#রহস্যের_কুয়াশা☠️
পর্ব_১০
#হাফসা_ইরিন_রাথি
দেখতে দেখতে অবশেষে চলেই এলো প্রতিযোগিতার দিন। ইহান আর মিলি আজ একটু আগেই চলে এলো স্কুলে।ওদের ৩ জনকে নিয়ে স্যার যাবেন।যাওয়ার পথে পুরোটা সময় ইহান মিলিকে জ্বালিয়েছে।
–আজকে যদি আমি প্রাইজ না পাই তাহলে তোমারে আমি কি যে করবো,দেখিও।
–কেনো আমি কি করলাম?
–আমি পড়াগুলো মনে মনে রিভিশন দিচ্ছিলাম আর তুমি পুরোটা রাস্তা জুড়ে আমার চুল টেনেছো।
”
”
”
পরীক্ষার সবকিছু ভালোমতই মিটে গেছে। ইহান একটুর জন্য হেরে গেছে তাও মিলিকে জেতানোর জন্য।উত্তরটা ইহানের নিজেরও জানা ছিল কিন্তু ও আনসার দেয় নি,এসবের থেকে রিদ ওর কাছে বেশি প্রয়োজন,জরুরি।
মিলি তো আনন্দে লাফাচ্ছে।পিঙ্কি মেয়েটাও যথেষ্ট ভালো করেছিল কিন্তু শেষের এক্সট্রা হার্ড প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারে নি।
–ইহান তুমি জানো,আজ আমি এত্তো এত্তো এত্তো খুশি!
পিঙ্কি ইহানের আর মিলির পাশেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে।মিলির কথায় চোখ তুলে হিংসুটে দৃষ্টিতে একবার তাকালো শুধু। ইহান মিষ্টি হেসে বললো,
–জানি।
বাসায় এসে মিলি ওর মায়ের কাছে গেলো উনাকে খবরটা দিতে।ওর মা তো ওকে প্রশ্ন করতে করতে শেষ।কিভাবে কি করলো এসব নিয়ে। ইহান চুপচাপ ওদের পাশেই দাড়িয়ে ওদের দুজনের এক্সাইটমেন্ট দেখছে আর মনে মনে ভাবছে,
–আমি কেনো এতটা খুশি হতে পারিনা!এতটা উল্লাস কেনো আসে না? আসবেও না হয়তো আবার সব আগের মতো না হলে।আবার সেই নদীর পাড়ে এলোচুলে আমার রিদকে না দেখলে!
ইহান মন খারাপ করে মিলির রুমে চলে গেলো।মিলি মায়ের সাথে গল্প করা শেষে ইহানকে না দেখতে পেয়ে আবার কেমন যেনো ভয় পেতে লাগলো “ইহান চলে গেলো নাতো আবার!”,এই আশঙ্কায়।দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দেখলো ইহান মাথা নিচু করে মন খারাপ নিয়ে বসে আছে।মিলি ওর কাছে গিয়ে নিজেও বসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইহানের মলিন মুখটার দিকে।
–কি হইছে তাকাই আছো কেনো?
–তোমার মন খারাপ কেনো ইহান?
ইহান খানিকক্ষণ কি একটা ভাবলো।
–আচ্ছা রিদ তুমি কি কখনো “তৃন্ময়ী” নদীতে গিয়েছিলে?
মিলির একমুহুর্তের জন্য মনে হলো নামটা বড় চেনা!কিন্তু পরক্ষণেই কেমন গুলিয়ে গেলো সব।আবছায়া হয়ে গেলো দৃশ্যটা।
–না আমি তো এমন নাম শুনিনি,যাবো কিভাবে।
–ওহ্!
মিলির মনে হলো ইহানের এই ছোট্ট “ওহ্” শব্দটায় অনেক হতাশা মিশে আছে তাই ইহানের মন ভালো করার জন্য বললো,
–তোমার বাসায় নিয়ে যাবা না?চলো যাই।
–না এখন না।তোমার ১০ বছরের জন্মদিনের দিন নিয়ে যাবো সেখানে!
–কিহ্!১০ বছর!তার মানে এখনও আরো ৪ বছর+ সময় বাকি!!!
–হুম,এখন রেস্ট নাও।আমি পরে আসবো।
–আরে শোন শোন……
কিন্তু ইহান ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেলো।মিলি গাল ফুলিয়ে বসে আছে ইহানের উপর অভিমান করে।
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
–কি হলো আজ সোজা জ্বীন রাজ্যে??কোনো বিশেষ খবর?
–না তেমন কিছুই না। মন খারাপ বলে আসলাম। তৃন্ময়ী-তে যাবো একটু।খুব মনে পড়ছে।
–হঠাৎ?
–রিদকে আজ এই নদীটার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।কিন্তু জানিস,ও নামটাই মনে করতে পারলো না!
দিনকাল একইরকমভাবে কাটছে।এর মধ্যে কোনো শত্রুর আক্রমণ আসে নি।আর অলিভার আর সেলিয়াস ও কোনরকম ঝামেলার সৃষ্টি করে নি।তারা যে বেঁচে আছে সেই অস্তিত্বটা পর্যন্ত ওরা কেউ টের পায় নি।প্রথম কদিন একটি আশঙ্কার মধ্যে ছিল ইহান,সব কাজে সতর্ক দৃষ্টি রাখতো কিন্তু আস্তে আস্তে যখন দেখলো সব ঠিকঠাক আছে তখন সহজ হয়ে আসে মন।কিন্তু বিপত্তি ঘটে ঠিক একবছর পর।আর সেটা ঘটে মিলির ছোটো বোন মিতুর মাধ্যমে, ইহানকে কেন্দ্র করে।মিতু এখন ৫ বছরে পা রাখলো।সে ছোটো থাকাকালীন সময়ে না ইহান চাইতেও সে ইহানকে দেখতে পেতো।কিন্তু এখন কথা বলতে পারে আর যথেষ্ট বড় হয়েছে বলে অদৃশ্য ইহানকে ও দেখতে পায় না।একদিন সবাই মিলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলো।তখন হঠাৎ মনে পড়ায় মিতু ওর মাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
–মা, ইহান কেনো আসে না?
মিলির মা আর মিলি দুজনেই চমকে গেলো ওর কথা শুনে।মিলির বয়স এখন বছর ৭ প্রায় তাই ও এখন এসব ঠিকই বুঝে যে বাসায় এই নামটা নেওয়া ভীতিকর।আর ইহানের ব্যাপারে এখন মিলি খুব সতর্ক যাতে অন্য কেউ ইহাকে দেখে না ফেলে বা ওদের কথা শুনে না ফেলে।ও বুঝতে পারে আরো ছোটবেলায় ওর বোকামির জন্যই ইহানের মতো একটা ভালো বন্ধু,খেলার সঙ্গীকে ও হারাতে বসেছিল।এখন তাই মিতুর কথাটা শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো ও।কান পেতে অধীর আগ্রহে দম বন্ধ করে মা কি বলে শুনার জন্য তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে।কিন্তু আগে কথা বললেন জারিফ সাহেব।
–ইহান বলতে কিচ্ছু নেই মা।তুমি হয়তো ভুল দেখেছো।
অকপট সারল্যে মিতু বললো,
–কিন্তু সে তো সেই ছোটো থেকেই আমাদের সাথে থাকতো বাবা।তাহলে কোথায় চলে গেলো?
জারিফ সাহেব ভয়, দুশ্চিন্তায় মেয়েকে থামাতে ধমকে উঠলেন,
–একদম এসব কথা বলবে না।চুপ করে খাবার খাও বলছি।
মিলি বাবার এমন ব্যাবহারের কারণ জানলেও এমন আচরণ করতে কখনো দেখেনি বলে খুব ভয় পেয়ে গেলো আর মিতু তো ভয়ে কেদেই দিলো।
মালিহা বেগম অনেক কষ্টে ওর কান্না থামিয়ে শান্ত করলেন।আর কোনো কথাবার্তা হলো না, খাবার টেবিলে একপ্রকার নিরবতা নেমে এলো।মিলি ভয়ে ভয়ে খাবার শেষ করে চলে গেলো নিজের রুমে।
ইহান তখন মিলির রুমে ছিল না কারণ ওর জ্বীন রাজের কাছ থেকে জরুরি তলব এসেছে।মিলি চুপচাপ শুয়ে আছে আর ঘুমের ব্যার্থ প্রয়াস করছে কিন্তু ঘুম ওর আসছে না। ইহান ওকে আগেই বলে গেছিলো সে তার বাসায় যাবে তাই ইহানের আসার কোনো আশা নেই। মন খারাপের সময়টায় প্রিয় মানুষটার সাথে মন খারাপের কারণটা share করতে পারলে ভালো লাগতো।কিন্তু আফসোস!
মিলি প্রায় অনেকক্ষন পর হালকা কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনতে পেলো।রাতের নির্জনতায় কথার আওয়াজগুলো স্পষ্টই হচ্ছিলো ক্রমশ।মিলি ভালো করে শুনার চেষ্টা করলো।
–প্লিজ না জারিফ।আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই না ঐখানে।ওর কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে।প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো।
–তুমি বুঝার চেষ্টা করো ব্যাপারটা এখন আর আগের মতো সহজ নেই।এখন এর সাথে মিতুও জড়িয়ে গেছে।আর আমি কিছুতেই আমার এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের ক্ষতি হতে দিতে পারি না।তার চেয়ে এর একটা বিহিত করাই ভালো।আমাদের সামান্য একটু রিস্ক নিতেই হবে।নাহলে ওদের জীবন বিষিয়ে যাবে।(চাপা ও উত্তেজিত কণ্ঠে)
–কিন্তু তুমি তো শুনলে মিতু কি বললো।মিতু বললো ইহান নামের ছেলেটিকে দেখেনা ও।(মিনতী ভরা কণ্ঠে)
–এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো চাল ওই জ্বীনটার।তুমি খেয়াল করেছিলে যখন টেবিলে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো তখন মিলি কেমন চুপসে ছিল ভয়ে।আমি আমার চোখের সামনে আমার মেয়েদের এমন অবস্থা দেখতে পারবো না।
কালকেই সকালে ওখানে যাচ্ছি এটাই আমার শেষ কথা।এই বিষয়ে মিলি বা মিতু কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই।
মিলি শুনলো মালিহা বেগম অনুরোধের সুরে কি যেনো বললো কিন্তু জারিফ সাহেব কঠোর কণ্ঠে তার বিরোধিতা করলো। কথাগুলো ঠিক বুঝতে না পারলেও মিলি এতটুকু বুঝে গেলো যে কালকে খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে ওর জন্য আর এই খারাপকে প্রতিরোধ করা ওর সাধ্যাতীত।
ভাবতে ভাবতে মিলি ঘুমিয়ে গেছিলো।ঘুম ভাঙলো ওর মায়ের ডাকে। এতো সকালে তো কখনো ডাকে না তাহলে আজ কেনো ডাকলো মিলি বুঝতে পারলো না।
–তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও আমরা সবাই বের হবো।
মিলি মায়ের মুখের দিকে তাকালো,বিষন্নতা গ্রাস করা।বুঝতে বাকি নেই রাতের তর্কে বাবা জয়ি হয়েছেন।
মিলি কথা না বলে চুপচাপ রেডী হয়ে নিলো।মনে মনে ইহানকে খুব আশা করছে কিন্তু ইহান আসছে না।
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
–তুমি কি জানো কেনো তোমায় রিদকে ওর মা বাবার সাথে স্বাভাবিক থাকার জন্য দিতে বলা হয়েছিল?
–কেনো?
–কারণ সে হতে পারে তোমার।কিন্তু তার জন্মদাতা পিতা মাতার অধিকার আছে তার সন্তানকে কাছে পাওয়ার,আদরে রাখার।
–আমি বুঝতে পারছি।
কিন্তু আমার জরুরি তলব কেনো হুজুর?আর এই কথাগুলোই বা কেনো?
–অলিভার রিদের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রাখছে ওর উপর।এমনকি ততটা নজর রাখছে যতটা তুমিও রাখো না।ওর লোকেরা প্রতিটি মুহূর্তে রিদকে চোখে চোখে রাখছে।ও যতো বড় হচ্ছে ওরা তত বেশি সতর্ক থাকছে।
আর কথাগুলো বলার কারণ এই প্রশ্ন তোমার মনে বারবার উকি মারছিল।
ইহান খুব অবাক হলো জ্বীন রাজের কথায়।ও সত্যি এই বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছে কিন্তু হিসাব মিলাতে পারে নি।মিলিকে ওর পরিবারের সাথে মিশতে দেখলেই ওর ভালো লাগতো না কথাগুলো খুব সত্য।কিন্তু অবাক হওয়া বাদ দিয়ে অলিভার এর কথাটা ভাবতে লাগলো।চিন্তিত হয়ে বললো,
–ধন্যবাদ হুজুর উত্তর দেবার জন্য।
কিন্তু অলিভারের ব্যাপারটা আমি কিছুই টের পাই নি। রিদ নিজেও কখনো ওর আশপাশে কেউ আছে এমনটা অনুভব……
হঠাৎ থেমে গেলো ইহান।ওইদিন রিদ রাতে অনেক ভয় পেয়েছিল রুমে কি যেনো দেখে।তাহলে ঐটাই কি……!!!
–কি হলো থেমে গেলে কেনো?
ইহান ব্যাপারটা খুলে বললো উনাকে।উনি সব শুনে বললেন,
–হ্যাঁ তুমি ঠিক ধরেছো।ঐটাই অলিভারের পক্ষের কোনো চর ছিল।সাবধানে নজরে রেখো ওকে।
কিন্তু এখন আপাতত তোমায় এখানে ২ দিন থাকতে হবে।রাজ্যের সৈন্যরা দীর্ঘ বিরতিতে যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন না।ওদের কদিন ট্রেনিং দিতে হবে তোমাকে।
রিদের দেখভালের দায়িত্ব রোজা আর রিমাদকে দাও ২ দিনের জন্য।
ইহানের যদিও কষ্ট হচ্ছিলো এখানে থাকতে হবে ভেবে কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলো যাদের জন্য নিজের প্রিয়তমা আত্মত্যাগ করলো তাদের শেষ রক্ষা যদি নাই হলো তাহলে কি মূল্য রইলো তার এই অমূল্য কাজের? ইহান জ্বীন রাজ্যে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।
চলবে”””