্ডার করেছে নাস্তা। যাতে সুরলার না বানানো লাগে।
“আমাকে বুয়ার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে এনেছেন?” করুণ গলায় বলে সুরলা।
“যা ভাবো তাই।” কথাটা বলে খাবার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় চয়ন। চয়নের কথাটা ভীষণ আঘাত করে সুরলাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here