বিধবা_বিবাহ পর্ব-২৪

0
867

#বিধবা_বিবাহ (পঞ্চবিংশ পর্ব)
“কিন্তু সঙ্গীতার মাথায় তো সিঁদুর দেখলাম না। এমনকি শাখা পলা তো দূর, নোয়াও দেখলাম না!” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে উঠলো ঐশী। ওর যেন এখনো কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছেনা সংগীতা বিবাহিত। বস্তুত কিছুদিন আগেই থানাতে গিয়ে অতনুর কড়ে আঙুল সঙ্গীতার স্পর্শ হওয়ার কারণে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল ঐশীর মনমধ্যে। তারপরই অভ্যাসবশত চোখ চলে গিয়েছিলো সঙ্গীতার সিঁথির দিকে। বয়সের ভারে ক্রমশ পাতলা হতে থাকা সেই সিঁথিতে সিঁদুরের চিহ্নমাত্রও ছিলনা। “যদিও আজকাল অনেকেই কাজকর্মের সুবিধার্থে সিঁদুর শাঁখা পলা পরেন না, কিন্তু নিদেনপক্ষে হাতে একটা নোয়া তো থাকবেই!” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। তারপর চোখ রাখলো উল্টোদিকে বসে থাকা যুবকটির দিকে। এতক্ষণ ধরে অতনুও একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ঐশীর দিকে। সেই দৃষ্টি পড়ে নিয়ে ঐশীর ফর্সা দুইগালে হঠাৎই লালচে ছোপ পড়লো।
“সবকিছু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেছে, কিন্তু বাঁ হাতটা লক্ষ্য করেনি।” ঠোটের কোনায় সূক্ষ্ম হাসি টেনে বলে উঠলো অতনু,”বলি সঙ্গীতার বাম হাতের অনামিকায় পরা আংটিটা কি চোখে পড়েনি?”
“মানে?” অতনুর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে উত্তর দিলো ঐশী। মনের পর্দায় কিছুতেই ভেসে উঠলনা সেদিনের দৃশ্যপট, তাই সঙ্গীতার অনামিকার জলছবির চিত্রও হারিয়ে গেলো নিজের মানসপট থেকে।
“সংগীতা ডিসুজা, খ্রিস্টান। তাই বিয়ের পর শাখা পলা, সিঁদুর না পরাই স্বাভাবিক।” হালকা গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো অতনু… খানিকক্ষণ আগে জেগে থাকা প্রেমিকসুলভ দুষ্টুমির ফিচেল হাসিটি উধাও হয়ে গিয়েছে ঠোটের কোন থেকে। পরিবর্তে কর্মরত একজন অফিসারের ন্যায় সহজাত গাম্ভীর্য ভর করেছে মুখাবয়বে। ঘন রোমশ পুরুষালী দুই ভুরুতে জমেছে প্রগাঢ়তার পরত।
“তবে সেদিন কেন লুকিয়ে গিয়েছিলে?” ঐশীর রাগের পারদ যে ক্রমশ চড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
“তুমি খেয়ালের মাথায় নিজের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারো, আমি সহকর্মীর ম্যারিটাল স্ট্যাটাস লুকিয়ে রাখলে দোষ?”টেবিলের উপর দুটো হাত রেখে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলে উঠলো অতনু।”যেখানে কিনা আমাদের দুজনের তরফ থেকে গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছে। বিয়েটা কি এতই সস্তা, ঐশী?”
সেই দৃষ্টির সামনে হঠাৎই কেমন কুঁকড়ে গেল ঐশী। মনের মধ্যে জমে থাকা কতশত ভাবনারা ফের পলির তলায় চাপা পড়তে শুরু করল চিরাচরিত স্বভাবজাত দোষের কারণে।
“আমি জানি ভাঙাচোরা জীবনের সাথে কাউকে জুড়ে নিতে মন বাধা দিয়ে ওঠে। বেশিরভাগ মানুষেরা আঘাত পেলে অন্য কাউকে আঁকড়ে বাঁচতে চায় জীবনভর। কিন্তু আমি জানি স্বভাবে তুমি ব্যতিক্রম, তাই তোমার ভাঙাচোরা জীবনের সাথে নিজেকে জুড়ে নিতে দুবার ভাবিনি।” ঐশীর ফর্সা কোমল হাতের উপর নিজের ভারী রোমশ হাতটা রেখে বলে উঠলো অতনু। সেই ছোঁয়াতেই হোক, বা অতনুর সহজাত স্পষ্ট কথার বাঁধনে ঐশীর শরীরটা নাম না জানা কাঁপুনিতে কেঁপে উঠলো। যৌনতার ছিটেফোঁটা না থাকা সেই ছোঁয়ায় বিন্দু বিন্দুতে জেগে রয়েছে বিশ্বাস, ভরসার স্পর্শ স্পর্শ। কালের প্রবাহে স্তর খসে পড়লেও উপযুক্ত পরিবেশে গজিয়ে ওঠে নব
উদ্যমে।

“ব্যতিক্রমী মানুষগুলোই গল্প হয়ে ওঠে আর বাদবাকিরা পড়ে থাকে….”

“সাদামাটার ভিড়ে।”অতনুর বক্তব্য সম্পূর্ণ করার আগেই ইচ্ছেখেয়ালে বহুদিন বাদে ‘পংক্তি বেরিয়ে এলো ঐশীর মুখ থেকে। একের পর এক অলিখিত দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতে যা চাপা পড়ে গিয়েছিল মনের গহিন কন্দরে। ঠিক যেমন উঁচু তাকের কোণে থাকা চামড়া বাঁধানো ডাইরিটা পড়ে থাকে ধুলোর অবহেলাতে।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। কারোর মুখে কোন কথা নেই, সুবিস্তৃত জানলার স্বচ্ছতা ভেদ করে বাইরের ব্যস্ত শহরে চোখ বুলোচ্ছে দুজনেই। কিন্তু এই নিস্তব্ধতা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না ঐশী। মুখ ফুটে অতনুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠল ফের,”কিন্তু অরিন্দম এত সহজে ধরা পড়ে গেলো? আইমিন সঙ্গীতার কাছে সবকিছু বলে দিলো…ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছেনা আমার।”
“স্রেফ একটা পুরনো টোটকা আর অরিন্দমের সাইকোলজি বুঝে এগিয়ে চলা…” হালকা হেসে বলে উঠলো অতনু,”লোকটার সাথে সামনাসামনি কথা না হলেও বুঝে গিয়েছিলাম ভীষণ ভাবে নিজেকে জাহির করতে ভালোবাসে। আর প্রচণ্ড মেকি..”
“মানে?” অতনুর কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে বলে উঠলো ঐশী।
“তোমার চ্যাটবক্সে পাঠানো মেসেজগুলো পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম কিছুটা। প্রত্যেক অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠেছিল নিজেকে বড়াই করার চেষ্টা। সাজপোশাক, কথাবার্তায় সবকিছুতে নিজেকে স্মার্ট, বুদ্ধিমান, কেয়ারলেস দেখাতে চেষ্টা করতো লোকটা। ব্যস্ত কফিশপে অন্তর্বাস দেখিয়ে তিনটে বোতাম খোলা জামা, দামি ঘড়ি জুতো, সর্বোপরি মেসেজে নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করতে চাইতো লোকটা। তাই নিরাপদ ফাঁকা ঘরে পুলিশের কাছে নিজের কুকীর্তি জাহির করতেও আটকায়নি। এটাও কিন্তু ওয়ান টাইপ অফ প্লেজার বুঝলে? ম্যাক্সীমাম দাগি অপরাধী নিজের কীর্তি জাহির করে আত্মতুষ্টি পায়। জানে কোনো সাক্ষ্য নেই। কিন্তু এই ওভার স্মার্টনেসটাই কাল হলো..”
“হুম, বুঝলাম…” অতনুর কথা শেষ হওয়া মাত্র ঐশী বলে উঠলো এবারে। “আর কি কি জানতে পারলে?”
“ওর পার্সোনাল রুম থেকে অগুন্তি মেমোরি কার্ড পাওয়া গিয়েছে, সাথে সিমও। আর ওদের ঘাঁটিটা ধরতে পেরেছি, নিশ্চয়ই দেখেছো মিডিয়াতে। কিন্তু আরেকটি ঘটনা মিডিয়াতে প্রকাশ পায়নি।” ঐশীর প্রশ্নের জবাবে বলে উঠল অতনু,”অবিনাশ তোমাকে কি উদ্দেশ্যে নিয়ে গিয়েছিল সেটা এখনও মিডিয়া জানতে পারেনি।”
“হানিমুনে নিয়ে গেছিল, আবার কি!” হাতটা নাড়িয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে উঠলো ঐশী।
“ওদের এজেন্সির তরফ থেকে মনু যাদবকে ড্রাইভার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তোমার প্রাক্তন স্বামী, দেবর দুজনেই এই ঘৃণ্য চক্রে যুক্ত। এখনো মনে হচ্ছে হানিমুন করার জন্য তোমাকে বেগুসরাইতে নিয়ে গিয়েছিল?” ঐশির চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো অতনু। সেই কথা শুনে উল্টোদিকে বসে থাকা তরুণীর শিরদাঁড়ায় বেয়ে একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত বেয়ে গেল। “সত্যিই তো, হানিমুন করতে হলে বেগুসরাই এর একটা স্বল্পখ্যাত জায়গাতেই কেন নিয়ে যাবে। যেখানে এই চক্রে লিপ্ত থাকার কারণে অবিনাশের কাছে প্রভূত অর্থ ছিল!” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। তারপর বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত মনে পড়ে গেল মনু যাদবও বিবাহ নামক ফাঁদ এঁটে নিজের স্ত্রীকেও পণ্য বানিয়ে তুলেছিলো।
“ছি!” নিজের অজান্তেই ঘৃণার বিষদগার বেরিয়ে এলো ঐশীর মুখ চিরে। ওর মনমধ্যে জেগে থাকা ছাইচাপা আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো নিমিষেই।
“আর মনুকে কোন ব্যক্তিটি ড্রাইভার হিসেবে যেতে বলেছিলো জানতে চাইবেনা?” ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো অতনু।

“কে?”

“অরিন্দম। ওই এজেন্সির হেড হিসেবে সেদিন মনুকে এই দায়িত্ব অরিন্দম নিজেই দিয়েছিলো।” বিগত দুদিন আগে সংগ্রহ করা তথ্যভান্ডার ঐশীর কাছে উপুড় করে দিলো অতনু।

“হোয়াট!” উত্তেজনা বশত প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো ঐশী।”কিন্তু অরিন্দম যে কলকাতাতে ছিলো, আই মিন আমরা বাই রোডে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অব্ধি ওতো বাড়িতেই ছিলো।”
“তার মানে তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর অরিন্দমও বেগুসরাইয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিলো।” অস্ফুটে বলে উঠলো অতনু। “আর পৌঁছেছে তোমাদের আগেই। কিন্তু মনুকে তারপর নির্দেশ দিলে তোমাদের পিক আপ কীকরে করতে আসে লোকটা?”
“মনু পিক আপ করেনি তো…ব্রেক জার্নি হয়েছিল সেদিন। হাফ রাস্তা চলার পর গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। তারপর মনু এসেছিল…” অতনুকে শুধরে দিয়ে বলে উঠলো ঐশী।
“বাই রোডে কলকাতা টু বেগুসরাই প্রায় এগারো ঘন্টা। মানে পাঁচ ছয় ঘণ্টার মাথাতে তোমাদের ড্রাইভার বদল হয় আর ফ্লাইটে গেলে পাঁচ ঘন্টাতে বেগুসোরাই পৌঁছে যাওয়া যায়!” টেবিলে এক চাপড় মেরে বলে উঠলো অতনু,”তবে তো হিসেব মিলেই গেলো। তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই অরিন্দম বেরিয়ে যায় তারপর পৌঁছে যাওয়ার পর মনুকে ড্রাইভার হিসেবে পাঠায়। ইজি ইকুয়েশন!”
“অরিন্দমকে জিজ্ঞেস করো, তাহলেই জানতে পারবে..” অতনুর কথা শুনে বলে উঠলো ঐশী।
“সেতো অবশ্যই, কিন্তু ডাউট আছে এইবার মুখ খোলার ব্যাপারে। মার খেলেও মুখে রা নেই! কিন্তু এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছে ডাটা চাইলেই পেয়ে যাবো।” ঐশিকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো অতনু,”কারণ দোষী নিজের মুখে দোষ স্বীকার করলেও অনেকক্ষেত্রেই আদালতে মিথ্যে কথা বলে, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রমাণ জোগাড় করে রাখতে হবে।”

“আর কিছু জানতে পারনি? অরিন্দম তো এখন তোমাদের হেফাজতেই। মারতে মারতে মেরে…”
“উফফ, সবকিছু ওইভাবে হয়না ঐশী।” খানিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো অতনু।”নিজের ওভার স্মার্টনেসের খেসারত দেওয়ার পর পরই লোকটা মুখে কুলুপ এঁটেছে। কিচ্ছু বলতে চায়নি জিজ্ঞাসাবাদের পরেও। তবুও চেষ্টা চালানো হচ্ছে, রাস্তা ঠিক বেরিয়ে আসবে…” ঐশীর উত্তেজনাকে প্রশমিত করার পর বলে উঠলো অতনু।”তাছাড়া সংগীতা বেগুসরাইতে আছে, ওখানকার ডিপার্টমেন্টও বসে নেই। এখন শুধু মনু যাদবের ধরা পড়ার অপেক্ষা। তারপর দুজনকে একসাথে বসিয়ে জেরা করতে পারলেই কেস সলভড।”

“সংগীতার বিয়ের ঘটনাটা চেপে যাওয়ার কারণ বুঝলাম, কিন্তু একসাথে থাকার ঘটনাটাও কেন চেপে গেলে?” ঐশীর মনে জেগে থাকা সূক্ষ্ম সন্দেহের পরত যে এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি, তা বলাই বাহুল্য।
“দেখছিলাম মানুষ কতটা অবিশ্বাস করতে পারে।” ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি টেনে বলে উঠলো অতনু। দুচোখ টেবিলের দিকে স্থির। কিন্তু
সেই হাসিতে আনন্দ খুশি প্রকাশের পরিবর্তে ফুটে উঠেছে ছাইচাপা দুঃখের প্রলেপ।
“এই কেসে কোনরকম এভিডেন্স ছিল না আমার কাছে। কিন্তু বেশি কিছু না ভেবে আমি ছুটে গিয়েছিলাম বেগুসরাইতে, মায়ের অসুস্থতার খবর মাথায় রেখেই। জানতাম আমি ছাড়া তার কেউ নেই, কিন্তু এটাও জানতাম তোমার মনের উপর দিয়ে কতখানি ঝড় যাচ্ছে। অগত্যা…”এক কথাগুলো বলার পর খানিকক্ষণ চুপ করে গেল অতনু, তারপর নিঃশব্দতা ভেঙে বলে উঠলো ফের,”চাইলে কেসটা অন্য অধঃস্তনের হাতে হ্যান্ড ওভার করতে পারতাম, কিন্তু ডিপার্টমেন্টে তাতে আমার সম্মান কমত বই বাড়তো না।”
“মানে?”অতনুর কথাটা বুঝতে না পেরে বলে উঠলো ঐশী।
“সঙ্গীতা যদি দেখতো নিজের ভাবি স্ত্রীয়ের সেনসিটিভ কেস আমি অন্য কারও হাতে তুলে দিচ্ছি, তবে সম্মানটা বাড়তো কি?” হালকা হেসে বলে উঠল অতনু।
“যাব্বাবাহ! সঙ্গীতা জানে আমাদের ব্যাপারে?” নিজের অজান্তেই গজদাঁতদুটো বার করে হেসে উঠলো ঐশী। নাহ্, আর কোন সন্দেহ, মন কষাকষির চিহ্ন মাত্র নেই। ঐশির মনে জেগে থাকা সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে ও।
“আমার মা জানে, গুষ্টিসুদ্ধ সবাই জানে। আর সঙ্গীতার থেকে লুকিয়ে রাখবো! উফফ,তুমি পারোও বটে ঐশী।” হো হো প্রাণখোলা হাসি হাসতে হাসতে বলে উঠলো অতনু।
“সেদিন আপনি করে কথা বলছিলে, তাই তো ভাবলাম…” আমতা আমতা করে বলে ওঠে ঐশী।
“বাব্বাহ, মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে পারলাম তবে, আহ্! আমার জীবনটা ধন্য অবশেষে…”দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ভরা কফিশপেই হেসে উঠলো অতনু।”কেন তুমি কি ভাবছিলে। আমি মেয়ে..?”
“আমি ভাবছিলাম তুমি মেয়ে তুলছো।”অতনুর মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো ঐশী। দিন কয়েক আগেই অতনু যে এইরূপ বাচনভঙ্গি ঐশীর তরফ থেকে এড়িয়ে গিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
ওর কথা শুনে থতমত হয়ে টেবিলে রাখা হাতটা নিজের দিকে টেনে নিল অতনু।
“মনের কথা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই।”অবিকল অতনুর বক্তব্য ঐশী বলে উঠলো এবারে। ‘বন্ধু বান্ধবদের সাথে যেমনভাবে কথা বলো, আমার সাথেও সেই ভাবেই বলো।”
“আর তুমি নিজের সাথে যেভাবে কথা বলো। আমার সাথে সেই ভাবেই বলো।” ঐশীর হাতদুটো নিজের পাঞ্জায় বন্দি করে বলে উঠলো অতনু।

“অবশ্যই, কিন্তু একটা শর্তে..”

“কি শর্ত?” ভ্রূ দুটো কুঁচকে যায় অতনুর।

“আমাকে মনি বলে ডাকতে হবে…”অস্ফুটে বলে উঠলো ঐশী।

——–

ব্যতিক্রমি হয়ে ওঠে গল্প,
সাধারণ সাদামাটা ভিড়ে।
হাসিমুখে জন্মায় লাইকেন,
পাথুরে মাটির বন্ধুরতা চিরে…

নিজের বাড়িতে ফিরে উঁচু তাকে রেখে দেওয়া ডাইরিটা ডিঙ্গি মেরে পেড়ে নিয়েছিল ঐশী। ওর মনমধ্যে অক্সিটোসিন বয়ে চলেছে পূর্নগতিতে। হারিয়ে ফেলা অভ্যাসগুলো বহুদিন বাদে ফিরে ফিরে আসছে নিজের বন্ধুর, কর্কশ মানসপটে। যেখানে লাইকেনের পরশ বুলিয়ে সৃষ্টি করছে নতুন ঊর্বর মৃত্তিকার। ঠিক যেমন অতনুর শরীর, মনের স্পর্শে ঐশীর পাথুরে মনটা ভরে উঠছে উর্বর চিন্তাধারাতে।
“তুমিই আমার লাইকেন।” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। এমন সময় পিসির কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই নরম গদি আঁটা বিছানায় উঠে বসে সে।
“বলছি মনি অতনুকে জানিয়ে দিয়েছিস তো বিয়েটা করবি না?” অগোছালো ঘরটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“আবার জ্বালাচ্ছে তো!” মনের ভাবনাটা নিজের অজান্তেই বেরিয়ে যায় ঐশীর মুখ থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে হেসে ওঠেন বাসন্তীলতাদেবী। “অতনুর মা বলছিলো তোদের বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে। শরীরটা যা খারাপ দেখলাম ওর। একমাত্র ছেলে..কখন কি হয়ে যায়!”
“ঘটকালি যখন তুমি করেছো। বিয়ে এগোনোর ব্যাপারটাও তুমিই সামলাবে।পিসিকে অবাক করে বলে উঠলো ঐশী।”দেখো এই মাসেই দিনক্ষণ পাও কিনা!”
“উফফ মেয়ের শখ দেখো।” ভাইঝিকে রাগিয়ে দেওয়ার লোভটা ঠিক সামলাতে পারলেন না বাসন্তীলতাদেবী। কিন্তু ফলটা হলো ঠিক উল্টো। বিন্দুমাত্র না রেগে ঐশী পিসির থুতনিটা নাড়িয়ে বলে উঠলো,”শখ তোমারও কম নয় গো! নিজের বিয়ের সময় তুমিও তো নেচেছিলে ধেই ধেই করে। আমার শখ উঠলেই দোষ?”বলে পা বাড়ালো বাইরে।
এমন সময় বাইরে পা ফেলা মাত্র সবিতাদেবীকে দেখে পা দুটো সিমেন্টের মেঝেতে যেন গেঁথে গেলো ওর। বস্তুত সেদিনের পর মায়ের সাথে সামান্য বাক্যালাপটুকুও হয়নী ওর। নিজের বিশ্বাসে আঘাত লাগার দরুন সবিতাদেবী আর কথা বললেনি মেয়ের সাথে, অন্যদিকে নিজের জিদ বজায় রাখতে ঐশীও মায়ের সাথে কথা বলেনি আগ বাড়িয়ে।
“শুনলাম অরিন্দমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তুই কি এই কারণেই সেদিন থানায় গিয়েছিলিস? কোনরকম ভুমিকা ছাড়াই সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠলেন সবিতাদেবী।
প্রত্যুত্তরে জবাব না দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল ঐশী। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল এতদিন ধরে..
“কি হয়েছে মা? বল আমায়।” নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/187280463052385/?app=fbl

©সম্প্রীতি রায়
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here