পারমিতা” পর্ব-২০

0
1766

#পারমিতা
পর্ব ২০
_নীলাভ্র জহির

সন্ধ্যাবেলা।
পারমিতা প্রীতুলকে সঙ্গে নিয়েই রোদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবছে। কথাটা জানতে পেরে সামান্তা কিছুতেই রাজি হল না। প্রীতুলকে জোর করে সে নিজের কাছে রেখে দিলো। সামান্তা বলে দিলো, আগামীকাল আমি ওকে তোর বাসায় রেখে আসবো। চিন্তা করিস না। তুই অফিস থেকে ফিরলে তারপর আমি চলে আসবো। তুই আজকে রোদের সঙ্গে দেখা কর। সবকিছু খুলে বল। তারপর ভালোমন্দ কি হয় আমাকে জানাস।
পারমিতা একা রওনা দিলো। ঘন্টা দেড়েক সময় লাগল রোদের সঙ্গে দেখা হতে। রোদ একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। রেস্টুরেন্টের খোলা আঙিনা সুন্দর লাইটিং। নিচে কাঠের বেঞ্চ পাতা। সেখানে রোদ বসে অপেক্ষা করছে।।পারমিতা যখন ওর সামনে এলো, দেখল গালে হাত দিয়ে নিরীহ ভঙ্গীতে বসে আছে। পারমিতা বলল, অনেক্ষণ অপেক্ষা করালাম।
– আমি এতবার করে লোকেশন জানতে চাইলাম, সেটা আমাকে বললেন না। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম আপনাকে।
– তার দরকার ছিল না। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন।
– এভাবে কেন বলছেন পারমিতা? আমি আপনার জন্য কিছুই করিনি। করার সুযোগ দিলেন কোথায়?
– সুযোগ?
– হ্যাঁ। কই কাছে আসতে দিচ্ছেন? কই আপনাকে জানতে দিচ্ছেন? দূর থেকে মানুষ চাইলেও কিছু করতে পারে না।

পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেলে বসে রইল। রোদ কিছুক্ষণ সময় নিলো নিজেকে শান্ত করতে। ওর মাঝে আজকে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো অস্থিরতা বিরাজ করছে। ছটফট করছে ক্রমাগত। সে হয়তো আজকেই পারমিতাকে প্রপোজ করতে চায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পারমিতা দ্রুত সবকিছু বলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
রোদ বলল, আপনাকে আমি কিছু বলতে চাই।
– তার আগে আমার কথাগুলো আপনার শোনা উচিৎ।
– বলুন?
– একটু সময় দিন আমাকে।
– তাহলে আমার কথাটা আপনি শুনুন?
পারমিতা রোদের চোখের দিকে তাকালো। লাল টকটকে চোখ দুটো দেখে ভয় হল ওর। রোদ হয়তো গতরাতে ঘুমায়নি। নিশ্চয় আজকে কেঁদেছে। নয়তো এমন চোখ হওয়ার কথা নয়।
পারমিতা বলল, আমি আপনাকে আমার নিজের জীবনের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। যে সত্যগুলো আপনি জানেন না। জানলে আমাকে আর এখনকার মতো রেস্পেক্ট নাও দেখাতে পারেন। কারণ কিছু সত্য মানুষকে কেবল দূরেই ঠেলে দেয়। কাছে আনে না।
রোদ অবাক হয়ে পারমিতাকে দেখল। এমন নিষ্পাপ মোমের মতো একটা মেয়ের জীবনে কি এমন সত্য থাকতে পারে?
রোদ জানার জন্য উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। ওর গলায় এসে সবকিছু আটকে যাচ্ছে। চাইলেও কথাগুলো বলতে পারছে না ও।
রোদ বলল, বলুন! চুপ করলেন যে?
পারমিতার বুক ফেটে যেতে লাগল কষ্টে। ওর বুক ভেঙে যাচ্ছে। এমন হলে তো কথাগুলো বলতেই পারবে না ও। সবকিছু এলোমেলো লাগছে ওর।
ওর দিকে তাকিয়ে সাহস করে এগিয়ে এলো রোদ। পারমিতার হাত ধরে বলল, আমি দূরে সরে যাবো না। যত কঠিন সত্যই হোক। আমি শুনতে চাই সেই কথাগুলো। কতটা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আপনি যাচ্ছেন সেগুলো আমার শুনতেই হবে।
রোদের হাতের স্পর্শ পেয়ে পারমিতা ধীরেধীরে স্বস্তি ফিরে এলেও ওর কষ্ট এতে আরও বেড়ে গেল। রোদ ধীরেধীরে ওকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করছে। কিন্তু পারমিতা পণ করেছিল সে কারও প্রেমে পড়বে না। আর কাউকে জীবনে জড়াবে না ও।
পারমিতা রোদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। রোদ বলল, সরি। জানি আমার অধিকার নেই হাত ধরার। এটা আমার জন্য অন্যায়।
– ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন তুলবেন না। আপনি অনেক সৎ একটা মানুষ। আপনার মতো একটা মানুষকে আমি আর ঠকাতে পারছি না।
– মানে!
– আমার জীবনের সত্যগুলো আমি বলতেও পারছি না, লুকাতেও পারছি না।
– আমি তো বললাম যত বড় সত্যই হোক, আমি সহজে নেবো। দূরে সরে যাবো না।
– পারবেন না। সেই সত্যের ভেতর আমি এখনো আছি। বেরিয়ে আসতে পারিনি।

রোদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। রীতিমতো উত্তেজিত গলায় বলল, কি বলতে চান আপনি? সবকিছু আমাকে খোলাখুলি না বললে আমি আর পারছিন না এই প্রেশার নিতে।
– আপনার সঙ্গে আমার সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।
– উচিত অনুচিতের প্রশ্ন কেন আসছে? কি এমন ঘটনা আছে এর ভেতর?
– আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। আমার একটা ছেলে আছে।

রোদ স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের পলক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল ওর। মাথা নিচু করে ফেলল ও। ওকে দেখে মনে হচ্ছে এরকম কঠিন বাক্য ও কখনো কল্পনাও করেনি।
পারমিতার গলা ধরে এলো। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, আমার জীবনে একটা লম্বা গল্প আছে। অনেক দীর্ঘ একটা গল্প। এখন বলে অল্প কথায় আমি শেষ করতে পারবো না। তবে এটুকু বলে রাখি, আমার ছেলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ওকে নিয়ে আপনার জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলাম। আপনি হয়তো ভাবছেন ও আমার বান্ধবীর ছেলে। ও আমারই ছেলে। ওর বাবা ডিভোর্সের পর কখনো যোগাযোগ করেনি আমাদের সঙ্গে। আমার ফ্যামিলিও আমার অস্বীকার করেছে। বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে একা জীবন সংগ্রাম শুরু করি আমি। যেই সংগ্রাম এখনো চলছে। এই জীবনে আপনার মতো এত মহান একজন মানুষকে ঠাঁই দিতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত।

রোদ বেঞ্চিতে বসে পড়েছে। একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে ও। পারমিতা কাঁদছে। রোদ উঠে এসে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে না। স্থির হয়ে বসে আছে। পারমিতার ইচ্ছে করছে যদি এক দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে চলে যেতে পারতো। যদি আর কখনো রোদের সঙ্গে দেখা হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারণ রোদের দেয়া চাকরিতেই সে জীবন চালাচ্ছে। চাকরি ছেড়ে দিলে কী করবে মা ও ছেলে?
রোদকে এভাবে বসে থাকতে দেখে পারমিতা হাতজোড় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। এই বিষয়টা আপনার কাছে লুকানো উচিৎ হয়নি। আমি আপনার কাছে লুকাইনি। আসলে ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলিনি আমি। এত বছর একাই যুদ্ধ করে এসেছি। আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ধীরেধীরে যেভাবে গড়ে উঠছে, আমি ভয় পাচ্ছি। তাই আপনাকে সব বলে দেয়া দরকার মনে করলাম।

পারমিতা বেঞ্চের অন্যপাশে বসে কাঁদছে। অনেক্ষণ সময় কেটে গেল এভাবেই। পারমিতার কান্না থামল না। সেটা যেন আরও বেড়েই গেল। ওকে এখন অনেক অসহায় দেখাচ্ছে। খারাপ লাগছে রোদের। ও উঠে এসে পারমিতার কাছে বসল। পারমিতাকে টেনে নিজের দিকে নেয়ার চেষ্টা করল। ওর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল পারমিতা।
রোদ বলল, আপনার জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে এটা আমি জানতাম না। জানলে আপনাকে কারণে অকারণে হয়তো বিরক্ত করে কষ্ট বাড়িয়ে দিতাম না।
– এখন কি আমাকে ভুলে যাওয়াটাই শ্রেয় নয়?
– না নয়। ভুলে যাওয়াটা সবকিছুর সমাধান নয়। প্রত্যেকটা সমস্যারই একটা সমাধান থাকে। আমি আপনাকে যতটা চিনেছি, আমার কাছে আপনি অনন্য। যে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, সে কতটা পাষাণ আমি জানিনা। জানতেও চাইনা। তবে গল্পটা আমার জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে। আপনার নিজের গল্প।
– আমার গল্পটা আমি কাউকে বলতে চাই না। আমি কারও জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়াতেও চাই না।
– আপনার ছেলে কোথায়?
পারমিতা চমকে উঠে রোদের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে ফেলল। রোদ বলল, কি নাম ওর?
– প্রীতুল।
– কোথায় রেখে এসেছেন?
– আমার বান্ধবী সামান্তার কাছে। সামান্তার বাসায় আছে ও। আমিও ওখানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরলাম।

রোদ চুপ করে রইল। সময় বয়ে যাচ্ছে। ওয়েটার বারবার এসে ঘুরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। খোলা আকাশের নিচে বসে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরে দুজনেরই হালকা লাগছিল। ওয়েটার একবার কাছে এসে ঘুরে যাওয়ার পর রোদ বাধ্য হয়ে কিছু খাবার অর্ডার করল। পারমিতাকে বলল, এদিকে বেসিন আছে। হাতমুখ ধুয়ে আসুন।

পারমিতা হাতমুখ ধুয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রোদকে দেখল। রোদকে অনেক বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এসব কথা পারমিতা নয়, রোদই বলেছে। অপরাধীর মতো চেহারা নিয়ে বসে আছে রোদ। পারমিতা মনেমনে ভাবলো, আজ থেকে রোদ আর আমি শুধু বন্ধু হয়ে থাকবো। ওকে এই প্রস্তাবটা দিতে হবে। তাহলে অন্তত রোদ এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবে।
পারমিতা রোদের পাশে এসে বসল। কোল্ড ড্রিংক্স এসে গেছে। রোদের অনুরোধে ড্রিংক্স তুলে নিলো পারমিতা। এক চুমুক খেয়ে বলল, আমার বিয়ে হয়েছিল যখন আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই। রাসিফ আমাকে পছন্দ করতো। কলেজে যাওয়ার পথে মাঝেমাঝে ওকে দেখতাম। আমার খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমেও আমাকে প্রপোজাল পাঠিয়েছিল। আমি সরাসরি না বলিনি, কারণ ওকে আমারও ভালো লাগত একটু একটু। প্রেম করবো নাকি করবো না এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতাম। রাসিফ আমার ফোন নাম্বার নিয়ে প্রায় প্রতিদিন রাতে ফোন দিতো, টুকিটাকি কথাবার্তা বলতাম। মানুষটার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। যদি জানার পর ধীরেধীরে প্রেমে পড়ে যাই, সেই ভেবে। নিজেকে কন্ট্রোল করেই কথা বলতাম। কিন্তু শান্তি লাগত না। আমার পড়াশোনার প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল। পাশ করে একটা ভালো চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করবো, এটা আমি রাসিফকেও বলেছিলাম। কিন্তু ওর সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ঠিক প্রেম করতে চাইনি। এতকিছুর মধ্যে রাসিফ আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিলো। আমাকে ওর ফ্যামিলি দেখতে এলো। কোনোরকম আয়োজন ছাড়া হুট করে বিয়ে দিয়ে দিলো আমাকে। আম্মুকে এত করে বোঝালাম আমি আগে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। আমাকে সেই সুযোগ দেয়া হল না। রাসিফ সরকারি চাকরি করতো। আব্বু আম্মু ভেবেছিল ওর চেয়ে ভালো পাত্র আর পাবে না। ব্যস, বিয়ে হয়ে গেল। রাসিফকে আমি অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলাম যেন বিয়েটা পিছিয়ে দেয়। রাসিফ বলেছিল, তোমাকে দূরে রাখতে পারবো না। আমার কাছে এসে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আমি হেল্প করবো তোমার স্বপ্ন পূরণে। তোমাকে এতটা যত্নে রাখবো যতটা যত্নে দুনিয়াতে কেউ তোমাকে রাখবে না। রাসিফ কথা রেখেছিল। প্রথম কয়েকটা মাস আমার মনে হয়েছিল আমি স্বর্গে আছি। ও আমার কাপড় পর্যন্ত ধুয়ে দিতো। আমাকে এত ভালবাসত, এত কেয়ার করত, যার কোনো তুলনা হয়না। আমি সবসময় ওকে হারানোর ভয় পেতাম।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পারমিতা। রোদ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। কিছু বলবে কিনা বুঝতে পারল না রোদ। পারমিতা বলল, আমি বিয়ের এক মাস পর থেকে কলেজে যাওয়া শুরু করি। ক্লাস করতাম। রেগুলার ক্লাস করতে পারতাম না। কিন্তু সপ্তাহে দু একদিন ক্লাস করেছি। রাসিফ আমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে যেত। আমি এত সুন্দর বসন্তের মতো সময় পার করেছি তখন।

আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পারমিতা। রোদ বলল, তারপর?
পারমিতা বলল, মানুষ কারণে অকারণে বদলায় এটা শোনে নি? সেও বদলে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই। আমরা ঢাকা শহরে ভালো একটা বাসা নিয়ে থাকি, ওর বাইক আছে। বাইকে করে ও আমাকে কলেজে রেখে আসে। দুজনে বাইরে রেস্টুরেন্টে বসি, খাই, ঘুরি। রাতে খুনসুটি করতে করতে মুভি দেখতাম। সবকিছু খুব সুন্দরভাবে চলতো জানেন? এত সুন্দর! একদিন রাসিফ বাসায় ফিরতে দেরি করল। ওর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। নতুন কিছু বন্ধু হয়েছে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও আবার যোগাযোগ হয়েছে। সবার সঙ্গে বসে আড্ডা দেয়, সিগারেট খায়। একেকদিন একেক জনের সঙ্গে। এভাবে ওর ধীরেধীরে বাসায় দেরিতে আসার প্রবণতা বেড়ে গেল। সেইসাথে আমার সঙ্গে ওর দূরত্বও বাড়তে লাগল। মানে আগে যেমন সকালে আমাকে সুন্দরভাবে বিদায় দিয়ে অফিসে যেত, সারাদিনে বারবার কল দিতো। তখন বিদায়ের সময় কিছু না বলেই চলে যেত। সারাদিন কল দিতো না। আমিই কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতাম খেয়েছে কিনা। ওর এই চেঞ্জ আমার ভালো লাগত না। তবুও ভাবতাম, বিয়ের প্রথম প্রথম সবাই ওরকম রোমান্টিক থাকে। পরে থাকে না, এটাই স্বাভাবিক। মেনে নিলাম। এরমধ্যে একদিন জানতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট। রাসিফ আবার আমার প্রতি যত্নশীল হলো। আমাকে কলেজে যেতে দিলো না। একটা সেমিস্টারে পরীক্ষা দিতে দিলো না। ও বাসায় তারাতাড়ি ফিরত। আমাকে রান্না করে খাওয়াতো। কিন্তু প্রেগ্ন্যাসির চার মাস পার হওয়ার পর আবার শুরু হল ওর দেরিতে বাসায় ফেরা। আবারও ও কেয়ারলেস হয়ে যেতে লাগল। বাসায় রান্নার জন্য বুয়া রাখলো। আমাকে কিছু করতে দিত না, কিন্তু সেও কিছু করে দিতো না আমাকে। আমার ব্যাপারে অনেক উদাসীন ছিল। এই উদাসীনতা বাড়তে বাড়তে অনেক বেড়ে গেল। আমি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তারাতাড়ি ঘুমাতাম। ও সারা রাত জেগে ফেসবুক চালাত, গেমস খেলত। ওর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্কে ফাটল ধরল। সবকিছু ফ্যাকাশে হয়ে যেতে লাগল। আমি ভাবলাম, বাচ্চা হওয়ার পর হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু হল না। বাচ্চা হওয়ার পর আমি বাবুকে নিয়েই সবসময় বিজি থাকতাম। আর ওর সঙ্গে আমার দুরত্ব বাড়তে বাড়তে এত বেড়ে গেল যে..
পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ও আমাকে না জানিয়ে নেশা করা শুরু করে দিয়েছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গাজা টানে, মদ খায়। এই আরকি। এসব বেড়ে গেল একসময়। ও আমার গায়ে হাত তুলেনি কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা দিতো অনেক।

পারমিতা কাঁদছে। রোদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, প্লিজ পারমিতা শক্ত হোন। অতীতককে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না। ভুলে যান প্লিজ। আমি আর শুনতে চাই না। আর আগ্রহ নেই আমার। আপনি এখন যে অবস্থায় আছেন, আমার কাছে সেটাই সবচেয়ে বড়। অতীতটা নয়।
– কিন্তু আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। আপনি সুন্দর, হ্যান্ডসাম। আপনার যোগ্যতা অন্য সবার চাইতে বেশি। আমি আপনার পাশে দাঁড়ানোর মতো যোগ্য নই। ভালো হয় যদি আমরা যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। একে অপরের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলি।
রোদ বলল, দুরত্ব বজায় রাখাটাই একমাত্র সমাধান?
– আর কোনো সমাধান নেই। হতে পারে না। হ্যাঁ, আমরা ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটাও চাই না। কারণ বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ব, আপনি আমার প্রতি হতে পারেন। তখন হঠাৎ দুরত্ব বাড়াতে কষ্ট হবে। দুজনেই কষ্ট পাবো। তারচেয়ে ভালো হয়, আমরা যদি শুধুমাত্র অফিসের সাধারণ পরিচয়ে থাকি। আর কোনো সম্পর্ক আমাদের মধ্যে না থাকে।
রোদ কি উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। সে যদি এখন কিছু বলেও ফেলে, পারমিতা সেটা মেনে নেবে না। উলটো তাকে ভুলভাবে বুঝিয়ে দেবে। তাই রোদ বলল, আপনি খাবারটা খান।
পারমিতা দুই চামচ খাবার মুখে দিয়ে বলল, আমি আজকে যাই। আবার আমাকে নামিয়ে দিতে চাইবেন না প্লিজ। আমি একাই যেতে চাই।
রোদ উঠে দাঁড়াল। পারমিতা ওর অপেক্ষায় না থেকে দ্রুত চলে গেল সেখান থেকে। এইমুহুর্তে ওর ভীষণ একলা থাকা প্রয়োজন। রোদ ওর পাশে থাকে ও আবার জড়িয়ে ধরবে নিশ্চিত। রোদকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here