ভোরের_আলো পর্ব-৬

0
1092

#ভোরের_আলো
পর্ব-৬

প্রচন্ড মনোযোগ সহকারে অর্পিতার কথাগুলো শুনলো সায়েম। আশফাকের সাথে সম্পর্কে না জড়ানোর যুক্তিগুলোও শুনলো। অর্পিতা মুক্তা অপেক্ষা করছে সায়েম উত্তরে কি বলে সেটা শোনার জন্য। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসছে না। নীরবতা ভেঙে মুক্তা জিজ্ঞেস করলো

– কথা বলিস না কেনো?
– হুম।
– কি হুম?
– কিছু একটা বল না ভাই?
– অর্পিতা শোন
– হুম
– তুই যে উনাকে ভালোবেসে ফেলেছিস এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। যেহেতু তোর নজর আটকে গেছে উনার উপর তার মানে উনার মাঝে অবশ্যই কিছু না কিছু আছে। উনার প্রপোজালে রাজি হলে যে তোকে এখনই বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই তাই না? তুই উনার কাছ থেকে সময় নিতে পারিস দুই বছরের জন্য। আর কারো সাথে রিলেশনশীপে গেলে স্টাডি, বিজনেস ঠিকমতো কন্টিনিউ করা যায় না এগুলো তোকে কে বললো? মুক্তা কি করছে না? রাতুল ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। অথচ ওর তো স্টাডি বিজনেসে কোনো সমস্যা হয়নি। তুই তোর রিলেশন, বিজনেস, স্টাডি কিভাবে ব্যালেন্স করবি সেটা পুরোটা ডিপেন্ড করবে তোর উপর। ভালো ছেলে সবসময় পাওয়া যায় না। মুক্তার কথা শুনে মনে হচ্ছে ছেলে ভালো। তবে এক দেখাতে তো আর মানুষ চেনা যায় না। তুই উনার সম্পর্কে খোঁজ নে। উনার সাথে ভালোভাবে কথা বল। কি করে, কোথায় থাকে, উনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সব খবর নে। এরপর নাহয় তুই নিজে সিদ্ধান্ত নে উনার সাথে রিলেশনে যাওয়া যায় কি না। গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর। বিজনেসটা আরো বড় হোক৷ উনার সাথে রিলেশনটা কন্টিনিউ রাখলি। যদি বড়মা আর চাচ্চুকে না বলতে চাস তাহলে এখন কিছু বলিস না। সময় হলে নাহয় জানাবি।
– রিলেশনে যেতে বলছিস?
– হুম৷ ছেলে ভালো হলে সমস্যা কোথায়?
– সায়েমের কথায় যুক্তি আছে অর্পি। তুই উনার সাথে কথা বলে দেখ।
– হ্যাঁ। তুই কাল উনাকে মিট করতে বল৷ মুক্তাকে সাথে নিয়ে ভালোমতো সব জেনে আয়।
– অর্পি, আশফাক ভাই না এটা?
ঘাড় ঘুরিয়ে নিচে তাকিয়ে অর্পিতা দেখতে পেলো আশফাক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এতরাতে উনি এখানে কেনো? ওপাশ থেকে সায়েম শুনতে পেলো মুক্তার কথা। খানিকটা অবাক হলো সায়েম। রাত তো অনেক হয়েছে। এগারোটার উপর বাজে। এতরাতে লোকটা চলে এলো বাসার সামনে। ওপাশ থেকে বেশ উৎসুক কন্ঠে সায়েম জিজ্ঞেস করলো
– কি রে? উনি এখানে এসেছে নাকি?
– হ্যাঁ চলে এসেছে।
– হা হা, ইন্টারেস্টিং তো। অর্পি কি দেখেছে উনাকে?
– হ্যাঁ। হা হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ভূত দেখছে।
– ফুল-টুল নিয়ে এসেছে নাকি?
– নাহ। খালি হাত তো।

অর্পিতার নাম্বারে কল দিলো আশফাক। নিচে থেকে ইশারা করছে কলটা রিসিভ করার জন্য। ফোনটা বাজতেই হুড়মুড় করে রিসিভ করলো অর্পিতা। আশফাক কি বলতে চায় সে কথা শোনার জন্য বড্ড তাড়া ওর।

– এই মেয়ে..
– হুম
– নিচে আসো।
– কেনো?
– কিটক্যাট এনেছি তোমার জন্য।
– আমি কি আনতে বলেছি?
– তুমি না বললে কি আমি তোমাকে কিছু কিনে দিতে পারি না?
– কেনো কিনে দিবেন আমাকে? কি হই আমি আপনার?
– অনেক কিছু।
– যেমন?
– বউ শব্দটার মানে বুঝো?
– নাহ।
– বুঝিয়ে বলা সম্ভবও না। পুরোটাই অনুভবের বিষয়। যদি সুযোগ দাও তো অনুভব করাতে পারি।
– কেনো হবো আমি আপনার বউ?
– কেনো হবে না? আমি দেখতে ভালো না তাই?
– হতে পারে।
– শোনো মেয়ে, ভালোবাসাটা বুঝার চেষ্টা করো। অনুভব করার চেষ্টা করো।
– যদি না করি?
– করবে কি করবে না সেটা পরের ব্যাপার। আগে তুমি নিচে আসো। দূর থেকে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
– কাছে এসে কথা বলার দরকারটা কি?
– আমি এতরাতে বাসা থেকে চলে এসেছি এখানে তোমার সাথে দেখা করার জন্য। আর তুমি ছাদ থেকে নিচে নামতে পারছো না?
– না। পারছি না।
– তাহলে আমি বাসায় আসি?
– একদম না।
– তাহলে তুমি আসো।
– না।
– ঠিকাছে। কি আর করা? আমিই আসছি।
আশফাক অর্পিতাদের বাড়ির গেইটের দিকে এগোচ্ছে। অর্পিতা দেখতে চাচ্ছে লোকটা কি আসলেই গেইট পর্যন্ত আসার সাহস আছে নাকি এমনিই মুখে মুখে বুলি শোনাচ্ছে। গেইটে এসে সত্যিই ধাক্কা দিলো আশফাক। অর্পিতা বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
– আরে থামুন। সরে যান এখান থেকে প্লিজ। আমি বের হচ্ছি।
মনে মনে হাসলো আশফাক। মেয়েটা ভেবেছিলো ও দরজায় ধাক্কা দিতে পারবে না। চোখের পলকে সেখান থেকে বলতে গেলে উধাও হয়ে গেলো সে। দারোয়ান টুনু গেট খুলে আশপাশে তাকিয়ে দেখলো কেও নেই। সে আবার গেট লাগিয়ে গানতে শুনতে লাগলো।
মুক্তার হাত ধরে অর্পিতা বললো
– মুক্তা, সত্যিই বাসায় চলে আসবে।
– এতরাতে নিচে যেতে চাচ্ছিস?
– তো কি করবো?
– পাখি ড্রইংরুমে টিভি দেখছে। টুনু ভাই তো গেটেই বসে আছে। বের হবি কিভাবে?
– পিছনের ছোট গেট?
– লক করা। চাবি কোথায় আছে?
– জানি না।
– আমিও তো জানি না।
– বোধহয় আম্মুর চাবির গোছায় আছে।
– মামি তো চাবির গোছা তো ওয়্যারড্রবে রেখে ঘুমায়।
– চল বের করি।
– যেকোন একজন যাই।
– তুই যাবি?
– না। তুই যা।
– আচ্ছা। তাহলে উনাকে কল করে বল পিছনের দরজা দিয়ে আসতে।
– আচ্ছা বলছি। সাবধানে যা। ধরা টরা পড়িস না।
অর্পিতা প্রচন্ড সতর্কতা নিয়ে পা টিপে এগিয়ে যাচ্ছে বাবা মায়ের রুমে। ঘুমুচ্ছেন উনারা। খুব ধীরে দরজাটা খুলতে হবে।
বাহিরে ফোন হাতে অপেক্ষা করছে মুক্তা। প্রচন্ড ভয় লাগছে ওর। মনে হচ্ছে এই বুঝি ধরা পড়ে গেলো। পিছন থেকে অর্পিতা কাঁধে হাত রাখতেই লাফিয়ে উঠলো মুক্তা।
– কি রে? ভয় পেলি নাকি?
– আরে ভয় লাগছে খুব৷ ধরা না আবার পড়ে যাই।
– আমারও ভয় লাগছে৷ কি করবো তাহলে? উনাকে না করে দেই?
– বাসায় যদি চলে আসে।
– আচ্ছা আয়। ধরা পড়লে পরেরটা পরে দেখা যাবে।
পিছনের দরজার সামনে পায়চারী করছে আশফাক। ওপাশ থেকে লোহার টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তালা খুলছে কেও।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অর্পিতা আর মুক্তা। ছয় সাত হাত দূরে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। আবছা বাতিতে আশফাককে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অর্পিতাকে দেখা মাত্রই পকেট থেকে চকলেট বের করে এগিয়ে দিলো আশফাক।
– এটা কি?
– চকলেট।
– লাগবে না। কি বলবেন জলদি বলেন।
– আগে চকলেট নাও। এরপর কথা বলবো
– আপনি আমার নিজের কেও না। নিজের মানুষ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আমি কিছু খাইনা।
– আমি কি তোমার নিজের না?
– না।
– তুমি আমাকে আপন ভাবো না। আর আমি পাগল তোমাকে একান্ত আপন ভেবে বসে আছি।
– আমি বলেছি ভাবতে?
– আমাকে আপন করতে ইচ্ছে হয়না?
– না।
– তুমি জানো মেয়েরা আমার কন্ঠ শুনলেই পাগল হয়ে যায়। কত মেয়ে ফোন করে বলে ভাইয়া জাস্ট পাঁচটা মিনিট কথা বলবো। আমি ওদের কাওকে পাত্তা দেই না। আর তোমার সাথে সেধে কথা বলতে আসি। সেই তুমি কি না বলছো আমার কন্ঠ শুনলে নাকি কান পঁচে যায়।
– অনেক মেয়ে আপনাকে ফোন দেয়?
– হুম দেয় তো।
– ওহ্!
– মন খারাপ হয়ে গেলো মনে হচ্ছে?
– আজব! মন খারাপ হবে কেনো? আপনি কি আমার প্রেমিক নাকি?
– তাহলে চেহারার রঙ উড়ে গেলো যে?
– উড়তে যাবে কেনো? রঙ ঠিকঠাকই আছে। আপনি ভুলভাল দেখছেন।
– আশফাক ভুল দেখেনা।
– ভাইয়া, আসলে অনেক রাত হয়েছে তো। কেও দেখলে ঝামেলায় পড়ে যাবো৷ কথা জলদি শেষ করুন প্লিজ।
– তোমার বোনকে বলো চকলেটটা নিতে।
– চকলেটটা নে তো অর্পি।

হাত বাড়িয়ে চকলেটটা নিলো অর্পিতা।
– খাও।
– এখন?
– হ্যাঁ।
– বাসায় যেয়ে খাই।
– না এখনি।
– অর্পি বাসায় যেতে হবে৷ জলদি খাওয়া শুরু কর। মামা দেখে ফেললে ঝামেলা হবে।
প্যাকেট খুলে দু’কামড় চকলেট খেতেই অর্পিতার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিলো আশফাক। অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আশফাকের দিকে। মুক্তা জিজ্ঞেস করলো
– আপনি না বললেন খাওয়ার জন্য?
– হ্যাঁ। এখন বাকিটা আমি খাবো।রাত অনেক হয়েছে। যাও, বাসায় যাও।
অর্পিতা মুক্তা হুড়মুড় করে আবার গেটের ভিতর ঢুকে তালা আটকে দিলো। ঘরের ভিতর যেতেই ফোন করলো আশফাক।
– আবার কি চান?
– কাল বিকেল পাঁচটায় আমরা মিট করছি।
– কেনো?
– কেনো টেনো বুঝি না। তুমি আসছো এটাই ফাইনাল৷
– আমার কাজ আছে।
– সেসব আমি শুনতে চাই না৷ সব কাজ বাদ। আমি তোমার সাথে বাহিরে বসে কথা বলবো এটাই শেষ কথা। খুব বেশি না। দু’ঘন্টা সময় দিলেই হবে।
– আচ্ছা দেখি।
– দেখি না। তোমাকে আসতেই হবে।
অর্পিতার আরেকটা ফোন বাজছে। আরাফাত ফোন করেছে। এই ফোনটার কথা কেও জানে না। ফোনটা কেনা হয়েছিলো শুধুমাত্র আরাফাতের জন্য। কলটা রিসিভ করতে হবে এক্ষুনি। আশফাকের কথার উত্তর না দিয়েই কেটে দিলো অর্পিতা। আরাফাতের ফোন রিসিভ করেছে সে।
– হ্যা… হ্যালো আরাফাত
– তুমি কি কোনো কারনে আপসেট অহনা?
– কই না তো?
– তাহলে সারাদিন কোথায় ছিলে?
– একটু ব্যস্ত ছিলাম।
– আমাকে কি একটা কল করারও সময় পাওনি তুমি?
– সত্যিই ব্যস্ত ছিলাম।
– কতবার কল করেছি৷ তোমার সাথে কথা না বলতে পারলে আমি কাজে মন দিতে পারি না জানো না?
– স্যরি।
– সত্যি করে বলো তো, আমার সাথে কি তুমি রাগ করেছো?
– নাহ। সত্যিই কিছু হয়নি। বাসায় গেস্ট ছিলো তো। তাই ব্যস্ত ছিলাম আরকি।
– আই লাভ ইউ৷ ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করো।
– বুঝি তো।
– তাহলে কথা না বলে আমাকে এভাবে কষ্ট দাও কেনো?
– আর হবে না এমন৷ সত্যি বলছি।
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here