Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৬২ ও শেষ পর্ব
—————————————
রাত পৌনে তিনটা। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করছি। কিন্তু ঘুম কিছুতেই চোখে ধরা দিচ্ছে না। চোখে ভাসছে সেই অলস দুপুরের ভাঙাচোরা উঠান টা। কাৎ হয়ে থাকা কিছু চেয়ার, উল্টানো টেবিল, ভাঙা গেইট, লটকে থাকা প্যান্ডেলের কাপড়, খাদ্যের উচ্ছিষ্ট আর সুনসান নিরবতা। দ্বিতীয় বার আমার একই বিয়ে ভাঙল। এরপরের দৃশ্য আমার চোখেই দেখা। এখনো স্বাভাবিক হতে পারছি না। বিয়ে ভেঙেছে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে ঘুম হাওয়া হয়ে গেল। কোথাও যেন ঠিক খাপে খাপ মিলছে না। কিছু একটা শূণ্য থেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার ভিতর ছুরি দিয়ে বার বার কেউ খোঁচা দিচ্ছে। উফফ্… অসহ্যকর! বিছানা থেকে উঠে বসলাম। বিশাল দেয়াল ঘড়িটা অনবরত চলছে। আম্মা পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে।
গায়ে ওড়না টা জড়িয়ে আমি রুমের বাইরে চলে এলাম। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। বড় মামা চলে গেলেও মামী যায় নি। তিনি আবার মশারী ছাড়া ঘুমাতে পারেন না। তাই মেহমান ঘরে ঘুমাচ্ছেন। তৈয়ব চাচুর ছোট ছেলে কেও সাথে এনে রেখেছেন।
বুকে হাত দুটো মুড়িয়ে আমি পুরো ঘরে হাটছি। এলোমেলো ভাবনার সুতা গুলো কে সোজা করার চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে হাটতে ঐ রুমের সামনে এসে দাড়ালাম যে ঘরে আব্বা আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। নিজের অজান্তে পা বাড়ালাম সেদিকে। এক অদ্ভুদ অনুভূতি রা চারপাশে ঘিরে আছে। দরজার কাছাকাছি এসেই ঢোক গিললাম। টোকা দিতে গিয়েও হাত থেমে গেল। হাত দরজায় রেখেই মাথা নিচু করে ফেললাম। নাহ্! আমার দ্বারা হবে না। ভাবতেই দরজা ভিতরে ঢুকে গেল। আমি চমকে উপরে তাকালাম। দরজা খোলা? আব্বা কি বাইরে বেড়িয়ে ছিল? তাহলে কি ভিতরে ঢুকে খিল আটতে ভুলে গিয়েছেন?
একটু ইতস্তত করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। অলস ভাবে বাল্ব টা জ্বলছে। মাথার উপর ফ্যান টা আস্তে আস্তে ঘুরছে। যেটার বাতাস মোটেও গায়ে লাগছে না। বিছানা অগোছালো। টেবিলে রাখা খাবার গুলো ঢাকনা দেয়া। তার মানে খাবার গুলো খাওয়া হয়নি।
চারপাশে তাকাতে তাকাতে আরাম কেদারায় নজর পড়লো। আব্বা আরাম কেদারায় মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। গায়ে তার চিরাচরিত পাঞ্জাবি পড়া। হাত দুটো বুকের কাছে মুড়ানো। চোখ দুটো দেবে গেছে। মনে হচ্ছে কয়েক মাস তিনি ঘুমাননি। হঠাৎ মনে হল তিনি ভীষণ শুকিয়ে গেছেন।
চোরা একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল। ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।
“তাহমিনা নাকি রে?”
আমি চমকে উঠলাম। বুক ধর ফর করতে লাগল। আব্বার দিকে ফিরে বললাম
“জি আব্বা! আমি!”
আব্বা এখনো চোখ মুদে আছেন। আশ্চর্য্য! তিনি কিভাবে বুঝলেন এটা আমি?
“এখানে এসে বস!”
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে উনার পায়ের কাছে বসে গেলাম। আব্বা চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল
“ওখানে বসলি কেন? মোড়া টেনে নে। বিছানার নিচে বড় মোড়া টা আছে। ওটা নে।”
“লাগবে না আব্বা।”
তারপর আবারো সবকিছু চুপ। অস্বস্তিকর নিরবতা। আব্বাই প্রথম কথা বলে উঠলেন
“এটাই সেই ছেলে তাই না?”
একটু চমকে উঠলেও নিরবে জবাব দিলাম।
“হুম!”
“কতদিন ধরে চিনিস?”
ভিতরে ভিতরে আরেকবার চমকে উঠলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। মাথা নিচু করে জবাব দিলাম
“কানাডা যাওয়ার প্রথম দিন থেকে।”
“ছেলে টাকে খুব বেশি ভালোবাসিস?”
ঠোট কামড়ে ধরে জবাব দিলাম
“হা আ-আব্বা!”
“আমাদের চেয়ে বেশি?”
আমি থমকে গেলাম। এ কেমন প্রশ্ন? এর উত্তর কি দেওয়া কখনো সম্ভব? আস্তে করে আব্বাকে ডাকলাম
“আব্বা…!”
“বল!”
“অনেক কঠিন প্রশ্ন আব্বা!”
“তার মানে তুই…!”
“না আব্বা!”
আব্বার কথা কে কেটে দিলাম। তারপর বললাম
“আমি তোমাদের ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি!”
“তাহলে আমাকে এত ঘৃণা কেন করিস?”
“আ-আব্বা!”
“এত সাধের অনুষ্ঠান করলাম কিন্তু ঐ ছেলেটা এসে ভেঙে চুরে দিয়ে বলতে লাগল এ বিয়ে হতে পারে না! তুই ভেবেছিস আমি ওর কথা বুঝতে পারবোনা! অতটুকু নির্বোধ তো নই আমি! তোর গাধা মামা ওকে লেলিয়ে দিলেই আমি ওকে ছেড়ে দিব বুঝি! তোর মামা তো আসলে এক নম্বরের বেকুব। সে ভেবেছে ছেলেটাকে বিয়ের কথা জানিয়ে দিলেই সে ভেঙে দিতে পারবে? অসম্ভব!”
আমি হা করে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিয়ে কিভাবে ভেঙেছে সেটা আমি জানতাম না। কিন্তু সেটা আব্বার কাছ থেকে এখনি শুনছিলাম। আব্বা চোখ খুললেন। বললেন
“বিয়ে আমি ভেঙে দিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগে দেখতে চেয়েছিলাম ছেলেটাকে। কোন ভরসায় এই ভিনদেশির হাতে তোকে তুলে দিব? আজ বাদে কাল যদি তোকে ফেলে চলে যেত তখন আমি কিইবা করতে পারতাম?”
“আ-আব্বা!”
“তাই পরিক্ষা করেছি। এই যে এতসব নাটক দেখেছিস সেগুলো করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। সত্যিই তোকে আমি জাওয়াদের সাথে বিয়ে দিতাম। যদি সেদিন এসে না বলতি অন্য কাউকে পছন্দ করিস। আর ছেলেটা কে হতে পারে সেটা বুঝতে আমার একদম কষ্ট হয় নি। পরিক্ষা তে দুজনেই পাশ করেছিস। কিন্তু আমি সইতে পারি নি। তোর এত ঘৃণা সওয়ার মত সহ্য ক্ষমতা আমার এখনো হয়নিরে।”
আমি থমকে গিয়েছিলাম। থমকে গিয়েছিলাম কথা শুনে। মনে মনে অপরাধবোধ টা টর্নেডোর মত প্রবল হয়ে যাচ্ছিল। কিল বিল করছিল পুরো শরীর জুড়ে। রুখতে পারলাম না নিজেকে। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমি। দুহাতে আব্বার পা কে জড়িয়ে ধরিয়ে হাউমাউ করে বলতে লাগলাম
“আব্বা আমাকে মাফ করে দাও। আমি বুঝতে পারি নি। আমি এ কি করলাম আব্বা? তুমি আমাকে মাফ করে দাও! তোমার এত খারাপ আর নীচ মেয়েটাকে তুমি মাফ করে দাও। সে আর তোমাকে কখনো ঘৃণা করবেনা আব্বা। কখনোই না। তোমার অবাধ্য হবেনা, তোমার অসম্মান করবেনা।”
আব্বার পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে আমি কাঁদছিলাম আর আব্বা নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন।
রাত কেটে গেল আব্বার কোলে মাথা রেখে। শেষ রাতে চোখে নেমে এল ঘুম।
ঘুম ভাঙল চেঁচামেচি তে। চোখ খুলতেই আবিষ্কার করলাম আমি বিছানায়। বিছানা থেকে উঠে বসতেই হৈ হৈ করে ছোট মামা ছুটে আসলেন। চিল্লিয়ে বলতে লাগল
“তোর এখনো ঘুম ভাঙেনি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জমিদারি দেখাচ্ছিস নাকি? উঠে যাচ্ছিস না কেন?”
“যা-যাচ্ছি মামা!”
মামা যেভাবে হৈ হৈ করতে করতে এলেন ঠিক সেভাবে হৈ হৈ করতে বেড়িয়ে গেলেন। আমি ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলাম। অন্যরকম একটা দিন। সূর্য প্রায় মাথার উপর। এক অন্যরকম আলো নিয়ে। যে আলোতে অসহ্যকর গরম নেই। উঠোন টাকে অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে। শরীফা খালা লাল একটা টুকটুকে শাড়ি আর মুখ ভর্তি পান নিয়ে হেটে বেড়াচ্ছেন। আমি হা করে দেখছিলাম। মনে হচ্ছে এক রাতে এত সব পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে!
দেখতে দেখতে পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলাম। কিন্তু খাবার টেবিলে এসে বড় সর একটা ধাক্কা খেলাম। আব্বা, বড় মামা আর লিও একসাথে সোফায় বসে গল্প করছে। আর ছোট মামা তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসাহাসি করছে।
কিছু বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে সবার? বোঝার চেষ্টা করছিলাম তখন আম্মা এসে টেনে নিয়ে গেলেন নাস্তা করতে।
আম্মা ও বেশ হাসি খুশি। ভাবলাম হয়ত আব্বা রুম থেকে বেড়িয়েছে তাই বুঝি সবাই এত খুশি। এ ভেবে কাউকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
লিও কে অনেকক্ষণ ধরে ডাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছিনা। বড় মামা আর ছোট মামা তাকে ঘিরে কিছু বুঝাচ্ছে। সেও মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে থাকতে পারে বলে সে ভাবে মনে হলো না। আব্বা দপ্তরের কাজে বেড়িয়ে গেছে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
বিকেলে বাড়িতে বড় মসজিদের মৌলবী সাহেব আসলেন। তিনি আমার আরবীর ওস্তাদ। তার কাছ থেকে আমি আরবী শিখেছিলাম। তাই তাকে দেখে মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলাম। আম্মা কে জিজ্ঞেস করলাম
“বড় হুজুর কেন এসেছে?”
আম্মা কাপড় গুছাতে গুছাতে জবাব দিল
“হুজুরের কাজ হুজুর করতে এসেছে!”
জবাব টা মনপুত হলো না। আব্বাও চলে এসেছেন। সবাই একসাথে ঐ রুমে বসে করছেটা কি?
বেশ কিছুক্ষন বাদে ছোট মামা লাফাতে লাফাতে মিষ্টি নিয়ে থপ করে একটা মুখে ঢুকিয়ে দিল আর বলতে লাগল
“নে নে বাদরী! মিষ্টি খা! তোর বাদর মুসলমান হয়েছে!”
শুনে মিষ্টি গলায় আটকে গেল। আমি খুক খুক কাশতে লাগলাম। মামা পানি এগিয়ে দিয়েই ধমক দিলেন
“খাওয়ার আগেই গলায় খাবার আটকায় কেমনে? এত মোটা সোটা গলা তারপরও ঢুকে না কেন?”
আমি পানি গিলে বললাম
“কি বললে মামা?”
“কি বললাম?”
“তুমি লিওর কথা বলছিলে! ও মুসলমা…”
“কেন রে? তুই জানিস না? বিয়ে করতে হলে তো তাকে আগে মুসলমান হতে হবে। তাই নাকি?”
“মা-মানে?”
“আরে পাগলি! দুলাভাই তোকে কিছু বলে নি?”
আমি মাথা নাড়লাম। না আমি কিছু জানি না। ছোট মামা বলল
“আজ সন্ধায় আকদ হয়ে যাবে রে বাদরী তোর! কিন্তু তার আগে তোর বাদর কে মুসলমান হতে হবে তো?”
মামা আরো একটা মিষ্টি নিতে নিতে বললেন
“আর এ মিষ্টি হল তোর বাদরের ইসলাম গ্রহনের মিষ্টি।”
আমার মুখে মিষ্টি টা ঠেসে দিয়ে বলল
“নে! তোর বাদর কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছে। এবার বিয়েটাও জলদি হয়ে যাবে।”
আমি মুখে মিষ্টি টা নিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। লিও সত্যি ইসলাম গ্রহন করেছে? বিয়ের জন্য নাকি সবাই তাকে বাধ্য করেছে? সে কি স্বেচ্ছায় ধর্ম ত্যাগ করেছে, নাকি বাধ্য করা হয়েছে?
মিষ্টি টা তাড়াতাড়ি গিলে অপেক্ষা করতে লাগলাম লিও কে পাওয়ার জন্য। বেশ কতক্ষণ অপেক্ষা করার পর লাট সাহেব দেখা দিলেন। তবে আমার হুশ কেড়ে নিয়ে। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় কালো কুচকুচে টুপি পড়ে এ কাকে দেখছি আমি? এই শ্বেত শুভ্র সৌন্দর্য্যে তো আমার নিষ্পাপ চোখ দুটো ঝলসে যাবে। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হা করে দেখতে লাগলাম তাকে। আগে মনে হত সাদা কাপড়ে বুঝি মেয়েদেরই অপূর্ব লাগে। কিন্তু সাদা পাঞ্জাবি তে লিও কে তো মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো প্রেম পুরুষ। পুরু লাল ঠোঁট দুটোতে লেগে আছে এক চিলতে হাসি, সেই হাসিতে গিরিখাদ গুলো স্পষ্ট হয়েছে বেশ ভালো ভাবেই।
“মিইইরা!”
“হাঁ?”
চমকে উঠলাম। লিও আমাকে চিল্লিয়ে ডাকছে। সে চিল্লাচ্ছে কেন?
“তুমি কি শুনছো?”
“শুনছি!”
“তাহলে জবাব দিচ্ছ না কেন? আর এমন করে দেখছোটা কি?”
আমার চমক ভাঙলো। দ্রুত তাকে টেনে নিয়ে আসলাম আমার রুমে। দরজা বন্ধ করতেই লিও চিল্লাতে লাগল
“সাংঘাতিক মিইইরা! করছো টা কি? সবাই কি ভাববে? এক রুমে আমরা দুজন… দরজা বন্ধ করে….!”
লিওর চেহারাতে দুষ্ট একটা হাসি ফুটে উঠলো। বললো
“তোমার কি ভীষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে? আমার তো অনেক পাচ্ছে।”
“শাট আপ!”
ধমকে লিওর মুখ চিমসে গেল। কাচু মাচু হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো
“বলো কি বলবে?”
“তুমি ইসলাম নিচ্ছো?”
“হুম!”
“কেন?”
“কেন আবার কি?”
“না মানে তুমি ইসলাম কেন নিচ্ছো?”
“তুমিই না বলেছিলে আমাদের ধর্ম আলাদা। আর ইসলামে বিধর্মীর সাথে নাকি বিয়ে মানা। তাই ইসলাম নিলাম। না হলে ওরা আমাকে দিচ্ছে না।”
“কি দিচ্ছে না?”
লিও অন্য দিকে তাকিয়ে বলল
“তোমাকে!”
আমি মূক হয়ে গেলাম। লিও বলল
“তাই ইসলাম নিয়েছি। এখন আমাদের বিয়েতে কোনো বাঁধা নেই। কি… ঠিক করেছি না?”
লিও দু হাতে আমাকে ধরে বলল
“বলো!”
আমি মাথা নাড়লাম রোবটের মত।
.
সন্ধায় একটা রুম পুরো খালি করে সেখানে পাটি বিছানো হলো। তাতে পাতলা চাদর বিছিয়ে সবাই বসলো। সামনে হরেক রকমের মিষ্টি সাজানো। সে সাথে পান খেজুর, পিঠা, শরবত রাখা আছে। আমাকে গোসল শেষে অযু করিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। গায়ে সদ্য কেনা টকটকে লাল রংয়ের পাতলা শাড়ি। ছোট ছোট ফুল তাতে। আর মাথার উপর ওড়না। সাজ বলতে তেমন কিছুই নেই। আম্মা আর চাচী সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন। বড় মামী পাশে বসে আমাকে হরেক রকমের কথা শুনাচ্ছেন। কথা গুলো ঠিক এ রকম
“হোন মাইয়া! স্বয়ামি হইলো মাথার তাজ। এরে মাথায় রাখবি। ফুল ঘরে ঢোকার লগে লগে সালাম করে নিবি। কি হুনছস?
“শুনছি শুনছি!”
“তার সকল কথা শুনবি, তার…”
মামীর কথা কেটে গেল। বড় মামা, তৈয়ব চাচু আর মৌলবী ঢুকতেই সবাই লম্বা ঘোমটা টেনে দিল। আর পুরো শরীর জুড়ে মৃদু কম্পন হতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা গলায় কি বললাম নিজেই জানি না।
অবশেষে আলহামদুলিল্লাহ বলে সবাই মুনাজাত ধরলেন। মুনাজাত শেষে বড় মামী ছল ছল করা চোখে আমার মাথায় চুমু খেলেন। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কাঁদতে লাগলেন।
সবাই কে মিষ্টি বিতরন শুরু হয়ে গেলো। আমি তখনো দ্বিধায় ভুগছিলাম। আমার কি সত্যি বিয়ে হয়ে গেছে? শেষ পর্যন্ত কি লিও কে আমার করতে পেরেছি?
গায়ে চিমটি কাটলাম। নাহ্ আমি স্বপ্ন দেখছি না সব বাস্তব। আমার বিয়ে হয়েছে। আমার প্রাণ পুরুষের সাথেই।
.
আমাদের বাসর ঘর সাজানো হল ছাদের ঘরে। আরো একবার ওযু করিয়ে বড় মামী বসিয়ে দিল। চাচী বড় বড় দু ঘড়া পানি এনে ঘরে রাখলো। আমি বুঝতে পারলাম না এখানে পানির কি কাজ?
সবাই বেড়িয়ে গেল আমাকে রেখে। পুরো রুমে ফুলের খুশবু তে মৌ মৌ করছে। সবাই ফুল দিয়ে এ রুম টাকে একদম ভাসিয়ে দিয়েছে। যে দিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই ফুল নজরে আসছে। আর বাইরে থেকে আসছে চাঁদনী। সেই সন্ধা থেকে এই খোঁপা টা বেঁধে আছি। এখন তো বেশ টন টন করছে ব্যাথায়। তাই খোঁপা টা খুলে চুল ছেড়ে দিলাম।
বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আকাশে মিষ্টির মত টসটসে একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সে সাথে অনেক গুলো তারা। আর পুরো ছাদ জুড়ে সেই চাঁদের চাদঁনী খেলা করছে। অন্ধকারের লেশ টুকুও কোথাও নেই। লেবু ফুল ফুটেছে হয়ত। বাতাসে তার খুশবু ভেসে বেড়াচ্ছে। দুহাতে নিজেকে জড়িয়ে বাতাসের কাছ থেকে লেবু ফুলের তাজা খুশবু টা নিচ্ছি।
হুট করে শিউরে উঠলাম। একটা শীতল স্পর্শে। দুটো হাত পিছন থেকে আমার কোমড় ছুয়ে যাচ্ছে। কিলবিল করছে আমরা পেট জুড়ে। আমি তার হাত ধরে ফেললাম। সে আমার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিল। প্রতিটা সেকেন্ডে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি। বার বার নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি।
“লি-লিও?”
লিও জবাব দিল না। চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি আবার ডাকলাম
“লিও?”
মাথা গোজা অবস্থায় লিও জবাব দিল।
“হুম?”
আমি জবাব দিলাম না। লিও নিজ থেকেই বলল
“আজ আমাদের বাসর রাত। আমি অপেক্ষা করেছি হাজার বছর এ একটা রাতের জন্য। তোমাকে আমার করে পাওয়ার জন্য। আজ সে রাত।”
ফিনফিনে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কাঁপুনি ছুটেছে শরীরে। আমি লিওর দিকে ফিরলাম। ওর দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সামনে দাড়ানো শ্বেত শুভ্রতায় মোড়ানো এ ভালোবাসা টা আমার স্বামী! ভাবতেই শিহরন বয়ে যাচ্ছে পুরো শরীরে। একটু হেসে নিচু হয়ে সালাম করার আগেই লিও ঝট করে ধরে ফেলল। বলল
“কি করছো?”
“সালাম করছি। মামী বলেছে তোমাকে সালাম করতে। ওখানেই নাকি আমার স্থান!”
লিও হেসে দিল। সেই হাসিতে ঝংকার তুললো আমার হৃদয়ে। বলল
“লাগবেনা! তোমার স্থান ওখানে না। এ পিঞ্জরে।”
লিও আমাকে টেনে নিল। তার বুকে। এ স্পর্শ টা পাওয়ার জন্য আমি কত দিন রাত তড়পেছি হিসাব নেই। বুকে ঝড় বয়ে গেছে অনেক। দু হাত দিয়ে আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। নাক গুজে দিলাম তার ফরসা বুকে। তার বুকে হলুদের খুশবু। নিশ্চয় কাঁচা হলুদে গোসল করানো হয়েছে তাকে।
লিও এক হাতে আমাকে জড়িয়ে অপর হাত মাথায় রাখলো। তারপর ফিস ফিস করে একটা সুরা পড়তে লাগলো। আমি অবাক হয়ে ওকে ডাকলাম। কিন্তু ও জবাব দিল না। এক নাগাড়ে সুরা পড়তে লাগলো। পড়া শেষে আমার মাথায় ফু দিল। আমি টিপ টিপ করে শুধু ওর কাজ দেখছিলাম। ফু দেয়া শেষে সে বলল
“দোয়া পড়ছিলাম। অনেক কষ্ট হয়েছে এ দোয়া মুখস্ত করতে। তাই তো আসতে দেরি হলো। এ দোয়া পড়ে নাকি তোমার মাথায় ফু দিতে হবে। তাই দিলাম।”
আমি হেসে দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিন্তু লিও আমাকে জড়িয়ে ধরতে দিল না।
দু হাতে আমার মুখ খানা ধরে ভেজা চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু আমার একটুও বিরক্ত লাগছিলো না। মিশে যাচ্ছিলাম মিষ্টি হাসিতে তার সাথে।
আমার সাথে হাসছিলো সেই টসটসে চাঁদও।
.
শেষ রাতে আলু থালু হয়ে ঘুমাচ্ছি। বেশি দেরি হয় নি ঘুমাচ্ছি। আধো ঘুম আধো জাগরনে লিও কে ডাকলাম
“লিও?”
লিও তখন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। একটা পা তুলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। কয়েকবার ডাকতেই জড়ানো গলায় জবাব দিল
“হু?”
“আমি একটা কথা ভাবছিলাম?”
“হু?”
“তোমার প্যারেন্টস যদি আমাকে মেনে না নেয়? তাহলে কি হবে?”
“হু?”
“লিও?”
জড়ানো গলায় এবার সে কথা বলল
“কি হবে?”
“বলো না লিও!”
লিও নিঃশব্দে হাসতে হাসতে লাগলো। বললো
“বিয়ে তো হয়ে গেছে। আর কি করবে ওরা?”
আমি জবাবে খুশি হতে পারলাম না। বললাম
“তুমি তো ওদের সন্তান। তারপরও উনাদের আশীর্বাদ ছাড়া বিয়ে করে ফেললাম। তুমি ধর্ম ত্যাগ করলে। সেগুলো কি ওরা ভালো চোখে দেখবে?”
“না দেখলে না দেখুক!”
“লিও ওরা তোমার বাবা মা!”
“তাতে কি? তুমি তো পাশে আছোই।”
“তারপরও!”
“ঝড় কি এখানে আসেনি? এসেছিল। পাশে ছিলাম। হাত ধরে শক্ত করে। মানিয়েছি ঝড়কে। তখনো থাকবো হাত শক্ত করে ধরে। ঝড় কে মানাতে। কি থাকবে তো?”
মন ভরে গেল আমার। দুহাতে লিও কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম
“অবশ্যই থাকবো! কখনো হাত ছাড়বোনা। যত ঝড় কিংবা তুফান আসুক। কখনোই না।”
.
#সমাপ্ত
.
হ্যাপি এনডিং…… হ্যাপি এন্ডিং…… আর কারা নাচতেছেন আসেন। আমি লুঙ্গী ডানস দিচ্ছি। আমার সাইলেন্ট রিডার্স রা আপনারাও কিন্তু সাইলেন্ট থাকবেন না। আমার সাথে অবশ্যই নাচবেন। ♥ আর হ্যা সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।