ভরসার_দুহাত পর্ব_২৬

0
322

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৬

“মোহাম্মদ মোবিন হোসেন।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে সে নামটা কোথাও শুনেছে। রুম্মান উমায়ের এর চাহনি দেখে বলল-
“তোর আবার কি হলো?”
“কিছু না”
“বুরাককে নিয়ে চিন্তা করছিস নিশ্চয়ই।”
উমায়ের জবাব দিলো না। বুরাককে নিয়েও তার চিন্তা হচ্ছে। রুম্মান উমায়ের এর হাত ধরে বলল-
“আমার দিকে তাকা”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকাল। রুম্মান মুচকি হেসে বলল-
“একজন প্রেমিকা আর একজনের চোখ দেখে বুঝতে পারে সেই মানুষটা কাওকে ভালোবাসে কিনা।”
“ননসেন্স”
উমায়ের ভেংচি কাটলো। রুম্মান শব্দ করে হেসে উঠে বলল-
“যদি বলি আমি সত্যি বলছি তাহলে? আমিও একজন ভালোবাসি। আর আমি তোর চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুই বুরাককে অনেক ভালোবাসিস। কিন্তু আসল কথা তুই বুঝতে পারছিস না বা বুঝতে চাইছিস না।”
“মানে?”
“মানে হলো, তুই বুরাকের অতীত নিয়ে ভাবছিস। বুরাকের বর্তমান নিয়ে ভাবছিস। দেখ উমায়ের এখন বুরাকের নাম ক্রিমিনালদের খাতায় আছে। তোর মনে এই বিষয়টার প্রতি খুব ঘৃণা রয়েছে। সেই ঘৃণার কারণে তুই বুঝতে পারছিস না যে তুই বুরাককে ভালোবাসিস।”
“ভালোবাসলেই বা কি? আমাদের ভবিষ্যৎ অসম্ভব রুম্মান।”
“রাখে আল্লাহ মারে কে”
বলেই রুম্মান হাসলো। উমায়ের রুম্মানের কথা শুনে ভাবনার দুনিয়ায় চলে গেল।

অন্যদিকে…..
বুরাকের বেশ বোরিং লাগছে। ববি না বলে কোথাও চলে গিয়েছে। ববি ফিরলে তার ক্লাস নিবে বুরাক। বুরাক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাথা ব্যাথা তেমন নেই কিন্তু মাথা বেশ ভার ভার লাগছে তার। ধীরে ধীরে বুরাক বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। গতকাল থেকে শুয়ে আছে। শুয়ে থাকতে থাকতে তার কোমড় ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। ধীরপায়ে হেটে কেবিনের দরজা খুলে উঁকি দিলো। আশে পাশে মানুষ কম। নার্স আর ওয়ার্ডবয়রা আসা যাওয়া করছে। বুরাক হঠাৎ পায়ে ব্যাথা অনুভব করলো। দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে বিছানায় বসলো। মোবাইল নিয়ে ববিকে কল করলো। কেবিন থেকেই কল টনের শব্দ আসছে। বুরাকের রাগ আরো বেড়ে গেল। ববি মোবাইল নিয়ে যায় নি। বন্ধুকে অসুস্থ রেখে সে কোথায় গেল। বুরাক বসে বসে ববির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে। হঠাৎ বুরাকের মোবাইলে কল টন বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে আননোন নাম্বার ভাসছে। বুরাক কল রিসিভ করলো।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম”
অপরপাশ থেকে উমায়ের এর কন্ঠ ভেসে আসলো।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ঘুমিয়ে ছিলে?”
“না”
“এখন কেমন আছো?”
“আগে থেকে অনেকটা ভালো।”
“ঔষধ আর খাবার ঠিক মতো খাচ্ছো তো?”
“কল দেয়ার কারণ বলো উমায়ের।”
উমায়ের বিছানার চাদর চেপে ধরলো। বুরাক উমায়ের এর উত্তরের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু উমায়ের উত্তর দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উমায়ের বলল-
“কেন আমি কি তোমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য কল দিতে পারি না?”
“পারো, কিন্তু তুমি এখন আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য কল দাও নি আমি জানি।”
“কি করে জানলে?”
“সেটা জানি না।”
“যদি বলি তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল তাহলে?”
বুরাক নিঃশব্দে হাসলো৷ কিন্তু উমায়ের টের পেয়েছে বুরাক হাসছে। উমায়ের লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“বিশ্বাস করা না করা তোমার উপর। আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিলো।”
“জানতাম, জিজ্ঞেস করো।”
“রাশিদ খানের বাকি বন্ধুদের নাম কি?”
“কেন?”
“যা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দাও।”
“টগর মোবিন আর বনি।”
মোবিন নাম শুনে উমায়ের চমকে উঠলো। বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“তাদের পুরো নাম জানতে পারি?”
“কেন? তুমি কি আমার জন্য ওদের গিয়ে মারবে? মারলে ভিডিও করে নিও আমি দেখে শান্তি পাবো।”
“মজা করো না বুরাক, প্লিজ তাদের পুরো নাম বলো।”
“ওকে শান্ত হও বলছি। প্রশান্ত মল্লিক টগর, মোহাম্মদ মোবিন হোসেন, মাহমুদউল্লাহ বনি।”
উমায়ের এর মনে হচ্ছে কেও তার হৃদপিণ্ড চেপে ধরে রেখেছে। রুম্মানের স্বামীর নাম মোহাম্মদ মোবিন হোসেন আর বুরাক যাকে মারতে চায় তার নামও মোহাম্মদ মোবিন হোসেন। দুজন যদি একজনই হয়ে থাকে তাহলে? উমায়ের এর মনে নানা ধরণের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বুরাক উমায়ের এর সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল-
“কোথায় হারালে? আর তুমি হঠাৎ তাদের নাম জানতে চাইলে যে।”
উমায়ের বিছানায় ধপ করে বসে বলল-
“জীবন মানুষকে মাঝে মধ্যে এমন পথে এসে দাঁড় করায় যে পথে বিপদ আর কঠিন হয়।”
“উমায়ের কি হয়েছে বলবে?”
“বুরাক তুমি বলেছি বর্ষার মাথায় আঘাত করেছিল রাশিদ খান। এতে তার বন্ধুদের কি দোষ বলো? তারা তো মারে নি বর্ষাকে।”
“আমার বোনকে না মারুক। তাদের মধ্যে একজন রেপিস্ট একজন ড্রাগস ডিলার আর একজন মেয়ে পাচারকারী। তাদের কি বেঁচে থাকার অধিকার আছে?”
উমায়ের বুকে তুফান শুরু হয়ে গিয়েছে।
“কে..কে করে এসব?”
“কে আর হবে? রাশিদ খানের বন্ধুরা। কেও ভালো না। তারা তিনজনই এখন খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে।”
“আর একটা প্রশ্ন করবো”
“করো”
“মোহাম্মদ মোবিন হোসেন নামক ছেলেটা কি বাজে কাজের সাথে জড়িত?”
“হ্যাঁ সে রেপিস্ট। প্রায় দশ বছর আগে তার নিজের ক্লাসমেটকে ধর্ষণ করে পালিয়েছিলো। বড়োলোক বাবার ছেলে। টাকা দিয়ে বেঁচে গিয়েছে। শুনেছিলাম মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।”
উমায়ের ঠাই বসে আছে। রুম্মান তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবন ধ্বংস হতে দেখতে পারবে না উমায়ের। বুরাক উমায়েরকে চুপ থাকতে দেখে বলল-
“আমার বোন বলছে মোবিনকে তুমি চেনো। যদি সে তোমার পরিচিত হয়ে থাকে আর তোমার সাথে কথা হয়ে থাকে। তার সাথে আবার দেখা হলে তাকে বলে দিও খুব শীগগিরই তার শেষ দিন আসতে চলেছে। বাঁচতে পারলে আমার থেকে বেঁচে দেখাক।”
বলেই বুরাক কল কেটে দিলো। উমায়ের কান থেকে মোবাইল নামিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তার চোখের সামনে বার বার রুম্মানের চেহারা ভেসে উঠছে। উমায়ের ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

৩ দিন পর….
উমায়ের ভার্সিটি যাবে আজ। যদিও ফিরোজ আনোয়ার বার বার বলছে না যেতে কিন্তু উমায়ের জেদ ধরেছে আজ যাবে। উমায়ের তৈরী হয়ে নাস্তা করতে ডাইনিং টেবিলে বসে বাবার অপেক্ষা করছে। বাবা কিছুক্ষণের মধ্যে আসলো। নুসাইফা বেগম একবার স্বামীকে দেখছে আর একবার মেয়েকে। দুজনের চেহারায় যেমন মিল স্বভাবেও তেমন মিল। দুজনেরই জেদ ভরপুর। বাবা বিরক্ত নিয়ে বলল-
“চায়ে চিনি কম কেন?”
নুসাইফা বেগম চোখ ছোটো ছোটো করে বললেন-
“এটা চা না কফি। আপনি আমাকে বলেছিলেন কিছুক্ষণ আগে চিনি ছাড়া কফি খাবেন কারণ আপনার ভুঁড়ি বেড়ে যাচ্ছে।”
শেষের কথাটা মা কিছুটা উঁচু স্বরেই বললেন৷ উমায়ের উসমান উজ্জ্বল নিঃশব্দে হাসছে। বাবা থতমত খেয়ে গেলেন। আসলেও তো উনি বলেছিলেন কিন্তু ভুলে গিয়েছে। উমায়ের হাসি থামিয়ে বলল-
“আব্বু আমার উপর রাগ থাকলে সেটা নিশ্চিন্তে প্রকাশ করুন।”
“আমাকে বলো, কি দরকার এখন ভার্সিটি যাওয়া?”
“আব্বু আমার ক্লাস মিস হচ্ছে। সামনে এক্সাম আমাকে পড়াশোনায় এখন মনোযোগ তো দিতে হবে না-কি।”
“সেটা বুঝলাম, কিন্তু আজই কেন? তুমি জানো না কত গন্ডগোল হলে এই কয়দিনে?”
“হ্যাঁ আব্বু জানি। তুমি চিন্তা করো না আমাকে নিয়ে। আমার কিছু হবে না বুঝলে?”
“তুমি খুব জানো বিপদ আপদের সম্পর্কে তাই না?”
“তিলকে তাল বানিও না তো। আমি আজ ভার্সিটি যাচ্ছি ব্যস আর কোনো কথা না।”
বলেই উমায়ের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গ্লাসে জুস ঢেলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল৷ বাবা বিরক্ত হয়ে নুসাইফা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমার আদরে ও এত জেদি হয়েছে।”
“হ্যাঁ ঠিক তেমনই যেমন আমার শ্বাশুড়ি মায়ের আদরে আপনি জেদি হয়েছেন।”
“হুম ঠিক বললে”
ফিরোজ আনোয়ার থতমত খেয়ে গেল কথাটা বলে। ভ্রু কুঁচকে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে মিটিমিটি হাসছে। ফিরোজ আনোয়ার নিজের বোকামির কথা ভেবে কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো।

উমায়ের ব্যাগ চেক করে বোরকা পড়ে নিলো। তৈরী হয়ে রুম্মানকে কল দিয়ে বলল সে আজ ভার্সিটি আসছে। রুম্মান খুশীতে পারছে না মোবাইলের ভেতর ঢুকে উমায়েরকে জড়িয়ে ধরুক। উমায়ের তারাতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে মায়ের সাথে দেখা করে নিলো। বাবা ড্রইংরুমে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। উমায়ের ড্রইংরুমে এসে বাবাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। ফিরোজ আনোয়ার মেয়ের উপস্থির টের পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। উমায়ের হেসে বাবার গাল ধরে টেনে বলল-
“আমার আব্বুকে রাগ করলে আরো বেশী কিউট লাগে দেখতে।”
ফিরোজ আনোয়ার বিরক্ত হয়ে বললেন-
“আমাকে মানাতে এসো না উমায়ের। আমার মন এখন খুব খারাপ।”
“আব্বু প্লিজ এখন রাগ সাইডে রেখে আমাকে যাওয়ার পারমিশন দিন।”
বাবা মুখ ভেংচি কাটলো। উমায়ের বিরক্ত হয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলল-
“আপনি আমার সাথে ভাব নিচ্ছেন তাই না? আমি এখন ভাব ধরি ভাবতে পারছেন কি হবে?”
বাবা কাচুমাচু খেয়ে গেল। তারাতাড়ি দাঁড়িয়ে উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“না আমার মামনি এমন কিছু করবে না। আচ্ছা আমি সরি বলিছি। যাও তোমাকে ভার্সিটি যাওয়ার পারমিশন দিলাম। কিন্তু তোমার নিজের অনেক বেশী খেয়াল রাখতে হবে।”
“আমি ওয়াদা করলাম নিজের অনেক বেশী খেয়াল রাখবো।”
বাবা মুচকি হাসলেন। উমায়েরও হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে গাল ধরে টেনে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। কিন্তু বাবার ভালো লাগছে না। উনি কিছুক্ষণ কর কাজে বের হবেন নাহলে উমায়ের এর সাথে যেতেন।

উমায়ের ভার্সিটি পৌঁছে কিছুক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভার্সিটি ভালো মতো দেখতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে অনেক বছর কর আবার ভার্সিটি এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে উমায়ের ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। হঠাৎ কেও একজন তার চোখ ধরলো। উমায়ের তার হাত ছুঁয়ে বলল-
“আমি জানি রে ফাজিল এটা তুই।”
রুম্মান উমায়ের এর সামনে এসে দাঁড়াল। উমায়ের চোখ খুলে রুম্মানকে দেখে বলল-
“আমি জানতাম তুই।”
“তুই আমার হাত ধরেছিস। আমার নরম নরম হাত ধরে চিনেছিস আমি জানি।”
“বাহ রে, এখন সব ক্রেডিট নিজে নিয়ে নিলি?”
রুম্মান শব্দ করে হাসলো। উমায়ের রুম্মানকে ভালো মতো দেখে বলল-
“তোকে আজ অন্য রকম লাগছে কেন?”
“অন্য রকম বলতে?”
“অন্য রকম মানে তোকে আজ একটু বেশীই সুন্দর লাগছে।”
“মেকআপ করছি দোস্ত মেকআপ। আসলে আজ উনি আসবেন।”
“উনি আবার কে?”
“আহা উমায়ের আমার কয়জন আছে?”
উমায়ের এর চেহারায় চিন্তার ছাপ ভেসে উঠলো। রুম্মান উমায়ের এর চেহারা দেখে বলল-
“আচ্ছা সরি, আসলে মোবিন আসবেন আজ। জানিস আমাদের পরিচয় হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে হয়েছে। তবুও আমার মনে হচ্ছে আমি মানুষটাকে অনেক বছর ধরে চিনি। এত তারাতাড়ি কাওকে ভালোবাসা যায়?”
“হয়..হয়তো এটা তোর আবেগ।”
“আমার কি আবেগের বয়স আছে বল?”
উমায়ের জবাব দিলো না। রুম্মান উমায়ের এর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল-
“সবচেয়ে মজাদার কথা কি জানিস? সে এখন আমার স্বামী। আমি তার জন্য সব করতে পারি সব।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চেহারায় থাকা হাসিটা দেখে উমায়ের এর মনে হচ্ছে তার ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। যদি বুরাক মোবিনকে মেরে ফেলে? উমায়ের আর রুম্মানের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। যেটা উমায়ের কখনোই হতে দিবে না। উমায়েরকে চুপ থাকতে দেখে রুম্মান বলল-
“তোর আবার কি হলো? বার বার চুপ হয়ে যাস কেন?”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। দুজন ক্লাসে গিয়ে বসলো। রুম্মানের প্রত্যেকটি কথা মোবিনকে নিয়ে। উমায়েরকে আরো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে রুম্মান। তৃতীয় ক্লাস চলাকালীন রুম্মানের মোবাইল কেপে উঠলো৷ ভাইব্রেট মোডে দেয়া মোবাইল। রুম্মান মোবাইল চেক করে দেখে মোবিন মেসেজ দিয়েছে সে ভার্সিটির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। রুম্মান উমায়েরকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে লজ্জামাখা কন্ঠে বলল-
“এসেছেন উনি এই ক্লাসের পর আমি চলে যাব।”
উমায়ের বিরক্ত হয়ে বলল-
“তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? কথায় কথায় তোর লজ্জা পাওয়ার বিষয়টা আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
“আমি কোথায় লজ্জা পেলাম?”
উমায়ের দাঁতে দাঁত চেপে রুম্মানের গালে চিমটি কেটে বলল-
“এমন লাল হয়ে যাস কেন তোর মজনুর কথা ভেবে?”
রুম্মান গাল ডলতে ডলতে বলল-
“একটা মাত্র মজনু থুক্কু স্বামী আমার। ক্লাস শেষ চল চল তারাতাড়ি যাই।”
বলেই রুম্মান দ্রুত নিজের ব্যাগ গুছাতে লাগলো৷ উমায়ের হাসছে তার কান্ড দেখে৷ উমায়েরও তার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। স্যার যেতেই দুজন ক্লাস থেকে বের হয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ভার্সিটির বাহিরে একটা ছেলে বাইকের উপর বসে আছে। রুম্মান দাঁত বের করে হেসে বলল-
“আহা আমার ভাগ্য, দেখ কত হ্যান্ডসাম দেখতে।”
উমায়ের রুম্মানের ইশারা দেখে সামনে তাকাল। ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে বলল-
“রুম্মান, এইটা তোর স্বামী না-কি দাদা শ্বশুর?”
রুম্মান চমকে উঠলো উমায়ের কথা শুনে। ভালো মতো মোবিনকে একবার দেখে আবার উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“দাদা শ্বশুর? উমায়ের তোর চোখ গিয়েছে। সামনে গিয়ে দেখ কত হ্যান্ডসাম।”
রুম্মান উমায়েরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল সামনে। মোবিন হাসিমুখে বাইক থেকে নেমে রুম্মান আর উমায়েরকে সালাম দিলো। উমায়ের মোবিনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে রুম্মানের দিকে তাকাল। রুম্মান উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। উমায়ের জোরপূর্বক হাসি দিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। রুম্মান বলল-
“আপনি এত তারাতাড়ি আসলেন যে?”
“বিকালে একটা কাজে যাব। নতুন ব্যবসা আমার। ব্যস্ত হয়ে যাব কাল থেকে। তাই আজ তারাতাড়ি আসলাম তোমার সাথে বিকাল পর্যন্ত ঘুরবো।”
রুম্মান খুশীতে আত্মহারা। মোবিন রুম্মানকে দেখে বলল-
“আপনার নাম উমায়ের তাই না?”
উমায়ের হাসিমুখে মাথা নাড়াল। রুম্মান বলল-
“একটু আগে আমাকে যা বলছিলি এখন বল তো সাহস থাকলে উমায়ের।”
উমায়ের ভ্রু কুঁচকে বলল-
“আমি সত্য বলতে ভয় পাই না।”
“তাহলে বল”
উমায়ের মোবিনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনার বয়স কত? আপনাকে দেখে রুম্মান থেকে এত বেশী বড়ো লাগে কেন?”
মোবিন ড্যাবড্যাব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল-
“কারণ আমি ওর থেকে প্রায় ১২ বছরের বড়ো।”
উমায়ের নাক মুখ কুঁচকে রুম্মানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আগে তো বলতি সমবয়সী ছেলেকে বিয়ে করতে চাস। এখন কি হলো?”
“সমবয়সী না পেলে আমার কি দোষ? এখন যাকে পেয়েছি সেই আমার জন্য বেস্ট।”
মোবিন হাসিমুখে বলল-
“শালিকা, আপনার কি আমার বয়স নিয়ে কোন সমস্যা?”
উমায়ের না সূচক মাথা নাড়াল। রুম্মান হাসতে হাসতে বলল-
“আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে শোনার পর থেকেই ও কেমন আজব ব্যবহার করছে। আসলে বেচারি যাকে ভালোবাসে তাকে না পাওয়ার চান্স বেশী।”
উমায়ের রুম্মানকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে নিচু স্বরে বলল-
“চুপ থাক, বুরাকের সম্পর্কে কাওকে বলবি না।”
“ওকে ওকে”
উমায়ের মোবিনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আচ্ছা ভাইয়া আসছি আমি। আপনি যান ওকে নিয়ে।”
“একা যাবেন আপনি?”
“হ্যাঁ, মানে আমার গাড়ি আছে।”
“তাহলে ঠিক আছে, রুম্মান চলো যাওয়া যাক।”
রুম্মান মাথা নাড়িয়ে উমায়েরকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল-
“লাভ এট ফার্স্ট সাইড যখন হয়, সামনে থাকা মানুষটার বয়স, চরিত্র কিছুই চোখে ধরা পড়ে না। শুধু একটা বিষয়ই মাথায় ঘুরে, আমি এই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস না নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখিস।”
বলেই রুম্মান উমায়েরকে দেখে বিদায় নিয়ে বাইকে উঠে বসলো। মোবিন উমায়েরকে সালাম দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। উমায়ের ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। রুম্মানের কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

কিছুদিন পর…..
বুরাককে আজ ডিসচার্জ করা হবে। সে খুব তারাতাড়িই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। শুধু মাথায় আঘাত লাগার কারণে তাকে বিশ্রাম নিতে হবে আরো ১ মাসের মতো। উমায়ের আজ সকাল থেকে বেশ খুশী। বুরাক যে রুমে থাকবে সে রুম উমায়ের নিজের হাতে গুছিয়েছে। বাবা মা আশ্চর্য হচ্ছে মেয়ের ব্যবহার দেখে। উমায়ের ঘর গুছিয়ে রান্নাঘরে আসলো। মা রান্না করছে। উমায়ের মায়ের সামনে গিয়ে বলল-
“হেল্প করি আম্মু?”
মা উমায়েরকে দেখে অবাক হয়ে বলল-
“হেল্প করবে? তাও তুমি? মামনি তুমি ঠিক আছো তো?”
“আহা আম্মু আমার আবার কি হবে?”
“না মানে তুমি ঘর গুছালে আবার রান্না করতে চাচ্ছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“মাঝে মধ্যে আমার ইচ্ছে করে রান্না করতে। প্লিজ হেল্প করতে দাও।”
“আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।”
“কি প্রশ্ন?”
“বুরাকের জন্য তোমার মনে কোন ফিলিংস নেই তো?”
উমায়ের থমকে গেল মায়ের প্রশ্ন শুনে। মা জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে উমায়ের এর দিকে। উমায়ের মাকে মিথ্যা বলতে পারে না। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো। মা বলল-
“উমায়ের, মনে কারো নাম লিখার আগে ভাবতে হয় যে ভাগ্যে তার নাম লিখা আছে কিনা। যদি তুমি বুরাককে ভালোবেসে থাকো। এখনই নিজেকে ওয়াদা করো তাকে ভুলে যাবে।”
উমায়ের মাথা নিচু করে ফেলল। তার গলা কাঁপছে কিছু বলতে পারছে না। মা আবার বলল-
“বুরাক যা যা ক্রাইম করেছে সেই কেস গুলো বন্ধ না হলে তার ফাঁসি হয়ে যাবে। পারবে তখন সহ্য করতে? এর চেয়ে ভালো তাকে ভুলে যাও।”
উমায়ের এর মনে হচ্ছে তার হৃদয় এখনই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। কষ্ট হচ্ছে তার খুব। কাওকে বলতেও পারছে না আবার সহ্যও করতে পারছে না। তখনই গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ আসলো। উমায়ের লম্বা নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। ববি গাড়ি থেকে নেমে বুরাককে ধরে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে বের হলো। বুরাকের চোখ দেখে মনে হচ্ছে তার ঘুম পেয়েছে। সে ববিকে ধমক দিয়ে বলল সে ঠিক আছে। উমায়ের হাসিমুখে এগিয়ে গেল। বুরাক উমায়েরকে আসতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। ববি উমায়েরকে সালাম দিয়ে বলল-
“কেমন আছো আপু?”
“ভালো, বুরাক আর আপনার ঘর গুছানো আছে গিয়ে দেখে নিন।”
ববি মাথা নাড়াল। বুরাক ধীরে ধীরে হাঁটা ধরলো। বাবা বলল-
“ববি বুরাক তোমরা তোমাদের ঘরে যাও। আর মামনি তোমার আম্মু কোথায়?”
“আম্মু রান্নাঘরে”
বাবা হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে। ববি আর বুরাক এগিয়ে গেল স্টোররুম অর্থাৎ তাদের ঘরের দিকে। উমায়ের কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বুরাকের পেছনে গেল। বুরাক খাটে বসে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে বলল-
“এখন শান্তি লাগছে। হসপিটালে আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই বাবা। অসহ্য লাগে।’
উমায়ের এগিয়ে আসতে আসতে বলল-
“তাহলে এমন কান্ড করো কেন যেটার দ্বারা অসুস্থ হয়ে যাও?”
বুরাক উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা ঘুরিয়ে ফেলল। ববিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“ববি আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে”
ববি একবার বুরাক আর একবার উমায়েরকে দেখে বলল-
“আমি আপনাদের অনুরোধ করছি। প্লিজ সামনাসামনি বসে ডিসাইড করুন আপনারা একে অপরের শত্রু না-কি বন্ধু হোন।”
বুরাক বলল-
“আমরা একে অপরের কিছুই হই না।”
উমায়ের বলল-
“হ্যাঁ ঠিক, বুরাক আমার জন্য এমন একজন মানুষ যার প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছু নেই।”
“এই শ্রদ্ধাও আমার প্রয়োজন নেই উমায়ের।”
“আমি কাকে শ্রদ্ধা করবো না করবো সেটা তুমি না আমি ডিসাইড করবো।”
ববি তাদের দুজনের ঝগড়া দেখে বলল-
“আমি একটা কল করে আসি আপনারা কথা বলুন।”
বলেই ববি দ্রুত ঘর থেকে বের হলো। বুরাক বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। উমায়ের ধীরপায়ে হেটে গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
“বুরাক, তোমাকে কিছু বলার আছে।”
“বলো”
“তোমাকে একটা ছবি দেখাবো, দেখে বলবে তুমি ছেলেটাকে চেনো কিনা।”
বুরাক উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“কার ছবি দেখাবা”
“সেটা তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
উমায়ের দ্রুত গিয়ে তার ঘর থেকে মোবাইল নিয়ে আসলো। রুম্মান ফেসবুকে ছবি আপলোড করেছে মোবিনের সাথে। উমায়ের মোবিনের একটা ছবি ডাউনলোড করে রেখেছে। সে দ্রুত বুরাকের ঘরে এসে দেখে বুরাক বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। উমায়ের ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বুরাককে নিচু স্বরে ডাকলো। কিন্তু বুরাক চোখ খুলছে না। উমায়ের অবাক না হয়ে পারলো না৷ এত তারাতাড়ি কেও ঘুমাতে পারে? বুরাক ধীরে ধীরে নাক ডাকছে। উমায়ের নিঃশব্দে হাসলো। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা বিষয়টা তার কাছে হাস্যকর। উমায়ের বুরাকের চুল আলতো করে ছুয়ে বলল-
“আমাদের জীবন এক না বুরাক কিন্তু আমার জীবন আমি তোমার নামে লিখে দিলাম।”

চলবে……

[গল্প শেষের দিকে। তাই এখন থেকে রেগুলার গল্প দিবো। ভুল ক্রুটি ধরিয়ে দিবেন প্লিজ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here