স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৩২

0
915

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩২

কালের বিবর্তনে সকল কিছুর মাঝেই পরিবর্তন ঘটে।
সময় কেটে যাচ্ছে। নতুন বছরের তিন মাস শেষ। পায়রা এবার দশম শ্রেণির ছাত্রী। কয়েক দিন আগেই ষোড়শীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বুঝ জ্ঞান তো বহু আগে থেকেই ছিলো তা আরও বাড়ছে ৷ ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখছে। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। নাকে মুখে পড়া গিলে নিতে হয়। পায়রা নিজ আগ্রহেই পড়ে। নীলাংশ নিয়ম করে তাঁকে যত্ন নিয়ে পড়ায়। শুধু কিছু বিষয়েই পায়রা একদমই আবেগি হয়ে পড়ে।
এই যেমন,নীলাংশ যখন একটু ধমক দেয় সে গলগল করে কেঁদে ফেলে, নীলাংশ যখন কথা বলে সে ধ্যান জ্ঞান ভুলে যায়। তাঁর পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা হয়ে ওঠেছে যেনো এই মানুষটাকে ঘিরে। মাঝে মাঝে সে নিজের এই অনুভূতিকে একদমই ছেলেমানুষী বলে চালিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
এইতো সেদিন নীলাংশ নিজের পরীক্ষার চাপে প্রচুর ব্যস্ত সময় পার করছিলো। চেয়েও পারেনি পায়রাকে দুই দন্ড সময় দিতে। ভার্সিটির টপ স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন হওয়ায় তাঁর উপর সবসময়ই একটা দায়িত্ব থাকে ভালো ফলাফল করার ৷ পরীক্ষার সময় পায়রার মনে সুপ্ত আশার উদয় হতো , কিছু সময় কাটানোর, তাঁর সুন্দর সাহেবের মনোমুগ্ধকর হাসিটাকে নিজের দৃষ্টিতে সমাহিত করার। তবে তা হতো না। কারণ সে মনে মনে এতকিছু অনুভব করলেও মুখ ফুটে বলতে পারেনা একটা শব্দও। চাপা স্বভাবের পায়রা এভাবেই মনের একচ্ছত্র আধিপত্যকারী তাঁর সুন্দর সাহেবের প্রতি জমানো অনুভূতি গুলোকে সযত্নে বাক্সে সাজিয়ে রাখে। স্বপ্নরা যেদিন বাস্তবে পরিণত হবে সেদিন তার সুন্দর সাহেবের সামনে খুলে বসবে অনুভবের মেলা।
নিজের অজস্র অনুভূতির সঠিক নাম সে খুঁজে পায় অবশেষে যখন নীলাংশের চোখের দিকে তাকায়। যে মানুষটার চোখে দিকে তাকিয়ে এক জীবন পার করে দেয়া যায় সেই তো ভালোবাসা। যার একটু হাসিতেই হৃদয়ে মাদলি বেজে ওঠে ঝনঝন শব্দে। তাঁর নাম শুনতেই লজ্জায় গাল সহ সম্পূর্ণ আত্মাই লাল নীল
বর্ণের হয়।
নীলাংশ পাক্কা মাস্টারের মতো বসে আছে ৷ হাতে রসায়নের মলাট লাগানো বইটা। নেড়েচেড়ে দেখছে কী যেনো। পায়রা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আড়চোখে একবার দেখে নিলো। কলিজা শুকিয়ে গেছে। এই পড়ার দুই ঘন্টা বাদে নীলাংশের মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ এই বাংলাদেশে কেনো? পুরো পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু পড়ার সময় নীলাংশের মুখভঙ্গি দেখে নিজেকে ঠিক রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কাল রাতে তাঁকে মোটামুটি অনেক গুলো পড়া দিয়েছে নীলাংশ। পায়রা রাতে অনেকক্ষণ পড়েছে। কিন্তু কী করবে? মনোযোগ ছিলো না একদমই। মন ঘুরে ফিরে চলে যাচ্ছিলো অন্য জায়গায়। কম বয়সের ভালোবাসা গুলো খুবই নাজুক হয়। এই সময় ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় জেঁকে বসে। যেদিন থেকে পায়রা নিজের অনুভূতির সঠিক নাম খুঁজে পেয়েছে তারপর থেকে সে একদন্ডও স্থবির হয়ে থাকতে পারেনা। তার কারণ আছে বটে।
যবে থেকে পায়রা স্কুলে আসা যাওয়া করতো মাঝে মধ্যেই দেখতো নীলাংশ নিনিকার সঙ্গে কথা বলছে। তখন সেসব গায়ে একদমই লাগায়নি সে। কিন্তু ভালোবাসা টের পাওয়ার পর নিনিকাকে কাঁটার মতো চোখে বিঁধে পায়রার। নিজেকে গালমন্দও করেছে এজন্য । কিন্তু যখন নিনিকা যখন কথা বলতে বলতে নীলাংশের দিকে ঝুঁকে নিবিড় নজরে তাকিয়ে থাকে বা কথার ছলে হাতে হাত রাখে পায়রার কলিজা পু্ড়ে ছারখার হয়ে যায়। তীব্র দাবানলে জ্বলে উঠার পর আত্মা ক্রন্দনে লিপ্ত হয়। খুব খুব অভিমান জাগে তাঁর সুন্দর সাহেবের উপর। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে তাঁর সুন্দর সাহেবও তাঁর জন্য এই তীব্র জ্বলুনি তীব্র ভীতি, হাড়ভাঙা ব্যাথা অনুভব করতে পারে! হয়তো না। নীলাংশ তো সবার সাথেই অমায়িক ব্যবহার করে।
তাঁর সাথে যেমন আট-দশ টা মানুষের সাথেও তো তেমনই। এসবই পায়রার নিজস্ব মনের কথা। নীলাংশের মনে যে আসলে ঠিক কী চলে তা জানেনা পায়রা। তবে, অনেক চায় নীলাংশ তার মনের কথা তাকে বলুক। সেও একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে তাহলে!
পড়া কমপ্লিট না হওয়ায় শাস্তিস্বরুপ পায়রাকে আজ একটা পর্যন্ত তাঁর কাছে পড়তে হবে বলে ঠিক করেছে নীলাংশ। পায়রা বাহিরে বাহিরে ভীষণ দুঃখী মুখ করে রেখেছে। যেনো তাঁর মতো দুঃখী একটা মানুষও পৃথিবীর বুকে নেই। কোন ক্লাসে যেনো একটা গল্প ছিলো ‘আসমানী’। তেমন কিছু এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু ঐ ছেঁড়া শাড়িতে একটা নারীচরিত্র ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। ঠিক সেইরকম একটি মুখ করেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় সে। অর্থাৎ শাস্তি সে গ্রহণ করেছে। যেই নীলাংশ বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পায়রা পারে না খুশিতে কেঁদে ফেলতে। প্রথম প্রেম বুঝি এতই সুখকর! পায়রা জানে রাত একটা কেনো সারা রাতও যদি নীলাংশের কাছে বসে পড়ে তাহলেও নীলাংশ একটা কাটখোট্টা মুখ করে বসে থাকবে। কিন্তু পায়রার মন এতটুকুতেই খুশি যে অনেক ক্ষণ পর্যন্ত নীলাংশের মন মাতানো সুগন্ধের সমারোহে ডুবে থাকতে পারবে। আশেপাশে শুধু নীলাংশের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াবে। সেই ঘ্রাণের থেকে কুড়িয়ে সে অল্প অল্প অক্সিজেন নিজের ভেতর টেনে নিবে। তাহলে, অক্সিজেনের নাম কী হবে?নীলাংশ সুগন্ধি অক্সিজেন! ধ্যাত, কী আজব চিন্তা করছে সে। নীলাংশ হঠাৎ-ই ঘরে আসলো। পড়া শেষ কিন্তু এখন আবার কী তা ভেবে পায়রা কপাল কুঁচকে তাকালো। নীলাংশ কোনো কথা বললো না হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিলো। পায়রা তাকিয়ে দেখলো কিটক্যাট চকলেট। যেদিনই নীলাংশ কোনো শাস্তি দেয়। সেদিন তেমন কোনো কথা বলেনা, শুধু এসে একটা চকলেট দিয়ে যায়। পায়রা মাঝে মধ্যে ভাবে সে কী বাচ্চা! যে চকলেট দিয়ে তাঁকে ভুলিয়ে রাখতে চায়! হোক শাস্তিটা পায়রার জন্য সুখকর। কিন্তু শাস্তি তো শাস্তিই তাইনা!
তাই বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বললো-

‘সুন্দর সাহেব! আমি কী বাচ্চা যে ঘুষ দেন!’

নীলাংশ মোটেও অবাক হলো না। পায়রার হাতে চকলেট টা গুঁজে দিয়ে বললো-

‘না। তুমি মোটেও বাচ্চা নও। ‘

পায়রা খুব খুশি হয়ে হাসলো। কারণ সবাই তাকে বাচ্চা বাচ্চা করে। সে তো ষোলোতে পা দিয়ে ফেলেছে তাই না! তাহলে সে আর বাচ্চা নেই বড় হয়ে গেছে। কিন্তু নীলাংশ তাঁর সকল খুশিতে এক বালতি পানি ঢেলে যেতে যেতে শক্ত কন্ঠে বললো-

‘তুমি হলো বাচ্চার আপডেট ভার্সন, পিচ্চি! ‘

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here