ভরসার_দুহাত পর্ব_২০

0
345

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২০

পরেরদিন রাশিদ খান, টগর, বনি ও মোবিনকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোর্টে মা বাবা ও বশির এসেছে। শাফিয়া, রেনু ও বুরাক বাসায়। বুরাক আসতে চেয়েছিল কিন্তু মা বুরাককে বলেছে শাফিয়া আর রেনুর খেয়াল রাখতে। বুরাক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। শাফিয়া প্লেটে খাবার নিয়ে এসে বুরাককে ডাকলো। বুরাক আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল-
“আপু, বর্ষা আর আসবে না তাই না?”
শাফিয়া একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছাড়লো। রেনুকে খেতে বলে সে বুরাকের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বুরাক শাফিয়ার উপস্থির টের পেয়ে শাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“কোর্ট যদি তাদের শাস্তি না দিতে পারে আমি নিজে ওদের শাস্তি দিব।”
“এটা সম্ভব না বুরাক। দোয়া কর যাতে কোর্ট তাদের ফাঁসির আদেশ না দিলেও যাবতজীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়।”
বুরাক জবাব দিলো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
“আচ্ছা এখন কিছু খেয়ে নে। আমি নিজের হাতে তোদের জন্য পরোটা বানিয়েছি। তুই না করতে পারবি না কারণ না বললেই আমি জোর করে খাওয়াবো।”
বুরাক জোরপূর্বক মুসকি হাসলো। শাফিয়া বুরাকের হাত ধরে নিয়ে এসে রেনুর পাশে বসালো।
“এখন তোরা খেয়ে নে। ফুপারা ২/৩ ঘন্টার মধ্যে এসে পরবে। উকিলের কাছে সব প্রমাণ আছে। আসামীরা এত সহজে পাড় পাবে না।”

মাগরিবের আযান চারপাশে ভাসছে। দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। বুরাক আর রেনু বসে কথা বলছিল। আর শাফিয়া রান্নাঘরে ছিল। দরজার শব্দ পেয়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখে বশির ও মা বাবা দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেহারায় বেদনার ছাপ। বশির মাকে ধরে ভেতরে ঢুকলো। বুরাক সবাইকে দেখে উঠে দাঁড়াল। মাকে বসিয়ে বশির হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা ভেতরে ঢুকতেই শাফিয়া দরজা খুলে এগিয়ে আসলো।
“কী হয়েছে? কোর্ট কী ডেট এগিয়েছে?”
বশির ধপ করে বসে পরলো মাটিতে। বাবা গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। বশির হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফেলল। শাফিয়ার হাত পা কাঁপছে পরিস্থিতি দেখে। সে বশির পাশে হাঁটু গেড়ে বলল-
“কী হয়েছে? তোমরা চুপ থাকলে আমরা বুঝবো কী করে কি হয়েছে?”
হঠাৎ বশির চিৎকার করে উঠলো। শাফিয়া ভয়ে মাটিতে বসে পিছিয়ে গেল। বশির নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। বাবা মা দুজনই নিঃশব্দে কাঁদছে। শাফিয়া দ্রুত বশিরকে ধরে বলল-
“কী হলো বশির কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো প্লিজ।”
“আমার বোনের আসামীদের আমি শাস্তি দেয়াতে পারি নি। খালিদ খানের উকিল কোথা থেকে যেন এক নেশাখোরকে ধরে নিয়ে এসেছে। সেই নেশাখোর সবার সামনে বলেছে যে সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বর্ষার মাথায় কাঁচের বোতল মেরেছে।”
“মা..মানে?”
“মানে বুঝো না তুমি? রাশিদ খান, টগর, মোবিন, বনি চারজনই নিষ্পাপ খালাস হয়েছে। আর সেই নেশাখোর যাবতজীবন কারাদণ্ড পেয়েছে।”
বলেই বশির আবার হাউমাউ করল কাঁদতে লাগলো। চারপাশে শুধু কান্নার শব্দ ভাসছে। কারো মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। বাবা চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল।
“আমি গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। ডাক্তার কল দিয়ে বলেছে বর্ষাকে যত দ্রুত সম্ভব কবর দিতে।”
বলেই বাবা চলে গেল। বুরাক দাঁড়িয়ে বশিরের দিকে হেটে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। বুরাক তার কাঁপা কাঁপা হাত বশিরের হাতে রাখতেই বশির মাথা তুলে তাকাল। বুরাককে দেখে দ্রুত দাঁড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলল-
“বলেছি না আমার কাছে না আসতে? অনুরোধ করছি আমার সামনে বার বার আসিস না।”
বুরাক দাঁড়িয়ে বলল-
“ভাইয়া, ওদের নাম কি বললে?”
“কি করবি তুই জেনে? গিয়ে শাস্তি দিবি তাদের? আরে তুই তো সাহায্য করেছিস ওদের। তুই বর্ষাকে ধাক্কা না দিলে ওদের হাতে আমার বোন খুন হতো না।”
“ভাইয়া বর্ষা কুকুর খুব ভয় পায়। কুকুর আমাদের দিকে দৌড়ে আসছিল তাই আমি ওকে সরিয়েছি। ভুলে ধাক্কা লেগেছে ভাইয়া সত্যি বলছি।”
“তোর এসব কথা আমি আর শুনতে চাই না। যা এখন আমার সামনে থেকে।”
“ভাই…”
“যা বলছি”
বশিরের ধমক শুনে বুরাক চুপসে গেল। শাফিয়ার ভীষণ মায়া হলো বুরাককে দেখে। বশির এই ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল। শাফিয়া বুরাককে বসতে বলে বশিরের কাছে আসলো। বশির জানালার পাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। শাফিয়া বশিরের দিকে হেটে গিয়ে বলল-
“আর শাস্তি দিবে বুরাককে? বুরাক তো বলেছে সে কেন ধাক্কা দিয়েছে বর্ষাকে। সে যদি জানতো বর্ষার এত বড়ো ক্ষতি হবে সে কি ধাক্কা দিতো বলো?”
বশির জবাব দিলো না। শাফিয়া আর একটু এগিয়ে গিয়ে বশিরের দিকে তাকাল। বশির চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। শাফিয়া বশিরের হাত শক্ত করে ধরে বলল-
“মাফ করে দাও বুরাককে।”
বশির ধীরে ধীরে চোখ তুলে আকাশের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। শাফিয়া জানে বশির বুরাকের উপর রাগ না। রাগ সেই অপরাধীদের উপর। সময়ের সাথে সাথে তার রাগও চলে যাবে।

গ্রামে যাওয়ার জন্য তারা সবাই বাসা থেকে বের হলো। বুরাকের বাবা তার বন্ধুর সাথে কথা বলে ট্রাকের ব্যবস্থা করেছে৷ বর্ষার লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যাবে তারা। আর তারা গাড়ি করে যাবে।বুরাক পলকহীন দৃষ্টিতে কাফনের কাপড়ে বাঁধা বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে বিষয়টা। সত্যি কি তার বোন আর ফিরে আসবে না? বাবা পানি কিনে নিয়ে এসে শাফিয়ার হাতে দিয়ে বলল তার ফুপিকে দিতে। বুরাকের দিকে চোখ যেতেই উনি লম্বা নিশ্বাস ফেলল। বুরাক মায়ের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। মা কেমন মনমরা হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশে কি হচ্ছে কোন কিছুর খেয়াল নেই তার। শাহরিয়ার শাহ এর বন্ধু বললেন-
“শাহরিয়ার, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন সব ভুলে যা। তোর আরও দু’টো সন্তান আছে। তাদের কথা ভেবে খালিদ খানের কথা ভুলে যা।”
“সে আমাকে হুমকি দিয়েছে আবার কেস করার কথা ভাবলে আমার পরিবারের ক্ষতি করবে। আর আমি জানি আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই এসব বলেছে।”
“হ্যাঁ আমি জানি, তবুও বলছি ভুলে যা।”
“আমি আর কখনো এই শহরে ফিরবো না। কোর্ট থেকে বলেছে আমাদের আর ঢাকায় না আসতে। আমি বুঝলাম না শহরে আসতে না কেন বলল?”
“এটা খালিদ খান টাকা দিয়ে করিয়েছে। সে ভাবলো তোরা যদি ঢাকায় এসে প্রমাণ জোগাড় করে ফেলিস। সবই পর প্ল্যান।”
“কোর্ট থেকে না বললেও আমরা আর কখনো আসতাম না। এই শহরে আসায় আমার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়েছে। আর খালিদ খান এবং তার ভাইদের আমি মাফ করবো না কখনো।”
“সে অবৈধ ব্যবসার রাজা। প্রতি মাসে সে রাস্তা থেকে অনাথ বাচ্চাদের তুলে নেয়। তারপর তাদের দিয়ে রাস্তাঘাটে সিগারেট পান বিক্রি করায়। শুধু তাই না, বাচ্চাদের মারামারি ট্রেনিং থেকে শুরু করে ভয়ংকর অস্ত্রের সম্পর্কে জানায়। যাতে তারা বড়ো হয়ে খালিদ খানের জন্য কাজ করতে পারে। এখন তুই বুঝতেই পারছিস কেমন কাজ হতে পারে।”
“আচ্ছা, ও কি সত্যি মানুষ?”
“রক্ত মাংসে তৈরী মানুষ হলেও সে মানুষ না। আরে তার রক্তেই সমস্যা। ওর বাবা জঙ্গি ছিলো। তো ছেলেরা কিভাবে ভালো হবে বল।”
“আমার ইচ্ছে করছে ওদের সবাই টুকরো টুকরো করে নিজে জেলে চলে যাই।”
“মাথা ঠান্ডা রাখ, ভাবী আর বাচ্চাদের তোকেই সামলাতে হবে। সাবধানে যা এখন।”
“আমরা পৌঁছে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“আহা গাড়ি নিয়ে টেনশন করতে হবে না। আমি আগামীকাল মসজিদে দোয়া পড়িয়ে দিব বর্ষার নামে।”
বুরাকের বাবা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“তোকে কিভাবে ধন্যবাদ দেই? তোর মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য।”
“আমাকে লজ্জিত করছিস।”
বাবা বন্ধুকে ছেড়ে মুচকি হাসলেন। এখন হাসিমুখে বিদায় নেওয়াই ভালো। সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। মা গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। রেনু শাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ভয় করছে তার খুব। শাফিয়ার মাথা ব্যাথা করছে। তাই সে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বশির এসে সামনের সিটে বসলো। শাফিয়া চোখ খুলে বশিরকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। ড্রাইভার বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। শাফিয়া দ্রুত চোখ খুলে বলল-
“বুরাক কোথায়?”
বশির সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল-
“ও হয় তো আব্বুর সাথে ট্রাকে আসবে।”
“ছেলেটাকে আর শাস্তি দিও না বশির। বাসায় গিয়েই ওকে একবার জড়িয়ে ধরে বলে দিও তুমি আর রেগে নেই ওর উপর।”
বশির জবাব দিলো না। শাফিয়া লম্বা নিশ্বাস ফেলে আবার চোখ বন্ধ করে বসলো।
বাবা বুরাক চারপাশে খুঁজছে। কিন্তু বুরাক কোথায় খুঁজে পাচ্ছে না। গাড়ির দিকে চোখ যেতেই ভাবলো বুরাক হয় তো গাড়িতে বসেছে। বাবা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে ট্রাকে উঠে বসলো। ট্রাকের ড্রাইভারকে বলল ট্রাক স্টার্ট দিতে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালানো শুরু করলো। বুরাক তার হাতে থাকা ছোটো টেডি বিয়ার কি-রিং এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বর্ষার টেডি বিয়ার খুব পছন্দ। পাশেই দোকানে টেডি বিয়ারের কি-রিং দেখে বুরাক দ্রুত কিনে নিলো
ফিরে এসে দেখে গাড়ি নেই। বুরাক ভালো মতো চারপাশে দেখলো। গাড়ি কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বুরাক তার বাবা ভাইকে অনেকবার ডাকলো কিন্তু কেও আসলো না। বুরাক থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। এতোই রেগে আছে বাবা আর ভাইয়া যে তাকে এক অচেনা শহরে একা রেখে চলে গেল? বুরাকের বেশ অভিমান হলো। হাতে থাকা কি-রিং শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বর্তমানে…..
বশির হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে। উমায়ের মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। উঠানে বিছানো মাদুরে শাফিয়া বসে আছে। বুরাক চোখের পানি মুছে বলল-
“সেদিন আব্বু ভাইয়া আমাকে সাথে নিয়ে আসলে আমি সন্ত্রাস হতাম না।”
বশির হাত ছেড়ে বলল-
“আমরা তোকে রেখে আসি নি।”
বুরাক বশিরের দিকে তাকাল। বশির এখন শান্ত গলায় কথা বলছে। বুরাক জিজ্ঞেস করলো-
“মানে?”
“আমরা ফেরার সময় তুই আশে পাশে কোথাও ছিলি না। বাবা মনে করেছে তুঔ আমাদের সাথে গাড়িতে। আর আমি মনে করেছি তুই বাবার সাথে ট্রাকে। বাসায় ফিরে দেখি সবাই আছে তুই নেই। আমরা সব জায়গা খুঁজি। মনে করেছিলাম তুই গাড়ি থেকে নেমে এলাকাই কোথাও চলে গিয়েছিস। পরে আমরা বুঝেছি তুই কোন গাড়িতেই উঠিস নি। আমি আর আব্বু পরেরদিনই আবার ঢাকা যাই। কিন্তু তোকে কোথাও পাই না। আমাদেরকে পুলিশ দেখে ফেলে আর হুমকি দেয় এই শহর থেকে চলে যেতে নাহলে খালিদ খান ক্ষতি করবে আমাদের। আমরা বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসি। কিন্তু আব্বু উনার বন্ধুকে বলে তোর খোঁজ করায়। প্রায় ১ মাস পর আমরা খবর পাই তুই খালিদ খানের সাথে যুক্ত হয়েছিস।”
“আমি ইচ্ছে করে হইনি। আমি তো জানতামও না খালিদ খান কে।”
“তাহলে বল তুই কিভাবে খালিদ খানের ওখানে গেলি।”
শাফিয়া বলল-
“বাবার ঘরে চলো সবাই। বাবারও জানা দরকার কি হয়েছিল।”
বশির মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলো। শাফিয়ার দাঁড়িয়ে আবার বলল-
“আমি বাচ্চাদের দেখে আসি তোমরা যাও।”
বলেই শাফিয়া চলে গেল। বুরাক উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে দেখে উমায়ের কাঁদছে। বুরাক আলতো করে উমায়ের গালে থাকা পানি মুছে দিলো। উমায়ের মাথা তুলে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“বুরাক, এক ঘটনার সাথে আর এক ঘটনা কিভাবে জড়িত থাকে আমরা বুঝতেও পারি না। তুমি সেদিন তোমার পরিবারের সাথে চলে আসলে আজ আমাদের অবস্থা কি যে হতো।”
“সব উপরওয়ালার হাতে। আমি না থাকলেও উনি কোন না কোন রাস্তা বের করে তোমাদের রক্ষা করতেন।”
“কিন্তু এখন উনি আমাদের যেভাবে রক্ষা করলেন উপায়টা বেশ সুন্দর।”
বুরাক তাকিয়ে রইলো উমায়ের এর দিকে। হঠাৎ কাশির শব্দ আসলো। বুরাক আর উমায়ের সামনে তাকিয়ে দেখে শাফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের আর বুরাক উঠে দাঁড়াল। শাফিয়া হেসে বলল-
“আসো সবাই তোমাদের অপেক্ষা করছে।”
বুরাক দ্রুত হেটে শাফিয়ার পাশ কাটিয়ে চলে গেল৷ উমায়ের মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হেটে শাফিয়ার সামনে গেল। শাফিয়া হেসে উমায়ের এর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। বাবা খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। বিরক্ত হয়ে বলল-
“আর কি শোনাতে চায় ও? শুনেছি তো যা শোনার।”
শাফিয়া এক ভ্রু উঁচু করে বলল-
“আপনি চুপচাপ বসে থাকুন। এত বছর তো একবার হলেও বুরাকের কথা তুলতেন৷ বুরাকের জন্মদিন আসলে মাকে বলতেন কোর্মা রান্না করতে, ফিরনি রান্না করতে। কারণ এসব বুরাকের পছন্দের খাবার।”
“এগুলো আমারো খুব পছন্দ।”
“আর ঢং করতে হবে না আব্বু।”
মা ধমকের স্বরে বলল-
“হয়েছে ঝগড়া? বুরাক তুই বলবি না-কি আমি চলে যাব?”
বুরাক বলল-
“না আম্মু বসেন। আজ আমি সব বলবো তারপর ঢাকা ফিরবো।”
বাবা বলল-
“তাহলে যা বলার তারাতাড়ি বলো।”
বুরাক একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে আবার বলা শুরু করলো।

অতীতের অংশ…..
বুরাক রাস্তাঘাট কিছু চিনছে না। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসে পরলো নিজেও জানে না। বাবা বন্ধুর বাড়ি কোথায় তাও জানে না। রাতও গভীর হচ্ছপ ধীরে ধীরে। চারপাশে কুয়াশা ভাসছে। বুরাক শীতে থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ সামনে সে মসজিদ দেখতে পেল। সেখানে অনেকজন বসে কথা বলছে। বুরাক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো কি করা যায়। শীতে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দ্রুত হেটে মসজিদের ভেতরে গেল। এখানে শীত কম। হঠাৎ বুরাকের হাতে কেও হাত রাখলো। বুরাক পেছনে ফিরে দেখে একজন ভদ্রলোক পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে বুরাক বুঝতে পারলো উনি মসজিদের দেখাশোনা করেন হয় তো। বুরাক সালাম দিলো। উনি হাসিমুখে সালামের উত্তর নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“তুমি কাকে খুজছো?”
“কাওকে না আংকেল, আমার এখানে কেও নেই। আমার বাবা মাকে পাচ্ছি না।”
“চিন্তা করো না, মহান আল্লাহ তায়ালা আছেন। উনি থাকতে বান্দার ভয় করতে নেই। তোমার শরীর বেশ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। একটু দাঁড়াও আমি আসছি।”
বুরাক মাথা নাড়াল। উনি মুচকি হেসে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলেন। উনার হাতে একটি কম্বল। উনি বুরাকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-
“তুমি কম্বল শরীরে পেঁচিয়ে শুয়ে পরো। আমি আগামীকাল তোমার সাথে তোমার বাবা মাকে খুঁজতে বের হবো।”
“আমার আব্বু আম্মু এখানে থাকেন না৷ আমরা চট্টগ্রাম থাকি।”
“আরে পাগল, তোমাকে রেখে উনারা কোথাও যাবে না। এমনও হতে পারে কিছুক্ষণের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এখানে আসবেন উনারা। তুমি বসো, কিছু খেয়েছো?”
“না, আমরা কেও খাইনি। আসলে আমার বোন আর নেই। কারো ক্ষুধা পাচ্ছে না।”
উনি বুঝতে পারলেন বুরাক এখন ঘোরের মধ্যে আছে। বেশ মায়া হলো উনার। বুরাকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“ভাগ্য নিয়ে আফসোস করতে নেই। যা হওয়ার হয়েছে। তুমি তোমার বোনের জন্য মন খুলে দোয়া করো। এখন গিয়ে বসো আমি তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসি।”
“আপনি আমার জন্য কেন এত কষ্ট করছেন?”
“তুমি এখন আল্লাহর ঘরে এসেছো। তোমার যত্ন নেয়া আমার দায়িত্ব।”
বলেই উনি বুরাকের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। বুরাক মুচকি হাসলো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখে একপাশে একটা বাচ্চা বসে আছে। বুরাক গিয়ে তার পাশে বসলো। বাচ্চাটা চোখ মুখ কুঁচকে বলল-
“কি চাই? আমার সামনে বসার কারণ কি?”
“আমি কাওকে চিনি না। আপনি আমার বয়সের। তাই ভাবলাম আপনার সাথে এসে বসি।”
“তুই কাওকে চিনিস না তাতে আমার কি? দূর হো এখান থেকে।”
তখনই পাশ থেকে সেই ভদ্রলোকের কন্ঠ ভেসে আসলো-
“ববি, কতবার বলেছি সবার সাথে সুন্দর মতো কথা বলতে।”
বুরাক উনার দিকে তাকাল। উনি হেটে এসে বুরাকের দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো। বুরাক প্লেট নিয়ে দেখে বিরিয়ানি। উনি মুচকি হেসে বললেন-
“প্রতিদিনই কোন না কোন কারণে মসজিদে শিরনী দিয়ে যায়। খেয়ে নাও, আর ববি তুমি। কি বলেছিলাম বলো।”
ববি মাথা নিচু করে বলল-
“সবার সাথে সুন্দর মতো কথা বলতে।”
“আর কি বলেছিলাম?”
“কারো সাথে ব্যবহার খারাপ করলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের অপছন্দ করেন।”
“ঠিক, তো এখন ওর সাথে আর বাজে ব্যবহার করবে না। তোমার নাম কি?”
বুরাক উনার দিকে তাকিয়ে বলল-
“বুরাক, বুরাক শাহরিয়ার শাহ।”
উনি কিছু না বলে মুচকি হাসলেন। ইশারায় বুরাককে খেতে বলে চলে গেলেন। বুরাক ববির দিকে তাকিয়ে দেখে ববি বিরক্ত চেহারা বানিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুরাক ববির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল-
“ফ্রেন্ডস?”
“আমি ইংরেজি বুঝি না। বাংলায় বল।”
“বন্ধু হবে আমার?”
ববি ভ্রু কুঁচকালো। একবার বুরাকের হাত দেখে হেসে হাত মেলালো।
“তোর ভাগ্য ভালো আমি তোর বন্ধু।”
বুরাক জবাবে হাসলো। বুরাক ববিকে খাবার সাধলো। ববি বলল সে খেয়েছে। দুজন মিলে গল্প করে রাত কাটিয়ে দিলে। বুরাক ববিকে কিছু বলেনি তার সম্পর্কে। যদি ববি তাকে ভুল বুঝে। সে এই অচেনা শহরে ভালো মানুষগুলোকে হারাতে চায় না।

মসজিদেই কেটে গেল ১ সপ্তাহ। বুরাক মসজিদ থেকে বের হয়নি একবারো। সে অপেক্ষা করছে কখন তার বাবা ভাই আসবে তাকে নিতে। ববি আর সে মিলে মসজিদ পরিষ্কার করতে বেশ সাহায্য করে। একদিন ববি আর বুরাক বসে কথা বলছিল তখনই সেই ভদ্রলোক এসে বললেন মাজারে শিরনী দিতে আসবেন। মসজিদে যারা যারা আছে তারা সবাই যাবে। বলেই উনি চলে গেলেন। বুরাক বলল-
“আমি যাবো না ববি।”
“কেন?”
“ভালো লাগে না।”
“কি যে বলিস, মাজারে কোটিপতিরা আসে শিরনী দিতে। জামা কাপড়ও দেয় তারা। তিনদিন ধরে আমরা এই জামা পড়ে আছি।”
বুরাক ভাবলো ববি ঠিক বলছে। রাজি হলো যাওয়ার জন্য। বিকালে সবাই মাজারে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলো। ববি খুব দুষ্টু প্রকৃতির। বুরাক হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় তার কান্ড দেখে। তার ভালো লাগলো ববিকে বন্ধু রূপে পেয়ে। মাজারে গিয়ে সবাই বসে আছে। সবাই খাবার আর জামা কাপড় দিচ্ছে তারা। ববি চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ থমকে বলল-
“ওরে বাবা কে আসছে দেখ।”
“কে?”
বুরাক চিনলো না মানুষটাকে। ববি বিরক্ত হয়ে বলল-
“তুই কি রে ভাই? কাওকেই তো চিনিস না। উনার নাম, খালিদ খান।”
বুরাক চমকে উঠল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে খালিদ খানের দিকে। খালিদ খান চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে আসছে। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সাথে হাসিমুখে কি যেন বলছেন। ববি নিচু স্বরে বলল-
“উনি অনেক ছোটো বাচ্চাদের সাহায্য করে জানিস। দোয়া কর যাতে আমাদেরও সাহায্য করে।”
খালিদ খান এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ বুরাক আর ববির দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বুরাক আর ববির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। বুরাকের হঠাৎ রাগ হলো খালিদ খানের চেহারা দেখে। খালিদ খান হাসিমুখে বুরাকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“নাম কি তোদের?”
ববি বলল-
“আমার নাম ববি আর ওর নাম বুরাক।”
“পরিবারে কে কে আছে?”
ববি কিছু বলার আগেই বুরাক শান্ত গলায় বলল-
“আমাদের কেও নেই। আমরা অনাথ।”
খালিদ খান হেসে পিছনে ফিরে তার লোকের হাত থেকে জামা আর কাপড় নিয়ে বুরাক আর ববির দিকে এগিয়ে দিলো। ববি আর বুরাক জামা নিয়ে ধন্যবাদ জানালো। খালিদ খান বলল-
“যাবি তোরা আমার সাথে?”
ববি জিজ্ঞেস করলো-
“কোথায়?”
“নতুন এক দুনিয়ায়। যেখানে তোরা নতুন করে নিজেকে চিনবি। নতুন নতুন লোকের সাথে দেখা করবি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথা। তোরা তোদের নিজস্ব দুনিয়ার রাজা হবি।”
ববি অবাক হয়ে বলল-
“রাজা হবো আমরা?”
“হ্যাঁ, তো বল যাবি আমার সাথে?”
বুরাক হাসিমুখে বলল-
“যাব, আমরা আপনার সাথে যাব। নতুন করে নিজেকে চিনবো। নতুন নতুন লোকের সাথে দেখা করবো। নিজের দুনিয়ার রাজা হবো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, একটা কুকুরকেও জীবিত রাখবো না।”
বুরাকের কথা খালিদ খান বুঝলো না। ভাবলো বাচ্চা মানুষ তাই যা মুখে আসলো বলল। খালিদ খান দাঁড়িয়ে বুরাকের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। বুরাক খালিদ খানের হাতের দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল। খালিদ খান বুরাকের চোখ দেখে হালকা ভ্রু কুঁচকালো। সে বুরাকের মধ্যে এমন কিছু খুঁজে পেলো যার খোঁজ খালিদ খান অনেক আগে থেকেই করছিল। খালিদ খান নিজের পকেটে হাত রেখে বুরাক আর ববিকে ইশারায় বলল তার সাথে আসতে। খালিদ খান ঘুরে হাটা ধরলো। বুরাক খালিদ খানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। হাত মুঠো শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here