পাতাঝরার শেষে……পর্ব ৬

0
1360

পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা

পর্ব – ৬) ..রাঙিয়ে দিয়ে যাও…

ঘড়িতে ঠিক রাত এগারোটা…
ঘন্টা দুয়েক হলো তার রিয়া দির ল্যাপটপ অন্বেষা নিজে হাতে তুলে দিয়েছে মিস্টার রায়ের হাতে…

ঘন্টা দুয়েক পরেও কোনো ফোন এলোনা মিস্টার রায়ের….
উল্টে মনে মনেই ভাবতে থাকলো রিতিকার মুখ থেকে সেদিন অতগুলো কথা শোনার পরও ল্যাপটপটা দেওয়া ঠিক হয়নি….

এই ধরণের মানুষ অন্যদের পার্সোনাল ডাটার মিসইউস করতে পারে, কে জানে কি কারণে Arrested ছিল!

কথাটা বারেবারে মাথাতে ঘুরপাক খেতে থাকলো, তবুও সবটা বলে উঠতে পারলোনা তার রিয়া দি কে, তখন তাড়াহুড়ো তে মাথাটাই কাজ করছিলো না অন্বেষার!

এদিকে কাল গিয়ে প্রফেসর কে কি বলবে সেটাও ঘুরপাক খেতে থাকে মাথার ভেতর…..

“অন্বেষা শুয়ে পর! যা হওয়ার হবে! কি করবি বল?”

“রিয়া দি, আমি একটা ব্যাকআপ নিলাম না!”

“এখন আর কি করবি! যেটা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! আর ভেবে কি লাভ?”

“আর মাস দুয়েকের মধ্যে ফাইনাল সেমিস্টার….
……কি ভাবে ম্যানেজ হবে, আর তাছাড়া পুরো ব্যাপারটা কলেজের হাতে নেই, থিসিস সাবমিশনের একটা টাইমলাইন থাকে….”

“এসব ছেড়ে ভাব নতুন করে শুরু করলে কতদিন লাগবে, দেখ Analysis টা তো করা আছে….”

“তাতেও, পুরোটা রেডি করতে, টাইপ করতে, ফরম্যাট করে গোছাতে টাইম লাগবে রিয়া দি!”

“আমি জানি অন্বেষা! তবে কি করবি! তোকে ফেস করতেই হবে এটা…
কাল গিয়ে কথা বল, দেখ কি বলে! আর এখন রাত করিস না….ঘুমিয়ে পর….”

“জানিনা গো কি হবে, তারপর তোমার ল্যাপটপ টাও আমি….”

“আরে বাবা! ঠিক আছে শুয়ে পর…..”

রাতের লাইটটা নিভিয়ে ফোনটা আবার তুলে নিলো হাতে, চিন্তায় কিছুতেই ঘুম আসছেনা…
অজান্তেই ডায়াল করে দিলো মিস্টার রায়ের নম্বর টা…..

“হ্যালো মিস্টার রায়…”

“অন্বেষা! আমি দেখছি কি করা যায়….এখন একটু busy, বাই…”

মিস্টার রায়ের কথা শেষ হতে হতেই কেটে গেলো লাইনটা…..
আগামী কালের কথা ভাবতেই ভীষণ টেনশন শুরু হলো আবার…
ক্লান্ত চোখে জল নেমে এলো আবার! ভীষণ বিরক্ত লাগছিলো….
কোনোরকমে জোর করে চোখ দুটো বুজে শুয়ে রইলো সে…..

তারপর কখন ঘুম জড়িয়ে এলো দুচোখে টের পেলোনা সে….

********************************************************

রাতে ধড়পড় করে উঠে বসলো অন্বেষা খাটে…..
একিই চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো ওকে….
কাল কি হবে? কতদিন সময় দিতে পারে….? নাকি একেবারেই Allow করবেনা!

কটা বাজে কে জানে….
ঘরের ছোট্ট জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখলো অর্ধেক চাঁদ ও কিছু তারা টিমটিম করে জ্বলছে পুরো আকাশ জুড়ে……
বেডসাইড ছোট্ট টেবিল থেকে হাতে তুলে নিলো ফোন…..

ফোনটাও কখন সুইচ অফ হয়ে গিয়েছে কে জানে!
খাট থেকে উঠে টেবিল ল্যাম্পটা অন করে দিলো, টেবিল ঘড়িতে ঠিক চারটে পনেরো….
ফোনের চার্জার টা কানেক্ট করে দিলো প্লাগে….

আনমনেই তারপর ওল্টাতে থাকলো বইয়ের পাতা….
মিনিট পনেরো পরে ফোনের ডান পাশের বোতামটা চেপে ধরলো খানিকক্ষণ……ফোনের আলোটা জ্বলতেই দেখলো মিস্টার রায়ের একটা টেক্সট মেসেজ….
problem solved…..
Aami

মুহূর্তেই অন্বেষার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো….মুহূর্তেই ঢুকে পড়লো ইনবক্সে পুরো মেসেজ টা পড়বে বলে…..
ইনবক্সে ঢুকতেই দেখলো….

“Problem solved….

Aami neeche garite achi, document er printout o neowa hoye giyeche! Everything is fine! 🙂 Tomar phone ta most probably switched off! Text ta dekhle neeche esho, I’m waiting….”

মুহূর্তেই অন্বেষা ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ব্যালকনি তে…..
হ্যাঁ সে ঠিক দেখছে লাল গাড়ি তখনও অপেক্ষা করছে ফুটপাথের এক কোণে…..

অন্বেষা আসতে আসতে বেরিয়ে এলো নিজের ঘরের বাইরে, সদর দরজা খুলতেই চোখে পড়লো একটা বড়ো তালা কোলাপ্সিবল গেটে!

উউফ! চাবিটাও কাকিমার ঘরে!
ধৈর্য হারিয়ে আবার এসে দাঁড়ালো ব্যালকনি তে!
এবারে ডায়াল করে দিলো মিস্টার রায়ের নম্বরটা…..

দু-চারটে রিং হতেই ফোনটা তুলে নিলো মিস্টার রায়….

“হ্যালো মিস্টার রায়…”

“হ্যালো মিস মিত্র! কাল সব ফিক্স হয়ে গিয়েছে! আপনার Document আমার কাছেই আছে….”
খুব ঠান্ডা ও ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর এলো মিস্টার রায়ের……

“Thank you so much! আমি চেয়েও নীচে আসতে পারছিনা….কলাপ্সিবল গেটে তালা আটকানো, চাবি আন্টির কাছে…..I’m so
sorry…….আপনি কাল সারাটা রাত গাড়িতেই ছিলেন? গাড়িতেই ঘুমিয়েছিলেন! ইসস….আমার জন্যে…”

“ইটস ওকে মিস মিত্র! আপনি কি রোজ এতো ভোরেই উঠে পড়েন….নাকি টেনশনে ঘুম ভেঙে গেলো আজ?” ঘুমে জড়ানো ঠান্ডা একটা আওয়াজ আবারো ভেসে এলো অন্বেষার কানে…..

“টেনশনে! এতো ভোরে উঠিনা….তবে আর ভালো লাগছেনা….এই ভাবে আপনাকে দাঁড় করিয়ে! ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে খুব রেস্টলেস লাগছে….”

“ওহ! আপনি ব্যালকনি তে! এক সেকেন্ড….

মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতেনা হতেই খুলে গেলো লাল গাড়ির দরজা, বা হাতে ফোন, ও ডান হাতে একটা স্পাইরাল বাইন্ডিং ফাইল নিয়ে বেরিয়ে এলেন গাড়ি থেকে মিস্টার রায়….

এক গাল হাসি নিয়ে হাতের ফাইলটা একটু উঁচু করে ধরলো সে…..
তারপর ইশারা করলো হাতের ফাইলটার দিকে….

ফোনে আবার ভেসে এলো মিস্টার রায়ের আওয়াজ…
“কি খুশি তো? উউফ! কি টেনশানেই না ছিলেন! একটা বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো কাল! মিস মিত্র প্লিজ আর কখনো এরকম করবেন না! আপনি জানেন তো তাড়াহুড়োতেই দুর্ঘটনা..”
ব্যালকনির দিকে চেয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো মিস্টার রায়….

“কাল আপনি আমাকে অন্বেষা বললে ডাকছিলেন! অন্বেষা বলেই ডাকুন….
মিস মিত্র বলার দরকার নেই…. আপনি আপনি করারও দরকার নেই ….কাল তো দিব্বি তুমি তুমি বলছিলেন…..
আর বয়েসেও আমি আপনার থেকে অনেকটাই ছোট…..মিস্টার রায়…..
এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড, কাকিমার ঘরের দরজা খুলেছে বোধহয়, আপনি দাঁড়ান, আমি আসছি ……”

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই অন্বেষা বেরিয়ে এলো নীল বাড়িটা থেকে…….
লাল গাড়িটার সামনে এগোতেই দেখলো মিস্টার রায়কে ….
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা গভীর দুটো চোখ ভীষণ মায়াবী লাগলো অন্বেষার! অবাধ্য ছোটছোট চুলগুলো এসে পড়েছে কপালে, মুখে একটা সরলতার হাসি…..

আজ এক নতুন মিস্টার রায় কে দেখলো অন্বেষা…..

“মিস মিত্র….এই যে..”

“অন্বেষা!”

আবার একটা হালকা হাসির রেখা অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায়ের ঠোঁটে….

“ওকে! ফাইন! অন্বেষা! এই হলো তোমার document আর এই তোমার রিয়া দির ল্যাপটপ……সব ঠিক আছে তো?”

“ল্যাপটপ টা ঠিক হলো কি ভাবে? আর প্রিন্ট আউট…স্পাইরাল বাইন্ডিং এগুলো কি ভাবে?”

“ল্যাপটপের ইসু টা আমি একা একা ফিক্স করেনি….আরো একজন ছিল আমার সাথে, কাল রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ সে সব রিস্টোর করতে পারলো…,
মোটামোটি বিশ বাইশ টা ইউটিউব ভিডিও দেখে, কিছু অনলাইন হেল্প নিয়ে, আর Recovery software এর দৌলতে আপনার document রিস্টোর করা গেলো…. একবার দেখুন এইটাই ঠিক document তো?”

রাস্তার স্ট্রিট লাইটের টিমটিমে আলোয় অন্বেষা
আবার চেয়ে দেখলো হাতের ফাইলটার দিকে, কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ টা ওঠাতে ওঠাতে…..

“প্রথম পাতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঠিক document….তবে আপনি বুঝলেন কি করে এইটাই …”

“কেন কালিই তো আপনি বললেন my documents এ রাখা আছে! আর অন্য কোনো ফাইল ছিলইনা ওই লোকেশনে…..

ওকে….. প্রায় পাঁচটা….আমি এবারে আসি ……আপনিও একটু রেস্ট নিয়ে নিন…..”

“প্রিন্ট করানোর দরকার ছিলোনা! কোথা থেকে করলেন? আবার বাইন্ডিং…!”

“অফিস গিয়েছিলাম তারপর! অফিস থেকেই প্রিন্টআউট নিলাম, বাইন্ডিং নিজেই করতে পারি, মেটেরিয়াল থাকে অফিসে! আমি আসি এখন! এসব কথা পরে হবে কখনো! বাই ….”

কথা শেষ হতে না হতেই মুহূর্তেই লাল গাড়ি এগিয়ে চললো সদর রাস্তার দিকে…..
অন্বেষা দাঁড়িয়ে রইলো একা….

পূর্ব আকাশের সূর্য তখনও নেই আকাশে, তবে
অপরিস্ফুট শঙ্খ সাদা ভোরের আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে…..
সেই আলোয়
সামনের বাড়ি ও গাছগাছালির নিচে জমে থাকা অন্ধকার ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে….
ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে আসছে লাল, নীল, সাদা বাড়িগুলো, হলুদ সবুজ গাছের পাতা গুলো!

ভোরের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ার ঝাপটায় শিশিরে ভেজা গাছের পাতাগুলো এক অদ্ভুত সুর তৈরী করেছে, এক অদ্ভুত আদর মাখানো সুর…..
যে সুর অন্বেষা আগে কখনো শোনেনি এর আগে!

***********************************************************

কলেজ শেষে গেটের বাইরে একটা লাল গাড়ি দেখে খানিকটা দৌড়ে এলো অন্বেষা!
“মিস্টার রায়ের গাড়ি না!”

হাসি মুখ নিয়ে আরও খানিকটা দৌড়ে যেতেই দেখলো একজন মেয়ে নেমে এলো গাড়ির দরজা খুলে, পায়ে স্নিকার্স, পরণে সাদা ধবধবে টি শার্ট, ফেডেড ব্লু জিন্স, লম্বা চুলগুলো এসে পড়েছে ঘাড়ে…..
মেয়েটা মুহূর্তেই ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটিকে হাত দেখিয়ে বিদায় জানালো আর তারপর ঢুকে গেলো কলেজ ক্যাম্পাসে…..

ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটা কে
ভীষণ রকম ভাবে দেখার চেষ্টা করতে থাকলো অন্বেষা…..
হ্যাঁ! মিস্টার রায়ের মতনই লাগছে……

মুহূর্তেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো অন্বেষার সাথে সাথে, হঠাৎই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আবার!

মুহূর্তেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করে দিলো মিস্টার রায়ের নম্বরটা…..
দুটো রিং হতেই একটা চাপা গলা শুনতে পেলো অন্বেষা…

“হ্যালো! এনিথিং রং?”

“আপনি এখন কোথায় মিস্টার রায়?”

“প্রেসেন্টেশনের মাঝে অন্বেষা, কেন বলতো….
কালকের ফাইলটা সব ঠিকঠাক…”

অন্বেষার চোখের সামনেই খুলে গেলো লাল গাড়িটার দরজা, মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ভদ্রলোক…..
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্বেষা…..
না না! উনি মিস্টার রায় নন!

“হ্যালো অন্বেষা…..
সব ঠিকঠাক….হ্যালো…..হ্যালো….”

“সরি! মিস্টার রায়…. এভরিথিং ইস ফাইন….
রাখছি….”

“ওকে! বাই….”

*******************************************************

বাসে উঠেই দুটো কানে হেডফোন লাগিয়ে অন্বেষা
বসে পড়লো জানালার ধারের একটা সিটে….

মনটা কেন এতো অশান্ত হয়ে পড়েছিল একটু আগে, কে জানে!
কেন এরকম হুট্ করে ডায়াল করে দিলো মিস্টার রায়ের নম্বর ভাবতে ভাবতেই পাল্টে চললো গানের ট্র্যাক!
কোনো গানই আজ ঠিকঠাক মনে ধরলোনা তার…
গানের ট্র্যাক পাল্টাতে পাল্টাতে পৌঁছে গেলো বাসস্ট্যান্ড….
আর তারপর ঢুকে পড়লো নীল বাড়িটায়…

******************************************************

“কিরে অন্বেষা, কি হয়েছে বলতো তোর! কাল টেনশনে ছিলিস, পড়তে বসলিনা…..
বুঝলাম! আজ কি হলো, এরম আনমনা কেন?”

“কোথায়? না তো?”

“তাই? খাতায় তখন থেকে আঁকিবুঁকি কেটে চলেছিস! তা এসব বুঝি মন দিয়ে কাটছিস? কি ভাবছিস এতো?”

“কিচ্ছুনা! একটা হিসেব মিলছে না রিয়া দি…..”

“কি ওই রুড লোকটা কাল কি ভাবে হেল্প করলো! ওহঃ প্লিজ! অন্বেষা! এখন তুই আবার ওই মাঝবয়েসী লোকটা কে নিয়ে ভাবতে বসিস না! তোর চেয়ে প্রায় সাত আট বছরের বড়ো হবে! তারপর অদ্ভুত বাড়ি, অদ্ভুত মানুষ! এই সব তারকাটা পাবলিক! কখনও কিছু ভি করে! কিরে…… কি ভাবছিস! আরে বাবা …..”

“নাঃ আমি সেটা ভাবছিনা গো!”

“তবে?”

“কিছুনা! এমনি একটা পড়ার জিনিস!”

“পরিষ্কার বললেই পারতিস বলতে চাসনা…এতো ঘুরিয়ে বলার কি হলো! যাক আমি ঘুমোচ্ছি…অনেক রাত হয়েছে!”

অন্বেষা সবটা বলতে চেয়েও পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে পারলোনা তার রিয়া দি কে…..

কি বলবে আজ কেন এক মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ এতো খারাপ লাগছিলো শুধু এটা কল্পনা করে যে একটা সুন্দর মেয়ে তার বসার জায়গাতে বসেছে বলে! কবে থেকে ড্রাইভিং সিটের জায়গাটা তার হলো!

এদিকে মনটা আনচান করছে পরপর দুসপ্তাহ ক্লাস নেই বলে…..
শুধু কি তাই বারবার ফোনের দিকে চেয়ে সে
কেনই বা তার ফোনের অপেক্ষা করছে কে জানে?

কেন রাগ হচ্ছে এটা ভেবে যে সে আর ফোন ব্যাক করলোনা আজ…
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ স্ক্রিনের আলোটা জ্বলে উঠলো! স্ক্রিনের ওপর নামটা দেখেই বেড়ে গেলো হৃদস্পন্দন!
অজান্তেই ঠোঁটের কোণ দুটো একটু চৌরা হয়ে এলো!

একটা ঢোক গিলে ফোনটা রিসিভ করে বললো
“হ্যালো”

“অন্বেষা, দুপুরে ফোন করেছিলে, কি বলছিলে তখন?”

“এমনিই Thanks বলার জন্যে ফোন করেছিলাম”
ভেঙে-ভেঙে কথাটা শেষ করলো অন্বেষা….

“এতো রাগিরাগি গলায় শুধু Thanks
বলবে বলে ফোন করেছিলি? সিওর?”

একটু অস্বস্তি ভরা গলায় অন্বেষা বললো
“না মানে মিস্টার রায়! এমনিই, রিতিকার এক্সাম কেমন হলো?”

“ভালোই দিয়েছে বললো! লিটারেচার তো এমনিও Favourite…..তোমার সাবজেক্ট বুধ ও শুক্রবার…..”

“হ্যাঁ জানি….ওকে বলবেন দরকার হলে ফোন করতে…”
হাসিহাসি সুরে বললো অন্বেষা….

“ওহ ভালো কথা মনে পড়েছে, আবার ভুলে যেতাম নয়তো পরে, বলছিলাম তুমি একেবারে নেক্সট টু নেক্সট উইকে এস….মানে এই সপ্তাহ আর পরের সপ্তাহে আসার দরকার নেই আর…..”

“কেন? এক্সাম তো শেষ? দেখুন মিস্টার রায় এইভাবে ফাঁকি দিলে…..”

“অন্বেষা, ওর স্কুলের একটা নাচ গানের function
….”

“এইসব নাচগান করে কিছুই লাভ হবেনা কিন্তু! যাক আমি কেন আপনাদের পার্সোনাল ম্যাটার এ ঢুকি! যাই হোক রিতিকা কে বলবেন অসুবিধে হলে ফোন করে নিতে…. ঠিক এটা বলার জন্যেই ফোন করেছিলাম…..”
হুড়হুড় করে কথা গুলো বলে থামলো অন্বেষা…

“সিওর! এটাই বলার ছিল!”
মিস্টার রায় ঠাট্টা করে বললো কিনা বুঝলোনা অন্বেষা….

হঠাৎ কেমন যেন একটু বিরক্ত লাগলো কথাবলার সুরটা….এবারে বেশ কাটকাট গলায় উত্তর দিলো অন্বেষা….
“মিস্টার রায়, আপনাকে আমার আর কি বলার থাকতে পারে! আমি এখন পড়ছি, আপনার সাথে আজেবাজে কথা বলার মতন সময় নেই আমার…”

খানিক্ষণের জন্যে চুপচাপ ফোনটা কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো ফোনের দুপ্রান্তের মানুষ….
তারপর খুব নীচু গলায় একটা ছোট্ট “বাই” শুনতে পেলো অন্বেষা!
মুহূর্তেই কেটে গেলো ফোনটা…

ফোনটা কেটে যেতেই আরও বিরক্তিকর লাগলো অন্বেষার…..আছাড় মেরে ফেলো দিলো ফোনটা বিছানার ওপর!
কিছুক্ষণ বসে রইলো চুপচাপ!

কিচ্ছুতেই বুঝে উঠতে পারলোনা ঠিক কোন কথায়
এতো রাগ হয়ে গেলো তার…..
দু সপ্তাহ টিউশনটা বন্ধ হওয়ার কারণে মিস্টার রায়ের সাথে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়েছে বলে……
না কি মিস্টার রায় ঠাট্টা করলো বলে…
আদেও ঠাট্টা করে কথাটা বলেছিলো কিনা কে জানে!
অথচ এতো অপমান করে দিলো আবার, অথচ এই মানুষটাই কাল সারাটা রাত ছিল গাড়িতে বসে, শুধু কলেজ যাওয়ার আগে অন্বেষার হাতে ফাইলটা পৌঁছে দেবে বলে….

ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে বইগুলো খাটের একপাশে রেখে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়…..
জানালা দিয়ে চেয়ে রইলো আকাশের তারাগুলোর দিকে!

******************************************************

আরও দিন দশ বারোর পরের কথা!
মার্চ মাসের মাঝামাঝি….আজ অন্বেষার কলেজের একটা ছোট গ্রূপ দোল উৎসব উপলক্ষে আজ রবিবারের দিন নন্দন চত্বরে ঘুরতে যাবে বলে প্ল্যান করেছে…..

তবে অন্বেষার মন নেই একটুও…
কলেজের সব চেয়ে কাছের বান্ধবী তৃষা বারবার বলেছে আসতে….

কলেজের বাকিরা প্রায় ক্লাস বাংক করে ঘুরতে যায় সিটি সেন্টার, আইনক্স…..

তবে ওদের যাওয়া হয়ে ওঠেনা কোনোদিনই….
সত্যি বলতে হাতে টাকাও নেই সেরকম!

তাই এই ছোট্ট প্রচেষ্টা….
নন্দনে একটা সিনেমা, এক কাপ চা, একটু ঘোরাফেরা আর একটু রং খেলা……

এই সময় ভাগ্য ভালো থাকলে অনেক রকমের প্রোগ্রাম চলে নন্দনের মাঠেই!
ঠিক জানেনা ওরা
……… যারা মাঠেই গান চালিয়ে রবীন্দ্র সংগীত, নৃত্য ও রং খেলা আয়োজন করে তারা ঠিক কোথাকার বা কোন কলেজের স্টুডেন্ট!

সে যাই হোক, মাস খানেক আগেও তো অন্বেষা বেশ উৎসাহে ছিল এই প্ল্যানটা নিয়ে…..

তবে ইদানিং থেকে থেকেই মুডটা অফ হয়ে যায় …..
নিজেও ঠিকঠাক জানেনা কেন হয় এরকম!

“অন্বেষা চল না প্লিজ…..!
দেখ তোর কলেজের বন্ধু সবাই, অথচ তোর কোনো উৎসাহই নেই! কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকিস আজ কাল! অদ্ভুত লাগে তোকে আজকাল জানিস তো…..”

“না গো রিয়া দি…..
এক বেলায় আরও একটা চ্যাপ্টার শেষ হয়ে যাবে….
থাক…..আর আমার এমনিই রং খেলতে ভালো লাগেনা…..”

“ধুর! এই শেষ দশ দিন পাগলের মতন পড়ছিস! তার আগের দুদিন শুধুই শুয়ে ঘুমিয়ে কাটালি…..কখন যে কি করিস আজ কাল!
চলনা….প্লিজ…..প্লিজ……চলনা……প্লিজ…..
এসে পড়বি….
দেখ আজ তোর পড়ানো থাকলে কি বলতাম….
তার ওপর রবিবার …..এরম ছুটির দিন আর আসবে…..”

“উউফ! রিয়া দি…এসে স্নান করতে হবে আবার!”

“তো করবি পাগলী….এমনিই প্যাচপ্যাচে গরম! চল না……প্লিইইইজজজ…..”

“ওকে!”

“এই তো এতক্ষণে মেয়ে রাজি হয়েছে…..
দ্যাটস লাইক মাই গার্ল…..”
বলেই জড়িয়ে ধরলো রিয়া অন্বেষা কে…..

*******************************************************

নন্দন চত্বরে এসে মনটা বেশ হালকা লাগছে আজ…..
শো ভেঙেছে প্রায় মিনিট পনেরো হলো,
ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা বেজে চল্লিশ মিনিট…..

উঁচু উঁচু গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো ওদের ছোট্ট গ্রূপের সবাই….

গ্রূপে মোটমাট পাঁচ জন মানুষ, তৃষা, অন্বেষা, রিয়া, ছায়া ও তার বয় ফ্রেন্ড রবিন…..
ওরা সবাই একিই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট শুধু রিয়া বাদে…..

চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সবে কাগজের খাপটা ডাস্টবিনে ফেলেছে অন্বেষা…..

“ঐই ……না! না! এখানে রং দিসনা….প্লিজ ….মাঠে চল! পাক্কা কেস খাবি…..”
“ভালো করে রং দে মানুষটা কে, বলে কি না আবার বিকেলে ফিরে স্নান করতে হবে…..আবার শাড়ি পড়তে হবে…..”
“রিয়া দি…..ঠিক হছেনা…..কিন্তু…..এইই প্লিজ মাথায় না….”
……”তাই না! রং আমিও এনেছি…..ওকে?”
“ভয় পাসনা….অন্বেষার হাতের টা আবির….ও মাল রং কেননা…..”

ওদের কোলাহলের মধ্যে অন্বেষা শুনতে পেলো একটা ক্ষীণ মৃদু আওয়াজ…..
“মিস! তুমি এখানে….”

“রিতিকা……
একিই নাচের ড্রেস! ভীষণ মিষ্টি লাগছে! কিন্তু…এখানে কি ভাবে?”

“আজকেই তো স্কুলের function ছিল……আমি ড্যান্স করেছিলাম…..এই জন্যেই তো দাদাভাই কে বলতে বলেছিলাম আজকের ক্লাসটা অফ করে দিতে…..”

“দাদাভাই কোথায়?”

রিতিকা হাত দেখিয়ে ইশারা করতেই অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায় কে!

দশ হাতের দুরুত্ব থেকেও অন্বেষা দেখতে পেলো মিস্টার রায়ের গভীর দুটো মায়াবী
চোখ,
আজ রিমলেস চশমা ছাড়া মুখটা একদম অন্য রকম দেখাচ্ছিল….
টিকালো নাক, ট্রিমড দাড়ি…..আজ চুলগুলো বড্ডো বাধ্য!
মুখে একটা সরলতার হাসি…..
পরণে কালো ফেডেড জিন্সের ওপর শঙ্খ সাদা পাঞ্জাবি…..

দুটো হাত ভর্তি লাল আবির উঠিয়ে নিলো অন্বেষা,
তারপর দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলো মিস্টার রায়ের দিকে,
মুহূর্তের মধ্যেই আবিরে মাখা দুটো হাত স্পর্শ করলো মিস্টার রায়ের গালগুলো কে!
পরণের শঙ্খ সাদা পাঞ্জাবিটা মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠলো জায়গায় জায়গায়…..

“মিস দাদাভাই রং খেলা একদম পছন্দ করেনা….. সরি দাদাভাই….আমি একদম ভুলে গিয়েছি বলে দিতে……”

এতক্ষণে হুশ ফিরলো অন্বেষার! রিতিকা ওদের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে এর মধ্যে…..
দশ হাত দূর থেকে রিয়ার চোখও ওদের দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে…..

অন্বেষা চেয়ে দেখলো একবার সামনের মানুষটাকে…..
মানুষটার দুটো চোখ তখনও চেয়ে অন্বেষার দুটো চোখের দিকে….
পড়ন্ত বেলার সোনালী রোদে,
লাল আবিরে মাখা মুখটা আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে তখন……
হালকা একটা মেল্ ডিওর সুবাস… ভেসে এলো অন্বেষার নাকে…..

নিজেকে একটু সামলে কম্পিত গলায় অন্বেষা বললো – “I’m sorry মিস্টার রায়…..আমার জানা ছিলোনা…”

হালকা একটা আদুরে গলায় অষ্ফুটিত স্বর বেরিয়ে এলো মিস্টার রায়ের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে….
“ইটস ওকে মিস মিত্র!”

এক ভাবে চেয়ে রয়েছে তখনও দুটো চোখ নিষ্পলক দৃষ্টি তে অন্বেষার দিকে…..

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here