নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা ||৪র্থ পর্ব||

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||৪র্থ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা অফিস শেষ বিকেল গড়াতেই বাড়ি ফিরে। না, নিজের বর্তমান ঠিকানায় আসেনি সে। এসেছে নিজের পুরাতন ঠিকানা তথা পিতা-মাতার বাড়িতে।

সে খুব করে ভেবেছে আরাধ্য আর নিজের সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু ভাবার পর মনে হয়েছে সে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। আর কিছুদিন আরাধ্যের নিকট থাকলে বরং বিতৃষ্ণাই বাড়বে মানুষটার প্রতি, সম্পর্কের প্রতি।

আরাধ্যের ‘সরি’ টেক্সটটা দেখেছে সে আবরাহামের কেবিন থেকে বের হওয়ার পরপরই। উত্তর দেয়নি, ফোন অফ করে রেখে দিয়েছে। কেন দিবে? মানুষটা বুঝুক প্রিয়জনের উপেক্ষায় কতোটা পোড়ন হয় হৃদয়ের।

কলিংবেল বাজাতেই নিবেদিতার মা নাদিরা খানোম এসে দরজা খুলেন। নিবেদিতা ভিতরে ঢুকতেই জুতার বেল খুলতে কোস্তাকুস্তি শুরু করে।

“কী রে তুই হুট হাট বাড়ি আসলি কেন? তাও আবার এত বড় বড় ব্যাগ নিয়ে। দুই বছর নাইয়োরের পর তো দুই দিনও থাকতে আসিস নাই?”

উৎকণ্ঠা নাদিরা খানোমের প্রশ্নে। সকাল থেকেই তাঁর মেয়ের চিন্তায় বিপি হাই। হবে নাই বা কেন?নিবেদিতা ভোর বেলা এসে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ব্যাগপত্র রেখে দরজার সামনে থেকে অফিসের জন্য রওনা দিয়েছে। অনেকবার তিনি নিবেদিতাকে কল করে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন কিন্তু স্বামী রৌদ্দুর সোহরাবের কড়া নিষেধ ছিল। মেয়ের কাজে না কি ডিস্টার্ব হবে।

প্রশ্নবিদ্ধ হয়েও উত্তর দেয় না নিবেদিতা। সে জুতা খুলার যুদ্ধে মশগুল। তখনই এগিয়ে আসেন রৌদ্দুর সোহরাব। ছোটোবেলার মতোই মেয়ের জুতা খুলে দেন তিনি।

“যত্তসব আদিক্ষেতা বাবা-মেয়ের।” বিড়বিড়ান নাদিরা খানোম।

“তোমার এত জ্বলছে কেন নাদু? আর মেয়েটা এতদিন পর এসেছে, তাও সোজা অফিস থেকে এত কাজ করে এসেছে। কোথায় পানি শরবত এগিয়ে দিবে, তা না, প্রশ্নের সব তীর ছুঁড়ছো একসাথে।”

“তা করবে না বাবা? আমি তো পর হয়ে গিয়েছি। উনার বড় বোন যেন কী বলতো? মনে পড়েছে, পরের সম্পদ আমি। পরের সম্পদের বোঝা মাথায় এসে পড়েছে, উত্তেজিত তো হবেই।” বাঁকা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধায় নিবেদিতা।

“এই যে বাবা-মেয়ে আবার এক হয়েছে আমাকে অপদস্থ করতে। আরে বাবা আমি তো মা, নয়মাস গর্ভে রেখে, একটু চিন্তা হবে না? চিন্তা হচ্ছিলো তোর জন্য, তাই জিজ্ঞেস করেছি। বল না, কোনো সমস্যা?”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নিবেদিতা। নাদিরা খানোম হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী, তাকে নিয়ে বেশ প্রতিরক্ষামূলকও তিনি। নিশ্চয়ই শুনে উত্তেজিত হয়ে ব্লাড প্রেশার হাই করে ফেলবেন, একশোটা কথা শুনাবেন বাবাকে এই বিয়েতে রাজি হওয়ায়। আর আজকের পর আরাধ্য সবসময়কার জন্য নিচু হয়ে যাবে নাদিরা খানোমের নিকট।

এসব কিছুই হতে দিতে চায় না যুবতী। তাই মুখশ্রীতে জোরপূর্বক চওড়া এক হাসি ফুটায় সে। অম্লান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ের দিকে।

“আজব তো মা আমি কি কোনো সমস্যা ছাড়া আসতে পারি না না কি?র তেমন কিছুই হয়নি আম্মো। আমার একঘেয়েমি এসে পড়েছিল ওখানে থাকতে থাকতে, আবার তোমাদের কথা মনেও পড়ছিল। তাই এসে পড়েছি।”

“আচ্ছা, তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর জন্য তোর প্রিয় ফুলকপির পাকোড়া, বাধাকপির বড়া, পিয়াজের পাকোড়া করেছি।”
হাসিমুখে রান্নাঘরের দিকে চলে যান নাদিরা খানোম। যেন এতক্ষণে তিনি স্বস্তি ফিরে পেলেন।

কিন্তু রৌদ্দুর সোহরাব বুঝতে পারলেন কোনো খটকা তো আছেই। নিবেদিতা স্বভাব, ব্যবহার, চালচলন সবই তাঁর একদম মুখস্থ। মেয়ের আচারণে অস্বাভাবিকতা আছে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। বরং, ফ্রেশ হতে যেতে তাগাদা দিলেন।

নিজের ঘরে ঢুকতেই নিবেদিতার চেহারা খানা দুঃখী ও মলিম হয়ে গেল।
“সরি বাবা, আম্মো। বাট আমি আমার দুশ্চিন্তা তোমাদের মাথায় দিতে চাচ্ছি না।”

___

আবরাহাম বাড়ি ফিরে বেশ রাত করে। বাড়িতে পা রাখতেই তার দাদীজান মনিশা সরদার খোঁচা দিলেন,
“এসেছে লাট সাহেব রাত্রির বারোটা বাজে। অবশ্য মায়ের শিক্ষাতেই তো বড় হয়েছে, এমন তো হবেই। খোকাকে কতবার বললাম যেতে দিস না ঐ বিদেশিনীর সাথে, তবুও… নূন্যতম শিক্ষা, সংস্কৃতি নেই ভিতরে! নিশ্চয়ই ক্লাব কিংবা বারে যেয়ে মদ গিলে এসেছে।”

মুচকি হাসলো আবরাহাম। দুই গালের টোলটা একটু স্পষ্ট হলো। তিলটা যেন হাসিটা আরও রূপ ঢেলে দিল। আবরাহাম এগিয়ে এসে মনিশা সরদারের রকিং চেয়ারের দিকে।

তাঁর দিকে ঝুঁকে বলে,
“গন্ধ পাচ্ছো গো জান? লোকে বলে নাতি না কি বাপ-দাদার গুণ নিয়ে জন্মায়। আমায় নেশাখোর বলা মানে তোমার জামাই-ই নেশাখোর ছিল, এখন ভেবে নেও। ওক্কে জান, নাও বাই।”

চোখ মেরে চলে গেল আবরাহাম। নাতির সৌন্দর্যে নিজেই অভিভূত হলেন মনিশা সরদার। বিড়বিড় করে বললেন,
“মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! নাতি তো আমার নাতিটা তো পুরাই চাঁদের টুকরো হয়েছে। কালই সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে পানি পান করাবো। নজর না লেগে যায় আমার চাঁদের টুকরা!”

বস্তুত, মনিশা সরদারের একমাত্র আদরের নাতি আবরাহাম সরদার এডউইন। কিন্তু প্রায় সাত বছর আগে আবরাহাম জেদ ধরে আমেরিকা চলে গিয়েছিল, এটা নিয়েই মূলত রাগ তিনি।

আবরাহাম ডিনার শেষ করে বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে পা রাখে সে। হাতে এক কাপ বরফ শীতল ব্ল্যাক কফি। তার এ এক অদ্ভুৎ অভ্যাস ঠাণ্ডা কফি পানের।

অকস্মাৎ সামনের বিল্ডিংয়ের দুই তলায় চোখ পড়ে তার। আবছা অন্ধকারে এক নারী ছায়ামূর্তি গিটার হাতে সুর তুলছে। যদিও দূরত্ব হওয়ায় মানুষটি কে তা ঠাহর করতে পারে না আবরাহাম, না ঠিকমতো গান শুনতে পারে। আর ধ্যানও দেয় না।

আবরাহাম বিভোর হয়ে পড়ে নিবেদিতার ভাবনায়। মেয়েটার শ্যামবর্ণা মায়াবী মুখশ্রী, ঠোঁট চেপে হাসা সবকিছুই মোহিত করেছে তাকে। তবে এ প্রথম নয়, অনেক নারীর প্রতিই এর পূর্বেই মোহিত হয়েছে সে।

এদিকে সুখ অবাক হয়ে যায় আবরাহামকে সামনের বাড়ির বারান্দায় দেখে। লোকটা কী অনায়াসে চুমুক দিচ্ছে কফি!

ভাবে,
– লোকটা নিশ্চয়ই এখানেই থাকে! উত্যক্ত করার একটা তো প্রতিশোধ নেওয়াই যায়।
কুটিল হাসি ফুটে উঠে তার অধরজোড়ায়।

___

আরাধ্যের সারাদিন গাধাখাটনি দিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছে। বাজে রাত একটা। মোকশেদা বেগম আগেই তন্দ্রায় ডুবেছেন।

গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। তবে আরাধ্য এসবে ধ্যান দেয় না। মনে করে নিবেদিতা ফিরে এসেছে। কোনোদিকে না তাকিয়েই সদরদরজা খুলে বেডরুমে ঢুকে সে।

গলা উঁচিয়ে ডাক দেয় নিবেদিতাকে।
“নিবেদিতা! নিবেদিতা! এক গ্লাস পানি দাও গো।”

কোনো সাড়া নেই। সচকিত হয় আরাধ্য। উঠে আলমারি খুলে। না, ফিরে আসেনি নিবেদিতার জিনিসপত্র। অর্থাৎ, নিবেদিতাও ফিরেনি।

মোবাইল বের করে নিবেদিতাকে কল দেয়। এবার ফোন সুইচ অন করা স্বস্তির শ্বাস নেয় সে। নিবেদিতা কল রিসিভ করে শীঘ্রই।

নিবেদিতা রৌদ্দুর সোহরাবের কাঁধে মাথা রেখে দোলনায় বসে চাঁদ দেখছিল। রৌদ্দুর সোহরাব রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করে বসেন,
“কী হয়েছে রে মা আরাধ্যের সাথে? আমাকেও বলবি না?”

বাবার প্রশ্নে আর হৃদয়কে বেঁধে রাখতে পারে না নিবেদিতা। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সহিত তার হৃদয় থেকে নিংড়ে বের করে নেয় সকল চাপা কষ্টের কথাও। তবে শিক্ষায় প্রশ্ন তোলার বিষয়টি উহ্য রাখে।

“দেখ মা, তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস সব বোঝার জন্য বিচার-বিবেচনা করার জন্য। আমি সেটাতে দখলদারিত্ব করবো না। তবে একটা কথা তুই যা বললি তার মানে তোকে ভালোবাসে না এমন কিছু নাও হতে পারে।

আবার পরকীয়া বা অন্যকারো মোহে পড়েছে তেমন কিছুও হয়তো না। হয়তো বোঝায়, চিন্তা-ভাবনায়, মানসিকতায় একটু সমস্যা৷ তোর সইলে তুই শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারিস, না পোষালে বা না শুধরালে… সব তোর ইচ্ছে। তবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে কিছুই নয়।”

রৌদ্দুর সোহরাবের কথা শেষ হতেই নিবেদিতার ফোন বেজে উঠে। উঠিয়ে দেখে আরাধ্যের কল। বাবার দিকে তাকায় সে। ইশারায় ফোন তুলতে বলে প্রস্থান করেন রৌদ্দুর সাহেব।

ফোন রিসিভ করতেই আরাধ্য ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“নিবেদিতা, বাড়ি ফিরে এলে না তুমি? আমি সরি তো বাবা! আঙ্কেল-আন্টিকে আমি সত্যি এসব প্রকৃত অর্থে বলিনি। ফ্রাস্টেশনে, রাগের মাথায়…”

“জানি তুমি এসব ইচ্ছে কোরে বলোনি এবং তুমি সরিও। কিন্তু তুমি তো একটা বছর আমাকে উপেক্ষা আর উদাসীনতার আগুনে পোড়ানোর জন্য সরি না।”

“কীসের উদাসীনতা? কীসের উপেক্ষা নিবেদিতা? সারা সময় কোন মানুষটা নিজের ওয়াইফকে এটেনশন দিতে পারে। এমন ভাবে বলছো যেন আমাদের মধ্যে কোনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই নেই এক বছর ধরে।”

“আমি খুব বেশি কথা বলতে চাই না বাবা-মা শুনবে। শুধু বলবো তুমি একটা বিষয় ভুলে গিয়েছো।
অধর ছোঁয়ার আগে ললাট ছুঁতে হয়,
দেহ ছোঁয়ার আগে হৃদয় ছুঁতে হয়।
এ দুটি এক অঘোষিত নিয়ম, যা মানতেই হবে প্রতিটি মানব-মানবীকে। নাহলে সে অপরাধী, কোনো গতানুগতিক পাপ ছাড়াই হয়তো।”

___

আবরাহাম সকাল বেলা তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়। গেটের বাহিরে বের হতেই কেউ এক বালতি রান্নাঘরের ময়লা মিশানো পানি ছুঁড়ে মারে তার দিকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বাক্যহারা আবরাহাম। রাগে চোখজোড়া ও অতিরিক্ত ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে উঠে। সুখ তা দরজার ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে মুখ চেপে হাসছে। ঘটনাক্রমে তাকে দেখে ফেলে আবরাহাম। সাথে সাথেই চিৎকার দিয়ে উঠে সে।

“এই মেয়ে! সুখ না তুমি? এদিকে আসো, তাড়াতাড়ি এদিকে আসো!”

সুখ ভয়ে ভয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে আছে। লোকটা কেমন রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে ষাঁড়ের মতোন। না জানি কী করে তার সাথে ষাঁড়!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here