বিধবা_বিবাহ পর্ব-২৩

0
835

#বিধবা_বিবাহ (চতুর্বিংশ পর্ব )
হোটেলের এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালপত্রগুলোকে ক্ষিপ্রহাতে গুছোচ্ছিল অতনু। হাতে মাত্র কয়েক ঘন্টা আছে আর, তারপরেই ফ্লাইটে করে ফিরে যেতে হবে প্রানের শহর কলকাতাতে। কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে মায়ের ফোন এসেছিল, প্রেশারের আপডাউন হচ্ছে ভীষণরকম ভাবে। তাই কাজশেষের আনন্দে মনটা বিভোর হয়ে গেলেও মায়ের শরীরখারাপের খবরটা তার মনটাকে যে বিষণ্ন করে রেখেছে, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু এমন তাড়াহুড়োর সময়ে মুঠোফোনটা সশব্দে বেজে উঠতেই ওর ভাবনাচিন্তার জালটা কেটে গেলো নিমেষেই। অস্বচ্ছ ডিজিটাল স্ক্রিনে তখন ফুটে উঠেছে ঐশীর সেভ করে রাখা নম্বরটা।
“হ্যাঁ বলো?” মুঠোফোনটাকে কান আর কাঁধের মাঝখানে চেপে রেখে ট্রলিব্যাগের চেন আটকাতে আটকাতে বলে উঠলো সে। বস্তুত দিনভর কাজের তাড়নায় একটাবারও খোঁজ নেওয়া হয়নি মেয়েটাকে।
“তোমরা মনু যাদবকে কি খুঁজে পেয়েছো?” ওপ্রান্তে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠা কণ্ঠস্বরটা শুনেই চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়লো অতনুর চওড়া কপালে।
“না, পাইনি এখনো। পুলিশ চেষ্টা করছে জোরকদমে। কিন্তু কেন বলোতো?” আধখোলা ব্যাগটা বিছানায় ফেলে রেখে বলে উঠলো অতনু। ঐশীর উত্তেজনার পরতের ছোঁয়া লেগে ওর মনটাও কেমন জানি কুডাক গেয়ে উঠলো।
“মনু যাদব আর কেউ না, আমাদের হানিমুন ট্রিপের সময় নিয়ে যাওয়া ড্রাইভারটা। যে কিনা অবিনাশের সাথে গোটা গাড়ী শুদ্ধ পড়ে গিয়েছিল খাদে।” হাঁফাতে হাঁফাতে ঐশী বলে উঠলো এবার।
“হোয়াট!” উত্তেজনার আবেশে স্থান-কাল ভুলে চিল্লিয়ে উঠলো অতনু। ছোট্ট চৌহদ্দিটা গমগম করে উঠেছে পুরুষালী বাজখাঁই গলার সেই চিৎকারে।
“উফফ! এত চিল্লাছো কেন?” ওপ্রান্তে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো ঐশী।”আমি এইমাত্র ওর ফটো এডিট করলাম..তারপর দেখি এই কেস…”
“ফটো! এডিট। কিসব বলছো তুমি?” ঐশীর কথা বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে বলে উঠলো অতনু। দিনভর কাজের শেষে ওর মাথাটা ঠিক যেন আর কাজ করতে চাইছেনা।
“চ্যাটবক্সটা খোলো শিগগির। আমি ফটো পাঠিয়ে দিয়েছি অলরেডি…” সংক্ষেপে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া নিজের কীর্তির কথা বলে গেল ঐশী। ওর গোটা শরীর তখন তখন মুহুর্মুহু কেঁপে চলেছে আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়। অবচেতন মনটা বারেবারে জানান দিচ্ছে মনু যাদবের সাথে অবিনাশও বেঁচে আছে। খাদে পড়া গাড়ির একজন আরোহী বেঁচে গেলে, অন্যজন মারা যাওয়া কি অতই সহজ! একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মনে পড়ে গেলো অবিনাশের নিজস্ব একাউন্ট থেকে লগইন করার কথাটা। মনের মধ্যে জেগে থাকা নিজের সন্দেহটা বেড়ে গেল শতগুণ…
“হয়তো অবিনাশের কথামতোই অরিন্দম লুকিয়ে গিয়েছিল এই সংবাদ। তারপর দুজনে মিলে অনৈতিক কাজকর্ম চালাচ্ছিল মনের সুখে।”আপন মনে বলে উঠলো ঐশী। কিছুক্ষণ আগেই থানার ইনচার্জ ওকে জানিয়েছেন অরিন্দমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিডিয়া, পাপারাৎজিদের ভিড়ে থিকথিক করছে জায়গাটা। গোটা শহরে খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছে আগুনের গতিতে।

“অতনু, আমার মনে হচ্ছে অবিনাশও বেঁচে আছে। মনু বাঁচলে অবিনাশ কেন বাঁচবে না!” উৎকণ্ঠা ভরে বলে উঠলো ঐশী,”তাছাড়া মনে করে দেখো, কিছুদিন আগেই ওর পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট থেকে লগইন করা হয়েছিল। আর ব্যাংকে মোটা টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিলো।
প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ চ্যাটবক্সের ডিজিটাল পাতা উল্টোতে লাগলো অতনু। এমনসময় দাঁড়িগোঁফে ঠাসা মনু যাদবের মুখটা নজরে পড়তেই আঙ্গুল বোলানো বন্ধ হয়ে গেলো ওর। একপলকে দেখলে কিছুতেই মনে হচ্ছেনা মানুষটা মনু যাদব। কিন্তু চোখের কোণে জেগে থাকা একটা গভীর ক্ষতর ছাপ জানান দিচ্ছে মানুষটি ফেরারি আসামিই বটে।
“তুমি সিওর এই লোকটাই তোমাদের ট্রিপে ড্রাইভার ছিলো?” ঐশিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেও তদন্তের খাতিরে ফের আরেকবার জিজ্ঞেস করলো অতনু। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই কাজে কোনো আনাড়ি যুক্তি, সাক্ষী যে কাজে দেয়না, তা বলাই বাহুল্য।
“কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করছনা?” উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলো ঐশী। ওর কণ্ঠস্বরে জমতে থাকা অভিমানের পরত পড়ে নিয়ে চুপ করে গেলো অতনু। আজ সারাদিন কাজের চাপে মেয়েটার কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, উপরন্তু এই প্রশ্নে অভিমান জমা স্বাভাবিক বৈকি। তাই পরিস্থিতিটা সামলাতে তড়িঘড়ি বলে উঠলো অতনু,”অবশ্যই বিশ্বাস করি। কিন্তু এতো গুরুত্বপূর্ণ কেসে বিশ্বাসের থেকে যুক্তির পাল্লা ভারী। তাই তোমার মুখের কথাতে বিশ্বাস করতে পারলাম না বলে রাগ কোরোনা। যাচাই করে দেখতে হবে আমাকে।” দোষী, নির্দোষ এর ফাঁদে একজনও নির্দোষ যাতে সাজা ভোগ না করে, তাই এরূপ ব্যবস্থা।
“বুঝেছি।”ওর বক্তব্যের সমর্থনে বলে উঠলো ঐশী।”তবে তুমি একটা কাজ করতে পারো। আমরা যে ট্রাভেল এজেন্সির আন্ডারে ঘুরতে গিয়েছিলাম তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারো।ওই এজেন্সিই গাড়ি, ড্রাইভার পাঠিয়েছিলো।”
“গুড আইডিয়া।” ঐশীর উপস্থিত বুদ্ধির উচ্ছসিত প্রশংসা করে উঠলো অতনু। এই প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরেছে ওর।
“দ্যা এক্সপ্লরার।” ওপ্রান্তে বলে উঠতেই চটপট রাইটিং প্যাডে লিখে নিল সে। তারপর কলটা ডিসকানেক্ট করে ইন্টারনেটে লোকেশনটা দেখে চটপট। এখান থেকে প্রায় দেড় কিমি দূরে সেই জায়গাটা।
“হায় ভগবান! এখন অত দূরে গেলে আমি ফ্লাইট ধরবো কখন?”আপনমনেই হতাশ হয়ে বলে উঠলো অতনু। এমন সময় মুঠোফোনটা ফের বেজে উঠতেই বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেল সে। কাজের মধ্যিখানে এভাবে অযাচিত কল আসলে মানসিক বোঝাপড়াগুলো যে বিঘ্নিত হয় তা বলাই বাহুল্য।

“হ্যাঁ বলুন অফিসার।” ক্ষিপ্রহাতে কলটা রিসিভ করে বলে উঠলো অতনু।
“একটা বিশেষ দরকারে আপনাকে ফোন করেছি। রিসেন্টলি মনু যাদবের অ্যাকাউন্ট থেকে অরিন্দমকে মোটা টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিল। কিন্তু অন্য আরেকটি একাউন্টেও ট্রান্সফার করা হয়েছিল, যার নামটি জানতে পারলেও আমরা তাকে রেকগনাইজ করতে পারছিনা। বাঙালি নাম,”ওপ্রান্ত বলে উঠলো এবার।
“অবিনাশ ভট্টাচার্য?” অফিসারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটাকে কানে চেপে বলে উঠলো অতনু…”কিছুদিন আগেই অবিনাশ নামক ব্যক্তির একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা হয়, ইনফ্যাক্ট সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকা পার্সোনাল প্রোফাইলেও লগ ইন করা হয়। বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে চাইছি।”একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে খানিকক্ষণ চুপ থাকলো অতনু, তারপর নৈঃশব্দ ভেঙে বলে উঠলো,”অবিনাশ ভট্টাচার্যকে
চিনি আমি, আই মিন নামটি জানি। আমার ফিয়ন্সের প্রাক্তন স্বামী উনি এবং সম্পর্কে অরিন্দমের দাদা।”
“ওহহ, এই ব্যাপার! ওই ভদ্রলোকের সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু তথ্য জানতে পারা গিয়েছে।” ওপ্রান্ত গলাখাকরি দিয়ে বলে উঠলো এবার। “সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যাক্টিভ থাকার ঘটনাটা শুনে মনে পড়লো মনু যাদবের বাড়িতে যতগুলো মোবাইল উদ্ধার হয়েছে, তারমধ্যে একটি মোবাইলে অবিনাশ ভট্টাচার্য নামক এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টও রয়েছে। এবং লোকেশন মনু যাদবের বাড়িতে।”
“বাহ,তবে তো সবই বুঝতে পা গেল…”উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো অতনু,”অবিনাশ মনু যাদবের বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল এতদিন।”
“আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে..”চিন্তাগ্রস্ত ভঙ্গিতে অফিসার বলে উঠলেন এবার,”যাদবের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তিনপ্রকার সাঈজের জামাকাপড় পাওয়া গিয়েছে, অবশ্যই পুরুষদের কাটিংয়ের। আপনি বললে আমি ফটো পাঠিয়ে দিতে পারি।”
“বেশ, তবে এক্ষুনি পাঠিয়ে দিন। বাই দ্যা ওয়ে আমারও কিছু জানানোর ছিল আপনাকে।” একহাতে ফোনটা কানে চেপে অন্যহাতে প্রসাধনের জিনিসপত্র দ্রুত হাতের গোছাতে শুরু করে অতনু।
“আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি মনু যাদবের ফটো আমার ফিয়ানসেকে পাঠিয়ে ছিলাম। এডিটর অ্যাপে ইচ্ছেখেয়ালে খানিক কারিকুরির পর দেখে মানুষটা আর কেউ নয়, ওদের হানিমুন ট্রিপে নিয়ে যাওয়া ড্রাইভার। যে কিনা অবিনাশকে সাথে নিয়ে পড়ে গিয়েছিল খাদের অতল গভীরে।”
“সেকি! খাদে পরার পরেও মানুষটা বেঁচে আছে! এটা কিভাবে সম্ভব!” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে প্রায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন অফিসার।”কবে গিয়েছিল হানিমুন ট্রিপে? আর ট্রান্সপোর্ট মেথড কি বাই রোডে হয়েছিল?”
“তাও প্রায় একবছর ধরুন…”স্মৃতির অতল হাতড়াতে হাতড়াতে উত্তর দিল অতনু,”আর বাই রোডেই এসেছিল। লোকেশন বেগুসারাইতে।”
“কিন্তু বেগুসরাইতে খাদ কোথায়…” অস্ফুটে ওপ্রান্ত বলে উঠলো এবার। দু-তিনটে টিলা আছে, উঁচু-নিচু উপত্যকাও আছে চারপাশে। কিন্তু সেই অর্থে গভীর খাদ নেই তো!”অবাক হয়ে বলে উঠলেন অফিসার।
“সেটা কি করে হয়… ওদের গাড়ি যে খাদেই পড়েছিল।” অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে উঠলো অতনু,”ইনফ্যাক্ট স্থানীয় থানাতেও এই ব্যাপারটি নিয়ে ইনভেস্টিগেট করা হয়েছিল।”
“মানে আমাদের থানাতে?” দ্বিধা জড়িত কণ্ঠস্বরে অফিসার বলে উঠলেন এবার,”তাছাড়া ড্রাইভারটা যে মনু যাদবই, সেটা আপনি নিশ্চিত হলেন কি করে?”
“কারণ ঐশী চেহারাটা রিকগনাইজ করতে পেরেছে। আর যেহেতু লোকটাকে একবছর আগে মাত্র কয়েকঘণ্টার জন্য দেখেছে, তাই আমার মনে হচ্ছে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হত, আই মিন টুরিস্ট এজেন্সির কাছে। লোকেশন বেশি দূরে নয়, দেড় কিমি মাত্র।” খুলে থাকা ঘরের জানলা আটকাতে আটকাতে বলে উঠল অতনু…
“তবে দেরি কিসের এখনই যাওয়া যাক!” ওপ্রান্তে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন অফিসার। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে কটুক্তি শোনার পর কেসটার যে দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছেন তিনি, তা বলাই বাহুল্য ।

“কিন্তু আমার যে ফ্লাইট আছে, আমি…”

“কোন অসুবিধা নেই। হাতে এখনো সাতঘন্টা রয়েছে। দরকার হলে আমাদের ব্রাঞ্চ আপনাকে পৌঁছে দেবে এয়ারপোর্টে।” অতনুর বক্তব্যের মাঝপথেই বলে উঠলেন অফিসার।

———–

“নমস্কার, আমরা বেগুসারাই ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি।” রিসেপশনে বসে একমনে খটখট শব্দ করতে করতে টাইপ করতে থাকা স্থানীয় মেয়েটি আচমকাই গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে থমকে যায়। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিফর্ম পরিহিত অফিসার ফের বলে উঠলেন তাকে উদ্দেশ্য করে,”ট্যুরিজম কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। ইমিডিয়েটলি।”
নির্দেশ পাওয়া মাত্র হিলের খটখট আওয়াজ তুলে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ভিতরে ঢুকে যায়। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গোটা হোটেলটা ঘুরে দেখতে শুরু করেও অতনু। বেশিরভাগই বিবাহিত দম্পতিরা এসেছেন এখানে। কুমকুমের ছোঁয়া লাগানো অবগুণ্ঠনে ঢাকা মুখগুলো নজরে পড়ছে ক্রমাগত। এমন সময় চোখটা আটকে গেল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী মেয়ের দিকে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা মেয়েটির মুখে কৈশোরজাত লাবণ্য ঢাকা পড়ে গিয়েছে গাঢ় মেকাপের পরতে। চুল পরিপাটি করে সাজানো, দৃষ্টি উগ্র। ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগলো না অতনুর। পরিস্থিতিটা কাটাতে ঘরের অন্যপ্রান্তে চোখ রাখল সে। ফের সমবয়সী আরেকজন অন্য আরেকটি মেয়েকে দেখতে পেয়ে মনটা কেমন যেন কুডাক ডেকে উঠলো। ঘরের ভিতর থেকে সুঠাম চেহারার অপেক্ষাকৃত বয়স্ক একজন পুরুষ বেরিয়ে এসেছেন মেয়েটার সাথে সাথে। এই মেয়েটারও সাজগোজের বহর রীতিমতো চোখে লাগার মত।
“ব্যাপারটা ভালো ঠেকছেনা অতনু। কারা এরা? বিবাহিত নয় যে, এদিকে জোড়ায় জোড়ায় বেরিয়ে আসছে। যেমন উগ্র সাজগোজ, তেমনি চালচলন।”অস্ফুটে ফিসফিসিয়ে ভেসে আসা কথাগুলো তরঙ্গের বেশে চলে এলো অতনুর কর্ণপটহে। ব্যাপারটা অফিসারও লক্ষ্য করেছেন বটে, আচমকাই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত মনে পড়ে গেল এই রঙের ঘরখানা তিনি আগেও দেখেছেন। এমন কারিকুরিতে ঠাসা জানালার গরাদ মাত্র দিনকয়েক আগেই কয়েকশো বার দেখে ফেলেছেন তিনি, ডিজিটাল স্ক্রিনের পর্দাতে। মনু যাদবের বাড়ি থেকে তল্লাশি করে পাওয়া মেমোরি কার্ড গুলো থানার কম্পিউটারের সাথে এটাচ করার পরে…
“এটাই ওদের ঘাঁটির অতনু! এটাই। আমি চিনতে পেরেছি! মনুর মেমোরি কার্ড থেকে পাওয়া প্রত্যেকটি ভিডিও ক্লিপে এই বিশেষ রংয়ের ডিজাইনের জানলার গরাদ দেখা গিয়েছিল। দেওয়ালগুলোও রঞ্জিত ছিল হালকা গোলাপি রঙে!” উত্তেজিত ভঙ্গিতে অতনুর হাতটা খামছে ধরলেন অফিসার। তারপর দ্রুতবেগে দৌড়াতে শুরু করলো ভিতরের ঘরের দিকে। একটু আগেই স্থানীয় রিসেপশনিস্ট মেয়েটি গিয়েছিল যেখানে।
“দরজা খোল! দরজা খোল বলছি!” বন্ধ দরজার আগলে অতনুর শক্ত পুরুষালী হাতের নির্মম আঘাত পড়ছে একের পর এক। কিন্তু জড়বস্তুর কাঠিন্যে বারবার হেরে যাচ্ছে আক্রোশে আছড়ে পড়া পাঞ্জার আঘাত। বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরায় ইউনিফর্ম পরিহিত অফিসারের ক্যাপচারড ছবি দেখে ম্যানেজার যে পালানোর চেষ্টা করছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। যদিও শেষ পর্যন্ত ওদের দুজনকে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ম্যানেজার দরজা এঁটে ভিতরে সেঁধিয়ে পড়েছেন।
“অতনু তুমি শিগগির হোটেলের সদর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দাও। তারপর চটপট দেখো ম্যানেজারের জানলা দিয়ে বাইরে পালানো যায় কিনা! আমি ফোর্সকে ডেকে নিয়েছি। ওরা বেরিয়ে গিয়েছে অলরেডি। তুমি শিগগির বাইরে বেরিয়ে দেখো পালানোর অন্য কোন রাস্তা আছে কিনা! প্রত্যেকটা ঘর খুঁজে দেখা সম্ভব নয়!” একহাতে রাখা মুঠোফোনটা পকেটের গুঁজতে গুঁজতে বলে উঠলেন অফিসার। অন্য হাতে দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরা দরজার লকিং সিস্টেমটা।
“কিন্তু আপনাকে ফেলে আমি কিভাবে চলে যাব…” আমতা আমতা করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে অতনু। বস্তুত ঘটনার ঘোর সে কাটাতে পারেনি এখনো।
“উফফ!তুমি কি পালিয়ে যাচ্ছো নাকি!” তিতিবিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন অফিসার। “স্রেফ দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দেখো পালানোর অন্য রাস্তা আছে কিনা.. যদি না থাকে, তবে দরজা খুলে দিয়ো। আমি তখন তোমার সাথে বেরিয়ে যাব..”
“আচ্ছা!” অস্ফুটে কতটুকু বলে প্রায় দৌড়াতে শুরু করলো অতনু। ইতিমধ্যেই পাশে থাকা অন্য একটি ঘরের দরজার ফাঁক পেরিয়ে শুটিংয়ের খন্ডচিত্র দেখা হয়ে গিয়েছে তার।জায়গাটি যে অরিন্দম অবিনাশের কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি, সেই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই।

“বল! কবে থেকে চলছে এইসব! আর কে তোদের পান্ডা?” হাতজোড় করে ক্রমাগত কাঁদতে থাকা মধ্যবয়স্ক পুরুষটির গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল অতনু। বলাবাহুল্য ইনিই ম্যানেজার।
“আমি জানিনা স্যার। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।” বাংলা হিন্দি মেশানো ভাষায় বলতে বলতে এবার প্রায় গুঙিয়ে উঠলেন তিনি।
“জানিস না! ইয়ার্কি হচ্ছে!” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারও ততক্ষণে মারাত্মকভাবে ক্ষেপে গিয়েছেন। প্যান্টের সাথে সেঁটে থাকা চামড়ার আচ্ছাদন থেকে বার করে নিয়ে এসেছেন ঠান্ডা ধাতব বস্তুটা।
“বলছি স্যার! বলছি।” রিভলভারের অবয়বট দেখামাত্র পায়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা করতে শুরু করল ম্যানেজার সাহেব।”অরিন্দম, অবিনাশ। দুইভাই এই সংস্থাটা চালাত মিলেমিশে।”
“চব্বিশ ডিসেম্বর, গতবছর। তোদের হোটেলে দুইজনের টিকিট বুক হয়েছিল।কে রিসিভ করতে গিয়েছিল?” হাতে থাকা বন্দুকের নলটা ম্যানেজারের মাথায় ঠেকিয়ে বলে উঠলেন অফিসার।
” এক্ষুনি বলছি স্যার! এক্ষুনি বলছি।” অফিসারের নির্দেশ পাওয়া মাত্র প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজস্ব কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেল ম্যানেজার। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গোটা ঘরে চোখ বুলাতে শুরু করলো অতনু। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবয়বগুলো ক্রন্দনরত খাবলানো ভিড়ের রূপ নিয়েছে। ঘরে বাইরে থিক থিক করছে উর্দি পরা পুলিশের দল।
“মনু গিয়েছিল সেদিন গাড়ি নিয়ে।” ডেক্সটপটা অফিসারের দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠলো ম্যানেজার সাহেব। ওনার গা’টা তখনও কেঁপে চলেছে থরথরিয়ে। ডিজিটাল স্ক্রিনে ততক্ষণে ফুটে উঠেছে মনুর দাড়ি-গোঁফে ঠাসা মুখটা।
“আপনার এখনও মনে আছে কীকরে?” বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে বলে উঠলো অতনু।
“ওই দিনটা কিকরে ভুলি বলুন? সাহেব যা চিল্লামিল্লি করলেন! শেষমুহূর্তে ড্রাইভার বদল করিয়ে মনুকেই পাঠালেন ওদের জন্য। শেষমেষ খাদে পড়ে মরেই গেল লোকটা!” ম্যানেজারের কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে দুঃখ মিশ্রিত খেদের অভিব্যক্তি। যেন নিজেকেই দোষারোপ করে চলেছেন তিনি।”আমি জানতাম মনুটা র‍্যাশ ড্রাইভিং করে। কেন যে সেদিন সাহেবের কথায় রাজি হলাম!
“কে সাহেব? অবিনাশ?” উঁচিয়ে থাকা নিজের রিভলভারটা পকেটে পুরতে পুরতে বলে উঠলেন অফিসার।
“নানা, অরিন্দম বাবু। উনিই তো এই চক্রের মাথা।” ম্যানেজার সাহেব এখন অনেকটাই ধাতস্থ হয়েছেন। বস্তুত ওনার বাচনভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নিজে ফেঁসে যাওয়ার কারণে গোটা দলবলকে সাথে নিয়েই ডুবতে চাইছেন তিনি। অধীনস্থ কর্মচারী হলেও মালিক অরিন্দমের প্রতি যে বিন্দুমাত্র বিশ্বস্ততা অবশিষ্ট নেই তা বলাই বাহুল্য। নইলে সাধারনত এত সহজে এদের পেট দিয়ে কথা বার করা যায় না…
“মনু যাদব বেঁচে আছে। এবং অবিনাশও।” টেনে টেনে সবকটাকে গাড়িতে ওঠাতে ওঠাতে বলে উঠল অতনু। তারপর আগে থেকে বুক করে রাখা ক্যাবে শরীরটাকে ছেড়ে দিল সে। চোখে ততক্ষণে ভর করেছে একরাশ ক্লান্তি। কোথায় ভেবেছিল তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু ক্রমাগত নতুন নতুন দিক উন্মোচনে তদন্তের নতুন নতুন শাখাপ্রশাখা গজিয়ে উঠেছে।
“ঐশীকে হানিমুনের বাহানায় নিয়ে এসেছিল অবিনাশ.. কি করতে চাইছিল ওকে দিয়ে!” ভাবতে ভাবতে গাড়ির নরম গদির ঝাকুনিতে চোখটা বুজে ফেলে অতনু। অচিরেই তলিয়ে যায় ঘুমের গাঢ় রেশে।

 

———

“সঙ্গীতা কবে গিয়েছে বেগুসরাইতে?” উল্টোদিকে বসে থাকা যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে ওঠে ঐশী। অতনু কলকাতায় ফিরে আসার পরদিনই অফিস কামাই করে সে কফিশপে এসেছে।
“হঠাৎ কি হল?” সতর্কভঙ্গিতে বলে ওঠে অতনু। এতদিন পরে ঐশীর সাথে দেখা হওয়ার পর এইরকম প্রশ্ন যে সে আশা করেনি, তা বলাই বাহুল্য। তবুও ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ মেনুকার্ডে চোখ বুলোতে থাকে সে।
ওর বলবার ভঙ্গিতে মনের মধ্যে পুষে রাখা সন্দেহটা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে সংগীতা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি অতনু। কিন্তু ঐশিও যে ছাড়ার পাত্রী নয়, তাই একবুক শ্বাস নিয়ে চড়াস্বরে ফের বলে ওঠে সে,”কেন আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনা তোমাকে?”
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো ঐশী?” আচমকাই সামনে রাখা মেনুকার্ডটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো অতনু। তারপর টেবিলের উপর নিজের পুরুষালী হাতটা রেখে ঐশীর দিকে ঝুঁকে এগিয়ে এসে বলল,”কোথায় তুমি জিজ্ঞেস করবে কেসের ব্যাপারে…
“নানা সন্দেহ কেন করবো…” মনের ভাবটা সম্পূর্ণ গোপন করে খানিকটা সংকুচিত হয়ে উঠল ঐশী। ওর মনটা বুঝতে পারছে বিয়ের আগেই এতসব বাঁধনে, সন্দেহে বেঁধে ফেলাটা হয়তো ঠিক হচ্ছেনা আর। কিন্তু অতনুকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা যাচ্ছে কই! দিনকে দিন যে চেপে বসছে আরো গভীর ভাবে…
“আমি জানি সন্দেহ করছে…” ঠোটের কোনায় একটা ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো অতনু,”আর এটাও জানি আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় চেপে বসেছে তোমার মধ্যে। কিন্তু জানিয়ে রাখি সঙ্গীতা বিবাহিত, এবং ওর সাথে বেগুসরাইতে আমার দেখাও হয়নি।”
“তবে সেদিন এড়িয়ে গেলে কেন?” ঐশীর দুচোখের তারায় নিমেষেই জড়ো হলো অভিমানের ঘনঘটা।
“বেশ করেছি। কেন করবো না?” সার্ভ করে রাখা কফিকাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলো অতনু। ওর দুচোখে তখন খেলা করছে দুষ্টুমির সূক্ষ্ম বিন্দু।

ক্রমশ
©সম্প্রীতি রায়
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/185902276523537/?app=fbl
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here