কাজল নদীর জলে পর্ব-২৮

0
1147

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

২৮.
রবির তীব্র কিরণ চোখের উপর ভীড় জমাতেই ঘুম ভেঙে যায় চয়নের। চোখ বন্ধ করেই অনুভব করে মাথায় কিছু একটা চেপে আছে। যাচাই করতে নিজের হাত রাখে মাথায়। কারো হাতের স্পর্শ লাগে। চট করে চোখ খুলে তাকায়। মাথার কাছে সুরলাকে ঘুমোতে দেখে অবাক হয়। রাতে চয়নের মাথা মাসাজ করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছে! রাতে সুরলার অস্থিরতা চয়নকে বেশ অবাক করেছে। নিজে ব্যাথা দিয়ে নিজেই সারিয়েছে। সুরলার অস্থিরতা দেখে চয়নের মনে হয়েছে, ব্যাথা চয়ন নয় সুরলা পেয়েছে। সুরলার হেড মাসাজ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। চয়নের মাথা ব্যাথা কমে গেছে অনেকটাই।

সুরলার থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটায় চোখ বুলায়। সাতটা বেজে তিপ্পান্ন মিনিট। আটটা বাজতে চলল! অনন্যদিন এই সময়ে সে জগিং থেকে ফিরে আসে। আজ এতবেলা অবধি ঘুমিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগে চয়নের। সাড়ে আটটায় অফিসের জন্য বেরুতে হবে। হাতে সময় একবারেই নেই। মাথা থেকে সুরলার হাত সরিয়ে তড়িৎ উঠে বসে চয়ন। বাথরোব নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দেয়। শাওয়ার শেষে বাথরোব গায়ে জড়িয়ে আসে রুমে। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে গিয়ে একবার ভাবে চুলের পানি সব সুরলার মুখের ওপর ঝেড়ে তাকে জাগাবে। এটা করতে যায় সে, কেন যেন করতে পারে না। ভেতর থাকা কোন এক সত্তা বাধা দেয় তাকে। বলে, মেয়েটাকে ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক না!
অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হয়। পরোটা আর গ্রীল নিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট থেকে। নিজে খেয়ে, বাকিটা ডাইনিং টেবিলে ডেকে রাখে।

ঘুম থেকে ওঠে সুরলা অবাকের অবাক হয়। চয়ন আজ তাকে কোন কায়দা করে জাগায় নি, আবার নাস্তা ও রেখে গেছে। এতটা ভালো কিভাবে হলো! এটা কাল রাতে তার সেবার পরিণাম কি-না ভেবে পায় না সুরলা।
চয়ন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বিষন্ন মনে। ফ্রেশ হয়ে টিভি ছেড়ে খেলা দেখতে বসে। সুরলা এসে রিমোট কেড়ে নিয়ে মুভির চ্যানেল দিলে ও কোন রিয়েকশন দেয় না চয়ন। সোফায় গা এলিয়ে দেয়। অথচ তার কোমর বেধে ঝগড়া করার কথা। রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। সুরলা ভ্রু কুঁচকায়। এ লোকের আজ হলোটা কী! সুরলা জিজ্ঞেস করতে যেতে গিয়েও করে না। লোকটা এমন থাকলে তারজন্যই ভালো। এমনিতে সারাদিন তাকে পঁচানোর পথ খুঁজে। এখন তো সেটা করছে না।

এভাবে প্রায় পাঁচদিন কেটে যায়। চয়ন পুরোপুরিভাবে সুরলাকে ইগ্নোর করতে থাকে। কোন কথা ও বলে না, আগ বাড়িয়ে ঝগড়া ও করে না। বাইরে থেকে খাবার এনে কিছু খায় আর কিছু টেবিলে রেখে রুমে চলে যায়। বাসায় ফিরে বেশ রাত করে। অফিস থেকে ফিরে বাকিটা সময় রুমেই কাটায় । সুরলাও নিজের মতো থাকে। সারাদিন খেয়ে দেয়ে, পরিবারের সাথে ফোনে আড্ডা দিয়ে, টিভি দেখে সময় পার করে। পঞ্চম দিন বিকেলে জোবায়েদা কল দেন সুরলাকে। কথাবার্তা শেষে জিজ্ঞেস করেন তাদের মাঝে সব ঠিক আছে কি-না বা নতুন করে কোন ঝগড়াঝাটি হয়েছে কি-না। সুরলা নেতিবাচক উত্তর দিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করে। জোবায়েদা জানান গত কয়েকদিন ধরে চয়নের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার বারেবার মনে হয় চয়নের মন খারাপ। কোন একটা বিষয় চয়নকে চিন্তায় ফেলছে, বা আঘাত করছে। জিজ্ঞেস করার পর এড়িয়ে যায়। সুরলাও বলে, “গত কয়েকদিন ধরে আমি ও লক্ষ্য করছি চয়ন কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে। আর সারাদিন বিষন্ন থাকে। রাতে করে বাসায় ফেরে আবার, সকালে জগিং-এ ও যায় না।”

জোবায়েদা চিন্তায় পড়ে যান। কী হলো ছেলেটার? শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে হুট করেই চয়নের জন্য চিন্তা হয় সুরলার। চয়নের বিষন্নতা মনে আঘাত হানে। অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে ইচ্ছে করে। নিজে কারণ খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু কোন কারণই চোখে পড়ে তার। চরণের কথা মনে পড়ে। চরণ নাকি তার ভাইয়ের মুখ দেখে মনের খবর বলতে পারে। এখন ও নিশ্চয়ই চয়নের বিষন্নতার কারণ জানা থাকবে চরণের। এই ভেবে চরণকে কল দেয়। রিসিভ হতেই কোন বণিতা ছাড়াই চয়নের ব্যাপারটা খুলে বলে এবং কারণ জিজ্ঞেস করে। সব শোনার পর চরণের উত্তর ছিল,
“এর একটাই কারণ, অনন্যা। ভাইয়া নিশ্চয়ই আবার অনন্যাকে দেখেছে, পুরোনো ঘা তাজা হয়েছে। যখনই ভাইয়া অনন্যাকে দেখে তখন বিষন্ন হয়ে যায়। ভাইয়ার মনে হয়, শুধু অনন্যা নয় তার আশেপাশে যারা আছে সবাই অনন্যার মত মায়া দেখিয়ে কোন স্বার্থের জন্য তাকে ব্যবহার করবে, পরে তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ভাইয়া সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। পরিবার আর আপনজনের মায়া থেকে দূরে থাকতেই ভাইয়া চট্রগ্রামকে কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এটা নতুন নয়। চট্রগ্রাম যাওয়ার পর ও ভাইয়া এই অদ্ভুত ব্যবহার অনেকবার করেছে, মা বাবা টের না পেলেও আমি টের পেতাম। যখনি টের পেতাম তখনি ভাইয়ার কাছে চলে যেতাম। বুঝিয়ে সঙ্গ দিয়ে ঠিক করতাম। ”
প্রতুত্তরে সুরলা রাগী কন্ঠে বলে,
“ওই অনন্যা পনোন্যাকে আমি হাতের কাছে ফেলে কুচিকুচি করব। একটা মানুষ কতজনের শান্তি কেড়েছে। ইচ্ছে করছে ওর খোঁজ নিয়ে বাসায় গিয়ে পিঠিয়ে আসি।”

সুরলার কথায় চরণ হেসে বলে,
“আপনাকে এত রণচণ্ডী হওয়ার দরকার নেই ভাবি। আপনি শুধু ভাইয়াকে সঙ্গী দিন। ভাইয়াকে এটা বিশ্বাস করান যে, সব মানুষ অনন্যার মত হয় না। সব ভালোবাসা মিথ্যা হয় না, কিছু ভালোবাসা সত্যও হয়, তাতে কোন ধোঁকা থাকে না। আপনি ভাইয়াকে বেশি করে সময় দিন, বাসায় যতক্ষণ থাকে পুরোটা সময় ভাইয়ার সাথে আঠার মত লেগে থাকুন, ভাইয়ার কেয়ার করুন। ভালোবাসে ধোঁকা খাওয়া মানুষ গুলো নতুন করে ভালোবাসতে ভয় পায়। তবে একটু খানি সত্যিকার ভালোবাসার আভাস পেলে সেটা আঁকড়ে ধরে বাঁচে। ভালোবাসার মানুষটাকে হৃদয়ের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখে। আপনি বুঝতে পারছেন আপনার করনীয় কী?”

সুরলা ইতিবাচক জবাব দিয়ে ফোন রেখে দেয়। ভাবতে বসে, এই প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলা, মান অভিমান, রাগারাগি, ভুল বুঝাবুঝি অনেক হয়েছে। এবার এর ইতি টানতে হবে। কষ্ট দুজনেই পাচ্ছে। দুজনকেই এর থেকে মুক্তি পেতে হবে। চয়ন থেকে রিফিউজ পেয়ে সেও কম করেনি। দুই পরিবারের সবার সামনে চয়নকে খারাপ বানিয়েছে। এর প্রতিশোধ চয়ন নিতে গিয়ে বিয়ে করেছে। যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছে, চয়ন তার স্বামী। এই সত্যটা অগ্রাহ্য করতে পারবে না সে। বিয়ের মতো সুন্দর আর পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা। কিছু ভুলবুঝাবুঝির কারনে এই সুন্দর বন্ধনটা তার শ্রী হারাচ্ছে। চয়ন মানুষটা খারাপ না, অনন্যার মত খারাপ মানুষ তাকে খারাপ বানিয়েছে। সে এবার সব ভুলে আবার নতুন জীবনের সূচনা করবে। চয়নের বন্ধ হওয়া মনের দরজায় কড়া নেড়ে নিজের জন্য ভালোবাসা জাগিয়ে নিবে। তারপর তার দেখা স্বপ্নগুলো একে একে পূরণ করবে চয়নের সাথে। এক বুক সাহস নিয়ে শপথ করে নতুন জীবনের।

রাতে চয়ন বাসায় ফেরার আগে ইউটিউব দেখে আর মাকে জিজ্ঞেস করে খিচুড়ি রান্না করে, সাথে ডিম ভাজা। জোবায়েদা বলছিল এটা নাকি চয়নের ভীষণ পছন্দ। চয়ন বাসায় ফিরে রুমে ডুকে দরজা দিয়ে দেয়। আধঘন্টা পর সুরলা দরজায় নক করে। একবার দুইবার তিনবার, দরজা খুলে না চয়ন। ঘুমিয়ে গেল নাকি!
সামান্য ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। এর মানে দরজা ভেজানো ছিল। গুটিগুটি পায়ে রুমে গিয়ে দেখে চয়ন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পুরো রুমটা এলোমেলো হয়ে আছে। এই বাসায় আসার পর থেকে আজ অবধি সুরলা চয়নের রুমে এলোমেলোভাবে একটা চিরুনীও পড়ে থাকতে দেখেনি। তার রুমটা সবসময় পরিপাটি থাকে। এত গোছালো স্বভাবের মানুষটা আজ কতটা অগোছালো হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগছে সুরলার। দেনামনা করে চয়নের রুম গুছিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ‘এটা কোথায় রাখব, ওটা কোথায় রাখব ‘ বলে চয়নের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চয়ন কোন উত্তর দেয় নি। চয়ন তার ভাবভঙ্গির পরিবর্তন না করে আগের মতো শুয়ে থাকে। সুরলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রুম গুছিয়ে চয়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
” রাতে খাবেন না?”

এবারও চয়ন কোন রিয়েক্ট করে না। সুরলা ফ্লোরে বসে। চয়ন শুয়েছে খাটের কিনারায়। সুরলা চয়নের মুখের কাছে বসেছে। এক হাত খাটে রেখে তার উপর থিতুনী রাখে। চয়নের কাধে হাত দিয়ে ডাকে,
“আমি জানি আপনি ঘুমান নি। উঠুন না? চলুন ডিনার করবেন।”

চয়ন তবুও নিশ্চুপ। সুরলা এবার কাধ ঝাকিয়ে জোরে বলে,
“মি.জুবায়ের আরেফিন আপনি কী উঠবেন নাকি আমি আপনার চুল টানা শুরু করব?”

এতক্ষণে ভাবভঙ্গী পরিবর্তন হয় চয়নের। চোখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় সুরলার দিকে। সুরলা মৃদু হাসে। সেই হাসি আর সুরলার গভীর দৃষ্টিতে চোখ আটকায় চয়নের। কুঁচকানো ভ্রু একবারেই কুঁচকে যায়। সুরলা হেসে চয়নের মাথায় হাত নেড়ে বলে,
“আপনাকে শায়েস্তা করার ওয়ে পেয়ে গেছি মি.। ভালোয় ভালোয় উঠুন, নয়তো চুল টানা খাবেন। এবার কিন্তু আমি আর মাসাজ করে দিব না। আমি আপনার পছন্দের খিচুড়ি রান্না করেছি, খাবেন চলুন।”

সুরলার আচরণ স্বাভাবিক ঠেকে না চয়নের কাছে। হুট করে এসে কী শুরু করেছে মেয়েটা! কুঁচকানো ভ্রু একবার প্রশস্ত হয়ে আবার কুঁচকে যায়। সুরলা চয়নের কপালে হাত দিয়ে কুঁচকানো কপালটা ঠিক করার চেষ্টা করে বলে,
“এত কপাল কুঁচকান কেন! কপাল কুঁচকাতে কুঁচকাতে এক সময় স্থায়ীভাবে কপাল কুঁচকে যাবে। তখন সবাই আমাকে ভ্রু ত্রুটির বউ বলে পঁচাবে। ব্যাপারটা কি ঠিক হবে বলুন?”

চয়নের চেহারায় বিস্ময় আর বিরক্তি খেলে যায়। সুরলা তার সাথে এত ভালোভাবে পেশ আসছে, ঘটনা কী! নিশ্চয়ই এর ভেতর কোন ঘাপলা আছে। চয়ন কপাল থেকে সুরলার হাত সরিয়ে বিরক্তিমাখা গলায় বলে,
” ডোন্ট ট্রাই টু টাচ মি।”

আত্মসমর্পণের মতো দুই হাত উঁচু করে সুরলা বলে,
” টাচ করব না। শুধু উঠে টেবিলে খেতে আসুন।”

“আমি খাব না। বিরক্ত করো না, যাও এখান থেকে।” কড়া গলা চয়নের। সুরলা গাল ফুলিয়ে বলে,
“এত কষ্ট করে আপনার জন্য খিচুড়ি রান্না করলাম, হাত ও পুড়িয়েছি দুই এক জায়গায়। অথচ আপনি খাবেন না!”

চয়ন উঠে বসে। চেঁচিয়ে বলে,
“আমি বলেছি খিচুড়ি রান্না করতে? বলিনি তো। নিজে রান্না করেছো, হাত পুড়েছো। এতে আমি কী করব? আমি যখন একবার বলেছি খাব না, তখন চলে না গিয়ে বিরক্ত করছো কেন? সমস্যাটা কী তোমার? আমাকে আমার মতো থাকতে চাচ্ছি, বুঝতে পারছো না তুমি? এসব ঢং করার মানে কী? আমার স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করছো? আবার শুরু করেছো আদিখ্যেতা। আবার কোন স্বার্থে ভালো সাজার চেষ্টা করছো বলো তো?”

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি স্বার্থন্বেষী? সব স্বার্থের জন্য করি?” প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলে সুরলা। চয়নের ক্ষিপ্ত উত্তর,
“শুধু তুমি নয়, তোমরা সব মেয়েরাই স্বার্থন্বেষী। স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করো না।”

আবারও অনন্যার কাজে তাকেই জাজ করছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রাগ হয় সুরলার। সেও ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“একজন স্বার্থন্বেষী ছিল বলে সবাই স্বার্থন্বেষী হয়ে গেল! একজন মানুষকে দিয়ে বাকি সবাইকে জাজ করা উচিত নয়। একজন খারাপ মানে সবাই খারাপ নয়। প্রাক্তনের কাছে ধোঁকা খেয়ে আপনি আমাকে ধোঁকাবাজ ভেবে আমার ভালোবাসা রিজেক্ট করেছেন। আমি দুটো কথা শুনালাম অমনি প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছেন। তারপর থেকে কোথাকার কোন ধোকাবাজ মেয়ের রাগ আমার উপর উঠাচ্ছেন। এখানে আমার দোষটা কোথায়? আপনি অন্য কারো কাজের সাজা আমাকে কেন দিবেন? আমাকে অনন্যা মনে করবেন কেন? অনন্যার কোন গুন আমার আছে? আমার জানামতে নেই। তারপর ও দিনের পর দিন আমি শাস্তি পেয়ে আসছি, ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে আসছি যেখানে আমার কোন দোষই নেই। ওই মেয়ে…

আর বলতে পারে না। তার আগেই চয়ন ওকে কাধ চেপে রাগত গলায় বলে,
“তুমি আমার অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছো? তোমার সাহস কী করে হয় এমনটা করার!”

আজ সুরলা ভয় পাবে না, কোনভাবেই না। তার দ্বারা চয়নের জীবন থেকে অনন্যার অধ্যায় মুছে নিতে হবে। তাই সে চয়নের রাগকে গায়ে না মাখিয়ে দায়সারা উত্তর দেয়,
” হ্যাঁ, অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি, তো কী করবেন আপনি?”
চয়ন সতর্ক করে বলে,
” আমি কী করতে পারি, তার ধারণা ও নেই তোমার। তাই ভালোয় ভালোয় বলছি নিজের মত থাকো, আমাকেও আমার মত থাকতে দাও। আমার কোন কাজে নাক গলাতে এসোনা। ভালো হবে না।”

“নিজের মতো থাকতে চাইলে আমাকে নিজের সাথে জড়ালেন কেন? বিয়ে করলেন কেন! কেন আমার জীবনটা নষ্ট করলেন। ”
“তোমার কী মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি? না, আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। রাগ আর জেদ বশত বিয়ে করেছি তোমায়। কেন জানো? তোমাকে তোমার ভাগ্য দেখাতে। যাকে খারাপ বলেছো, তার গলায় ঝুলেছো এটা প্রমাণ করতে। ” তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে চয়ন। সুরলা অদ্ভুতভাবে হেসে বলে,
” প্রতিশোধ নেয়া আর আমাকে আমার ভাগ্য দেখানো তো শেষ। এবার ডিভোর্স দিয়ে দিন? আপনি ও এক্সকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকার সুযোগ পাবেন, আমিও মুক্তি পাব।”

ডিভোর্সের কথা আসায় চয়ন চুপ করে যায়। সুরলা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে, চয়ন পরিবারের কথা ভেবে ডিভোর্সের কথা মাথায় আনতে পারে না। সে সুরলাকে নিজের কাছে রাখবে, কষ্ট ও দিবে। কিন্তু সুরলা যে সেটা হতে দিবে না। সুরলা হেসে বলে,
“ডিভোর্সের কথা বলতেই নিরবতা চাদরে গা ঢাকা দিলেন! বলুন? দিন ডিভোর্স? আমি পরিবারকে জানিয়ে দিই। এসব প্রতিশোধের নেশা ভালো লাগছে আর। বিশ্বাস করুন, আমি হাফিয়ে উঠেছি।”

চয়ন সুরলার হাত ছেড়ে বিছানা থেকে নামে, তারপর অন্যদিকে ফিরে গমগমে গলায় বলে,
“আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না, যাও এখান থেকে। দয়া করে আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। ”

সুরলা চয়নের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। চয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,
” ক’দিন আগে আপনাদের এলাকায় এক মহিলা তার সন্তানকে মেরে ফেলেছে। আপনি শুনেছেন সম্ভবত। ওই ঘটনা শোনার পর কি আন্টি উপর আমার ঘৃণা জন্মেছে? আন্টি আপনাকেও এভাবে মেরে ফেলতে পারে এটা মনে হয়েছে? উত্তর দিন। আমি চলে যাব এর পরই।”

সুরলার কথা বুঝতে পারে না চয়ন। রাগের মাঝেও ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চয়নের ভাবভঙ্গি দেখে সুরলা ধীর গলায় বলে,
“আপনার উত্তর সম্ভবত ‘ না’। কারণ আপনি জানেন এটা সম্পূর্ণ অর্থহীন ভাবনা। ওই মহিলা সন্তানকে মেরেছে বলে যে আন্টিও আপনাকে মেরে ফেলবে এমনটা কথা নয়। সবার মনমানুষিকতা সমান নয়। সেই মহিলার মন মানুষিকতার সাথে আন্টির মন মানুষিকতার মিল খোঁজা বোকামি। আপনার মা তেমনটা করতে পারেন না, কারণ তাকে আপনি জন্মের পর থেকে উদার আর কোমল হিসেবেই দেখে আসছেন, আপনাদের জন্য তার আত্মত্যাগ ভালোবাসা অনুভব করছেন প্রতিনিয়ত। ওই মহিলার কাছে এসব কোন গুন ছিল বলেই সে সন্তানকে মেরেছে। তার কাছে মনুষ্যত্ব ছিল না। দুজনের মিল সাজে না। ”

সুরলা থামে। তারপর চয়নের একটা হাত মুঠোবন্দি করে কোমল গলায় বলে,
“একের কাজ দিয়ে অন্যকে যাচাই করা উচিত নয়, সব মানুষ এক নয়। কেউ ভালো কেউ খারাপ। অনন্যা খারাপ ছিল, সে আপনার সাথে যা করেছে তা রীতিমতো অপরাধ। আপনার ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে সে। সে ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে তাই সবাই খেলবে এটা ভেবে আপনি জীবনকে থামিয়ে দিতে পারেন না। এতদিন অবধি আপনার আমাকে রিজেক্ট করার কারণ জানতে উৎসুক ছিলাম আমি। আপনার খারাপ হওয়ার পেছনে কারণটা জানতাম না বলেই হয়তো একটু বেশি রিয়েক্ট করেছি সব ব্যাপারে। এখন আমি আপনার অতীত জেনেছি, আমাকে অগ্রাহ্য করার পেছনে কারণটা ধরতে পেরে ক্ষমা করেছি আপনাকে। অতীতে আমাদের মাঝে থাকা সব দ্বন্দ্ব ভুলে গেছি। এখন সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চাইছি। আপনি কি অতীত ভুলে আমাকে সঙ্গ দিতে পারবেন?”

উৎসুখ চোখে উত্তরে আশায় চয়নের পানে চেয়ে থাকে সুরলা। চয়নের চেহারা থেকে রাগ, ক্ষোভ আর বিরক্তির আভা বিলীন হয়ে বিস্ময়ের আভা দেখা দেয়াটা চোখ এড়ায় না সুরলার। চয়নের বিস্ময় দেখে মৃদু হাসে সুরলা। বলে,
“জনাব, আপনার নিরবতাকে আমি সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিব?”

চয়ন সুরলার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চায়। সুরলা চয়নের হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল গুজে শক্ত করে ধরে। তারপর বলে,
“অতীত নিয়ে আর কত ভাববেন? এবার বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে ভাবুন। আমিময় চমৎকার একটা জীবন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আপনাকে। একটু মনের দরজাটা খুলে দিন, আমি কবে থেকে নক করছি। আপনার মনে আমার জন্য একটুখানি জায়গা হলেই হবে। এই যে দেখুন আপনার হাত ধরেছি, এই হাত এই বাধন ছাড়ব না। অনন্যার মতো আপনাকে ছেড়ে যাব না কখনো। হাতে হাত রেখে পাড়ি দেব জীবনের সব বসন্ত আর তান্ডব মাখা সব বৈশাখ। শুধু একবার আমাকে নিজের বাধনে বেধে নিন। ভালোবাসাটা এক তরফা থেকে দুই তরফা করে নিন। তারপর আপনাকে অনন্যার কথা মনে হতেই দিব না। প্রমিজ।”

চয়ন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে সুরলার পানে। এই মুহুর্তে তার কী বলা উচিত বা করা উচিত সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। এমন একটা ভরসার হাত কত হন্ন হয়ে খুঁজেছে তার ইয়াত্তা নেই। অনন্যাও তার ভরসার হাত হয়েই এসেছে। কিন্তু মাঝপথে ছেড়ে চলে গেছে। সুরলা যে তাকে ছেড়ে যাবে তার নিশ্চয়তা কী! আজকাল কাউকে বিশ্বাস করতেই ভয় হয় তার, আবার না ঠকে যায়। হুট করে কিছু বলে পারে না চয়ন। অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চয়নের ভাবুক চেহারায় উত্তর খুঁজে সুরলা। উত্তর তো অনেক দূরে, বিন্দুমাত্র সুত্রও পায় না। সুরলা কোমল সুরে বলে,
“এখনি উত্তর দিতে হবে না, আপনি ভাবুন আমার কথাগুলো নিয়ে। তারপর ভেবেচিন্তে উত্তর জানাবেন। ”

বাধন থেকে সুরলা নিজের হাত খুলে নেয়। সুরলার হাত ছেড়ে দেয়াটা পছন্দ হয় না চয়নের। তার মনে হয়, ভরসার হাত গুলো একবার ছুটে গেলে আর সান্নিধ্যে আসে না। চয়নের মন বলে এই হাত আকঁড়ে রাখো, মস্তিষ্ক জানান দেয় অতীতের ধোঁকার কথা। মস্তিষ্কের সর্তকীকরণের ফলে চয়ন তড়িৎ হাতটা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না। উত্তর নেতিবাচক হলে সে নিজেই এই হাত খুঁজে নিতে পারবে এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।
প্রসঙ্গ পালটে সুরলা বলে,
” আমি ডিনার করতে যাচ্ছি। ডিনার করার হলে জয়েন করুন।”

বলে চলে যায় সুরলা। চয়ন নিজেকে রিল্যাক্স করতে বারান্দায় চলে যায়। খাবার টেবিলে বসে চয়নের অপেক্ষা করে সুরলা। চয়ন আসে না। তার ও আর খাওয়া হয় না। বিষন্ন মনে রুমে ফিরে যায়।

.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে চয়নকে পায় না। তার ওঠার আগেই বেরিয়ে গেছে চয়ন। সুরলা চয়নের ফাঁকা রুমের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কাল নিজের সমস্ত সাহস ঢেলে চয়নের সামনে নিজের সব অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। সুরলা ভেবেছে তড়িৎ জবাব না দিলেও অন্তত চয়নের মাঝে বিন্দু বিন্দু পরিবর্তন আসবে। ঘুম থেকে ওঠে সে বুঝতে পারে তার ভাবনায় ভুল ছিল।

অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়ই অফিস থেকে ফিরেছে চয়ন। বাসায় ফিরে সবার আগে সুরলার রুমে যায়। সুরলা তখন জানালার ধারে বসে পড়ন্ত বিকেলের আকাশটা দেখছে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। সুরলাকে দেখামাত্র চয়ন বলে ওঠে,
“ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। হাতে একদম সময় নেই।”

আকস্মিক চয়নের আগমন এবং কথায় চমকায় সুরলা। বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকে চয়নের পানে। চয়নের উত্তর কী নেতিবাচক নয়তো? কোথাও এরজন্যই চয়ন তাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে না তো! চয়ন কী সত্যিই তাকে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবছে! মস্তিষ্কে বিচরন করা নানান ভাবনা সুরলার মনে আঘাত হানছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here