পাতাঝরার শেষে……পর্ব ২

0
1972

পাতাঝরার শেষে (2)
©মৌপর্ণা

পর্ব ২) সেই দুটো চোখ……

“…………উউফ! অন্বেষা! আর ভাবিস না! এবারে তুই হয় পাগল হয়ে যাবি ওই লোকটার মতন বা তুই পাগল লোকটার প্রেমে পরে যাবি……”

“বাজে কথা বলোনা তো রিয়া দি….! তোমার ….. ঘুরে ফিরে ওই এক চিন্তা……প্রেম!”

“ওমা! এটাতে খারাপ কি আছে বলতো?
একুশ বছর বয়েস, তোর বয়েসে লোকে প্রেম করে, ব্রেকাপ করে, সোলো ট্রিপে যেতে যেতে অরিজিৎ সিংয়ের Bada pachtaoge, bada pachotaoge শুনছে, বা Isme tera ghata
Mera kuch nahi jata গাইছে…..

রিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই দুজন মিলে হো হো করে হেসে উঠলো ওরা!

রিয়া – অন্বেষার পিজি রুমমেট…..
একটা বড়ো হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করে, বয়েসে বছর চারেক বড়ো অন্বেষার চেয়ে, ভারী বন্ধুক্ত দুজনের,
আপদে বিপদে, শরীর খারাপে, মন খারাপে, খুশি তে, দুঃখ তে, বৃষ্টি ভেজা দিনে, কড়া গরমের দিনের সঙ্গী……
এই এতো বড়ো শহরে, ওরা দুজনে দুজনকার বন্ধু, গার্জেন সব!
তারপর পিজির কাকিমার বকাঝকা খাওয়ার পার্টনার…..

“তবে! যাই বলো রিয়া দি, আজ আমি সত্যি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম? ওরম সল্টলেকের একটা সরু গলি, গলি থেকে আরো একটা গলি, তারপর জায়গাটা কেমন নিরিবিলি!
কলকাতায় নয়তো কোকিলের আওয়াজ! আজ আমি শুনেছি জানো…
তারপর যখন ওই লোহার গেটটা বন্ধ করলো, আমি তো লাইক…..শেষ…..আজকেই……
তারপর ইন্টারভিউ…..
সিরিয়াসলি রিয়াদি, আমার এখনো হাসি পাচ্ছে!
আর ওই ডাইনিং এর ভদ্রমহিলা, কি অদ্ভুত একটা তাকানো, আর ওরম একটা বিশাল বাড়ি, কেমন যেন গা ছমছমে একটা ব্যাপার….
আর ওই গোমড়ামুখো!
রুক্ষ কাটকাট কথা মিস্টার রায়ের! এক ফোটা মুখে হাসি নেই, ইমোশনলেস ক্রিয়েচার……
নয়তো তুমিই ভাবো ওরম একটা সুন্দরী মেয়েকে অপমান করে দিলো……
How?…..আবার তার ওপর ড্রেস নিয়ে খোঁটা!
আচ্ছা একটা মেয়ের কি কোনো স্বাধীনতা নেই কি পড়বে না পড়বে…..”

“কিন্তু তুই তো বললি উনি বলেছেন ড্রেস ইস নট
Appropriate ফর দিস জব….”

“হ্যাঁ! তাই বা কেন বলবে?”

“তোর মাথাটা গেছে, আরে বাবা টিচার খুঁজছেন উনি, নিজের কম্পানির মডেল নয়…..”

“তাই বলে ওরম অপমান করবেন!”

“মানুষটা ওইরকমই হয়তো…..এবারে তুই প্লিজ অরুণজিৎ রায়ের গল্পটা ছেড়ে চা টা তে চুমুক দে! প্লিজ! এমনি জলজলে চা! ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে পারবি?”

“এই রিয়াদি বাই দা ওয়ে, আজ একটা জুস দিয়েছিলো রিরি দেড় বাড়িতে…..
জুস, না স্কোয়াশ শিওর নয় তবে দারুন ছিল খেতে……”

“ডোন্ট কল হার রিরি, ওর ভালো নাম রিতিকা…..”

আবারো হাসিতে ফেটে পড়লো ওরা দুজনে…

*****************************************************

রাতে পড়তে বসে কেমন যেন মনটা ছটফট করছিলো অন্বেষার!
কেন মুখটা অতটা চেনা চেনা লাগছে, কেন?
কেন মুখটা বারবার ভেসে উঠছে মনের ভেতর!

জোর করেই এবার খানিকটা পড়ায় মন বসালো অন্বেষা, নাঃ কিছুদিনের মধ্যেই থার্ড সেমিস্টার, মাস দুয়েকও পুরোপুরি বাকি নেই পরীক্ষার…
এবার পড়াশোনাটা করতেই হবে……
তারপর টিউশনিটা করতে গিয়ে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হবে তো বটেই…..

এমনিই মাস চারেক আগে হওয়া ইন্টারভিউ তে সিলেক্টেড হয়নি সে, বাড়িতে এই নিয়ে নানান কথা, সেকেন্ড ইয়ারের শেষে কিছু একটা মোটামোটি মাইনের চাকরি না পেলে ধরে বেঁধে যে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!
একমাত্র অন্বেষার বাবা ছাড়া কেউই চাইনি অন্বেষা মাস্টার্স টা কলকাতা থেকে করুক,
ওই মানুষটার স্বপ্নের সাথে একদম ছেলেমানুষি নয়!
মাঝে মাঝে মনে হয়, ওরম একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট! ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট!
সারাটাজীবন ধরে শুধু পড়াশোনায় করে গিয়েছে সে, ইভেন সাইন্স কলেজেও প্রথম দুটো সেমিস্টার এর রেজাল্ট ওয়াইজ সে ক্লাসে দ্বিতীয়!
অথচ চাকরির খাতায় নাম উঠলোনা শুধু স্কুল মার্কশিটের ফাইলটা দুর্গাপুরে ছিল বলে,
লক্ষই করলোনা এতো বড়ো একটা জিনিস!
গ্রাজুয়েশন এর মার্কশিট দেখিয়ে ভেবেছিলো ম্যানেজ হয়ে যাবে সব!
কিন্তু সেই লোকটা কিছুতেই মানবেনা……
আগে জানলে বাবা নিশ্চই ছুটে আসতো কলকাতায়…..
যাকগ্যে বারবার একিই জিনিস ভেবে সেদিন টা আর ফিরে আসবেনা….
তার চেয়ে আগামী দিন গুলোর কথা ভাবাই ভালো……
এখনো তো অনেক কম্পানি আসবে হয়তো…২ মাস পর রয় এন্ড রয় পুল ক্যাম্পাসিং বা অফ ক্যাম্পাসিং এর খোঁজ রাখতে হবে……
আচ্ছা মিস্টার রায় কে বলে রাখলে কেমন হয়?
আবার ভেসে উঠলো সেই মুখটা!
এবারে ভীষণ রাগ হলো অন্বেষার নিজের ওপর!

যে লোকটা একটা সুযোগ দিলোনা সেইদিন,
উল্টে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে বলে দিলো ৬ মাস পরের ক্যাম্পাসিং এর ট্রাই করো, মার্কশীট নিয়ে এসে…….
তার কথা কেনই বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে সে……

রাতে যখন স্টাডি টেবিল থেকে উঠলো তখন ঘড়িতে দুটো….
টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়….

*****************************************************

হুড়হুড় করে কেটে গেলো মাঝের দুটোদিন…..
বুধবারের কলেজ সেরে যখন রিতিকা দেড় বাড়ির কাছের বাস স্ট্যান্ডে নামলো তখন ঘড়িতে আটটা বেজে দুই……
আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেলো, তাড়াহুড়ো করে ঢুকে পড়লো রায় ম্যানশনে,
আজ বাড়িটা একদম অন্য রকম, ডাইনিং এর সোফা আজ ফাঁকা, তবে সবকটা আলো জালানো
ওপর ও নীচের ঘরে,
অন্বেষা এদিক ওদিক না তাকিয়ে উঠে গেলো সিঁড়ি বয়ে, তারপর সোজা ডান দিকের ঘরে ঢুকতেই যাবে, দেখতে পেলো একটা বছর কুড়ির ছেলে, হাতে খুব সম্ভতঃ হার্ডড্রিংকস…..হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো পাশের ঘর থেকে…..
তারপর অন্বেষার দিকে তাকালো মাথা থেকে পা পর্যন্ত, অন্বেষা তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লো রিতিকার ঘরে….

“গুড ইভনিং মিস!”
রিতিকার মুখে সেই সরল হাসি…..

“এক্ষুণি যিনি গেলেন, উনি তোমার দাদা রিতিকা….”

“হমম ma’am ছোড়দা…..”

“আর আগেরদিন যিনি আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে এলেন উনি বড়দা? মানে অরুণজিৎ রায়…”

“নাঃ মিস! অরুণজিৎ রায় আমার দাদাভাই….
মানে মিস ছোড়দা, বড়দা ওরা cousin
দাদাভাই আমার নিজের দাদাভাই…..”

“আচ্ছা…….বুঝলাম……চলো এবারে শুরু করা যাক….তো কি দিয়ে শুরু করবে…ফিজিক্স না কেমিস্ট্রি…..”

ইতিমধ্যেই ঘরের পরিচারক এসে দাঁড়ালো অন্বেষার পেছনে…..
“দিদিমনি, কিছু জলখাবার আনি? কি খাবে বলতো তুমি?”

“না আমার কিছু লাগবে না জেঠু…..”

লোকটা একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো অন্বেষার দিকে, কিছু বলতে চাইলো বোধহয়, ভেজা ভেজা গলায় বললো
“তাহলে চা বিস্কুট খাও, বা জুস…..”

“বেশ…. জুস….”

“আচ্ছা!”

পুরো বাড়িটা কেমন যেন গোলমাল লাগে অন্বেষার……
বাবা, মা নয়, রিতিকার দাদাভাই রিতিকার গাইড….আজ অবধি রিতিকার বাবা, মা এর সাথে দেখা হলোনা অন্বেষার, তারপর আগের দিন ওই মহিলার অদ্ভুত দৃষ্টি….
আজ রিতিকার ছোড়দার নোংরা তাকানো…..
একটা অদ্ভুত ইনসিকিউরিটি কাজ করে অন্বেষার এই বাড়িতে এলে….

কোনো কথা না বাড়িয়ে রিতিকার ক্লাস শুরু করলো অন্বেষা…..

মুহূর্তে কেটে গেলো দেড় ঘন্টা, সাড়ে নটার অ্যালার্ম টা বেজে উঠতেই অন্বেষা রিতিকা কে বিদায় জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো,
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই দেখলো মিস্টার রায় বসে সোফায়, সঙ্গে ল্যাপটপ, হাতে ফাইল…..
কোনো রকমে গলাটা পরিষ্কার করে অন্বেষা বললো
“আমি আসছি মিস্টার রায়….”

“মিস মিত্র! ওয়ান মিনিট প্লিজ, একটু দরকার ছিল আপনার সাথে…..”

“হ্যাঁ বলুন….”

“আপনি জানেন তো এই মাসের ফিস টা অ্যাডভান্স করে দেওয়া আছে আপনাকে…”

“হ্যাঁ! জানি…..
কিন্তু কেন বলুন তো!”
ভেঙে ভেঙে কথাটা জিজ্ঞেশ করলো অন্বেষা….

“তাহলে নিশ্চই এটাও জানেন যে আগেরদিনের চেকটা হারিয়ে ফেললে আর আমি আপনাকে পেমেন্ট করবোনা….”

অন্বেষার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো, সত্যি তো আগেরদিনের চেকটা কোথায় রেখেছে? আর গতদুদিন একবারও সে কথাটা মনে ছিলোনা তার…..
অরুণজিৎ রায় আবার শুরু করলেন

“কি হলো? তাহলে হারিয়ে ফেললে আপনি ফিস টা আর চাইবেন না তো? ”

কাঁপা কাঁপা গলায় অন্বেষার গলা থেকে বেরিয়ে এলো “না”

“বেশ! তাহলে আসুন….. আপনি বোধহয় বাড়ি ফিরছিলেন…..”

অন্বেষা ফেকাসে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে, তারপর ভেজা গলায় বললো
“আসছি….”

“সিরিয়াসলি মিস মিত্র! এতো Attitude!
ভাঙবো তবু মচকাবো না….”
বিদ্রুপ করে হাসলো মিস্টার রায়….তারপর টেবিলের ওপর থেকে চেকটা আবার বাড়িয়ে দিলো অন্বেষার দিকে…..

আবারো সেই কাটখোট্টা গলায় বললো
“আমি আপনার পার্সোনাল Assistant নই….
যে আপনি হারিয়ে যাওয়া জিনিস গুছিয়ে রাখবো….পরের বার থেকে খেয়াল রাখবেন! আর কি বলছিলেন আপনি….
রেস্পন্সিবিলিটি….! উউফ! আবার সেই বিদ্রুপের হাসি দেখলো হাসলো মিস্টার রায়….
তারপর হাসি থামিয়ে বললো
গুড নাইট…..”

এতো রুডলি কেউ কি ভাবে বিহেভ করতে পারে?
ছলছল চোখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো অন্বেষা…..
তারপর এগিয়ে গেলো বাইরের গেটের দিকে….

“ম্যাডাম … গুড নাইট…..”
দারোয়ান হাসি মুখে বিদায় জানালো অন্বেষা কে….
সিকিউরিটি অফিস বন্ধ এখন!
লোহার গেট খুলে দিলে, অন্বেষা হাঁটতে শুরু করলো বাস স্ট্যান্ডের দিকে…..

****************************************************

আনমনা হয়ে হাঁটতে – হাঁটতে যখন অন্বেষা বাস স্ট্যান্ড পৌঁছলে তখন ঘড়িতে ঠিক দশটা, এতো রাত কখন হয়ে গেলো?
এতো রাতে বাস পাওয়া যাবে?

এদিকে দ্রুত গতিতে হাওয়া চলছিল, এই বুঝি ঝড় উঠলো বলে, বাস স্ট্যান্ড খাঁখাঁ….করছে,
একটা বাস এলেই মিনিট পনেরো, বা হয়তো এরকম ফাঁকা রাস্তাতে দশ মিনিট, কিন্তু পনেরো মিনিট পরও কোনো বাসের দেখা মিললনা….

এদিকে প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে এরই মধ্যে! বাস স্ট্যান্ডের সরু শেডের নীচে কোনোমতে দাঁড়িয়ে রইলো অন্বেষা…
প্রবল বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে গিয়েছিলো পরণের কুর্তি লেগিন্স! আজি ব্যাগ থেকে ছাতাটা কি মরতেই বের করে রাখলো অন্বেষা……

এদিকে একটা বাসেরও পাত্তা নেই….
চোখটা কেমন ছলছল করে এলো, মনে মনেই ভগবান কে ডাকতে থাকলো অন্বেষা…..
“একটা বাস….ভগবান….একটা বাস….ভেজা গায়ে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা……”

ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে দশটা….
এতটা অসহায় নিজেকে কোনোদিনও মনে হয়নি অন্বেষার……

হঠাৎ একটা লাল গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাস স্ট্যান্ডে, ঠিক অন্বেষার সামনে, হৃদস্পন্দন বেড়ে
গেলো অন্বেষার!
গাড়িটা সমানে হর্ন দিয়ে যাচ্ছে অন্বেষার সামনে দাঁড়িয়ে…..

অন্বেষা গাড়ির হর্ন উপেক্ষা করে চেয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে, যদি কোনো বাসের দেখা পাওয়া যায়…..
হর্নের আওয়াজের সাথে দ্রুত নিশ্বাস বেড়ে চলেছিল অন্বেষার,
তৎক্ষণাৎ, গাড়ির দরজার কাঁচটা নেমে গেলো, আর চোখে সব টাই বুঝতে পারছিলো অন্বেষা, এবারে কি করবে?
যেমনি একটু এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো সেই চেনা আওয়াজ ভেসে এলো অন্বেষার কানে….

“মিস মিত্র! গাড়িতে উঠে আসুন……” বেশ ধমকের সুরে বললো মানুষটি…..

একিই এতো অরুণজিৎ রায়…..

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্বেষা….কাঁপা কাঁপা গলায় বললো –
“আমি পুরো ভিজে আছি মিস্টার রায়!”

এবারে দরজা খুলে মিস্টার রায় গাড়ি থেকে নেমে এলেন, গাড়ির খোলা দরজার দিকে ইশারা করে বললেন চোখ দুটো বড়োবড়ো করে বললেন –
“গাড়িতে উঠে বসুন….এক্ষুণি…মুভ ইনসাইড …..
ফোনটা কি করতে রাখেন নিজের সাথে…… ”
বেশ উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে কথাটা শেষ করলো মিস্টার রায়….

ভেজা জামা কাপড়েই অন্বেষা উঠে বসলো গাড়িতে…..
ড্রাইভার সিটের পাশে…..
অন্বেষা গাড়িতে উঠে গেলে ড্রাইভার সিটে বসে পড়লো মিস্টার রায়…..

ঘন – ঘন নিশ্বাস পড়ছিলো অন্বেষার……গলাটা শুকিয়ে এসেছিলো, হাত পা তখন কেঁপে চলেছে!
কান্নাটা কোনো মতে আটকে রাখলো গলায়….
ভয়ে চোখ থেকে… দু ফোটা জল গড়িয়ে এলো গাল বেয়ে…..

“রিলাক্স! মিস মিত্র! এভরিথিং ইস ফাইন…..রিলাক্স ……ওকে? I’m there with you…….ওকে? আমি আছি……ওকে?……রিলাক্স …..রিলাক্স…..
have some water …
এখন বেটার লাগছে? হমম? এভরিথিং ইস ফাইন…….রিলাক্স….আর জাস্ট দশমিনিটে আপনি পিজি তে পৌঁছে যাবেন…..রিলাক্স…..
জাস্ট সিট্ বেল্টটা লাগাতে হবে একটু কষ্ট করে…..আমি হেল্প করে দিচ্ছি কেমন…..জাস্ট রিলাক্স….”

অন্বেষা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে…..
বোধহয় অন্বেষা বুঝতে পারছিলো এই চেনা আওয়াজ সে আগে কোথায় শুনেছে ……
সেই একিই কথা….একই সুর….
আমি আছি ……. I’m there with you…….ওকে?……হ্যাঁ, ঠিক এই দুটো চোখ…..ঠিক দেখছে সে…..ঠিক দেখছে…..

***************************************************************

বছর দেড়েক আগের কথা, কোলকাতাতে তখন নতুন অন্বেষা ……

তৃষা খুব জোরাজুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো অন্বেষাকে নিজের বাড়ি….সেদিন সারাটাদিন অন্বেষা তৃষার বাড়িতেই ছিল…..
রাতে প্রচুর আড্ডা দিতে দেরি হয়ে গেলো, তৃষার মা খুব জোর করলো অন্বেষাকে সেদিন রাত টা তৃষার বাড়িতে থেকে পরের দিন সকালে বেরোনোর জন্যে….
দুজনে একসাথেই কলেজ যাবে বলে ঠিক হলো…..
Durganagar স্টেশন থেকে dumdum junction
তারপর দমদম মেট্রো দিয়ে সেন্ট্রাল,
সেন্ট্রাল থেকে কলেজ……
তখন অন্বেষার বাসে উঠতে সমস্যা হতো বলেই তৃষা মাথা থেকে এমন বুদ্ধি বের করেছিল……

তৃষা ও অন্বেষা সেদিন একসাথেই ছিল ট্রেন আসার আগে অবধি…..
ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকতেই কি ভাবে যেন আলাদা হয়ে গেলো ওরা, এদিকে অন্বেষা দেখতে পেয়েছে তৃষা ট্রেনে চেপে পড়েছে, কাজেই কোনোমতে ট্রেন ছাড়া যাবেনা…..

তাড়াহুড়োতে কি মনে করে জেনারেল কামড়াতে উঠে পড়েছিল কে জানে…..
ট্রেনে উঠতেই সেদিন অদৃশ্য ও অসংখ্য হাত স্পর্শ করে চলেছিল অন্বেষার শরীর!
প্রথম প্রথম দুএকটা আঙ্গুল…..তারপর অসংখ্য নোংড়া স্পর্শ!
ভয়ে, ঘেন্নায় একটা কান্না মেশানো আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিলো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে, প্রতিবাদের কোনো সুর নয়, হেরে যাওয়ার একটা সুর বেরিয়ে এসেছিলো গলা চিরে…..
“প্লিজ দাদা, একটু সরে দাঁড়ান…..আমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদা….আমার খুব কষ্ট হচ্ছে……বলে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে সে!”
অসহায় মেয়েটাকে কাঁদতে দেখেও নিস্তার দেয়না ওই হাত গুলো, তবে শিড়দাঁড়াটা বেশ শক্ত করে কেউ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে, দাঁড়িয়ে পরে অন্বেষার পেছনে, তারপর লুকিয়ে নয়…..
অতগুলো লোকের সামনে স্পর্শ করে অন্বেষার দুটো কাঁধ…..কাঁধটা বেশ জোরে ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে বলে…..
“স্টেবেল….রিলাক্স ….কিচ্ছু হবেনা…..প্রতিবাদ করো….কাঁদবে না….একদম না……”

তারপর মুহূর্তেই অন্বেষাকে একটু পিছিয়ে টেনে নিয়ে রডের এপারে দাঁড় করিয়ে দেয়, নিজের দুটো হাত ছড়িয়ে, ঠিক অন্বেষার পেছনেই দাঁড়িয়ে পরে ….
তারপর পেছন থেকে রডটা ধরে ফেলে আবার, আগলে নেয় অন্বেষাকে নিজের দুটো হাতের মাঝে……
মুহূর্তেই অন্বেষা বুঝতে পারে, পুরো শরীরটায় আর ঠেকছেনা কোনো আঙ্গুল…..
নেই কোনো নোংড়া স্পর্শ!
ওই রকম ভিড়েও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আগলে নেয় অন্বেষা কে ….দুটো হাত দিয়ে বানিয়ে ফেলে একটা আস্তরণ…..যে আস্তরণ ভেদ করে কেউ স্পর্শ করতে পারেনি সেদিন আর অন্বেষাকে…..
পুরো রেল কামরায় চিড়েচ্যাপ্টার চাপাচাপির সত্ত্বেও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দেবতা কি ভাবে সেই শক্ত আস্তরণ বাহুর জোরে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তা অন্বেষা জানেনা…
এমনকি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও দেবতার শরীরের কোনো অংশ স্পর্শ করেনি অন্বেষার শরীর টাকে….
শুধু কানের সামনে বলে যাওয়া কথা গুলো….
স্পর্শ করেছিল অন্বেষার হৃদয়টাকে….
বলেছিলো..
“এখন বেটার লাগছে? হমম? এভরিথিং ইস ফাইন…….রিলাক্স……ওকে……I’m there with you…….ওকে?……
একদম চিন্তা করবেন না…..বি স্টেবেল….আপনি ট্রেন থেকে নামার পরেই আমি নামবো…..আপনি কোথায় নামবেন?
দমদম? …….
……….
তাহলে তো চলেই এসেছে!
আর দুটো মিনিট কষ্ট করুন ম্যাডাম…..প্লিজ পেছনে ঘুরবেন না….
ভীষণ থার্স্ট….আমি ব্যালান্স পাবনা……রিলাক্স, এই তো দমদম ঢুকছে গাড়ি……ওকে? সামনে সবাই নামবে…..হ্যাঁ শিওর….আমি নামিয়ে দেব সব্বাই কে….ওকে! রিলাক্স…..

তারপর দমদমে গাড়ি ঢুকতেই অন্বেষা দেখলো খুব অদ্ভুত ভাবে সবাই সরে গেলো সামনে থেকে, সেদিন অন্বেষার পেছন পেছন নামলো আরও অনেক লোক!
ভিড় ঠাঁসা ট্রেন থেকে বেরিয়ে অন্বেষা তাকিয়ে থাকলো কামরার দিকে, দেখলো দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে অন্বেষার দিকে, ভিড়ের মধ্যেই অন্বেষার চিনে নিতে অসুবিধে হলোনা সেই দুটো চোখ, সেই দুটো হাত যেটা আগলে রেখেছিলো অন্বেষা কে শেষ দুটো স্টেশন…..

মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়ার আগে অন্বেষা এক ঝলক দেখেছিলো আনকমন একটা চেহাড়া, তবে বেশ মানানসই……….সেই দুটো চোখ……
……………ভরাট দুটো উজ্জ্বল চোখ……….

মুহূর্তেই ট্রেন অন্বেষাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলো সেদিন নিজের শেষ ঠিকানায়…..

“মিস মিত্র, এবার কোন দিকে? ”

চেনা সুরের আওয়াজ শুনে অন্বেষা আবার তাকিয়ে থাকে ওই চোখ দুটোর দিকে….

“মিস মিত্র? লেফট? না সোজা….”

এতক্ষণে তাড়াহুড়োর সুরে অন্বেষা বলে ওঠে লেফট…..লেফট……

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here