#ভোরের_আলো
৪৫.
– তুমি প্রচুর অগোছানো একটা মানুষ। যখনই বাসায় আসি তখনই দেখি কাপড় চোপড় এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখো। কেন?
ল্যাপটপে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছিলো আশফাক। অর্পিতার চেঁচামেচিতে মাথা তুলে তাকালো অর্পিতার দিকে।
– তুমি গোছাবে এজন্য এলোমেলো করে রাখি।
– তুমি তো মনে হচ্ছে আমাকে অনেক জ্বালাবে!
– হ্যাঁ জ্বালাবো। একদম কলিজা ভুনা করে ফেলবো। এখনও সময় আছে পালাও।
– পালাতে দিলে কোথায়? কোনো রাস্তা আছে কি? বিয়ের দুদিন পর এসে যদি বলো পালিয়ে যাও তাহলে পালাবো কি করে?
– তাহলে আমার জ্বালা সহ্য করো।
– তবে অবশ্য বুদ্ধিটা মন্দ দাওনি৷ বেশি জ্বালা যন্ত্রণা দিলে উধাও হয়ে যাবো। আমাকে আর খুঁজেও পাবে না।
কথাটা শুনে সোফা ছেড়ে উঠে এলো আশফাক। পেছন থেকে অর্পিতার কোমড় আঁকড়ে ধরলো। অর্পিতার পিঠের অংশটুকু লেপ্টে নিলো নিজের বুকের সাথে।
– কোথায় যেনো যাবে বলছিলে। যাও তো দেখি।
– আমি তো বলিনি এখন যাবো।
অর্পিতার ঘাড়ের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে এসেছে আশফাক। ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব পাচ্ছে অর্পিতা। নিঃশ্বাস ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে৷ পুরো শরীর জুড়ে অবশ অনুভূতি হচ্ছে। আশফাকের গায়ের উপর শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে চোখ বুজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। অর্পিতার কোমড়টা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেছে আশফাক। অর্পিতার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– এখন যাবে না তো কখন যেতে চাচ্ছো?
– পরে। যখন তোমার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হবো তখন।
– আমি যে ছাড়ছি না।
– আমিও চাই আমাকে তুমি আঁকড়ে ধরো। আরো শক্ত করে…..
অর্পিতার গায়ের ওড়নাটা টান দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। চোখের পলকে খুব দ্রুত নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো অর্পিতাকে৷ এখনও চোখ বুজে আছে সে। তার গালে হাত রাখলো আশফাক। বললো,
– যদি কখনো জানতে পারো আমি খারাপ? আমি তোমার সাথে শুধু ভালোবাসার নাটক করেছি। তখনও কি তুমি বলবে তোমাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে?
– এমনটা কখনো হতেই পারে না।
– যদি হয়?
– হবে না। আমি জানি। আমার ভালোবাসায় খাঁদ থাকতে পারে। কিন্তু তোমার ভালোবাসায়? অসম্ভব।
– তোমাকে আমি মাঝেমাঝে বুঝতে পারি না অর্পি।
– বুঝতে পারো না মানে?
অর্পিতার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে আশফাক বললো,
– কিছু না।
– তুমি যখন আমার নামটা ধরে ডাকো তখন মনে হয় যেনো জগতের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বুঝি তুমি আমাকে ডাকছো। তোমার সামনে এসে দাঁড়ালে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে৷ হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য। নিজের উপর আর নিজের কোনো ক্ষমতা থাকে না। কোথায় যেনো হারিয়ে যাই। আচ্ছা তুমি কি হিপনোটাইজ করতে পারো?
– হা হা হা,,,,, কি বলো পাগলের মতো কথাবার্তা! আমি হিপনোটাইজ করবো কিভাবে?
– তাহলে তোমার সামনে দাঁড়ালে আমি এমন হয়ে যাই কেনো?
– আশফাক!
কাঁধের উপর কারো স্পর্শ পেয়ে ঘোর কাঁটলো আশফাকের। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে কৌশিকের মা দাঁড়িয়ে আছে৷ শূন্যচোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আশফাক। চোখে মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। ফ্লোরে অনেকগুলো সিগারেটের শেষাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেইসাথে সিগারেটের ছাইগুলোও। আশফাকের মাথার উসকোখুসকো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে রাজিয়া বললেন,
– সারারাত ঘুমাসনি তাই না?
ডানে বামে মাথার নেড়ে নিশ্চুপ উত্তর দিলো আশফাক৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে গেলেন রাজিয়া৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে থাকা টুলটা নিয়ে এসে আশফাকের পাশে বসলেন। আশফাকের পিঠে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– ফজরের নামাজ শেষ করলাম মাত্র। পানি খেতে এসেছিলাম এদিকে৷ ঘরের দরজাটা খোলা ছিলো। ভাবলাম একটু দেখে যাই তোরা কি করছিস।
– ওহ্।
– এই ঠান্ডার মধ্যে সারারাত এখানেই বসে ছিলি?
– হুম।
-ওর ফ্যামিলি তো মেনে নিয়েছে। এখনো কি চিন্তা করছিস?
– খালাম্মা?
– হুম?
– আমি অনেক খারাপ তাই না?
– কেনো রে বাবা?
– আমি আসলে কারো ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত না৷
– এসব কেনো বলছিস?
– এজন্যই তো বাবা মা কখনো আমাকে আগলে ধরেনি৷ রাস্তার কুকুরের মত দিন কাটিয়েছি৷ যে আগলে ধরলো তাকে আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে পৌঁছিয়েছি। ও মারা যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। চেষ্টাও করেছে। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এ ধরনের কাজ করতে পারে? আমি ওকে ওর মত করে কখনো ভালোবাসিনি। তবু ওর এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনা৷ মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি বুঝি দম আটকে মারা যাচ্ছি৷ ও তো আমাকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছে৷ এতখানি ভালোবাসার পর যখন ও আমাকে আরেক মেয়ের সাথে ঐ অবস্থায় দেখেছে তখন ওর কেমন লেগেছে? আমি যদি আজ ওকে অন্য কারো শুধু হাতটা ধরে হাঁটতে দেখি সেটাই তো আমার সহ্য হবে না৷ হয় ওকে মারবো আর নয়তো আমি নিজে মরে যাবো৷ সেখানে ও আমাকে,,,,, আর ভাবতে পারছি না৷ মাথাটা ঝিমঝিম করে আমার। ভালোই হয়েছে বাবা মা আমাকে ভালোবাসেনি৷ বাসলে হয়তো ওদেরকেও কষ্ট দিতাম।
– ভুল তো মানুষেরই হয় তাই না?
– আমার বউ একটা বোকা৷ আসল নকলের পার্থক্য বুঝে না৷ আমার মত একটা পিশাচকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। আর আমি যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই মূল্যায়ন করতে পারিনি। ওর মতো করে কেও আমাকে কখনো আমাকে ভালোবাসেনি৷ কেও না৷ আমার মাঝে ডুবে গিয়েছিলো মেয়েটা৷ আমি ছাড়া কিছু বুঝতো না।
– একটু শান্ত হওয়ার চেষ্টা কর। এভাবে তো তুই কষ্ট পাচ্ছিস রে বাবা৷ যা হয়ে গেছে তা কি আমরা কেও বদলাতে পারবো?
– হ্যাঁ, কষ্টে আছি। ঠিক কতটা কষ্টে আছি তা কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। সবাই বাহিরটুকুই দেখছে৷ ভিতরে কোন আগুন জ্বলছে সেটা কেও দেখছে না৷ আমার বউ পর্যন্ত না৷ এই মেয়েটা আগে আমার মুখ দেখলেই বুঝে যেতো আমার মন খারাপ। আর এখন ওর সামনে কেঁদেও কোনো ফায়দা হয় না৷ ওকে আমি বুঝাতেই পারিনা কতটা কষ্টে আছি।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিলো আশফাক ৷ বাহিরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে৷ দুই ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে কাঁদছে। চুপচাপ আশফাকের চোখের কোন বেয়ে পড়া পানিগুলোকে দেখছেন রাজিয়া। তার চোখজোড়াও ছলছল করছে।
কিছুক্ষণ বাদে আবার বলতে শুরু করলো আশফাক,
– আমার জায়গায় কেও দাঁড়িয়ে নেই। ওর ভালোবাসাটা কেও পায়নি। পেয়েছি আমি। সেই ভালোবাসার অনুভূতিগুলো একান্তই আমার। সেই ভালোবাসা হারিয়েছি আমি। আপনারা কেও হারাননি। কষ্টটা কেও বুঝবেন না৷ জগতে কারো উজাড় করা ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে ফেলার চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে খালাম্মা? এরচেয়ে বিষাক্ত অনুভূতি আর কি থাকতে পারে? বিশেষ করে আমার মতো মানুষের ভাগ্যে ভালোবাসা এসে যখন ধরা দেয় আবার নিজ দোষে যখন সেটা হারিয়ে ফেলি তখন? আমার এখনকার অনুভূতিগুলো কি কেও বুঝবে? অর্পিতা বুঝবে? আমি কি বুঝাতে পারবো? সম্ভব না।
-একটু ধৈর্য্য ধর বাবা৷ বউ তো আসছে ঘরে৷ ধীরে ধীরে দেখবি বউ তোকে আবার আপন করে নিবে।
– ধৈর্য্যই ধরতে পারছি না। ও আবার আমাকে আগের মত ভালোবাসবে কবে থেকে? আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না৷ বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে। অসহ্য যন্ত্রণা হয় আমার। এই মেয়েটাকে আমি সবসময় হাসিখুশি দেখেছি। এখন ও একটা জীবিত লাশের মত ঘুরাফেরা করে৷ গায়ের রঙ কেমন কালচে হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। এই কয়দিনেই অর্ধেক শুকিয়ে গেছে। ওকে দেখলে নিজেকে আধমরা লাগে৷ মনে হয় আমার গলা কেও টিপে ধরেছে। কি করলাম আমি এটা? কেনো করলাম? ওকে আমি শেষ করে দিলাম খালাম্মা? আমার বউ শেষ।
নিজের মাথার চুলগুলো দুহাতের মুঠোয় ভরে টানছে সে। আশফাকের একহাত ধরে আটকালেন রাজিয়া৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
– বউকে তো ভালোবাসিস। ভালোবাসতে থাক৷ ভালোবাসা দিয়ে একটু একটু করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাক৷ কতদিন ও তোকে দূরে সরিয়ে রাখবে বলতো?
– ওর ভালোবাসা আর আমার ভাগ্যে নেই খালাম্মা। ও আর আমাকে ভালোবাসে না।
– কে বললো তোকে? হুম? এত ভালোবাসা কি একদিনেই ফিকে হয়ে যায় রে? ও তোকে এখনও ভালোবাসে৷ রাগ আর কষ্টের দেয়ালে ভালোবাসা চাপা পড়েছে৷ দেয়ালটা একটু একটু করে ভেঙে ফেল। দেখবি ভোরের আলোর মতো ওর ভালোবাসাটাও একটু একটু করে তোর মনের ঘরে আলো ছড়ানো শুরু করবে৷
– হতাশ লাগে খুব। কোনোদিন কি ও আমার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে?
– তোর মত ছেলের মুখে এসব কথা মানায় না আশফাক। যেই ছেলে ঐরকম বাজে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে তার মুখে হতাশার গল্প মানায় না।
– পরিস্থিতি তো এক না৷ তখন আমার মনে জোর ছিলো। কারন তখন আমার কোনো অপরাধ ছিলো না৷ এবার অপরাধী আমি৷ ও দূরে চলে যাওয়ার পর থেকে আমার সমস্ত মানসিক শক্তি শেষ। ওর দিকে তাকালে আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। আমার আগের অর্পিতা আমি ফেরত চাই। এসব ধৈর্য্য ধরা আমার দ্বারা সম্ভব না৷ এতদিন ও আমাকে পাগলের মত ভালোবেসেছে৷ আমাকে এখনও পাগলের মতই ভালোবাসতে হবে৷ আর নয়তো আমিই পাগল হয়ে যাবো।
(চলবে)