পাতাঝরার শেষে……পর্ব ৭

0
1603

পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা

পর্ব ৭) Avoid Him!

“আহেম…আহেম….তাই বলো এই ব্যাপার….মেয়ে তাহলে প্রেমে পড়েছে…….”

“উউফ! রিয়া দি আসতে, ওরা শুনলে কাল পুরো কলেজ জেনে যাবে…..”

“জানলে জানুক! প্যায়ার কিয়া কই চোরি নাহি কিয়া…..”
বলে গুনগুন করে গান ধরলো রিয়া…

“রিয়া দি….প্লিজ আসতে….আসতে……প্লিজ….”

“একটা শর্ত আছে! আমাকে আজকে সবটা বলতে হবে……বল ডান….”

“ডান….এখন প্লিজ চুপচাপ থাকো….প্লিজজ”

“By the way…..he don’t look like 30, maximum 26! Are you sure about his age? He is too good! Damn handsome yaar”

“উউফ রিয়া দি, তৃষা যদি একটাবার শুনতে পারে কাল সবাই জেনে যাবে….প্লিইজজ”

“ওকে! ওকে! বাট seriously তোর সাথে হেভি লাগছে রে! কিরকম যেন একটা সিম্পেল লুক তোদের দুজনেরই…..
বিশ্বাস কর! আজ যদি কোনো director
দেখতো না পাক্কা নেক্সট মুভি তে তোরাই লিড রোল…..”

“উউউফফফ! রিয়া দি …..”

“সরি! সরি! এক্সসাইটেড হয়ে পড়েছি তোদের কে একসাথে দেখে…..”

এতক্ষণে অন্বেষা দেখলো তৃষারা হাত দেখিয়ে ডাকছে ওদের বাসের পেছনের দিকে…
“তাড়াতাড়ি! সিট্ ভোরে যাবে….”

***************************************************

“তাহলে কবে থেকে? হমম?”
পিজি তে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো ওরা বারান্দায়….

“তুমি ব্যাপারটা যেরকম ভাবছো সেরকম নয় কিন্তু!”
খুব নীচু ও ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো অন্বেষা…
মুখের হাসিটা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো অন্বেষার….

“তাহলে কিরকম শুনি?”

“কিছুইনা…..গো…..”

“তাই? অন্বেষা আজকে তোর মুখে আমি সেই হাসিটা দেখেছি যেটা উধাও ছিল এতদিন…..”

অন্বেষা মুখটা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো….
তারপর দুচোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা…..

“কি রে তুই কাঁদছিস? কি হয়েছে বাবু? ইটস ওকে! আর এরম প্রেমে পড়লে কে কাঁদে…
তুই সত্যি পাগল…”

“তুমি ব্যাপারটা কিচ্ছু জানোনা রিয়া দি…”

“কি জানিনা? অন্বেষা কি হয়েছে? তোদের মধ্যে কিছু…”

“না, না এসব কি বলছো!”

“তবে কি?”

“লোকটা সম্পর্কে আমি খুব একটা ভালো কিছু শুনিনি গো…..
মানে একদিন কথায় কথায় রিতিকা বলে ফেলেছিলো অনেক কিছু…..
……আমি ঠিক তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারছিনা গো…..ব্যাপারটা হলো আমি যত চাইছি ব্যাপারটা থেকে দূরে সরে আসতে….
তত বেশি জড়িয়ে পড়ছি আমি ……
এমন কেন হচ্ছে রিয়া দি…….
ঋতেশ এর কথা ভাব, বাড়ির পাশে থাকে, হাসিখুশি নর্মাল! ভালো চাকরি করে, ওপেন মাইন্ডেড….ছোট্ট বেলা থেকে আমার বন্ধু!
কতদিন হলো আমাকে প্রপোজ করেছে, বাবা মা এখনো চায় আমাদের ব্যাপারটা এগোক, বা যেকোনো অন্য ছেলের সাথে আমার বিয়েটা দিতে চায়……
কিন্তু ……
আমার মনে শেষ দশদিন থেকে কি চলছে….আমি ঠিক বোঝাতে পারবোনা…..

ঋতেশ এর জন্যে আমি চেয়েও কখনো ভালোলাগাটা তৈরী করতে পারিনি, আর মিস্টার রায়ের জন্যে চেয়েও ভালোলাগাটা মুছে ফেলতে পারছিনা….”

“ভালোলাগাটা নিজের ইচ্ছে মতন তৈরী বা মুছে ফেলা যায়না অন্বেষা…..”

“তাই বলে মিস্টার রায়!”

“কেন? তোর অসুবিধে টা কোথায়? এমন কি শুনেছিস তুই? আরে বাবা কাউন্সিলিং করায় এই তো, আর কি যেন বলছিলিস ট্রেন নম্বর মনে থাকে, এক্সসেপশনাল IQ, আর তোর চেয়ে অনেকটাই বড়ো….কিন্তু তাতে কি?”

“ক্রাইম রেকর্ড আছে মোস্ট প্রবাব্লি…”

“হোয়াট? তুইই এটা আমাকে আজকে বলছিস?”

“Sorry রিয়া দি ….”

“ছাড়! তুই কি ভাবে জানলি….কে বলেছে?”

“রিতিকা বলেছে তবে আমার মন বলছে সত্যি বলেছে, মোর দ্যান ইট মিস্টার রায় নাকি ও বাড়ির কেউ নয়, তারপর বাড়ির মধ্যে পরিষ্কার একটা বিভাজন, জয়েন্ট ফ্যামিলি, অথচ কেউ কারোর সাথে কথা বলেনা রিয়া দি…..

একটা বড়ো গোলমাল আছে রিয়া দি….
আমাকে যবে থেকে বললো রবিবার আসার কথা, যবে থেকে…..

সেদিন থেকে পুরো বাড়িটা ফাঁকা থাকে……কেউ থাকে না যে সময় আমি যাই ……
কি করে সম্ভব বলতঃ!

আয়নার সাথে কথা বলা, ট্রেন নম্বর মনে রাখা,
নিজের লেখাদের সাথে বন্ধুক্ত, রিয়া দি আমায় মনে রাখা একবার দেখেই, এগুলো সবটা নর্মাল মনে হয়….

কেমন একটা স্থির চোখে তাকানো তারপর বলা আমি হার্মফুল নই……..আমি হার্মফুল নই…….
একটা ঘুপটি ঘরে থাকেন উনি…..
দরজা বন্ধ সবসময়! কোনদিন দেখবে না দরজাটা খোলা….

ঘরের মধ্যে একটা ভ্যাপসা গন্ধ…..

কোনো হসপিটালের গন্ধ…..না কি আমি বুঝিনি আজও!

গাটা কেমন যেন গুলিয়ে আসে আমার….
প্রথম দিন একটা ছোট্ট জানালা খোলা ছিল…
মানে ইন্টারভিউয়ের দিন…..
তাই বোধহয় গন্ধটা একবার নাকে এলেও খুব অস্বস্তি হচ্ছিলোনা যেন রিয়া দি…
তবে পরের দিন……
আরও ঘন্টা খানেক থাকলে আমি হয়তো বমি করে দিতাম!
আমি বুঝতে পারছি রিয়া দি একটা বড়ো গোলমাল আছে…..
সবটা জেনেও আমি কি ভাবে…..”
কথাটা শেষ হতে না হতেই….অন্বেষার গলাটা আবার ভিজে এলো….

“ইটস ওকে! ইটস ওকে!” বলেই রিয়া জড়িয়ে ধরলো অন্বেষা কে…..

“আমি কি করবো রিয়া দি! তুমি প্লিজ বলে দাও….ওই মুখটা সারাটাদিন চোখের সামনে ভাসছে, আমি পড়তে পারছিনা…..দু মাস বাকি নেই পরীক্ষার ইন ফ্যাক্ট এক মাস দশ দিন বাকি…..
জুনে নেট….
একটা চাকরি নেই….
আর এই সময়!”

“ইটস ওকে বাবু!”

“নাথিং ইস ওকে রিয়া দি…..নাথিং ইস ওকে….”

“শোন আমার কথাটা মন দিয়ে শোন….কিরে…
অন্বেষা!”

“হমম বলো…”

“যেমন চলছে তেমন চলুক, কেমন! এত স্ট্রেস নিসনা….জোর করে এইসব ব্যাপার কন্ট্রোল করতে পারবিনা…..
একদিনে এইসব ভোলা সম্ভব নয়….
তবে আমার মনে হয় বেরিয়ে আসাই ভালো….
মানে ক্রাইম রেকর্ড, আমি যদি বাকিটাকে ইগ্নরও করি…..
তারপর বড়োলোক! হয়তো টাকা দিয়েই বেরিয়ে এসেছে…..
সারাটাজীবন কাঁদার চেয়ে
আজকের কান্নাটা কেঁদে নেওয়া অনেক ভালো বাবু! নিজে থেকে কোনো কন্টাক্ট করবিনা…..
কেমন?

“না ফোনে কথা হয়না সেরকম!”

“গুড….আজকের পর আর এসব চিন্তা নয়……
অনেক সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে……
পড়তে বস এখন!”

“হমমম….আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে রিয়া দি!”

“ভালোবাসা কাকে কাঁদায় নি বলতো!
যাতনা ছাড়া যে ভালোবাসা অসম্পূর্ণ!
তবে এই ভালোবাসা ভয়ানক অন্বেষা!
ভয়ানক! শোন ……
একটু busy থাকার চেষ্টা কর! সবটা ঠিক হয়ে যাবে! আজ ওভাবে রং দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি….ইন দ্যাট কেস…..”

“নিজের মধ্যেই ছিলাম না তখন! হঠাৎ কি যে হলো!”

“ইটস ওকে…অন্বেষা…..আর লোকটার গাড়িতে আসা বন্ধ কর! ড্রপ দিতে চাইলেও না…..”

“হমম…..”

“একটু কষ্ট হবে বাবু…..আসতে আসতে সবটা সয়ে যাবে! তোকে নিজের ভালোটা বুঝতে হবে!”

“রিয়া দি!”

“বল….”

“বলছি তোমার কি মনে হয়, ফাইনাল এক্সামটা হয়ে গেলে দুর্গাপুর চলে যাবো, যদি কোনো চাকরি না পাই…..”

“পাগল হয়ে গিয়েছিস! আর চাকরি? শুধু সরকারি চাকরির ওপর রিলাই করতে পারবি!”

“জানি…কিন্তু….”

“ওসব পরে ভাবা যাবে….এখন এক্সামটা তে ফোকাস কর! আর একটা কথা, ও বাড়িতে কিছু খাবিনা তুই…..কিচ্ছুনা…..মনে থাকে যেন…..জলও না! আর লোকটাকে সামলে চলিস,
এই ধরণের লোক কি মনে করে তোর উপকারটা করেছে কে জানে!

“হ্যাঁ! ঠিক আছে…..”

********************************************************

হুড়হুড় করে কেটে গেলো আরও ছটা দিন….

রবিবার যখন রয় ম্যানশনে ঢুকলো অন্বেষা….
বাকি সব দিনের মতন হারাধন বাবু দরজা খুলে দিলেন তারপর এগিয়ে গেলেন ভেতরে……

একটু ভেতরে ঢুকতেই অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায় বসে বাইরের সোফাতেই….
কোলে ল্যাপটপ!

হৃদ্স্পন্দনটা কেমন যেন বেড়ে গেলো হঠাৎ…..
মুহূর্তেই মনে পরে গেলো তার রিয়া দির কথা –
কি উদ্যেশে ভালোমানুষি করছে কে জানে?

অন্বেষা কে দেখতেই ঠোঁটের কোণায় একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো মিস্টার রায়ের….

চোখের চাহুনিটা সেই আগের দিনের মতন!
দুটো ঠান্ডা চোখ চেয়ে আছে অন্বেষার চোখের দিকে……..
বোধহয় কিছু বলবে ভাবছিলো….

তবে অন্বেষা সেটার সময় দিলোনা, দ্রুত এগিয়ে গেলো সিঁড়ি বেয়ে রিতিকার ঘরের দিকে, ওপরে উঠতেই দেখলো দরজাটা বন্ধ,
একিই রিতিকা কোথায়?
আঁতকে উঠলো অন্বেষা!
সমস্ত বল প্রয়োগ করে ভীষণ জোরে ধাক্কা দিলো দরজাটায়…..

গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার করে উঠলো “রিতিকা? তুমি কোথায়?”

দরজার থাবা মারার প্রকান্ড আওয়াজে ও অন্বেষার চিৎকার শুনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে মিস্টার রায় দাঁড়ালো বন্ধ দরজার সামনে……
ঠিক অন্বেষার সামনে……
“অন্বেষা! কি হয়েছে?”

“রিতিকা কোথায়? কি প্ল্যান আপনার? কি করতে চান আমার সাথে…..কি করতে চান? ভেবেছেন কি আমায় একলা পেয়ে…..”

বীভৎস চিৎকার থেমে গেলো বন্ধ দরজাটা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে!
সহজ সরল বাচ্চা মেয়েটা দাঁড়িয়ে তখন অন্বেষার সামনে…..

“দরজা লক কেন ছিল রিরি?”
খুব গম্ভীর ও ভারী গলায় প্রশ্নটা করলো মিস্টার রায়…..

“লক ছিলোনা দাদাভাই….
মিস মনে হয় নবটা না ঘুরিয়ে ধাক্কা দিচ্ছিলো দরজায়, তাই দরজা খুলছিল না…..”

রিতিকার কথা শেষ হতে না হতেই অন্বেষার নজর গেলো দরজার লক বা নব টার দিকে! ঠিক সে লকটা না ঘুরিয়ে ধাক্কা দিচ্ছিলো দরজায়….

মিস্টার রায় আবার প্রশ্ন করলো রিরি কে –
“মিসের ভুল ধরতে তোমায় বলিনি রিরি….
তুমি কোথায় ছিলে? এতক্ষণ ধরে যখন শুনতে পাচ্ছ দরজায় নক করছে মিস, এতোটা সময় চুপচাপ বসে ছিলে ঘরের ভেতর!”

খুব নীচু গলায় রিতিকা(রিরি) বললো –
“Sorry দাদাভাই! আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম….তাই একটু…..আজকে খুব গরম বলে AC টা চালিয়ে ছিলাম…..তাই দরজাটা ভেজানো ছিল….Sorry মিস…..”

মিস্টার রায়ের সামনে তখন দুজনেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে…..
গলাটা পরিষ্কার করে মিস্টার রায় বললো –
“ইটস ওকে! মিস কে নিয়ে ঘরে যাও…”

মুহূর্তেই কথাটা শেষ করে হুড়হুড় করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন মিস্টার রায়….তারপর নিজের ঘুপটি ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন সে…..
করিডোরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো অন্বেষা…

“মিস Sorry”

“ইটস ওকে….চলো…..”

*******************************************************

“অন্বেষা এনাফ! তুই কেন বুঝতে পারছিস না বলতো যা হয় ভালোর জন্যেই হয়! যখন থেকে ফিরেছিস তখন থেকে একটাই কথা বলে চলেছিস…..”
বেশ বিরক্তি নিয়ে কথাটা শেষ করলো রিয়া…..

“রিয়া দি! আমি অকারণে মানুষটা কে…..”
বলতে বলতে আবারো গলাটা ধরে এলো অন্বেষার……

“আমার দিকে চেয়ে দেখ! লক্ষী বোন আমার! আমার কথাটা তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর! দেখ তুই নিজে থেকে ইচ্ছে করে Avoid করতে পারছিলিস না!
অথচ ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলিস…..
এদিকে তুই টিউশন পড়ানো টা ছাড়বিনা …..
একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে যদি পরের দিন থেকে তোর মুখোমুখি হওয়াটা বন্ধ হয়ে যায় এতে সব চেয়ে বেনিফিট তোর!
At least তোর এক্সামটা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা কর! তারপর না হয়…..”

“ততদিনে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে…”

“হ্যাঁ হোক! শেষ হয়ে যাক…..
যে মানুষটা Arrested ছিল, তার সাথে সম্পর্ক রাখারই বা কি আছে!
একটা চাকরি না পাওয়া অবধি পড়া….
তারপর আর ও বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই….”

“আমরা কিন্তু পুরো ঘটনাটা জানিনা রিয়া দি..”

” তোর কি মনে হয় – এখন সত্যিটা Analysis
করার সঠিক সময়! এক্সামের আগে….
কাকুর কথা ভাব অন্বেষা…
একটা মানুষ শেষ প্রায় দুবছর থেকে লড়ছে তোর জন্যে নিজের ফ্যামিলির সাথে……
নিজেদের দাদার সাথে, নিজের ওয়াইফের সাথে, কেন? শুধু তুই মানুষ হবি বলে…..
তুই একটা ভালো চাকরি করবি বলে……
তুই সব কিছু এক নিমেষে ভুলে যাবি…….
অন্বেষা…..তুই শুনছিস…..না কি…..”

“তুমি ঠিক বলছো রিয়া দি…..”

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here