প্রতিশোধ পর্ব_৬

প্রতিশোধ
পর্ব_৬
#লেখিকা_সুপ্রিয়া_নস্কর

আয়ুসীর উপর অনাথ আশ্রমের কাজ দেখার দায়িত্ব দিয়েছে আয়ান।তাই আয়ুসী আজ আশ্রমে গিয়েছে।আশ্রমের ছেলেমেয়েদের হাতের কাজ যে শেখাবেন সেই লোকটিকে নিয়ে সে আশ্রমে হাজির হয়েছে।এদিকে আশ্রমের ছেলেমেয়েরা তাকে ছাড়তে চায় না।তাই লোকটি চলে যাওয়ার পরও সে ওখানেই থেকে যায়।বাচ্চাদের বায়নাতে গল্প শোনাতে শোনাতে রাত হয়ে যায়।তাই অগত্যা তাকে উঠে পরতে হয়।আশ্রমের লোকেরা তাকে কিছু দূর এগিয়ে দেয়।কিন্তু আয়ুসী চায় না ওর জন্য কারোর অসুবিধা হয়।তাই বলে ও নিজেই যেতে পারবে।

একা একা হাঁটতে থাকে।আশ্রমটা বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরে আর আশেপাশে বাড়িঘরও কম।গলিতে গলিতে কুকুরের চীৎকারে আয়ুসী ভয় পেয়ে যায়।কোনোরকমে কুকুরগুলোকে এড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে।মনে মনে ভাবে কেন আশ্রমের লোকটিকে ফিরিয়ে দিলাম।নিজেকেই গালাগালি করতে থাকে।আর বলে-বেশি পাকামি,নিজের বিপদ নিজে ডাকলাম।

ভয়ে তার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।কারন কুকুরগুলো তাকে দেখে এমনভাবে ডেকে উঠছে যে আয়ুসী মাঝে মাঝে থতমত খেয়ে যাচ্ছে।একেই সে কুকুরকে ভয় পায়।তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে থাকে।একটি কুকুর হঠাৎ তার সামনে এসে চেঁচিয়ে ওঠে।আয়ুসী দু পা পিছিয়ে যায়।কী করবে বুঝতে না পেরে বলে-হেই,হেই।

আপনার সবাই জানেন এটি আমাদের কুকুর তাড়াবার একটি প্রচলিত প্রদ্ধতি।

আয়ুসীও সেই পদ্ধতি বেছে নেয়।কুকুরটি সরে যেতে থাকে।কিন্তু পাশ থেকে একজনের গলা শোনা যায়-দেখ,খুকুমনি কেমন কুকুর তাড়াচ্ছে।

আয়ুসী দেখে একজন নয়,অনেকজনই বসে আছে।অন্ধকারে সবাইকে দেখা যাচ্ছে না।ওই জনের কথায় সবাই হাসতে থাকে।আয়ুসী দেখে ছেলেগুলো বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।আয়ুসী ছুটতে চায়।কিন্তু তার পা যেন চলছে না।ছেলেগুলো এগিয়ে আসে।লাইটের আলোয় ছেলেগুলোর মুখ দেখা যায়।মুখে কদর্য হাসি।তার মধ্যে থেকে একজন বলে-চল খুকুমনি আমরা তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।এই বলে আয়ুসীর হাতটা ধরতে যায়।আয়ুসী লোকটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ছুটতে শুরু করে।ছেলেগুলোও ওর পিছন নেয়।

হঠাৎ সামনে একটি গাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে।ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছাকাছি এলে গাড়িটা থেমে যায়।আয়ুসী গাড়ির কাছে গিয়ে বলতে থাকে-দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।

কিন্তু ভিতরে যাকে দেখে তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।

ভিতর থেকে বলে-কী হয়েছে?

আয়ুসী-স্যার,প্লিজ ওরা—-

গাড়িতে আয়ান ছিল।

আয়ুসী আর কিছু বলতে পারে না।এদিকে লোকগুলোও এসে গেছে।লোকগুলো আয়ুসীর সামনে।আয়ান গাড়ি থেকে নামে আর একটি লোক আয়ুসীর গায়ে হাত দিতে যায়।আয়ান হাতটা ধরে ফেলে আর লোকটির হাত মুচড়িয়ে দেয়।অন্য লোকগুলোও আয়ানের উপর হামলা করে।কিন্তু আয়ানের কাছে পেরে ওঠে না।আয়ানের পিটুনির কাছে সবাই পালিয়ে যায়।

লোকগুলো চলে গেলে আয়ান দেখে আয়ুসী কাঁপছে।আয়ান আয়ুসীর কাছে গিয়ে আয়ুসীকে ডাকে।আয়ুসী আয়ানের দিকে তাকায়।

আয়ান-ভয় নেই,ওরা চলে গেছে।তুমি গাড়িতে ওঠো।আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

আয়ান গাড়ির দরজা খুলে দেয়।আর আয়ুসী কিছু বলে না।গাড়িতে উঠে পরে।আয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়।কিন্তু মাঝে মাঝে আয়ুসীকে দেখে আয়ুসীর চোখে মুখে এখনও ভয়ের ছাপ।একটি জায়গায় এসে গাড়িটা থামিয়ে আয়ান নেমে যায়।কিন্তু কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও আয়ান না আসায় আয়ুসী ভয় পেতে থাকে।সেও গাড়ি থেকে নেমে আয়ানকে খুঁজতে থাকে।অবশেষে আয়ানকে আসতে দেখে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে আর বলে-কোথায় চলে গিয়েছিলেন,আমাকে ফেলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন।

আয়ান একটু অবাক হয়ে যায়।কী করবে বুঝতে পারে না।মনে অসংখ্য দ্বিধা নিয়ে আয়ুসীর মুখটা তুলে বলে-জল কিনতে।জলটা খেয়ে নিন।

আয়ুসী আয়ানের দিকে তাকায়।তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।আয়ানও আয়ুসী পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।জলের বোতলটা এগিয়ে দেয় আয়ুসীর দিকে।আয়ুসী বোতলটা নেয়।আয়ান দেখে আয়ুসী জল খায় না।বোতলটা হাতে ধরে রেখে দূরের দিকে চেয়ে থাকে।আয়ান দেখে আয়ুসীর চুল বাতাসে উড়ছে।চোখে মুখে চুল উড়ে পড়ছে কিন্তু সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।আয়ান তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে।তাই সে চমকে ওঠে।ফোনটা ধরে বলে-হ্যাঁ,ধ্রুব
আমি ফিরছি।তুই চিন্তা করিস না।

আয়ান ফোনটা রেখে আয়ুসীকে দেখে।সে সেরকম ভাবেই তাকিয়ে।

আয়ান বলে-আয়ুসী চলুন।রাত হয়ে যাচ্ছে।

আয়ানের ডাকে আয়ুসীর হুঁশ ফেরে।বলে-হুমম
এই বলে সে গাড়িতে উঠতে যাবে।তখন আয়ান তার হাত ধরে টানে।একটু বেশিই জোরে টেনে ফেলেছে।তাই আয়ুসী একবারে আয়ানের বুকের কাছে।দুজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে।দুজনের চোখের পাতা পড়ছে না।পাশ থেকে একটি লরি হর্ন দিতে দিতে চলে যায়।হর্নের আওয়াজে দুজন এই জগতে ফিরে আসে।
আয়ান প্রথমে কথা বলে-জলটা খেয়ে নিন।এতো কষ্ট করে আনলাম।

আয়ুসী হাতে রাখা জলের বোতলের দিকে চেয়ে বলে-ওও,হুমম।আমি খাচ্ছি।

এই বলে সে জল খায় আর আয়ান গাড়ির দরজা খুলে দেয়।আয়ুসী উঠে পরে।আয়ানও উঠে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে।

এদিকে আয়ুসীর দেরি হওয়ায় নিলয় ওর ফোনে ফোন করে।কিন্তু ফোন বন্ধ থাকায় সে চিন্তা করতে থাকে।আর দিদির জন্য বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।আয়ান আয়ুসীর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।দিদিকে দেখে নিলয় ছুটে আসে।

নিলয়-এই তোর কী হয়েছে?

আয়ুসী-কিছু হয়নি।

নিলয় আয়ানকে দেখে।আয়ান বলে-দিদিকে ঘরে নিয়ে যাও।

আয়ুসী আর নিলয় বাড়ির দিকে যেতে থাকে।আর আয়ান দাঁড়িয়ে থাকে।আয়ুসী একবার পিছন ফিরে আয়ানকে দেখে আবার চলে যায়।আয়ানও বাড়ির দিকে গাড়ি ছোটাতে শুরু করে।

নিলয়ের অনেক জোরাজুরিতে আয়ুসী বাড়ি ফিরে নিলয়কে সব বলে।নিলয় ভয় পেয়ে যায়।আয়ুসী ভাইয়ের ভয় পাওয়া দেখে বলে-আরে আমার কিছু হয় নি।ওতো ভয় পাওয়ার কী আছে।

নিলয় কাঁদতে কাঁদতে বলে-দিদি তোর কিছু হয়ে গেলে আমি যে মরে যাব।

আয়ুসী ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনে ভাইকে জড়িয়ে ধরে।সত্যিই তো এই জীবনে তারা দুইজন দুইজনের ভরসা।

ভাইকে শান্ত করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আয়ুসী তার প্রিয় জানলার ধারে বসে।আর বারবার আয়ানের মুখটা মনে পরতে থাকে।আর যখন ওকে জড়িয়ে ধরার কথা মনে পরে তখন যেন কেমন তার হতে থাকে।ভাবে ইশ,কী করলাম।আমাকে কী ভাবল।তখনই আয়ুসী মনে পরে যে তার জন্য এতো করল তাকে একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি।মনে মনে বলে কালকেই বলে দেবে।

এইভেবে সে চোখটা বন্ধ করে কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই আয়ানের মুখটা ফুটে ওঠে।আয়ুসী একটু চমকে ওঠে।কিন্তু আজ সে ভয় পায় না।তার ভালো লাগে।এ এক অজানা ভালোলাগা।এই ভালোলাগাতে কী আছে ভালোবাসার পূর্বভাস?

অন্যদিকে আয়ান বাড়িতে গিয়ে ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।হাতে গিটার থাকা সত্ত্বেও তার গিটারে আজ কোনো সুর ওঠে না।আর আয়ুসীর কথাই ভাবতে থাকে।

চন্দ্র আলোকিত রাত্রে এই দুই নরনারী
মনের কোনে যে অজানা গোপন ইচ্ছা
লুকিয়ে রেখেছে,বিধাতার খেলায় কার
ইচ্ছা পুরণ হবে।আর সেই ইচ্ছাপূরণ
কী অন্যের জীবনে সংশয় ডেকে
আনবে?না,অন্য কিছুর পূর্বাভাস দেবে?

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here