আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৫০

0
1752

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫০
———————————————–
তুষারপাত কমে আসায় ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ আর অফিস সব খুলছে। আমি আমার রিসার্চ ফার্মে যোগ দিয়েছি। বহু কাজ জমে আছে। যদিও বা আমি এখনো ওখানে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিনা। টুকিটাকি কাজই আমাকে দেয়া হয়। তারপরও ইন্টার্ণি হিসেবে সে দায়িত্ব টা বিশাল। কয়েক দিন বাদে পরিক্ষা ও। অনেক প্রেশারে আছি। আজ বিকেলে লিওর সাথে দেখা করতে বললো।
.
ফার্মে কাজ শেষ করে বাইরে লিওর জন্য দাড়িয়ে আছি। ওর এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। গত বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ওর দেখা নেই। আমার হাতের মুটোয় অল্প কিছু কাজু বাদাম। ল্যাবে পরিক্ষার জন্য আনা হয়েছিল। ওখান থেকে কয়েকটা নিয়ে এসেছি। আর এখন হাটতে হাটতে ওই কাজু বাদাম গুলো খাচ্ছি। রিসার্চ ফার্মের বিশাল ইয়ার্ড পেরিয়ে স্টার্ডব্রুক এভে। এ এভের রোড সরাসরি প্যাসিফিক এভে পর্যন্ত গিয়েছে। রোড সাইডে পাতা বিহীন ম্যাপল আর দেবদারু গাছের দেখা মিলছিল। আশে পাশে একটু একটু পর পর কয়েকটা ঘন ঝোপ। রেড রিভারের পাশের এই স্টার্ডব্রুক এভে রোড টাই আশে পাশে ঘন ঝোপ ঝাড় বেশি। শীতকাল হওয়ায় পত্র পল্লব গুলো প্রায় ঝড়ে গিয়েছে। খালি কাটা কাটা ঝোপ গুলায় দাড়িয়ে আছে। শুধু ফণিমনসা গুলো সবুজ রং নিয়ে দাড়িয়ে আছে। যেতে যেতে আমি থমকে দাড়ালাম। কাটা কাটা সে ঝোপ গুলো তুষারে সাদা হয়ে আছে। সেই সাদা সাদা কাটা ঝোপের মাঝখান থেকে একটা তুষার সাদা ছোট্ট খরগোশ বেড়িয়ে এসেছে। এসেই ইতি উতি করে কিছু খুজছে। বোধহয় খাবার খুজছে। শীতকাল হওয়ায় প্রাণী দের খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। যারা পেরেছে দেশ ছেড়েছে। বাকিরা ধুকে ধুকে মরছে। আমি একটু এগিয়ে গেলাম। আমাকে কাছে যেতে দেখেও খরগোশ টা নড়লোনা। হাটাচলা ও বেশ দুর্বল। ওটাকে আমি কোলে তুলে নিলাম। কোলে তুলতেই সেটা গুটিসুটি মেরে বসে গেল। আমি সেটাকে আমার মাফলারের সাথে পেঁচিয়ে নিলাম। হয়ত তার ঠাণ্ডা লাগছে। তারপর হাতের কাজু বাদাম গুলো দিলাম। ওগুলো সে কুট কুট করে খেতে লাগল। দেখতে বেশ লাগছে।
পি পি পিপ…
হঠাৎ গাড়ির সাইরেনের শব্দ। আমি চমকে উঠলাম। আর খরগোশ টা মাফলারের ভিতর ঢুকে গেল। দেখলাম লিওর কার। আমাকে থামতে দেখে ও কারের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসতে লাগলো। কাছে আসতেই বললাম
“এত জোরে কেউ হর্ণ বাজায়? আমরা অনেক ভয় পেয়েছি!”
“স্যরি মিইইরা। তোমাকে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি শুনো নি।”
আমি আবার ভীত খরগোশ টার দিকে তাকালাম। ও ভীষন ভয় পেয়েছে। লিও আবার বলল
“এক সেকেন্ড… আমরা মানে? তোমার সাথে আর কে আছে।”
মাফলারের সাথে খরগোশ টাকে পেচিয়ে নিলাম। একটু স্মিত হেসে বললাম
“দেখবে?”
“দেখার জন্যই তো বললাম। আর… তোমার হাতে ওটা কি?”
“মি. র্যাবিট! সুন্দর না দেখতে? কেমন ধবে ধবে সাদা আর তুলতুলে।”
“ওহ্! ওটাকে নিলে কেন? রেখে দাও!”
“নাহ্! এটাকে আমি পুষবো!”
খরগোশ টার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর খরগোশ টা কাজু বাদাম খেতে খেতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
ভ্রু কুচকে লিও বললো
“রিয়্যালি?”
“হুম!”
লিও এখনো হা করে তাকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম
“কি হলো!”
“যতটা আদর এখন এ পুচকে খরগোশ টা পাচ্ছে এ কয়েক বছরে তুমি ততটা আমাকেও করো নি!”
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালাম। বললাম
“তুমি কি এটাই বলতে এসেছিলে?”
“ওহ্ নাহ্! ভুলেই গিয়েছিলাম। গাড়ি তে উঠ!”
আমি গাড়িতে উঠলাম। উঠেই বললাম
“কোথাও কি যাচ্ছি?”
“নাহ্!”
কার থামল স্টারবাকের সামনে। দুটো কফির অর্ডার দিয়েই জানালা বরাবর আমরা বসলাম। আমি বসেই বললাম
“ওর জন্য কিছু অর্ডার দিলে না?”
“কার জন্য?”
খরগোশ কে দেখিয়ে বললাম
“মি র্যাবিটের জন্য।”
“ওর জন্য অর্ডার করতে হবে?”
“হবে। দেখছোনা ওর কত খিদে পেয়েছে?”
খরগোশ টা যেন দুর্বল ভাবে মাথা নেড়ে সায় জানালো। লিও হার মেনে বির বির করে কিছু বললো। বুঝতে পারলাম না। তারপর কিছু টুকরো করা গাজরের অর্ডার দিল।
আমি ওটা কে টেবিলে বসিয়ে গাজর খেতে দিলাম। লিও কফি পান করতে করতে তীর্যক দৃষ্টিতে ওটাকে দেখছিল।
“এবার বলো।”
“কি!”
“তুমি না বললে তোমার কথা আছে!”
“ওহ্ হ্যা! আমি নিউইয়র্ক যাচ্ছি!”
আমি চমকে গেলাম। বললাম
“কাল?”
“নাহ্!”
“কিন্তু পরিক্ষা তো কয়েকদিনের ভিতর শুরু হয়ে যাচ্ছে!”
“এখন না। পরিক্ষা শেষে!”
“ওহ্!”
“মন খারাপ করো না। মাত্র দু সপ্তাহের জন্য যাচ্ছি! বাবা অসুস্থ একটু। তাই যেতে হচ্ছে। একটা কনফারেন্স আর সাথে কয়েক টা মিটিং আছে। এটেন্ড করেই চলে আসব।”
“ইটস ওকে!”
আমরা দু জনেই মৌন হয়ে রইলাম। শুধু খরগোশ টার কুট কুট গাজর খাওয়ার শব্দ আসছে। হয়ত ক্ষনিকের জন্য বিচ্ছেদের ডঙ্কা সুর হৃদয়ে বেজে উঠেছে।
সেদিন আর আমাদের মাঝে কোনো কথা হলো না। অদৃশ্য এক সুতার টান অনুভব করছি হৃদ গহীনে। সেটা বারে বারে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসছে।
.
আবছায়া সন্ধ্যায় বই হাতে নিয়ে বসে আছি। কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারছিনা। ইরিনা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো আমার কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? উত্তরে জানালাম পরিক্ষার প্রেশার।
.
রাতে স্নো ফলস ঘটতে লাগলো। আমি হা করে বাইরের দেখতে লাগলাম। বুকে কেমন যেন ব্যথা হচ্ছে। আম্মা কে ভীষন মিস করছি। খুব করে মন চাইছে আম্মার কোলে মাথা রেখে শুই। না জানি আম্মা কেমন আছে?
ভাবছি আর খরগোশ টাকে একটা একটা কাজু বাদাম দিচ্ছি। খরগোশ টা কাজু বাদাম বেশ পছন্দ করে। হতাশা ঢাকতে ওটাকে বললাম
“কাজু বাদাম কি তোমার ভীষন প্রিয়?”
উত্তরে যেন খরগোশ টা বলল
“হ্যা ভীষন প্রিয়। সেবার গ্রোসারি শপে আনা একটা খালি থলে লম্বাটে মোচওয়ালা বাইরে ফেলে দিয়েছিল। আমি সেটার ভিতরে কয়েকটা কাজু বাদাম পেয়েছিলাম। কি দারুন স্বাদ!”
“আচ্ছা তোমার পরিবারে কে কে আছে? তুমি কি একা?”
“আমার পরিবারে বাবা মা আর আমার বোন আছে!”
“ওরা কোথায় তাহলে?”
“হারিয়ে ফেলেছি! রেড রিভারের পাশে যে ঘন জঙ্গল টা আছে না? ওখানে আমার বাড়ি। ঠাণ্ডার কারনে অন্যত্র যাচ্ছিলাম। তুষারে আমি ওদের হারিয়ে ফেলেছি!”
“ওহ্!”
“আচ্ছা তোমার পরিবারে কে কে আছে!”
“আমার আম্মা আছে, আব্বা আছে আর একটা ছোট্ট মামা আছে!”
“তারা কোথায়?”
“তারা অনেক দূরে আছে।”
“দূরে কোথায়?”
“বাংলাদেশে!”
“বাংলাদেশ? সেটা আবার কোথায়? রেড রিভারের ওপাশে? আমি কখনো ওখানে যাই নি!”
“আরে পাগল! বাংলাদেশ এখানে না। অনেক অনেক দূরে! প্লেনে করে যেতে হয়।”
“তাহলে সেটা তো অনেক দূরে!”
“হুম… আচ্ছা তুমি কি আমার সাথে বাংলাদেশ যাবে?”
খরগোশ টা উত্তর দেয়ার আগেই ফোন বেজে উঠলো। লিওর ফোন। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে লিওর ফিস ফিস করা কন্ঠ ভেসে আসলো।
“মাই লিটল প্রিন্সেস… কি করছো?”
“মি. র্যাবিটের সাথে কথা বলছি!”
“মন কি বেশি খারাপ!”
“হুম! তোমাকে অনেক মিস করছি!”
“তোমার জানালার কাঁচ টা উপরে তুলো!”
“মা-মানে?”
“যেটা বলছি করোই না!”
আমি হুড়মুড় করে বেড থেকে নেমে গেলাম। জানালার কাচ তুলতেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস ধাক্কা দিলো। অল্প অল্প তুষার পড়ছে। আবছা অন্ধকারে দূরের কিছুই স্পষ্ট না।
“তুমি কোথায়?”
“এই তো!”
হোস্টেল ইয়ার্ডের কোনে গেইট। গেইটের পাশে ল্যাম্পপোস্ট। সেই ল্যাম্পপোস্টেরর আলোতে লিও কে দেখা গেল। সে কারের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তার মাথায় খানিকটা তুষারও জমেছে। আমাকে দেখতেই হাত উপরে তুলে হাই জানালো। ওকে দেখতেই মনে একটা শান্ত হাওয়া বয়ে গেল। আমি জানালার সাথে হেলান দিলাম।
“কেন এসেছো?”
“তুমি মিস করতে পারো আর আমি করলে দোষ?”
“সেটা তো বলি নি!”
“সেটায় বলতে!”
একটু হেসে বললাম
“তোমার কেন মন খারাপ বল!”
“তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমিও চলো না আমার সাথে।”
“অবশ্যই যেতাম। যদি অফিসিয়াল না হতো। এটা তোমার পারিবারিক দায়িত্ব। এখানে আমি না ঢুকলেই ভালো।”
“এটা কেমন কথা। আগে হোক পরে। তুমি তো আমার পরিবার হতেই যাচ্ছো তাই নাকি!”
“বাদ দাও!”
“ঠিক আছে। তোমাকে তাহলে একটা জোকস শোনায়?”
“হুম!”
.
রাত কেটে গেল এভাবে কথা বলতে বলতে। সে রাতে ভীষন মন খারাপ থাকলেও লিওর জোকস শুনতে শুনতে মন ভালো হয়ে গেল। হাসতে হাসতে চোখে প্রায় পানি এসে গেল। কিন্তু হাসি থামলো না। অনেক কষ্টে হাসি লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। পাছে হাসির ধমকে কারো ঘুম ভেঙে যায় সে ভয়ে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here