আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৮

0
2722

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৮
————————————————
এডালিন সবার সম্পর্কে একটু একটু ধারনা দিচ্ছিলো ঠিক সে সময় ফুস করে কেউ একজন প্রবেশ করল। তাকিয়ে দেখলাম সকালে দেখা ছেলেটা। দ্য সাইকেল মানব। ব্যাক প্যাক পিঠে মুখে হালকা হাসি ঝুলিয়ে সবার সাথে কথা বলছে। ও প্রবেশ করতেই এডালিন হালকা ইশারা করে আমাকে বলল
“এ হচ্ছে এড। সকালেই তার সাথে দেখা হয়েছে। তোমাকে জানিয়ে রাখি এড তিনটা বিষয়ে সব সময় চ্যাম্পিয়ন। চাইলেও তাকে হারাতে পারবেনা।”
ভ্রু কুচকে বললাম
“কোন তিনটা বিষয়?”
“সাইকেল রেইস, ম্যাথ এন্ড কুট বুদ্ধি।”
“মানে?”
“মানে বুঝলা না? সাইকেলে রেসে কেউ ওকে আজ পর্যন্ত হারাতে পারেনি। ম্যাথে ওর মার্ক সব সময় হাইস্ট এবং ফিচলে বুদ্ধিতে সে সব সময় সেরা। যে কারো সমস্যায় এমন এমন সব ফিচলে বুদ্ধি দিবে যে সমস্যা দূর ও হবে আবার ব্যান্ডও বাজবে। হাই স্কুল থেকে ওকে চিনি। গুড লুক আর ফিচকে বুদ্ধির জন্য মেয়েরা পিছনে পড়েই থাকে। সেও ফুর্তিতে থাকে মেয়েদের নিয়ে।”
“আমি জানতাম পড়ালেখায় ভালো ছেলে মেয়েরা ফিচলে বুদ্ধি সম্পন্ন হয় না। কেমন হাবা গোবা টাইপ, সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে।”
আমার কথা শুনে এডালিন হো হো করে কতক্ষণ হাসলো। তারপর বলল
“তাকিয়ে দেখতো টামিনা! বইয়ে মুখ গুজে রাখা ছেলের মত মনে হচ্ছে কিনা এড কে?”
গভীর চিন্তা নিয়ে এডের দিকে তাকালাম। অতিরিক্ত ফর্সা মুখ মন্ডলের উপর বাদামি রংয়ের চুল গুলো ছড়িয়ে আছে পরম মমতায়। ধুসর চোখ দুটো তে অনবরত চঞ্চলতা খেলা করছে। সুচালো নাক টুকু হিমালয়ের মত খাড়া হয়ে আছে। ঠোট দুটো যেন পান খেয়ে লাল করে ফেলা হয়েছে। বেখেয়ালে এড অনবরত ঠোটে জিব বুলিয়ে যাচ্ছে। রোলাক্স ঘড়ি পরিহিত হাত টা বার বার কপাল থেকে বেয়াড়া চুল গুলো কে সরিয়ে দিচ্ছে। এক কানে ছোট্ট একটা রিং পড়ানো। সকালে শুধু টি গেঞ্জি পরিহিত থাকলেও এখন তার উপর কালো জিন্সের শার্ট পরিহিত।
.
খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক দেখলাম। দেখতে দেখতে একটু খটকা লাগলো। তার ধুসর চোখ দুটো কোথাও যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছি বুঝতে পারছিনা। ভালো করে হা করে তাকাতে গিয়ে এডের চোখে চোখ পড়ে গেল। আমি ভ্যাবাচাকা খেলাম। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিচে বইয়ের দিকে মনোযোগী হওয়ার ভান করলাম। বুকে ধুক ফুক ধুক ফুক একটা শব্দ হচ্ছিল। কেন যে এত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে গেলাম? ইয়া আল্লাহ! এখন আমাকে তার পিছে পিছে ঘোরা লেজুড় মেয়ে গুলোর মতই মনে করবে নাকি?
আড় চোখে দেখছিলাম সে কি আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা? কিন্তু নাহ! ওখানে আর তাকে দেখতে পেলাম না। কোথায় গেল? এত তাড়াতাড়ি কারো কোথাও যাওয়া সম্ভব?
“মিইইইরা!”
কানের পাশে ফিস ফিসে আওয়াজে নিজের নাম শুনে বুকের মধ্যে ছ্যাত করে উঠল। ঝমের মত চমকে উঠলাম। মনে হল যেন তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ কলিজায় টান দিয়েছে।
“লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউর আজিম!”
বুকের মধ্যে একরাশ থু থু ছিটিয়ে দিলাম। তারপর বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে পিছনে তাকালাম। ততক্ষণে এড হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
রাগে চোখে পানি এসে গেল। প্রথম দিনই অচেনা কেউ তার সাথে এভাবে মশকরা করবে ভাবতেও পারি নি। এডালিনও তার সাথে যোগ দিয়ে হাসছে। মনে হচ্ছে র্যাগিংয়ের শিকার হলাম।
অনেক ক্ষন পর হাসি থামিয়ে এড নামের ফিচকে শয়তান টা ধপ করে আমার পাশে বসে পড়লো। তারপর হাসতে হাসতেই বলল
“স্যরি!”
আমি কোনো কথা বললাম না। বইয়ের দিকে নজর দিলাম। অথচ বইয়ের কোনো একটা লাইনও আমি বুঝতেছিলাম না। কিন্তু এড আবারো ডাকলো
“মিইইইরা?”
আমার এত সুন্দর মীরা নাম টাকে কেমন ডালের মত গুলিয়ে ডাকছে। মনে হল মাথা ধরে গালে কয়েকটা ঠাস ঠাস থাপ্পড় দিই। এরপর মনে হল এড আমার নাম জানলো কিভাবে? তার সাথে তো প্রথম দেখা। আমার নাম তো তার জানার কথা না। ইনফ্যাক্ট মীরা নাম টাই কেউ জানে না। সবাই জানে আমার নাম তাহমিনা।
এড আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো এর মধ্যে ক্লাসে মিস লির প্রবেশ।
.
এডালিনের উপর কিছুটা ক্রুদ্ধ আমি। তাই ক্লাস শেষে কারো অপেক্ষা না করে আপন মনে বেড়িয়ে গেলাম। করিডর বেয়ে নিচে নেমে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কিছু খাওয়ার জন্য। সকালে তাড়াহুড়ো তে ভালো করে কিছু খেতে পারি নি। কিন্তু এখন ক্ষুধা টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
গুন গুন করে গান গেয়ে স্কার্ফের মাথায় আঙ্গুল পেচাতে পেচাতে এগিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ একটা শব্দ পেলাম। মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ ডাকছে। থমকে দাড়ালাম। পিছন ফিরে দেখলাম বেশ কিছু দূরে এড কে দেখা যাচ্ছে। কি ব্যাপার!
এড সেখান থেকেই হাত নাড়িয়ে আমাকে ডাকলো
“হেই ফ্লাওয়ার গার্ল। আমার জন্য একটু দাড়াও।”
আমি থমকে দাড়ালাম। এড এসে সামনে দাড়ালো।
“মিইইইরা তুমি কি ক্যান্টিনে যাচ্ছো?”
“তুমি আমার নাম জানলে কি করে? আ-আর ফ্লাওয়ার গার্ল…!”
“আরে মিইইইরা! এত তাড়াতাড়ি তুমি আমাকে ভুলে গেলে?”
সন্দিগ্ন চোখে এডের দিকে তাকালাম। ধুসর চোখ গুলো বার বার এক জনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দোনোমনা হয়ে খানিকটা ইতস্থত স্বরে বললাম
“লিও?”
“আহ-হা! এই তো ফ্লাওয়ার গার্ল! তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো।”
“তু-তুমি? এখানে?”
লিও কে এখানে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেছি। মুখ দিয়ে ভালো করে শব্দ বেড়ুচ্ছে না। মনে হচ্ছে মরা মানুষ কে চোখের সামনে জীবিত দেখছি। ওদিকে লিও কে চিনতে পেরেছি বিধায় সে আমাকে দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে আসলে এক লাফে তিন কদম দূরে সরে এলাম। তারপর বললাম
“ডোন্ট টাচ মি!”
লিও থমথম খেয়ে গেল। টিপ টিপ করা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“কি হলো মিইইইরা?”
তার হয়তো মনেই আসেনি আমি এই কথা টা বলবো। তাদের জন্য জড়িয়ে ধরাটা একটা সৌজন্যতা। কিন্তু আমার জন্য সেটা জান নেওয়ার মত ছিল।
“নাথিং! ”
মুহুর্তে পরিবেশ টা অস্বস্থি কর হয়ে পড়লো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। লিও এখনো বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছি।
অসস্থি পরিবেশ টা কাটিয়ে লিওই প্রথম বলে উঠল
“তুমি কি ক্যান্টিনে যাচ্ছো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
“আমিও যাচ্ছি। চলো এক সাথে!”
আবারো মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম। এক সাথে বসে ওর সাথে খেতে পারবো তো?
“কি ভাবছো!”
“কিছু না”
“তাহলে চলো”.
“হুম”
.
অবশ্য ক্যান্টিনে অস্বস্থি কর অবস্থায় পড়তে হলো না। এরই মধ্যে রিচা আর এডালিনও তাদের ক্লাস শেষ করে হাজির হয়েছে। বেশ কিছুক্ষন পর কার্লও এসে যোগ দিল। ছয় জনের টেবিলে আরো বেশ কয়েক জন যোগ দিল। গল্পে গুজবে টেবিল টা মেতে উঠলো। আমি শুধু চুপচাপ এক কোনে স্যুপের পেয়ালায় চামচ নাড়াচ্ছি।
.
বিকেলে ফিরে এসে মাকে আবারো ফোন করলাম। কিন্তু এবারো বন্ধ পেলাম। একটু কথা না বললে যে মনে মধ্যের উস খুস টা যাবে না। এরই মধ্যে প্রফেসর হুড আমার জিনিস পত্র গোছাতে বললেন। হোস্টেলে আমার কক্ষ টা তৈরি হয়েছে। তাই আজ রাতই আমি সেখানে যাচ্ছি। অতএব আমি আমার জিনিস পত্র সব গুছিয়ে নিলাম। আলো থাকতে জ্যাক আর জিলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছি শুধু তাদের সাথে। এর মধ্যেই তাদের জন্য মায়া পড়ে গেছে। ইশশশ! যদি এখানে থাকতে পারতাম! কিন্তু সেরকম টা সম্ভব না।
মিসেস হুড আমাকে একটা গিফট দিলেন। খুলে দেখলাম একটা উলের মাফলার। সামনেই শীত চলে আসবে তখন এটা বেশ কাজে দিবে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
রাতে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে দেখলাম জ্যাক আর জিল দাড়িয়ে আছে। হাতে ছোট্ট আকৃতির একটা টব।
“কি হলো জ্যাক? এটা কি?
“মিনা এটা তোমার জন্য। জিল দিয়েছে!”
“কি এটা?”
“ক্যাকটাস। রোজ সকালে এতে পানি দিবে।” দেখবে এটাতে ফুল ফুটবে!”
মনটা ভরে গেলো। স্বাচ্ছন্দ্যে টব টি হাত বাড়িয়ে নিলাম।
“থ্যাংক ইয়ু জিল এত সুন্দর গিফট দেয়ার জন্য।”
“আমার গিফট টা নেবে না মিনা?”
“কই দাও!”
“এদিকে আস!”
ইশারা করে জ্যাক তার দিকে ডাকলো। কানে কানে কিছু বলতে চাইছে মনে হয়। আমি নিচু হলাম ওর কথা শোনার জন্য।
জ্যাক আমার মুখের কাছাকাছি এসে চট করে একটা চুমু দিয়ে দিল। আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকাতেই সে একটা মিষ্টি হাসি দিল। এত গুলো ভালোবাসার বিনিময়ে কাউকে কিছুই দিতে পারলাম না। শুধু বুকের মধ্যে খানিকক্ষন চেপে রাখলাম। বুঝলাম না যাওয়ার বেলায় আমার মনটা ভালো হয়ে গেল কেন?
.
(চলবে)

.
দুঃখিত দেরীতে দেওয়ার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here