#ভোরের_আলো
পর্ব-৩
সকালে টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছে আশফাক। ও ঘুম থেকে উঠার আগেই রাত্রি বেরিয়ে গেছে। রিমন নাস্তা না করেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো অফিসের জন্য। বাঁধ সাধলো আশফাক।
– না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেনো?
– অফিসে খেয়ে নিবো।
– ঘরে নাস্তা থাকতে অফিসে কেনো খাবি?
– এমনি।
– দেখ অহেতুক মেজাজ দেখাবি না। আয় এখানে। আমার সাথে বসে নাস্তা খা।
– অহেতুক মেজাজ দেখাচ্ছি? তোমার কাছে এই ব্যাপারগুলো অহেতুক মনে হয়?
– রাত্রিকে কি আমি বিয়ে করবো? বিয়ে তো আর করবো না। তাছাড়া ওর প্রতি আমি বিন্দুমাত্র দুর্বল না।
– সমস্যাটা তো এখানেই। ওকে তুমি বিয়ে করবে না। ওর প্রতি তুমি দুর্বলও না। তাহলে ওকে বাসায় আনার মানে কি? ও এখন অন্য কারো বউ। একসময় মেয়েটা তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে। তারমানে তো এই না যে তুমি ঐ এক কাহিনী মনে ধরে বছরের পর বছরের বসে থাকবে। ঐ ঘটনার অলরেডি ১০-১২ বছর হয়ে গেছে। এখন তো তোমার মুভ অন করা উচিত।
– ওটা নিছক কোনো গল্প ছিলো না। রাত্রি হলো একটা গভীর ক্ষত দাগ। যেটা বুকে নিয়ে ঘুরছি ফিরছি ১৪ টা বছর ধরে। আজীবনেও এই দাগ মিটবে না।
রিমন এই ব্যাপারে কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। বিগত ছয় বছর ধরে এই একই কথা আশফাকের কানে ঘ্যানর ঘ্যানর করেই যাচ্ছে। আশফাক এক কানে ঢুকায় আরেক কান দিয়ে বের করে। কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে রিমন। পিছন থেকে কয়েকবার আশফাক ডেকেছে রিমনকে। ঘুরে তাকায়নি সে। নিজের মতো করে লিফটে করে নেমে এসেছে। মাঝেমাঝে আশফাকের এসব কাজকর্মে দম আটকে আসে রিমনের। তার ভাইয়ের সব দিক ভালো। বলা যেতে পারে সর্বগুন সম্পন্ন। কিন্তু এই মেয়ে মানুষের প্রতি নেশাটাই ছেলেটার সমস্ত গুনগুলোকে ঢেকে দেয়।
অফিসের জন্য মাত্রই বেরিয়েছে আশফাক। সে নিজেই ড্রাইভ করে অফিস যাচ্ছে। পল্টনে ওর অফিস। ফকিরাপুল মোড়টা পার হতেই রাস্তার একপাশে চোখ আটকালো আশফাকের৷ ঝালমুড়ি কিনছে অর্পিতা। পাশেই রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তা বসে আছে রিকশায়। খুব দ্রুত গাড়িটা একপাশ করে নিলো আশফাক। গাড়ি থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো সে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিলো অর্পিতা। সামনে থেকে কেও দৌঁড়ে আসছে টের পেলো সে। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো আশফাককে। মূহূর্ত্বে মুখটা কালো হয়ে গেলো অর্পিতার। ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে আশফাকের দিকে।
– দেখো, আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। গতকাল একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি আমার সাথে দুষ্টুমি করেছো। তাই আমিও তোমার সাথে দুষ্টুমি করেছিলাম৷
– আমি কেনো আপনার সাথে দুষ্টুমি করবো? আমি কি আপনাকে চিনি?
– সেটাই। তুমি তো আমাকে চিনো না। তাহলে দুষ্টুমি কেনো করবে? আসলে আমার বুঝার ভুল ছিলো। স্যরি।
– আপনি মানুষটা এমনিতেও ভালো না। এভাবে অপরিচিত কোনো মেয়ের দিকে কেও তাকিয়ে থাকে?
– অপরিচিত? কই অপরিচিত? আমার কাছে তো মনে হচ্ছিলো আমার খুব পরিচিত কেও। একদম আপন।
লোকটা আবার কাহিনী শুরু করেছে। মাত্রই না স্যরি বললো। মানে কি এসবের? অর্পিতা বেশ বিরক্ত এ ধরনের কথাবার্তায়। গতকালের মতো আজকে ফের চেঁচামেচি করার মুড নেই ওর। চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলো অর্পিতা।
– মামা, চলেন।
রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরাতেই রিকশার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো আশফাক৷
– কি আশ্চর্য! আপনি এমন কেনো করছেন?
– অর্পিতা বেশি না। যাস্ট দশ মিনিট দাঁড়াও। তোমাকে কিছু বলার আছে।
– শুনলামই তো কি বললেন।
– না। শুনোনি। আমার অনেক কথা বলার আছে৷ প্লিজ।
– আমি ভার্সিটিতে যাবো। কাজ আছে আমার। দেরী হয়ে যাচ্ছে।
– দেরী হবে না। শুধু দশ মিনিট।
গতকাল থেকে লোকটাকে বেশ গভীরভাবে দেখছে মুক্তা। হাবভাবে মনে হচ্ছে অর্পিতাকে ভালো লেগেছে। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায় লোকটা অর্পিতার প্রেমে পড়েছে। লোকটা দেখতে খারাপ না। কথাবার্তা, পোষাক-আষাক দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই। লোকটার কথা বলার ঢং বেশ সুন্দর। বিশেষ করে কন্ঠটা। একদম মনে ধরার মতো। ঐ কন্ঠে গালি দিলেও বোধহয় শুনতে ভালো লাগবে। লোকটা জান প্রান দিয়ে অর্পিতাকে রিকুয়েস্ট করছে তার কথা শোনার জন্য। আর অর্পিতা লাগাতার না করেই যাচ্ছে। মুক্তার মতে লোকটা কি বলতে চায় সেটা শোনা দরকার। ছেলে যদি বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে একটাবার খোঁজ নিতে তো দোষ নেই। সবদিকে ভালো হলে ওর বিয়েটাও নাহয় মামা মামী ঠিক করে রাখলো অথবা আকদ করে রাখলো।গ্র্যাজুয়েশনের পর নাহয় ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করা হবে। যেমনটা ওর বেলায় হয়েছে। এইতো মাসখানেক আগেই তো রাতুলের সাথে এংগেজমেন্টটা সেড়ে ফেলেছে মামা। আবিদ প্রস্তাব আনা মাত্র মামা আর দেরী করেননি। সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে নিলো রাতুলের। ভীষন পছন্দ হলো মামার। ব্যস দেরী না করে সব কথা পাঁকা করে ফেললেন। এবার অর্পিতার পালা। ওর একটা গতি হয়ে গেলে মামার মাথা থেকে চিন্তার ভার নেমে যাবে। অর্পিতাকে থামিয়ে মুক্তা বললো
– ভাইয়া আসলে আমাদের ইম্পরট্যান্ট নোট আনতে যেতে হবে। ভার্সিটি থেকে আসার সময় নাহয় আপনার কথা শুনবো। আপনি ফ্রি আছেন তো?
– হুম। আমি ফ্রি আছি। কতক্ষণ লাগবে তোমাদের ভার্সিটিতে?
– আমার সময় নেই। আমি কারো সাথে দেখা করবো না।
– উফ! অর্পি চুপ কর তো। কথা বলতে দে। এখন তো সাড়ে দশটা বাজে। আপনি একটার দিকে ইডেনের ২ নম্বর গেটের সামনে এসে দাঁড়াবেন। আমরা সেখানে আপনার জন্য ওয়েট করবো।
– তোমরা আমার সাথে কথা বলবে তো? মিথ্যা কথা বলছো না তো?
– বিশ্বাস করবেন কি করবেন না সেটা আপনার ইচ্ছা। তবে আমি মিথ্যা বলছি না।
– তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। ওখানে গিয়ে যদি তোমাদের না পাই তাহলে তোমাকে কল করবো।
– ০১৯*******।
অর্পিতার রিকশা এগিয়ে চলছে। আশফাক গাড়িতে উঠে বসেছে৷ অফিসের দিকে এগোচ্ছে ও। কিছু কাজ শেষ করতে হবে। ঘন্টাখানেক লাগবে। এরপর যাবে অর্পিতার সাথে দেখা করতে৷ মনে মনে হাসি পাচ্ছে আশফাকের। কি নাটক রে বাবা! একজন লাফাচ্ছে কথা বলবো না। আমি ছেলেদের পাত্তা দেই না। আরেকজন ইনডিরেক্টলি বুঝিয়ে দিলো এই প্রস্তাবে আমরা রাজি।
গতকালের আচরনটা মাথা থেকে ঝাঁড়তে পারছে না আশফাক। মগজে কিলবিল করছে প্রতিনিয়ত। নিজে সাধু সেজে আরেকজনকে খারাপ বানানো! ওর ধোয়া তুলসী পাতার ভাব ভালোমতো ছুটিয়ে দিবে এবার। বহুদিন হয় তুমুল প্রেম করা হয়নি কারো সাথে। রাত্রিকেই বোধহয় ১৪-১৫ বছর আগে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলো আশফাক। এরপর আর কাওকে সেভাবে ভালোবাসা হয়নি। ওরকম যত্নে আগলে রাখাও হয়নি। তবে এবার রাখবে। মিথ্যেমিথ্যি যত্ন করবে মেয়েটার। মেয়েটাকে সত্যিসত্যি প্রেমে ফেলতে হবে। তবেই না ওকে অপমানের শোধটা তোলা যাবে ঠিকমতো।
– তুই ঐ লোকটাকে দেখা করতে বললি কেনো?
– লোকটা তোকে পছন্দ করেছে। দেখতে শুনতে খুবই ভালো। কন্ঠ শুনেছিস উনার? একদম কানে আটকে থাকার মতো। যদি উনি প্রস্তাব দেয় তাহলে মামাকে বলবো খোঁজ নিতে।
– তুই যে ফোন নাম্বার দিলি ছেলে যদি বিরক্ত করে?
– করবে বলে মনে হয় না। দেখে তো মনে হলো না ঐরকম স্বভাবের। আর যদি বিরক্ত করে তাহলে ব্লক করে দিবো।
– লোকটাকে আস্কারা দিলি। এখন দেখিস কিভাবে বিরক্ত করে।
– পজিটিভলি সব কিছু দেখার চেষ্টা কর অর্পি। ভালোও তো হতে পারে।
(চলবে)