পাতাঝরার শেষে……পর্ব ৫

0
1390

পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা

পর্ব – ৫) সাস্পেক্টেড…

আরও মাস দুয়েক কেটে গিয়েছে এর মধ্যে!

রিতিকার পড়াশোনা চলছে পুরোদমে….
অন্বেষারও থার্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট বেশ ভালো….
শুরু হয়েছে ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল সেমিস্টার…..
ইদানিং সপ্তাহে রোজ ক্লাস থাকেনা, ফলেই নিজের পড়াশোনার জন্যে বেশ খানিকটা সময় পায় অন্বেষা আজকাল……
রিতিকার সাথে বেশ একটা বন্ধুক্তের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শেষ কয়েক মাসে…..

রিতিকার ক্লাস এখনো সপ্তাহে একদিনিই হয়, তবে একটু লম্বা সময় ধরে চলে…..
সব মিলিয়ে বেশ কাটছিলো সবটা……

অন্বেষার লক্ষ্য ছিল এখন শুধুই একটা চাকরি!
আর কোনো ক্যাম্পাসিং হয়নি এর মধ্যে…
মন্দার বাজারে আর কোনো কম্পানি আসবে কিনা, ঠিক জানেনা অন্বেষা….

ব্যাংক পিও, রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টের অনেকগুলো সরকারি চাকরির ফর্ম ভরলেও আজও স্বপ্ন Chemical Analyst এর রোল টা!
তবেই তো নিজের ফিল্ডে চাকরি করতে পারবে সে!
তবে মধ্যবিত্তর মানুষের কাছে চাকরি
প্যাশন নয়, চাকরি শুধুই রোজগারের এক মধ্যম, তাই পাশাপাশি চলছে সরকারি চাকরি, নেট, গেটের মতন ইত্যাদি পরীক্ষার প্রিপারেশন……

************************************************************

আজ আরও একটা রবিবার…..
প্রতিসপ্তাহের মতন আজও বাড়ি ফাঁকা,
রিতিকার ঘরে ঢুকতেই এক রাশ হাসি নিয়ে রিতিকা জানালো থার্ড ইউনিট টেস্টে ক্লাসে
ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি দুটোতেই হাইয়েস্ট নম্বর তার !

অন্বেষার মনটা তাই আজ বেশ ফুরফুরে, আবার আজ মাস পয়লা তাই কেমিস্ট্রি বইয়ের শেষ পাতা থেকে রিতিকা চেকটা বের করে দিলো অন্বেষা কে
“মিস ফিস টা !”

ইদানিং একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে অন্বেষা, গত দুমাস থেকে আর মিস্টার রায় নিজে মুখোমুখি হননি অন্বেষার!
তবে চেক ভীষণ ভাবে সময়ে এসে পৌঁছয় তার হাতে রিতিকার মাধ্যমে!
আবার রোববার পুরো বাড়িটা অদ্ভুত ভাবে ফাঁকা থাকে এই সময়টা….
যেন এই বাড়িতে দুজন লোক থাকে, ঘরের পরিচারক হারাধন বাবু ও অন্বেষার স্টুডেন্ট রিতিকা!
হারাধন বাবু সময়ে নিয়মমাফিক দরজা খুলে দেয় প্রতিদিন, তারপর এক গ্লাস শরবত এসে পৌঁছয়…..
ব্যাস এটা ছাড়া আর মুখোমুখি হননা তিনি…..
কোথায় যায় বাকি লোকেরা?

রিতিকার সাথে অনেক গল্পই হয় মাঝেমাঝে, পুজোর গল্প, স্কুল টিচারের গল্প,
তবে অন্বেষা এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেনি কখনো যে কি ভাবে ঘরটা এতটা ফাঁকা থাকে রবিবার?

হঠাৎ আজ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো রিতিকা কে –
“রিতিকা! তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করবো….”

“হ্যাঁ বলোনা মিস, কি কথা!”
কেমিস্ট্রি reaction টা ব্যালান্স করতে করতে উত্তর দিলো রিতিকা….

“বলছিলাম, এই সময় তোমাদের বাড়িতে কেউ থাকেনা? মানে আগে তোমার মা বসে থাকতেন ডাইনিং এর সোফায়, তারপর তোমার cousin
তোমার দাদাভাই সবাই থাকতেন…
ইদানিং দেখি….”

রিতিকার মুখটা ফেকাসে হয়ে গেলো নিমেষে…
ভেজা গলায় সে বললো
“মা নয় মিস ….. জেঠিমা উনি…..মা তো নেই…..”

“নেই মানে?”

“মারা গিয়েছেন, একটা Car Accident হয়েছিল…….”

অন্বেষার গলাটা শুকিয়ে এলো নিমেষে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো অন্বেষার….

অন্বেষা দেখলো দুটো সরল চোখে জমেছে বিন্দুবিন্দু জল….
সযত্নে দুটো আঙ্গুল চশমার ফ্রেমের নীচ দিয়ে মুছে ফেললো সেই জলটা….
তারপর আবার কলমের খচমচ আওয়াজ
ভেসে এলো অন্বেষার কানে…..
অদ্ভুত ভাবে চুপচাপ হয়ে গেলো পুরো ঘরটা….
বাইরের কিছু পাখি কিচিরমিচির করছিলো বাইরের গাছটা তে…..
কি গাছ অন্বেষা ঠিক জানেনা…..
এক মনে চেয়ে রইলো গাছটার দিকে….

“মিস….. হয়ে গিয়েছে….”
মৃদু ভেজা স্বরে অন্বেষা ফিরে এলো কেমিস্ট্রির খাতায়….
আনমনে equation টা চেক করতে করতে বললো

“কতদিন আগে হয়েছিল Accident…”

“সিক্স ইয়ার্স হয়ে গেলো…..আমি তখন ক্লাস থ্রি তে ছিলাম মিস”

“আচ্ছা….
একদম নিজেকে একা মনে করবেনা, কেমন? আমি আছি, জেঠিমা আছেন….”

“জেঠিমার সাথে আমি কথা বলিনা মিস……”

খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো অন্বেষা রিতিকার দিকে…..ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
“কেন?”

“আমি জানিনা মিস!
জেঠিমা দাদাভাই কে পছন্দ করেনা তাই…..
বলে দাদাভাই….
দাদাভাই ভালো নয়…… নর্মাল নয়…….
দাদাভাই এ বাড়ির কেউ নয়….
এটাও বলে দাদাভাই একবার Arrested হয়েছিল…..
জেঠিমা আরও এরকম অনেক বাজেবাজে কথা বলে!”

“হোয়াট? Arrested ছিল মানে? পুলিশ কেস…. ”
কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা…..

“জানিনা মিস………..দাদাভাই এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি কখনো…..আর আমি ওদের কারুর কথা বিশ্বাস করিনা!”

“কিন্তু রিতিকা…”

রিতিকা এবারে বেশ দৃঢ় গলায় বলে চলে – ”
দাদাভাই আমাকে খুব ভালোবাসে….
দাদাভাই ছাড়া আমার আর কেউ নেই মিস!
আমি আগে বুঝতামনা এই কথাটা….
ওই একমাত্র মানুষ যে আমার ভালো চায়,
আমি পুরো ব্যাপারটা জানিনা মিস, কিন্তু আমি এইটুকু বুঝি দাদাভাই যেটা বলে, সেটা ঠিক বলে, তাইতো আমি ওর সব কথা শুনি….
তাই আমি নিজে থেকেই কারুর সাথে কথা বলিনা…..যারা ওকে কষ্ট দেয়…..”

“রিতিকা, শোনো…..একজন কে এভাবে চোখ বন্ধ করে …..”

“প্লিজ মিস! প্লিজ!
তুমি কিচ্ছু জানোনা…..
আমার প্রতিটা প্রয়োজনে দাদাভাই আমাকে হেল্প করে!
রাত জেগে আমায় পড়িয়েছে…..
প্রতিটা প্যারেন্ট মিটিং এ দাদাভাই গিয়েছে, আমার ছোট, বড়ো সব ধরণের প্রব্লেমস দাদাভাই সল্ভ করেছে, আমার জ্বর হলে, শরীর খারাপ করলে দাদাভাই রাত জেগেছে…..
আমি তাই আর কিচ্ছু জানতে চাইনা…..
আমি শুধু এইটুকু জানি মিস
দাদাভাই আমার পাশে সবসময় আছে…ও
থাকবে……”

রিতিকা কে কখনো এতো উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি অন্বেষা…..
কিছু একটা বলবে ভেবেছিলো, তৎক্ষণাৎ অন্বেষার কানে ভেসে এলো তার
রিয়া দির বলা কথা গুলো –
“তুই পড়াতে যাস, পড়াবি, চলে আসবি….
কে কি করছে না করছে,
কে হার্মফুল, কে অদ্ভুত, কে ক্যারেক্টারলেস, এসব নিয়ে মাথা ঘামাস কেন?

তুই ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি তে কন্সেন্ট্রেট কর! সিলেবাস শেষ করবি…. মাসের চেকটা নিবি চলে আসবি….
কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই আনলেস তোকে ওরা কেউ physically টাচ করছে বা ইনসাল্ট করছে….”

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অন্বেষা বলে উঠলো
“ফিজিক্স বইটা বের করো রিতিকা…
আগের দিনের হোমওয়ার্ক শেষ হয়েছে?”

“হ্যাঁ মিস!”
রিতিকার গলায় আবার মৃদু ও সরু আওয়াজ শুনতে পেলো অন্বেষা……

***********************************************************

আজ রাতে বাড়ি ফিরে, কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া শেষ করে অন্বেষা বই নিয়ে বসে পড়লো আবার!

অনেক হয়েছে একই ভাবনা – চিন্তা…..আর নয়!

মনে মনেই ঠিক করে ফেলেছিলো বাসে আসতে আসতে,
আজকে রিতিকার মুখে শোনা কথাগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই করবে না সে তার রিয়া দির সাথে….
প্রথম কারণ অন্য বাড়ির আলোচনা করে সময় নষ্ট করার মতন সময় তার হাতে নেই এক্কেবারে …….
দ্বিতীয়ত আগের দিন পরিষ্কার ভাবে তার রিয়া দি তাকে বলে দিয়েছিলো যেটা তার মন চায় সেটাই করতে, সে নতুন করে রোজরোজ অন্বেষাকে ঠিক ভুল শেখাতে পারবেনা….
ঠিক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতন বয়েস হয়েছে অন্বেষার…….

বাড়ি ফিরেই তাই মুখ হাত ধুয়ে, বই নিয়ে বসে পড়লো সে, তবে পড়ায় মন বসলো না এতটুকু…..
দেখতে দেখতে ঘড়িতে এগারোটা কুড়ি বেজে গেলো…..

বইয়ের একই পাতার দিকে চেয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকলো খাতায়….

ইদানিং পড়াশোনাটা বড্ডো এক ঘেয়ে লাগে অন্বেষার…
এর আগে এমন কখনো হয়নি…..
নেটের বইটা ভীষণ মোটা….
অর্ধেকের বেশি বইটা এখনো বাকি….
তবে কিচ্ছু করার নেই…
Msc টা শেষ হতে মাস চারেক বাকি….
তারপর বেকার….

তার ঠিক পরেই জুন মাসে NET…..
এ বছর Phd বা একটা চাকরি না করলে নির্ঘাত আবার উঠে আসবে বিয়ের কথাবার্তা….

আর সেটাই ঠিক চায়না অন্বেষা…..
একটা চাকরি না পেলে এতগুলো বছর পড়াশোনা করে লাভ কি হলো!

আনমনা হয়ে তখনও খাতায় আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে অন্বেষা!
চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে তার জন্যে তার বাবার লড়াইয়ের কথা গুলো…..
অন্বেষার Result হাতে পাওয়ার পর প্রতিবার তার বাবার হাসি মুখটাই ছিল তার পুরস্কার….
আজও ভাবলে হাসি পায় বাবা কেমন সব লোককে ডেকে ডেকে বলতো….
“…..দাদা, মেয়ে এবারও ক্লাসে প্রথম…..একদম প্রথম!”

বুড়ো মানুষটা ভীষণ কষ্ট করেছে তার জন্যে, নিজের দাদা, বৌদি, এমন কি নিজের সহধর্মিনীর সাথে রীতিমতন ঝগড়াঝাটি করে অন্বেষা কে পড়তে পাঠিয়েছে কোলকাতাতে…..
একটা চাকরি না পেয়ে যদি বাকি দিদি দেড় মতন শুধু ঘর সংসারই করতে হয় তবে বাবার
ঝগড়াঝাটির কি মূল্য থাকবে….

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে টা আবছা হয়ে আসে আবার…..
চোখের জলটা মুছে, এবারে প্রথম MCQ
টা পড়তে থাকে মনেমনে…..

মুহূর্তেই বেজে ওঠে ফোন, এতো রাতে মিস্টার রায়! কি জন্যে?

একবার ভাবে লাইনটা কেটে দেবে বা ফোনটা সাইলেন্ট করে দেবে, তবুও শেষ রিংটাতে স্লাইড করে দেয় সবুজ চিহ্ন টা…
ফোনটা বাঁ কানে নিয়ে বলে
“হ্যালো…”

“হ্যালো মিস মিত্র….Sorry এতো রাতে বিরক্ত করার জন্যে…”

“নো প্রব্লেম! বলুন!”

“Actually একটু আগে রিরি আর আমি ডিনার করছিলাম, ওকে আজ একটু বেশিই চুপচাপ দেখাচ্ছিল, অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, কিছু বললোনা…..
মিনিট পাঁচেক আগে এসে নক করলো ঘরের দরজায়…..
এসে আমাকে জানালো আপনাকে ও আজ অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে যেটা ওর মনে হয়েছে সেগুলো বলা ঠিক হয়নি, হয়তো…..!
আমাকে ও বলেনি কি কথা হয়েছে,
আমি আপনার কাছে এটাও জানতে চায়না যে আপনাদের কি কথা হয়েছে!
শুধু এইটুকু জিজ্ঞেস করার ছিল আপনি আজ যাই শুনে থাকুন না কেন, আপনি পরের সপ্তাহে আবার আসছেন তাইতো? মানে…”

“তার আগে এটা বলুন বাড়ির সবাই একসাথে গায়েব হয় কি ভাবে তাও ছুটির দিনের বিকেলে?”

“আমি কাউকে গায়েব করিনা মিস মিত্র, ওরা নিজে থেকেই রবিবার গায়েব থাকে অনেকটা সময়, তাই আপনাকে ওই সময় ডাকা…..”

“আর আপনি কোথায় থাকেন?”

“কোনোদিন অফিসেই থাকি, আজ যদিও ঘরেই ছিলাম….”

“কেন? নিজের বাড়িতে কেন ঘর লাগিয়ে থাকেন?”

“আপনার বোধহয় মনে নেই, আপনি বলেছিলেন, রায় ম্যানশনের কাউকেই আপনার ঠিক পছন্দ নয়…..তাই …..”

“বুঝলাম! একটু বেশিই ভালো হওয়ার চেষ্টা করছেন না?”

“Sorry….এটা বুঝলাম না…..”

“শুনুন মিস্টার রায়, আমি ক্লাস নাইনে পড়িনা, আমাকে কিচ্ছু বোঝাতে আসবেন না! ভালোই ব্রেন ওয়াশ করেছেন বাচ্চা মেয়েটার! …..
সে যাই হোক আপনাদের পার্সোনাল ম্যাটার….
আমি পড়ানোর টাকা পাই, নিশ্চয় পড়াবো…
আপনি এই ভালো মানুষিটা চালিয়ে যান কেমন, কারণ সত্যি সত্যি আমি বেশ কমফোর্টাবেল…..আপনাদের বাড়িতে….শেষ কয়েকমাস…
আমি আসছি নেক্সট উয়িক, আপনার আর কিছু জানার না থাকলে গুডনাইট….”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে, ফোনটা কেটে দেয় অন্বেষা……
বই খাতা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়…..
নিজেকে বড্ডো অসহায় লাগে,
চেয়েও একটা দায়িত্ত্ব এড়িয়ে যেতে পারছেনা,
হ্যাঁ টাকাটা সত্যি দরকার,
তবে এতটা নয় যে তার জন্যে একজন পাস্ট
ক্রিমিনাল বা সাস্পেক্টেড পাস্ট
ক্রিমিনালের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে পড়াতে যেতে হবে!
শেষ বার সে নিজে পড়াবেনা বলে, আবার নিজেই ফোন করেছিল মিস্টার রায় কে…
এখন আবার কোন মুখে বলবে – যে সে আর পড়াবেনা ……
এরকম কখনো হ্যাঁ, কখনো না বলে একজনের দায়িত্ত্ব নেওয়া যায়না….তারপর একমাসের মধ্যেই রিতিকার পরীক্ষা….
এরকম পরীক্ষার আগে হুট্ করে ছেড়ে দিলে, মেয়েটার কনফিডেন্স আবার ডাউন হয়ে যেতে পারে…..
তারপর টাকাটা অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর…..

*******************************************************

মাস খানেক পরের আরও একটা রবিবার, আজও পুরো বাড়িটা ফাঁকা, রিতিকার ক্লাস চলছিল পুরোদমে, পরের সপ্তাহ থেকে রিতিকার পরীক্ষা শুরু, তাই দিন পনেরো বন্ধ থাকবে ক্লাস…..
শেষ মিনিট রিভিশন চলছিল তখন, প্রিপারেশন বেশ ভালো রিতিকার…

হঠাৎ অন্বেষার ফোনটা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে রিয়া দি…..

“হ্যাঁ রিয়া দি বলো….”

“রিয়া, একটা বড়ো প্রব্লেম হয়ে গিয়েছে…”

“কি প্রব্লেম গো?”

“ল্যাপটপ অন হচ্ছেনা…..”

“কি বলছো? না না কাল রাতেই তো সব ঠিক ছিল, তুমি ফোর্স রিস্টার্ট করো….”

“সব করেছি অন্বেষা, কিছুতেই অন হছেনা….
তোর থিসিসটার কোনো ব্যাকআপ নেওয়া ছিল….বা মাই Documents ছাড়া অন্য কোনো ড্রাইভে সেভ করেছিলিস?”

“না, অন্য কোনো ব্যাকআপ ছিলোনা, কি হবে রিয়া দি…..তুমি প্লিজ একটু দেখোনা…..রিয়া দি, প্লিজজ……মঙ্গলবার সাবমিশন…..জানো তো…..”

“হ্যাঁ রে বাবা, আমি জানি বলেই তো…..
তুই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়, শোন না….. দেখছি কি করা যায় বুঝলি….”

“কি হবে রিয়া দি? আমি মরে যাবো…”
একটা চাপা কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে এলো কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে……

“অন্বেষা…..রিলাক্স…..আমি তো বললাম তুই আয়….আমি দেখছি কি করা যায়….এখন রাখছি বাই…..”

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে অন্বেষা বসে রইলো খানিকক্ষণ…..বিদ্যুৎ বেয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে…

কিছুই মাথায় আসছেনা এখন কি করবে সে, মাস চারেক ধরে কমপ্লিট করা কাজ দুটো রাতের মধ্যে কখনোই শেষ করা সম্ভব নয়…..

নিজের ওপর বিভৎস্য রাগ হতে থাকলো তার,
বিন্দু বিন্দু জল চোখ বেয়ে গড়িয়ে এলো গালে….
তারপর জোরেজোরে নিশ্বাস পড়তে থাকলো…কানে ধাপা ধরে এলো….”

ক্ষীণ একটা আওয়াজ বোধহয় ভেসে এলো কানে “মিস কি হয়েছে? কি হয়েছে মিস? তোমার শরীরটা খারাপ করছে না? মিস…..”

অন্বেষা কোনো উত্তর দিলোনা….
মুহূর্তেই গুছিয়ে ফেললো ব্যাগ, তারপর ব্যাগটা দ্রুতো কাঁধে উঠিয়ে ঝড়ের বেগে নেমে গেলো সিঁড়ি বেয়ে …..

চার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে পাগলের মতন থাবা বসাতে থাকে লোহার গেটে…..
দারোয়ান ছুটে এলো সাথে সাথেই…..
সে কি বলছিলো কিছুই কানে এলোনা অন্বেষার….
মুহূর্তেই দেখলো লোহার গেট খুলে গেলো….

সাথে সাথেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো লোহার গেট দিয়ে…..
পাগলের মতন ও ভাবেই ছুটে চললো অন্বেষা বাস স্ট্যান্ডের দিকে…….

কোনোএকটা ড্রাইভ অ্যারাউন্ড আইল্যান্ডের কাছে যেতেই দ্রুত বিদ্যুৎ গতিতে হাতটা ধরে
কেউ তাকে টেনে নিলো নিজের বুকের ওপর…..

বিভীৎস্য একটা ব্রেকের আওয়াজ শুনতে পেলো অন্বেষা…..
একটা স্টেট বাস দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই…..

এতক্ষণে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে চেয়ে দেখলো সে…
মিস্টার রায়!

হুশ ফিরতেই অন্বেষা বুঝলো লাইন দিয়ে বাস দাঁড়িয়ে পড়েছে একের পর এক….
বাস ড্রাইভার বাস থেকে নেমে যাচ্ছেতাই অপমান করে চলেছে মিস্টার রায় কে…..

মিস্টার রায় কেমন যেন ঠান্ডা গলায় বুঝিয়ে চলেছেন বাস ড্রাইভার ও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় কে….

এতক্ষণে ওদের সব কথা গুলো কানে আসছিলো অন্বেষার আসতে আসতে…..
মিস্টার রায় কেমন একটা ঠান্ডা গলায় বুঝিয়ে চলেছেন বারবার
“দাদা! আপনাদের বলছি তো, ভুল হয়ে গিয়েছে, উনি একটা বড়ো বিপদে …..”

“তাই বলে তো উনি আমাদের বিপদে ফেলতে পারেন না…তাইনা? যান, একবার বাসে উঠে দেখুন….ওরম হঠাৎ ব্রেকের কারণে আমার ছেলের হাঁটুর দিকটা কিভাবে কেটে গিয়েছে…..”

মিশ্রিত স্বর ভেসে আসছিলো অন্বেষার কানে….
“এই ভাবে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে বাসের সামনে এসে পড়বেন, তারপর Accident হলে সব দোষ বাস ড্রাইভারের…..”
…….”সত্যি তো ঝামেলা করতে হয়, পার্কে বসে কর, বাড়ির বেডরুমে কর, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝামেলা করতে করতে বাসের সামনে….সত্যি কি বলবেন বলুন….আজকাল কার ছেলে মেয়ে….”
সত্যি এদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই….”
“ঠিক বলেছেন দাদা..”

অন্বেষা সবটা বুঝেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারলোনা…..চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে…..
হাত দুটো জোর করে সে তখনও ক্ষমা চেয়ে চলেছে বাকিদের কাছে…..

মিনিট দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এলো…
একটা চাপা গলায় অন্বেষা বললো

“মিস্টার রায়….Sorry!”
তারপর সাথে সাথেই মুখটা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গাতে….

খুব ঠান্ডা গলায় একটা উত্তর এলো…
“অন্বেষা, এবারে প্লিজ পাঁচটা মিনিট দাঁড়াও….প্লিজ….আমি গাড়িটা আনছি কেমন….আমি যাবো আর আসবো…..প্লিজ….ততক্ষণ অপেক্ষা করো….
তুমি বুঝতে পারছো তো – তুমি ঠিক নেই….”

অন্বেষা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে….
মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বেরোলো না অন্বেষার, শুধু মাথাটা একটু নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সে….

*******************************************************

মিনিট দুয়েক হলো লাল গাড়িটা অন্বেষা কে নিয়ে রওনা হয়েছে পিজির দিকে…..

অন্বেষা অদ্ভুত ভাবে চুপচাপ বসে রয়েছে বাইরের দিকে চেয়ে….

বাইরের দিকে চেয়েই সে বললো –
“আজ Accident টা হলে ভালোই হতো….”

“পাগল হয়ে গিয়েছো? দেখো আমি জানিনা কি হয়েছে, তবে সেটার মূল্য তোমার জীবনের থেকে বেশি হতে পারেনা…..”

“আপনি জানেন না মিস্টার রায়, বাবা আমার জন্যে অনেক লড়াই লড়েছে…..
আজ বোধহয় সব স্বপ্ন গুলো শেষ করে ফেলেছি আমি নিজেই….”

“কি হয়েছে?”

“চারমাস ধরে বানানো থিসিস টা রিয়া দির কম্পিউটারে ছিল…..
কম্পিউটার ওপেন হচ্ছেনা…..
ফোর্স রিস্টার্ট করেও না….
কোনো ভাবেই না…..
কোনো ব্যাকআপ নেওয়া নেই….
ভেবেছিলাম আজ বাড়ি ফিরে প্রিন্টআউট করতে দেব…..
আর আজই…..”
বলতে বলতে আবারো গলাটা ভিজে এলো অন্বেষার…..

“ইটস ওকে…
হয় কখনো কখনো এরম ছোটোবড়ো ব্যাপার জীবনে….
আমরা ট্রাই করবো কেমন?

“ছোট ব্যাপার! আপনি জানেন document
টার ইম্পর্টেন্স…..
আপনি কি ভাবে বুঝবেন? নিজেদের কম্পানি….”

“কতটুকু জানো তুমি আমার সম্পর্কে?
যাক ছাড়ো! অন্বেষা ……
নাথিং ইস মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান ইওর লাইফ….”

“আপনি জানেন বাবা আমার জন্যে কত লড়াই করেছে….”

“জানিনা…
তবে এই টুকু বুঝি…. তুমি মারা গেলে ওনার বেঁচে থাকা স্বপ্ন – আশা সব শেষ হয়ে যাবে নিমেষে…..
তবে তুমি যদি এবার হেরেও যাও …..যদি!
তবে দেখবে উনি আবার তোমার পাশে এসে দাঁড়াবেন, প্রতিবারের মতন!
ম্যাক্সিমাম কি হবে অন্বেষা….
একটু বকা খাবে….নতুন করে থিসিসটা আবার করতে হবে!
বা…..
খুউব খারাপ কিছু হলে ডিগ্রি টা পেতে লেট্ হবে……আর কি হবে?
এতটুকু জিনিস ফেস করতে পারবেনা….
আমি কিন্তু ভাবিনি তুমি এতটা দুর্বল!
আমার জায়গায় থাকলে কি করতে?”

অন্বেষার মনের মধ্যে হওয়া ঝড়টা একটু থিতিয়ে পড়লো মিস্টার রায়ের কথাগুলো শুনে……
ঠিকই তো বলেছেন উনি….
এতো পাগলের মতন করারও কিছু হয়নি..
ম্যাক্সিমাম কি হবে?

“আচ্ছা অন্বেষা! শোনো আমি ওয়েট করছি….ওপরে যাও…..রিয়া দি কে কনভিন্স করিয়ে ল্যাপটপটা আমাকে এসে দিয়ে যাও….
প্রায় নটা বেজে গেলো! তাই বেশি দেরি না করে তাড়াতাড়ি দিয়ে যাও ল্যাপটপটা…
আমি দেখি কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না? ”
মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই গাড়িটা আবার এসে দাঁড়ালো নীল বাড়িটার সামনে…..

অন্বেষা গাড়ির দরজা খুলে ঢুকে গেলো নীল বাড়িটাতে…..

(চলবে)

সকল পাঠক বন্ধুদের অসংখ্য ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্যে! যে কোনোরকমের ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা খরবেন এবং ধরিয়ে দেবেন!
ঘরে থাকুন! ভালো থাকুন! সুস্থ থাকুন !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here