Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫৬
———————————————–
মামার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। হকচকিয়ে বলে উঠলাম
“মামা!”
মামা শান্ত স্বরে বলল
“কি মামা? কিছু বলবা?”
“আ-আমি আমি…”
পুরো শরীর আমার থর থর করে কাঁপছে। তখনো বিয়েতে রাজি ছিলাম না। এখনো এ বিয়েতে রাজি না। কিন্তু এত গুলো উৎসুক চোখের সামনে বলার সাহস টা হারিয়ে ফেলেছি।
হৃদপিন্ড টা বিকট শব্দে কাঁপছে। টলমল করছে পা দুটো। মামা বললেন
“বল তুমি কি? এখন তো পড়া শেষ হইছে। আর তো সমস্যা নাই?”
আমি দম খিচে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমি সাহস হারিয়ে ফেললাম। কোথায় হারিয়ে ফেললাম? কোথায় হারিয়ে ফেললাম? কেন আমার টা সাহস ফিরে আসছে না। আ-আমার বলা দরকার। আর বলার জন্য সাহস দরকার।
এবার আব্বা বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন
“তাহমিনা!”
আমি হকচকিয়ে আব্বার দিকে তাকালাম।
“জি আব্বা!”
“আমি এ বিয়েতে আর কোনো সমস্যা চাই না। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তুমি রুম থেকে বেরুবে না। যদি বিয়েতে কোনো সমস্যা হয় তাহলে মনে রাইখো এরপর যা হবে তার জন্য তুমি দায়ি থাকবে। মনে থাকবে তো কথা?”
“জি-জি আব্বা!”
.
সালিশ সেদিনের মত শেষ হল। আমি রুমে এসে দরজা বন্ধ করে নিচে বসে গেলাম। ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিলেন। শব্দ করে মন খুলেও কাঁদতে পারছিনা। আমি এখন কি করবো? কি করা দরকার আমার? আমার হাত পা এত অসার হয়ে আসছে কেন?
সন্ধা বেলায় আম্মা আসলেন। হাতে ট্রে। পরোটা, সবজি, পায়েস, চা, ভাজি সব তাতে আছে।
আমি তখন নিচে বসে বিছানায় মাথা রেখেছিলাম। খোলা চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছিল। কিন্তু আমার বাঁধতে ইচ্ছা করছিল না। আম্মা এসে মাথায় হাত দিতেই হালকা চমকে উঠলাম। বললাম
“আম্মা তুমি!”
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আম্মা বলল
“উঠ চা খাবি। পরোটা তেল কম দিয়ে ভেজেছি।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসলাম। পরোটা ছিড়ে সবজি তে ডুবিয়ে খেতে লাগলাম। আম্মা উঠে চুল গুলো মুটোয় এনে উচু করে খোঁপা বেধে দিলেন। তারপর আবার সামনে এসে বসলেন। বসেই বললেন
“কিরে সবজি ভালো হয় নি?”
“হয়ছে মা।”
“তাহলে এমন করে খাচ্ছিস কেন?”
আমি আম্মার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। আমার আম্মা সেই আগের মতই আছে। পড়নে তাঁতের শাড়ি, হাতে বালা, কানে স্বর্ণের রিং, মাথার মাঝখানে সিঁথি কেটে করা খোঁপা। একদম টিপিকাল মা। একটুও পাল্টায় নি। শুধু এই দীর্ঘ সময়ে একটু শুকিয়ে গেছে। আমি হেসে বললাম
“তোমারে খুব কষ্ট দিসি। তাই না মা?”
“কি আবোল তাবোল বলিস! আমারে কষ্ট দিবি ক্যান?”
“এই যে তুমি শুকায় গেছো। কষ্ট না দিলে তো শুকায় তে না।”
আম্মা হাসলো। হেসে বলল
“আমি দিন দিন জোয়ান হচ্ছি নাকি বুড়ি হচ্ছি রে? শুকাবো না তো কি? তুই খা। খাওয়ার সময় এসব চিন্তা করিস না।”
আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষে আম্মা চলে যেতে চাইলে আমি হাত ধরে ফেললাম। আম্মা ভ্রু কুচকে বলল
“কি হলো?”
“তুমি একটু বসো। আমি ঘুমাবো।”
আম্মা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ট্রে টা টেবিলে রেখে বিছানায় বসল। আম্মা বসতেই আমি তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আম্মা একটু হকচকিয়ে গেলেন। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন
“কি হয়েছে তাহমিনা?”
“কিছু না। তুমি মাথায় হাত বুলাও। আমি ঘুমাবো।”
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আম্মু কি বুঝলো জানি না। তবে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমাকে ডাকলেন
“তাহমিনা?”
“হুম?”
“তোর বড় মামার কথায় কিছু মনে করিস না। উনি এরকমই। সব কথা মুখের উপর বলে ফেলে। এজন্য হয়ত লোক পছন্দ কম করে। কিন্তু বিশ্বাস কর ভাইজানের মন টা অনেক ভালো। সবার জন্য চিন্তা করে।”
“হুম।”
“এই যে তুই কানাডা যাবার পর তোর বাবা যে এমন রেগে গেল যে তোর বড় মামা ছাড়া আর কেউ সামলাইতে পারে নাই। এমন কি তোর তৈয়ব চাচু ও না।”
“হুম!”
“কি হু হু করছিস? তাহমিনা! ঘুমিয়ে পড়লি?”
“না!”
“আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ছিস।”
“আচ্ছা মা একটা কথা বলো।”
“বল।”
“আমি আসছি পর্যন্ত আমার ফোন খুজে পাচ্ছি না। বিকালে ব্যাগ গোছাতে গিয়ে দেখলাম ব্যাগ এলোমেলো। আমার ভিসা টাও নেই। কিছু টাকা ছিল। সেগুলো ও গায়েব। তুমি কি কিছু জানো মা?”
আম্মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। নিঃশ্বাস টা সরাসরি আমার মুখে পড়লো। আমি অনুভব করলাম একরাশ হতাশা মিশে আছে এ নিঃশ্বাসে। তিনি বললেন
“আমি তো জানি না তাহমিনা। দেখবো কোথায় আছে।”
“আচ্ছা।”
.
দুদিন পর ছেলে পক্ষ হতে তার বাবা মা আসলেন। উদ্দেশ্য আমাকে দেখা। শুধু দেখায় নয়। বিয়ের দিন তারিখও পাকা করার কথা। ওরা যে আমাকে আগে দেখে নি তা নয়। তবে এবার নতুন করে কি দেখার আছে সেটা আমার মাথায় আসলো না। সোনালী পাড়ের সবুজ শাড়ি পড়িয়ে চাচী আমাকে বড় ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত আছেন বাবা, বড় মামা, মা, তৈয়ব চাচু।
চাচী ওখানে নিয়ে গিয়ে সবাইকে সালাম দিতে বললেন। আমি দিলাম। চাচী আমাকে সোফাতে ছেলের মার পাশে বসিয়ে দিলেন। ছেলের মা একবারর তাকিয়ে আর তাকালেন না। কথা শুরু করলেন ছেলের পিতা। বললেন
“তৌহিদ সাহেব মেয়েকে আমরা আর নতুন করে কি দেখব? আমার ছেলের পছন্দ বলে কথা। তাতেই আমরা রাজি।”
বড় মামা উচ্ছাসিত গলায় বলল
“এই জন্যই আপনাকে এত পছন্দ বেয়াই সাহেব। আমাদের মেয়ে হাজারে একটা। যাকে পছন্দ না করে উপায় নেই।”
বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন।
তৈয়ব চাচু বলে উঠলেন
“বেয়াইন সাহেবা আপনি তো কিছু নিচ্ছেন না। সন্দেশ টা নিন। খুব মিষ্টি সন্দেশ।”
মহিলা হেসে বললেন
“নিবো না কেন? অবশ্যই নিব। ছেলের বিয়ের মিষ্টি বলে কথা।”
আমাকে দেখার কথা। কিন্তু ছেলের মা বা ছেলের বাবা, কেউই ফিরেই তাকালেন না। আড্ডা তে মশগুল হলেন সবাই। কানাডা থেকে ফিরে আমি বাবার মুখে হাসি দেখি নি। কিন্তু এখন দেখলাম। বাবা বেশ ভালো হাসতে পারে।
সবশেষে উঠলো বিয়ের দিন তারিখের কথা। আমি মনে মনে চমকে উঠলাম। মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটি ঠোকরাতে লাগলাম। বড় মামা বললেন
“আগামী শুক্রবার বিয়ের জন্য শুভ দিন। কি বলেন বেয়াই?”
“আপনি মুরুব্বী মানুষ। আপনার মুখের উপর কিছু বলতে পারি? তাইলে শুক্রবারই পাকা করি? তা আমাদের জমিদার সাহেব কি বলেন?”
আগামী শুক্রবার আসতে আরো চারদিন বাকি। আমি ঢোক গিললাম। ভয়ে ভয়ে মাথা তুললাম। আব্বা গলায় খাকড়ি দিয়ে বলল
“শুক্রবার বেশি দেরী হয়ে যাবে। বিয়ে পরশু হোক।”
আব্বার কথা শুনে রীতি মত আমার ঘাম ঝড়তে শুরু করেছে। বড় মামা বললেন
“কি বলো তৌহিদ? এত তাড়াতাড়ি উনারা আয়োজন করবেন কি করে?”
“আয়োজন চাইলে একদিনে করা যায়। আমি তো আজই বিয়ের কথা বলছিনা। মাঝখানে একটা দিন আছে।”
.
বচসা চলল আরো আধা ঘন্টা। তবে শেষ মুহুর্তে ও আব্বা জিতলেন। আমার বিয়ে পরশু। আগামীকাল গায়ে হলুদ। কথা হলো কোন জাঁকজমক ছাড়াই আড়ম্বর বিয়ে অনুষ্টান হবে।
আমি আর থাকতে চাইলাম না। চাচী কে বললাম
“আমার মাথা ব্যাথা করছে। আমাকে এখান থেকে বের কর চাচী।”
চাচী সবাইকে বুঝিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন। পারত পক্ষে আমার ওখানে থেকে কোনো কাজ ছিলো না। না আমি কিছু বলতে পারবো, না কিছু শুনতে পারবো।
চলে এলাম আবার রুমে। এবার আর কান্না এলো না। রুমে এসে আলমারীর আয়নায় তাকালাম। তবে আয়নার ওপাশে দাড়িয়ে থাকা শাড়ি পড়া মেয়েটাকে কোনোভাবেই আমি বলে মনে হল না। মনে হল অন্য কেউ। যে না পারে সইতে, না পারে কইতে।
.
সন্ধায় একপাল আত্মীয় স্বজন এসে জুটলো। কাউকে দাওয়াত করা হয় নি। সবাই ঘরের মানুষ। তবুও এত মানুষ জমা হল যে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য নিজের রুমের কোণা ও পাওয়া গেল না। আমার কিছু করার ছিল না। রুম থেকে বের হওয়া আমার জন্য মানা ছিল। যখনি বের হতাম চাচী না হয় শরীফা খালা সাথে সাথে থাকত। আম্মা হয়ত কিছু বলতেন। কিন্তু বড় মামার কারণে কিছু বলতে পারলেন না। আমি শুয়ে শুয়ে শুধু আমার প্রথম মৃত্যুর জন্য আয়োজন দেখতে লাগলাম।
.
অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেল। কাজী বাড়ির ছেলে জাওয়াদের সাথেই। যখন আমাকে কবুল বলতে বলা হচ্ছিলো তখন বার বার উঠানের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এই বুঝি লিও আসবে। অন্তত শেষ বারের মত তাকে একটি বার চোখে দেখতে পাবো। কিন্তু নাহ্! সেটা আর হলো না। বিয়েটা হয়ে গেলো। লিওর দেখা আর পেলাম না। বিদায়ের সময় আমার একটুও কান্না পেল না। মা কাঁদতে লাগলেন হু হু করে। প্রতিবেশিরা কানাকানি করছিল আমার কান্না নিয়ে। কেন আমি কাঁদছিনা। কিন্তু আমি কাঁদবো কিভাবে? কার জন্য কাঁদবো? কেউ কি আমার আছে?
.
(চলবে)
.
পর্বটা ছোট। এর জন্য দুঃখিত। কাল শেষ পর্ব আপলোড করি। কি বলেন সবাই?