প্রতিশোধ পর্ব_৭
💘
#লেখিকা_সুপ্রিয়া_নস্কর
আয়ুসী পরদিন অফিসে এসে আয়ানকে খুঁজতে থাকে।কিন্তু দেখতে পায় না।আয়ান সেদিন খুব দেরিতেই অফিসে আসে।আয়ান এলে আয়ুসী ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে।নানা অছিলায় আয়ানের ঘরের সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে।শুধুমাত্র ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য নয়।তার আয়ানের মুখটা বার বার দেখার ইচ্ছা হয়।কিন্তু আয়ানের কাছে অনেক লোক থাকায় সে আয়ানের কাছাকাছি যেতে পারে না।
অবশেষে বিফল হয়ে ফিরে আসে।নিজের কেবিনে এসে কাজ করতে থাকে।এদিকে টিফিনে সব স্টাফরা নিজের লাঞ্চ করতে চলে গেলেও আয়ুসী যায় না।কারন কোনোদিন সে টিফিনে খেতে যায় না।এতোটাই মগ্ন হয়ে কাজ করছিল যে আয়ান এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।
আয়ান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বলে-এই যে শুনছেন।
আয়ুসী আয়ানকে দেখে অবাক হয়ে যায়।উঠে দাঁড়িয়ে বলে-হ্যাঁ,স্যার কিছু বলবেন।
আয়ান-আপনি এখনও এখানে,লাঞ্চ করবেন না?
আয়ুসী-না,স্যার ঠিক আছে।
আয়ান-চলুন।
আয়ুসী-কোথায়?
আয়ান-অফিসের ক্যান্টিনে।
আয়ুসী-কিন্তু স্যার—-
আয়ান-আপনি যাবেন ,না জোর করে নিয়ে যেতে হবে।
আয়ুসী—-
কী আর করবে আয়ুসী।আয়ানের সাথেই তার যেতে হল।
ক্যান্টিনে যায় কিন্তু দেখে অনেকেই কৌতূহলবশত তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।আয়ুসী সংকোচ বোধ করতে থাকে।আয়ান একটি চেয়ার টেনে আয়ুসীকে বসতে বলে।কিন্তু আয়ুসী বসে না।আয়ান আয়ুসীর কাছে গিয়ে বলে-এবার কী আপনাকে জোর করে বসিয়ে দিতে হবে।
আয়ুসী-না,না আমি বসছি।
আয়ুসী বসে।আয়ানও একটি চেয়ার টেনে বসে পরে।
আয়ুসীকে আয়ান নিজের পছন্দ মতো অর্ডার দিতে বলে।আয়ুসী নিজের জন্য একটি স্যান্ডউইচ অর্ডার দেয়।আর আয়ানকে কিছু খেতে বললে সে কফি ছাড়া আর কিছু দেয় না।
আয়ুসী মাথা নীচু করে থাকে।কারন সে জানে অনেকেই তাদেরকে দেখছে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আয়ুসী বলে-কাল রাতের জন্য ধন্যবাদ।
আয়ান-এতে ধন্যবাদের কী আছে।
আয়ুসী-কাল আপনি যদি না আসতেন—–
এই বলে আয়ুসী চুপ করে যায়।
আয়ান-আপনি কী এখনও ভয় পেয়ে আছেন।
আয়ুসী-না,না—-
আয়ান-কিন্তু আপনার চোখ অন্য কথা বলছে।
আয়ানের কথাতে আয়ুসী আয়ানের চোখের দিকে তাকায়।দেখে আয়ান এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে।
আয়ুসী আবার চোখ দুটো নামিয়ে নেয়।আয়ুসীর মাথায় একটি কথা অনেকক্ষন ধরে পাক খাচ্ছে।কিন্তু সে জিজ্ঞাসা করবে কিনা এই দোটানায় আছে।
অবশেষে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে।আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে-স্যার আপনি কাল রাত্রে ওখানে কী করতে গিয়েছিলেন?
আয়ান আয়ুসীর কথায় চমকে যায়।কী বলবে বুঝতে পারে না।
আয়ান-ওই দিকে আমার একটু দরকার ছিল।
উত্তরটা আয়ুসীর কাছে সংগত মনে হয় না।সে চুপ করে থাকে।আর আয়ান নিজের ফোন বার করে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আসলে সেদিন আয়ান আশ্রমে আয়ুসীর সাথে যে লোকটি গিয়েছিল তাকে ফোন করে জানতে পেরেছিল আয়ুসী আশ্রমে তাই আয়ান গিয়েছিল।কেন গিয়েছিল সে নিজেই জানে না।
এদিকে তাদের অর্ডার চলে আসে।আয়ুসী আয়ানের খাওয়া দেখে অবাক হয়ে যায়।আয়ান কফিতে চুমুক দেওয়ার আগে কফির প্লেটে একটু কফি ঢেলে নেয়। সেটা খাবার পর তারপর কফির কাপ থেকে কফি খায়।
আয়ানকে দেখে তার একজনের কথা মনে পরে।আবছা আবছা ছোটোবেলার স্মৃতি চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
আয়ান দেখে আয়ুসী তার দিকে তাকিয়ে।খাবারটা সামনেই তার পরে আছে।
আয়ান আয়ুসী সামনে আঙুল দিয়ে তুড়ি মারে।আয়ুসী ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে।
আয়ান-খাবারটা দেখার জন্য নয়,খাবার জন্য।
আয়ানের কথাতে আয়ুসী লজ্জা পেয়ে যায়।
আয়ান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে-আচ্ছা,আপনি সেদিন আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন না?
আয়ুসী-কোন দিন?
আয়ান-যেদিন ওই কুকুরগুলো—-
আয়ুসী চুপ করে থাকে।
আয়ান-আপনি কুকুরে খুব ভয় পান?
আয়ুসী একনাগাড়ে বলে যেতে থাকে-হ্যাঁ,ছোটোবেলা থেকেই আমার কুকুরে ভীষণ ভয়।দূর থেকে ভালো লাগে।কিন্তু কাছে এলে মনে হয় এই বুঝি কামড়ে দিল।
একটু থেমে বলে-আপনি ভয় পান না?
আয়ান-ভয় কেন পাব?আমার নিজেরই তো—-
আয়ান চুপ করে যায়।আর কিছু বলে না।
আয়ুসী-কী?
আয়ান-কিছু না।আজ মি আহুজার সাথে মিটিং আছে অফিসের পরে।ওনার অফিসেই যেতে হবে।
আয়ুসী-আর কে কে যাবে?
আয়ান-আপনি আর আমি।অফিসের পরে কোথাও যাবেন না।আমি আপনাকে ডেকে নেব।
এই বলে আয়ান চলে যায়।আর আয়ুসী ভাবতে থাকে কী হল।হঠাৎ এরকম মিটিং।কালও তো বলেননি।বাড়িতে বলে আসা হয়নি।তাই ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় তার যেতে দেরি হবে।
এদিকে অফিসের পরে সবাই যে যার মতো চলে যায়।আয়ুসী নিজের কেবিনে বসে বসে ভাবতে থাকে কখন যে ডাকবে।ঘরের মধ্যে পাইচারি করতে থাকে।এদিকে অফিস পুরো খালি হয়ে যায়।কী করবে বুঝতে পারে না।ভাবে একবার গিয়ে দেখে আসবে।কিন্তু যদি রেগে যায়।তাই সে যায় না।অপেক্ষা করতে থাকে আয়ানের ডাকের।
একঘন্টা হয়ে গেল তাও আয়ানের কোনো পাত্তা নেই।আয়ুসী রাগে গজগজ করতে থাকে।মনে মনে বলে কী দরকার এমনভাবে আটকে রাখার।আমার কী আর কোনো কাজ নেই।আজ দেখ ছাড়বো না।সারাক্ষণ মুখে হাসি কিছু তো মুখের উপর বলাও যায় না।কিন্তু আজ—-
এই বলতে বলতে সে আয়ানের ঘরের দিকে যায়।কিন্তু দেখে আয়ান তার চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে আছে।আয়ুসী রেগে যায়।আমাকে বসিয়ে রেখে ঘুমানো।দরজার কাছে এসে আয়ুসী আয়ানকে ডাকতে থাকে-স্যার,আমরা কখন যাব।
কিন্তু আয়ানের দিক থেকে কোনো উত্তর নেই।
আয়ুসী-বা বা এ কী ঘুম!
আয়ুসী আবার ডাকতে থাকে।কিন্তু আয়ান কোন সাড়া না দেওয়ায় আয়ুসীর এবার ভয় করতে থাকে।আস্তে আস্তে আয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।কী করবে বুঝতে পারে না।আয়ানের গায়ে হাত দিতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নেয়।অফিসে কেউ নেই কাকেই সে ডাকবে।অনেক দ্বিধা নিয়ে সে আয়ানের গায়ে হাত দেয়।হাত দিয়ে দেখে গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
আয়ুসী বুঝতে পারছে না কী করবে।অফিসের সিকিউরিটি গার্ডকে খুঁজতে যায়।কিন্তু তাকে দেখতে পায় না।এদিকে বাইরে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে।তার সাথে ঝড় আর বাজ পড়ছে।আর আয়ুসী ভয় পেয়ে যাচ্ছে।একদিকে আয়ানের এই অবস্থা আর অন্যদিকে প্রকৃতিও যেন মাতাল হয়ে উঠেছে।কাকে ফোন করবে কী করবে সে বুঝে উঠতে পারে না।
আয়ুসী তাড়াতাড়ি করে আয়ানের জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকে।কিন্তু কী দিয়ে দেবে।কাপড় নেই।নিজের ওড়নার দিকে তার নজর পরে।আয়ানের টেবিলে রাখা কাঁচি নিয়ে ওড়না থেকে একটু কাপড় কেটে নিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাসে ভিজিয়ে আয়ানের কপালে দিতে থাকে।
আয়ান আয়ুসীর ছোঁয়া পেয়ে চোখটা খুলে দেখে।আর বিড়বিড় করে বলে-আয়ুসী তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।
আয়ুসী বলে-স্যার আপনার কী শরীর খুব খারাপ লাগছে?
কিন্তু আয়ান আর কিছু বলে না।আবার চোখটা বন্ধ করে নেয়।আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে-প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।
এতক্ষণ আয়ুসী লক্ষ্য করেনি।কিন্তু এবার লক্ষ্য করে আয়ান ওকে তুমি করে বলছে।
এদিকে আয়ুসী আসার আগে মি আহুজা আয়ানের ফোনে ফোন করেছিল।কিন্তু আয়ান না ধরায় ধ্রুবকে ফোন করে।ধ্রুবও আয়ানকে ফোন করতে থাকে।আয়ান তখন ফোন ধরার অবস্থায় ছিল না।ধ্রুব তাই অফিসের দিকেই আসতে থাকে।কিন্তু এতো জোরে ঝড় হচ্ছে আর বাজ পড়ছে যে সে আর এগোতে পারে না।গাড়িটা একজায়গায় থামিয়ে সে দাঁড়িয়ে পরে।আবার আয়ানের ফোনে ফোন করে।এবার ফোনে ধ্রুবর নাম দেখতে পেয়ে আয়ুসী ফোনটা ধরে।
ধ্রুব-এই আয়ান তুই কোথায়?
আয়ুসী-স্যারের খুব জ্বর।আপনি—-
ধ্রুব-আপনি কে?
আয়ুসী-আমি আয়ুসী বলছি।আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।
ধ্রুব আর দেরি করে না।প্রকৃতিও একটু শান্ত হয়ে আসায় তাড়তাড়ি করে অফিসে চলে আসে।
আয়ানের কেবিনে গিয়ে দেখে আয়ুসী আয়ানের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে।আর কেঁদেই চলেছে।ধ্রুবকে দেখে ছুটে আসে।
ধ্রুব-ওকে এখনই বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
আয়ুসী-ওনাকে ডাক্তার দেখাতে হবে তো।
ধ্রুব-হ্যাঁ।
আয়ুসী আর ধ্রুব আয়ানকে ধরে গাড়িতে বসায়।তারপর বাড়িতে এনে ডাক্তারকে ফোন করে।কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে যায়।ওষুধ আর একটা ইনঞ্জাকশন দিয়ে দেয়।ধ্রুব আয়ুসীকে আয়ানের কাছে রেখে ওষুধ আনতে চলে যায়।
আয়ুসী ওর মাথায় পাশে বসে থাকে।এদিকে আয়ান জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে-কেন এরকম হল।আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলে তোমরা।কেন তোমাদেরকে কেড়ে নিল।
আয়ুসী তখন অজান্তেই তার হাত নিয়ে আয়ানের মাথায় হাত বোলতে থাকে।হঠাৎ আয়ান আয়ুসীর হাতটা ধরে বলে-কেন করল বল।কেন,কী জন্য কেড়ে নিল।কী দোষ করেছিল।
এদিকে আয়ুসী বুঝতে পারে না।তাই আয়ানের মুখের কাছে ঝুঁকে ওর কথা শোনার চেষ্টা করে।এদিকে ধ্রুব ফোনে ওর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে।ধ্রুবর গলার আওয়াজে আয়ুসী একটু সরে বসে।
হ্যাঁ,মা।তুমি চিন্তা কর না।আমি এখানেই থেকে যাব।-এই বলে ধ্রুব ফোন কেটে দিয়ে আয়ুসীর দিকে তাকায়।আর বলে-ওষুধ আনতে একটু দেরি হয়ে গেল।আপনাকে আজ অনেক কষ্ট করতে হল।
আয়ুসী-না,না ঠিক আছে।
ধ্রুব আয়ুসীকে দেখে।সত্যি মেয়েটার মুখে যেন মায়া মেশানো।তারপর ধ্রুব এসে আয়ানকে ওষুধগুলো দেয়।আর আয়ুসীকে বলে-চলুন আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি।
আয়ুসী-না,না,আমি বাড়িতে একা যেতে পারব।আপনি এখানেই থাকুন।
ধ্রুব-রাত হয়ে আসছে।আপনাকে একা কিভাবে—-
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধ্রুব বলে ড্রাইভারকে বলছি আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে।
আয়ুসী-এসবের দরকার নেই।
তখন ধ্রুব আয়ুসীর কাছে এসে বলে-দাদার কথা শুনতে হয়।
ধ্রুবর মুখে দাদা শুনে আয়ুসী ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকে।
ধ্রুব-কী হল,চলুন।
আয়ুসী একটু হেসে বলে-এই বোন বললেন আবার আপনি বলছেন।
ধ্রুবও হেসে ফেলে-ঠিক ঠিক।তাহলে তুইও আপনি বলবি না।কী ঠিক তো।
আয়ুসী হাসতে থাকে।
ধ্রুব-চল,না হলে বাড়িতে চিন্তা করবে।
আয়ুসীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ধ্রুব আয়ানের কাছে বসে।কপালে হাত দিয়ে দেখে বলে-জ্বরটা মনে হয় একটু কমেছে।
চলবে—-