কাজল নদীর জলে পর্ব-২৭

0
997

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

২৭.
জানালার ধারে বিষন্ন মনে বসে আছে সুরলা। তার এই বিষন্নতার কারণ চয়ন। আজ চয়নের অতীত জেনেছে সে। চয়ন অফিস যাওয়ার পর চরণ কল করে সুরলাকে। রিসিভ করতেই নিজের পরিচয় দেয়। কুশল বিনিময় শেষে বলে,
“ভাবি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ। ”
“ভাইয়া আপনার সাথে রাফ বিহেভ করে, তাই না?” চরণের কথায় সুরলা চমকায়। চরণ কী জেনে গেছে সত্যটা? নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করে,
” রাফ বিহেভ করবে কেন?”
“ভাইয়া আপনাকে মেনে নিতে পারেনি। আমি জানি আপনাদের মাঝে ভালোবাসাটা শুধু আপনার পক্ষ থেকে ছিল, ভাইয়ার পক্ষ থেকে ছিল না। ভাইয়া আপনাকে এক প্রকার জেদ আর ক্ষোভ বশত বিয়ে করেছে। সেই ক্ষোভ ওঠাতেই আপনাকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছে। ঠিক বললাম তো?”
সুরলা ভাবনায় পড়ে। তার জানামতে সে বা চরণ তো তাদের মধ্যকার কথা কাউকে বলেনি। তবে জানল কিভাবে? সে জিজ্ঞেস করে,
“চয়ন বা আমি তো কাউকে বলি নি। আপনি জানলেন কিভাবে?”

চরণ হেসে বলে, ” ভাইয়াকে আমার থেকে ভালো কে জানে? ভাইয়া সব রগ আমার চেনা। ভাইয়ার মনে কী চলে তা ভাইয়ার মুখ দেখে বলতে পারি আমি।” থেমে বলে,
” সকালে ভিডিও কলে কথা বলার সময় আপনার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আমার খটকা লেগেছে। ভাইয়া যখন সাফাই দিচ্ছিল তখন আমার মনে হয়েছে ভাইয়া মিথ্যা বলছে, আপনি ইচ্ছে করে যান নি হাত পুড়াতে, ভাইয়ার হাত আছে এতে। সত্যি করে বলেন তো ভাবি, আপনার হাত কিভাবে পুড়েছে? আমাকে আপনার ভাই ভেবে বলুন।”

রাশনার পরে কেউ একজন তার দুঃখ বুঝতে চাইছে। সুরলা না বলে পারে না। একে একে সব বলে দেয়। বলতে গিয়ে দুই একটা গলা কেঁপে ওঠেছে। সবটা শুনে চয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হতাশ গলায় বলে,
“আমার ভাইটা এমন ছিল না। ভাইয়ার এতটা কঠিন হওয়ার পেছনে অনন্যার দায়ী?”

“অনন্যা কে?” প্রশ্ন ছুড়ে সুরলা। চয়ন চাপা শ্বাস ফেলে বলে,
” ভাইয়ার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা হয়ে আগমনকারী মানুষটার নাম হচ্ছে অনন্যা। ভাইয়ায় ক্লাসমেট ছিল সে। কলেজ লাইফ থেকে ভাইয়ার আর অনন্যার রিলেশন ছিল। দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসতো। অনন্যার সব খরচ চালাতো ভাইয়া। অনন্যা ও সাবলিলভাবে সবকিছুর আবদার করতো। সম্পর্কের পাঁচ বছরের মাথায় হুট করেই অনন্য বদলে যায়। ভাইয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ব্যস্ততা ভেবে হেলা করলেও পরে ভাইয়া সিরিয়াসলি নেয় ব্যাপারটা। একদিন সরাসরি এড়িয়ে যাবার কার‍ণ জিজ্ঞেস করে। অনন্যা প্রথমে দেনমনা করলে ও পরে জানায়, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। ভাইয়ার সাথে তার আর যাচ্ছে না। অভিনয় করতে করতে হাফিয়ে গেছে সে। ”
“অভিনয়!” বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে সুরলা। চরণ জবাব দেয়,
“হ্যাঁ অভিনয়। সে ভাইয়ার সাথে টাইমপাস করেছে এতবছর অবধি। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, টাকা, বড়লোকের ছেলে দেখে ভাইয়ার সাথে রিলেশনে গেছে।যাতে ভাইয়াকে নিজের ক্রেডিট কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারে । এবং সে সফলও হয়েছে। চল্লিশোর্ধ্ব কোটিপতি ব্যবসায়ী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। অনন্যা ওই ব্যবসায়ীকে বিয়ে করবে। তার অনেক টাকা। ভাইয়া তখনো স্টুডেন্ট, বাবার টাকায় চলে। ওই ব্যবসায়ীর তুলনায় ভাইয়া একবারেই নিচুশ্রেণীর। এইসব বলে সে ভাইয়ার সাথে ব্রেকাপ করে । ভাইয়ার ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে ব্যাপারটা হজম হয়না ভাইয়ার। দিশেহারা হয়ে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে যায়। ডাক্তারি চিকিৎসা আর আমাদের প্রচেষ্টায় মাস কয়েকের মাঝে ভাইয়া ঘা কাটিয়ে ওঠে। ততদিনে অনন্যা বিয়ে করে নিয়েছে ওই ব্যবসায়ীকে। ঘা কাটিয়ে ওঠে ভাইয়ার মনে মেয়েদের জন্য ঘৃণা জন্মে। ”

সুরলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। একটা মানুষ এতটা নিচু প্রকৃতির কিভাবে হতে পারে ভেবে পায় না সে। চয়নের উপর দিয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা ভাবতেই বুক কাঁপে তার। যেখানে এক তরফা ভালোবাসা হওয়া সত্ত্বেও ভালোবাসার মানুষটা থেকে রিজেকশন আর কয়েকটা কটুকথা সহ্য করতে পারেনি সুরলা। সেখানে একটা মানুষকে মনে প্রাণে ভালোবেসে, একটা সম্পর্কে জড়িয়ে ধোকা খাওয়ার ব্যাথা কিভাবে সহ্য করেছে চয়ন? এর জন্যই এতটা কঠিন হয়ে গেছে! সুরলার সাড়াশব্দ না পেয়ে চরণ হ্যালো বলে। সুরলা বাস্তবে ফেরে আছে। কিছু একটা ভেবে বলে,
“মানছি অনন্যা যা করেছি তার রীতিমতো অপরাধ ছিল। চয়নের সাথে খুব খারাপ হয়েছে। দোষ করলে অনন্য করেছে, আমি কী করেছি? আমাকে কেন সেদিন এতগুলো কথা শুনাল?”

” ভাইয়া মনে করে, সব মেয়ে এক। সবাই লোভী, শুধু টাকাই বুঝে। তোমাকে ও তেমনই ভেবেছে। তাই রাফ বিহেভ করেছে।” চাপা শ্বাস ফেলে চয়ন। সুরলা ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“সব মানুষ এক নয়। একজন খারাপ মানে সবাই খারাপ নয়। দোষ করেছে অনন্যা ফল ভোগ করছি আমি।”
“ভাবি, আমি কী আপনাকে ঢাকা আনার ব্যবস্থা করব? ভাইয়া তো ওখানে ভালো থাকতে দিবে না। ” চরণ চায় তার ভাই বদলাক, ভালোবাসাকে গ্রহণ করুক। কিন্তু অনন্যার দোষে নির্দোষী একটা মেয়েকে কষ্ট দেয়ার পক্ষপাতিত্ব নয় সে। তাই সুরলাকে ফিরিয়ে আনবে, যাতে তার ভাই আর কষ্ট দিতে না পারে। খানিক ভাবে সুরলা। বলে,
“যাবার হলে আমি বলব।”

ফোন রেখেই ভাবনায় পড়ে সে। চয়নের সাথে ঘটা ঘটনাগুলো ভাবতেই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনন্যার উপর রাগ চাপে। ওই খারাপ মেয়েটার জন্য সে আজ ভালোবাসা বঞ্চিত।

পুরো দিনটা বিক্ষিপ্ততার সাথেই যায়। সন্ধায় পিৎজার প্যাকেট হাতে বাসায় ফিরে চয়ন। সুরলা তখন বিক্ষিপ্ততা কাটাতে টিভি ছেড়ে একটা মুভি দেখতে ব্যস্ত । দরজা খোলার শব্দে আড়চোখে একবার তাকায় চয়নের দিকে। তারপর আবার টিভির দিকে চোখ ফেরায়। চয়ন পিৎজার প্যাকেট রাখে ডাইনিং টেবিলে। তারপর ফ্রেশ হতে চলে যায় রুমে। ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা পিৎজা দেখে সুরলার ক্ষুধা বেড়ে যায়। চয়নকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধার জ্বলায় না পেরে লজ্জা সরম ভুলে পিৎজা নিয়ে খেতে শুরু করে। ছয় পিস খাওয়ার পর পেটে আর জায়গা থাকে না। পিৎজা আবার আগের মত রেখে দেয়। পানি খেয়ে টিভি দেখায় মন দেয়। একটা হলিউড মুভি চলছে। নাম গ্লাস। বেশ রহস্যঘন ছবি। সুরলা ডুবে যায় মুভিতে। খানিক পর টিভি বন্ধ হয়ে যায়। সুরলা চোখ সরিয়ে উপরে তাকায়, এসি চলছে, লাইট, সব চলছে। তারমানে লোডশেডিং হয় নি। তবে টিভি বন্ধ হল কিভাবে! রিমোটে হাতের চাপ লেগে বন্ধ হয়ে গেল না তো! ভাবতেই পাশে রাখা টিভির রিমোট খুঁজে। পাশে তাকাতেই দেখে রিমোট হাতে চয়ন বসে আছে। চোখে মুখে বিরক্তি তার। সুরলা বুঝতে পারে, টিভি বন্ধ হয়নি, চয়ন বন্ধ করে দিয়েছে। সে রিমোটের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“টিভি বন্ধ করলেন কেন? রিমোটটা দিন, আমি মুভি দেখব।”
রিমোট অন্যদিকে সরিয়ে চয়ন বলে,
“আগে উত্তর দাও, পিৎজা খেলে কেন? আমি বলেছি খেতে?”

পিৎজার কথা জিজ্ঞেস করতেই খানিক লজ্জা পায় সুরলা। খাদকের মত এতটুকু পিৎজা খেয়ে নিল! তাও চুরি করে, ভাবতেই লজ্জা লাগছে তার। চয়নের দিকে এক পলক তাকায়। চয়ন আবার তাড়া দেয়। সুরলা লজ্জা সংবরণ করে বলে,
“ক্ষিধে পেয়েছে তাই খেয়েছি।”
“তাই বলে পুরোটাই সাবাড় করে ফেলবে! এতটা খাদক কেন তুমি?”
সুরলা খোচা দিয়ে তড়িৎ বলে,
” কাজের বুয়ারা খাদকই হয়। তারা ঠিকমতো খাবার পায় না তো, তাই যা পায় তার উপর হামলে পড়ে। আপনার চোখে আমি তো কাজের বুয়াই তাই না?” অভিমানভরা কন্ঠ সুরলার।

চয়নের বুঝতে বাকি থাকে না ,সুরলা সকালের কথাটাকে টানছে। সে ও রগড় করে বলে,
“তা কাজের বেটি সকিনা, কয় বাসায় কাজ করেন? আয় কেমন? ”
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুরলা বলে,
“এক বাসায় কাজ করতে গিয়েই জীবন শেষ। জানেন? ওই বাসার সাহেবটা আস্ত বদ। মায়া দয়া নেই। তার বাসার ছোট্ট একটা মেয়েকে দিয়ে খাটায়। খাওয়াও দেয়না। মেয়েটা একটু খেতে গেলেও কথা শোনায়। ফুলের মত মেয়েটার কষ্ট দেখে আমার কষ্ট লাগে। রাগ হয় ওই বদলোকের উপর, ইচ্ছে করে কোন বক্সারের হাতে ধরিয়ে দিই, বক্সার ঘুষি মেরে বডিকে ফোস্কা ফোস্কা করে দিবে তখন ভালো হবে।”

সুযোগ বুঝে নিজের আক্রোশ ঝাড়ে সুরলা। চয়নের দিকে তাকাতেই দেখে চয়নের রাগত চাহনি চোখে পড়ে। সুরলা বুঝে তার কথাটা বলা ঠিক হয় নি। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
“রিমোটটা দিন, আমি মুভি দেখব।”

রিমোট আকঁড়ে কটমট করে তাকিয়ে আছে চয়ন। যেন চোখ দিয়ে বাষ্প করে দিবে। সুরলার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার উপর কোন সিড়র আঘান হানতে চলেছে। সে পালাতে উঠে দাঁড়ায়। চয়নের ফোন বেজে ওঠে। রুমে বেশ শব্দযোগে বাজছে ফোনটা। এখান অবধি শব্দ আসছে। সুরলা সেদিকে কান না দিয়ে যেতে নেয়।
চয়ন গম্ভীর গলা কানে আসে,
“কিছু কিছু বুয়া ভীষণ চল-চাতুরী হয়। নিজেরা স্বার্থন্বেষী আর লোভী হয়ে ও নিজেকে ছাড়া সবাইকে খারাপ ভাবে, অন্যকে খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টায় থাকে। এদের সাথে রুড বিহেভই করা উচিত। বক্সারের হাতে সাহেবকে নয়, ওই সকল বুয়াদের তুলে দেয়া উচিত।”
সুরলা থমকে দাঁড়ায়। চয়নের পুরনো কথা টেনে খোঁচা দেয়াটা হজম করতে পারে না যেন। চয়ন তাকে লোভী, স্বার্থন্বেষী, চল-চাতুরী ভাবে। যেখানে সে এসবের কিছুই নয়। অনন্যা ছিল এমন।সে তো এমন নয়, তবে চয়ন তাকে অনন্যার দোষ দিয়ে যাচাই করবে কেন! তার কোন কাজ বলে সে লোভী, স্বার্থন্বেষী, চল-চাতুরী? অনন্যার রাগ চয়ন তার উপর ঝাড়বে কেন! চয়নের প্রতি বিরক্তি আর রাগ জমে সুরলার মনে। পেছু ফিরে প্রতিবাদী সুরে কিছু বলতে চায়। চয়ন বলার সুযোগ না দিয়ে ধমকে বলে,
” কোন কথা না বলে রুম থেকে আমার ফোন নিয়ে আসো। যাও?”

চয়নের ধমকে ভেতরকার সব কথা ভুলে যায় সুরলা। কথার পিঠে কথা বলার সাহস পায় না। মনে মনে গালি দিতে থাকে। চয়ন ফিরতি ধমক দেয়।বাধ্য হয়ে রুম থেকে ফোন এনে দেয় সুরলা। দেয়ার আগে স্ক্রিনে একবার চোখ বুলায়। মা-২ লেখাটা ভাসছে স্ক্রিনে। সুরলা ভাবে তার শ্বাশুড়ির দ্বিতীয় নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। চয়নকে ফোন দিয়ে হাটা ধরে। চয়ন সুরলার হাত ধরে আটকায়। ফোন কানে দিয়ে ইশারায় পাশে বসতে বলে। সুরলা হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে চয়ন জোর করে বসিয়ে দেয়। চয়নের ফোনে বলা কথা শুনে,
“হ্যাঁ মা, সব ঠিকঠাক আছে।
ও ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন? বাবা কেমন আছে?
ওর জন্য চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে। ওর রাগের কথা তো জানেনই। কোন কারণে রেগে আছে বোধহয় তাই কথা বলছে না।
আমি বলেছি, আমার কথাও শুনেনি। উলটো কড়াকথা শুনিয়েছে।
হ্যাঁ পাশেই আছে।
দিচ্ছি, দেখি কথা বলে কি-না। ”
অপাশের কথা শুনে না , চয়নের কথাও বুঝতে পারে না সুরলা। মা ছেলে কার কথা বলছে কে জানে! চয়ন ফোন কান থেকে সরিয়ে সুরলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“মা তোমার সাথে কথা বলবে। ”

শ্বাশুড়ি ভেবে সুরলা ফোন হাতে নেয়। বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
অপাশ থেকে সাবিনার কান্নাভেজা গলা ভেসে আসে।
“কেমন আছিস সরু?”
এই কন্ঠ ভীষণ চেনা সুরলার। এ টা যে তার মায়ের গলা। সে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভাসা নাম্বারে চোখ বুলায়, হ্যাঁ তার চেনাচেনা মুখস্থ নাম্বারটাই স্ক্রিনে ভাসছে। তারমানে মা-২ দিয়ে মায়ের দ্বিতীয় নাম্বার নয়, দ্বিতীয় মায়ের নাম্বার হিসেবে সেভ করেছে। সুরলা অবাক চোখে তাকায় চয়নের দিকে। চয়ন শান্ত গলায় বলে,
” মা তোমার জন্য সারাদিন কান্নাকাটি করে, তুমি কথা বলো না এটা মানতে পারেনা। মায়েদের উপর রাগ করতে নেই। রাগ ভুলে কথা বলো। ”

সুরলা চুপচাপ ফোন কানে তুলে। সাবিনার গলা ভেসে আসে,
“সরু আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখে আমাদের কোন দোষের সাজা দিচ্ছিস বলতো? একটাবার আমাদের কথা মনে পড়ে না তোর? একটাবার মনে হয় না তোর সাথে কথা না বলতে পেরে তোর বাবা, মা, খালামণি কিভাবে থাকছে? ” বলতে বলতে কেঁদে দেন সাবিনা। মায়ের কান্নায় মন গলে যায় সুরলার। নিজ কর্মের অনুশোচনা হয়। চয়নের উপর জমে থাকা জেদটাকে তার বাবা মা পরিবারের উপর উঠিয়েছে অভিমান হিসেবে। এটা ঠিক হয়নি। তারা কত ভালোবাসে তাকে। কান্নার দলেরা ভীড় জমায় চোখে।
কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
” আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চট্রগ্রাম পাঠানোর কারণে তোমাদের উপর রেগে ছিলাম । সরি মা। তোমাদের ছাড়া আমি ও ভালো নেই। খুব মিস করি তোমাদের। ”
সুরলাও কেঁদে দেয়। মা মেয়ে দু’জন ফোন কানে দিয়ে কাঁদছে। সুরলা মাকে বলে,
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও না মা? আমার এখানে ভালো লাগছে না। ”

সাবিনা ভাবেন, মেয়ে তাদের মিস করছে তাই যাবার কথা বলছে। তিনি চোখ মুছে বলেন,
“নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। নিজেকে সময় দে, দেখবি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর চয়ন তো আছেই তোকে সঙ্গ দিতে। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি ওখানটা তোর প্রিয়স্থান হবে। আমি জানি চয়ন তোর খেয়াল রাখে।”

সুরলা অভিমান ভরা গলায় বলে,
” তোমরা শুধু ওর পক্ষেই কথা বলবে। ও আসার পর থেকে আমাকে পর করে দিয়েছো তোমরা। সবখানে শুধু ওর নাম জোপো।”
“ছেলেটার উপর এখনো রেগে আছিস! ছেলেটা ভীষণ ভালো, তোকে ভীষণ ভালোবাসে। নিজেদের মাঝে সব ঠিক করে নে। চয়নের ধৈয্যের পরীক্ষা নিস না আর।”
মেয়েকে সান্ত্বনা দেন সাবিনা। সুরলা পাশে বসা চয়নের দিকে তাকায়। টিভির সাউন্ড মিউট করে এক ধ্যানে খেলা দেখছে। সুরলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে, “যদি তুমি সত্যটা জানতে! ভালোবাসাটা ভীষণ নয়, এক বিন্দু পরিমাণ ভালো ও বাসে না সে আমায়। পারলে তো ঘৃণা করে।” প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,
“বাবা কোথায়? আশেপাশে আছে?”
“তোর বাবা আসেনি এখনো। সরল আছে। কথা বলবি?”
“দাও।”

সরলকে ফোন দেয় সাবিনা। সুরলা বলে,
“কেমন আছিস বান্টি?” সরলকে বান্টি ডাকে সুরলা। সরল বরাবরের মতই ক্ষেপে যায়।
“বান্টি বুন্টি ডাকবে না আমায়। ভালো নামে ডাকবে। ”
“আমি তো তোকে আদর করে ডাকি, আপি না তোকে কত ভালোবাসে!” কোমল গলায় বলে সুরলা। সরল দমে যায়। ঠোঁট উলটে বলে,
“আপু তুমি চলে আসো না? আমি তোমাকে মিস করছি। ”
“আমি ও তোকে মিস করছি, পারলে তো ওউড়ে চলে আসি। কিন্তু পারছিনা। তবে খুব শীঘ্রই আসব।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সুরলা। সরল আকুতিভরা কন্ঠে বলে,
“চলে আসো প্লিজ! এসে কী আবার চলে যাবে?”
“একবার ফিরে আসি, তারপর তোদের ছেড়ে যাব না আর। আমি তুই নিতু নিলয় নিতিকা আপু মিলে খুব মজা করব।”
“ইয়েএএএ, খুব মজা হবে।” বলে লাফিয়ে ওঠে। সুরলা হাসে ভাইয়ার চিৎকারে। সরল বোন বলতে অজ্ঞান। সরলের সাথে কথা বলে ফোন রাখে সুরলা।

ফোনটা চয়নকে দিতেই চয়ন হেসে বলে,
“বান্টির বোন আন্টি, আপনার সব পরিকল্পনা মাথা থেকে বের করে দিন, কারণ আমার থেকে এত সহজে মুক্তি পাচ্ছেন না আপনি। যেখানে যাবেন আমাকেই পাবেন।”

সুরলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আপনি আড়িপেতে আমাদের কথা শুনছিলেন! ভারী খারাপ লোক তো আপনি!”

“সে আর নতুন কী! তবে তোমার কান্না দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। ‘মা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও’ বলে কিভাবে কাঁদছিলে! যেন পাঁচ বছরের বাচ্চাকে মা হোস্টেলে রেখে এসেছে।” চয়নের মুখে উপচে পড়া হাসি। চয়নের হাসি দেখে ভীষণ রাগ লাগে সুরলার। ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“সব হয়েছে আপনার জন্য, না আপনি আমাকে বিয়ে করতেন আর না এখানে নিয়ে আসতেন আর না আমাকে এই দিন দেখতে হতো।”

“আমি একটাবার তোমাকে বলেছি, তুমি আমাকে বিয়ে করো? বলিনি তো। নিজ থেকেই করেছো। বর দেখা না দেখা ছিল তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার কী দোষ এতে! আমার উপর জেদ ধরে অন্যকাউকে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকেই বিয়ে করেছো তুমি। সো সেড মিসেস জুবায়ের।”

বাঁকা হেসে আফসোসের সুরে বলে চয়ন। সুরলার রাগের মাত্রা বাড়ে। এতসব করে এখন বলে, আমার কী দোষ! ডেভিল একটা। কটমট করে তাকায় চয়নের দিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় চয়ন। রাগে কী করবে ভেবে না পেয়ে চয়নের চুল টেনে ধরে। সর্বশক্তি দিয়ে চুল টানে। আকস্মিক এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না চয়ন। ঘটনা বুঝে উঠতে পারে না সে। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা লাগায় বুঝে আসে সবটা। সুরলার হাত ছাড়ার চেষ্টা করে। পারে না। সুরলার শক্তি দেখে অবাক হয় সে, এটুকুনি মেয়ের এত শক্তি এলো কোথা থেকে!
“চুল ছাড়ো, ব্যাথা পাচ্ছি। ভালো হবে না কিন্তু!”

চয়নের আর্তনাদ সুরলার কানে যায় না। সে চুল ঝাকাতে ঝাকাতে বলে,
” আপনার চুল নয় পারলে আপনাকেই মাথাই ছিড়ে ফেলব। আমার জীবন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? কেন শাস্তি দেন আমায়? আমায় নিয়ে মজার করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে! খুন করে ফেলব নেক্সট টাইম আমায় নিয়ে হাসাহাসি করলে। অনেক সহ্য করেছি আর নয়। কী ভেবেছেন আপনি? আমাকে টর্চার করবেন আর আমি চুপ থাকব? আমি চুপ থাকব না, নারী নির্যাতন মামলা করব আপনার নামে। বদলোক একটা।”

“যা ইচ্ছে তা করো, কিন্তু আগে চুল ছাড়ো। মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। ” ফিরতি আর্তনাদ করে ওঠে চয়ন। সুরলা তার রাগ চয়নের চুলের উপর ঝেড়ে চয়নকে ছেড়ে দেয়। তারপর রিমোটটা হাতে নিয়ে রুমের দিকে এগোয়। যেতে যেতে বলে,
“আমার থেকে রিমোট নিয়ে নিয়েছিলেন না? এখন দেখুন টিভি।” রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় সুরলা। এদিকে মাথা ব্যাথায় চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসে চয়নের।

রাত তখন প্রায় দেড়টা। ওয়াশরুমে যাবার জন্য রুমের দরজা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সুরলা। দরজা খুলবে কী খুলবে না ভাবছে সে। দরজা খুললে যদি বাইরে চয়নকে দেখতে পায় তখন কি হবে? চুল টানার অপরাধে চয়ন তাকে কড়া শাস্তি দিবে। সন্ধ্যায় বীরের বেশে চয়নকে শায়েস্তা করলেও রুমে যাওয়ার পর শায়েস্তার পরিণাম মনে পড়েছে। এই বদ্ধ ফ্ল্যাটে সে আর চয়ন ছাড়া কেউ নেই। রাত কিংবা দিনে না চাইতেও চয়নের সাথে তার দেখা হবে। তখন কি চয়ন তাকে ছেড়ে দিবে? মোটেও ছাড়বে না নিশ্চিত সে। যে পরিমাণে চুল টেনে ছিঁড়েছে তাতে ছেড়ে দেবার কথাও না। এতসব ভেবে রুমে বসে থাকতে চাইলে ও পারছে না। বাধ্য হয়েই বেরুতে হচ্ছে।

এত রাত চয়ন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে রুমে থেকে বেরিয়ে কাজ সেরে চলে আসবে। চয়ন টের পাবে না। এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে নিঃশব্দে রুমের দরজা খুলে। মাথা বের করে এদিকে ওদিক চোখ বুলায়। চয়নের রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।পা টিপে টিপে ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে যেতে গিয়ে কিচেনের থেকে কিছু পড়ার শব্দ কানে আসে। ভূত প্রেতের কথা ভেবে ভয় পায় সুরলা। রুমে ডুকে ও বেরিয়ে এসে কিচেনে উঁকি দেয়। দেখে, চয়ন মাথায় আইস ব্যাগ চেপে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। খানিক আইস ব্যাগ নামিয়ে ফ্রিজ থেকে আইস ট্রে বের করে কয়েক টুকরো আইস নিয়ে মাথায় চেপে ধরে। একটু চাপ দিয়ে মুখ কুঁচকে হাত সরিয়ে নেয়। চেহারা ভর্তি আর্তনাদ খেলা করছে যেন। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। চয়নকে অস্বাভাবিক লাগছে সুরলার কাছে। চয়ন কী অসুস্থ! কী হয়েছে? কোথাও চয়নের এই ব্যাথার কারণ আমার চুল টানা নয় তো! জানতে উৎসুক সুরলার মন। চয়নের অবস্থা দেখে খারাপ লাগে সুরলার । নিজেকে দমাতে না পেরে ধীর পায়ে কিচেনে প্রবেশ করে। চয়নের সামনে গিয়ে ধীর গলায় বলে,
“কী হয়েছে?”

সুরলার কথা শুনে সামনে দৃষ্টি ফেলে সুরলাকে দেখে চয়ন অগ্নীদৃষ্টিতে তাকায় সুরলার পানে। তারপর মাথা থেকে আইসের টুকরো নামিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় কিচেন থেকে। চয়নের সেই দৃষ্টিতে সুরলা রাগ ক্ষোভ ব্যাথা সব দেখতে পায়। তার বুঝতে বাকি নেই, চুল টানাই চয়নের অসুস্থতার উপসর্গ। অনুশোচনা হয় তার। চয়নের উদ্দেশ্যে কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়।

চয়ন রুমে গিয়ে মাথায় হাত রেখে শুয়ে আছে। সুরলা গিয়ে দাঁড়ায় বেডের পাশে । করুণ কন্ঠে বলে,
“মাথা কী বেশি ব্যাথা করছে?”

সুরলার কথা না শোনার ভান করে নিজের অবস্থানে অবিচল থাকে চয়ন। সুরলা তাকিয়ে থাকে চয়নের পানে। মাথায় বরফ ঢলে মাথাটাও মুছেনি। চুলের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। সুরলা রুমের এদিক ওদিকে তাকিয়ে টাওয়াল খুঁজে। রুমে না পেয়ে বারান্দায় যায়, বারান্দার রশিতে ঝুলানো দেখে নিয়ে আসে। টাওয়াল হাতে চয়নের মাথায় পাশে এসে বসে। মাথা মুছতে চয়নের মাথায় হাত দিলে চয়ন চোখ থেকে হাত সরিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। মাথা থেকে সুরলার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে রাগত কন্ঠে বলে,
“তোমার কোন সিমপ্যাথি লাগবে না । যাও এখান থেকে। ”

সুরলা বিড়বিড় করে বলে, “ব্যাথায় মরছে, তাও ঝাঁজ দেখাতে ভুলবে না। ”
তারপর চয়নের মাথায় ফিরতি হাত রেখে শাসানির সুরে বলে,”চুপচাপ যেভাবে আছেন ওভাবেই থাকুন। কোন নড়াচড়া করবেন না। নড়াচড়া করলে এবার মাথা থেকে চুল নয়, ঘাড় থেকে মাথা উঠিয়ে নিব।”
একপ্রকার জোর করেই চয়নের মাথা টাওয়াল দিয়ে মুছে দেয়। তারপর আলতো হাতে মাথা মাসাজ করতে থাকে। এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পেয়ে ব্যাথা কমে আসবে। মাসাজে আরাম পেয়ে চোখ বুঝে চয়ন। সুরলা জিজ্ঞেস করে,
“ব্যাথা কম লাগছে?”

চয়ন চোখ খুলে তাকায় সুরলার দিকে। সুরলার চেহারায় অস্থিরতার আভা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
“চুল আমার টেনেছো, ব্যাথা আমি পেয়েছি, কষ্ট অনুভব আমার হচ্ছে , তবে তোমার চেহারায় অস্থিরতা কেন? আমার মতো জঘন্য ব্যক্তির জন্য তোমার মত মাত্রাতিরিক্ত ভালো মেয়ের চেহারায় ভেসে থাকা অস্থিরতার সাইন্সটা ঠিক বুঝে আসছে না। কেস কী বলো তো করলা বেগম? আবার ভালোটালো বেসে ফেলনি তো! ”

এই অসুস্থতার মাঝেও মানুষ মজা করে কিভাবে! ভেবে পায় না সুরলা। সুরলাকে পঁচানোর কোন ট্রিকসের কাছে যেন স্থান কাল পাত্র কোন ম্যাটার করে না। বিরক্তিকর চাহনি দেয় সে। তারপর বলে,
” “রাস্তায় কোন বিড়াল কুকুরকে পড়ে থাকতে দেখলে আমার খারাপ লাগে। মানবতাবোধ থেকে অস্থিরতা আসে। কেউ তখন এই অস্থিরতাকে অন্য নাম দিলে, তা বেমানান লাগবে।”
চয়নের কথাই চয়নকে ফিরিয়ে দেয়। সুরলার কথায় ভ্রু নাড়িয়ে বাঁকা হাসে চয়ন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here