পারমিতা” পর্ব-৪৫

0
2867

#পারমিতা
পর্ব ৪৫
নীলাভ্র জহির

রোদকে নিয়ে রাসিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পারমিতার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কি হবে এবার?
রাসিফ জানতে চাইল, কেমন আছো পারমিতা?
পারমিতা কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। রাসিফ এখনো তার বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকবে এটা তার কল্পনাতেই ছিলনা। অসহায়ের মতো পারমিতা এদিক-সেদিক তাকায়।
রোদ পারমিতার কাছে জানতে চাইলো, কে উনি?
পারমিতা আর কোন উপায় না দেখে বলল, আপনি ভিতরে যান। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে আসছি। তারপর আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলছি।
রোদ একবার রাসিফের দিকে তাকাল আর একবার পারমিতার দিকে। তারপর মুখ শক্ত করে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। রাসিফ জানতে চাইল, বাহ আজকাল গাড়ী থেকে নামছ। বেশ আরামে আছো মনে হচ্ছে।
– তুমি কি ভেবেছো আমি খুব কষ্টে আছি?
– তাই তো ভেবেছিলাম।
কারো বাইরেটা দেখে কি বোঝা যায় সে আরামে আছে নাকি কষ্টে আছে?
– না, যায় না। যাইহোক আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি। সেটা বলেই চলে যাব।
– প্লিজ বলে ফেলো। আমার তাড়া আছে।
রাসিফ বাঁকা সুরে উত্তর দেয়, কিরকম তাড়া তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দেখো পারমিতা, আমিও অনেক ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলেছি। কিন্তু এখন আর সেটা পারছি না। সেই কখন বেরিয়েছ ওনার গাড়িতে করে। ফিরলেও ওনার গাড়িতে করে। সে আবার তোমাকে হাত ধরে গাড়িতে ওঠায় নামায়। উনার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক তা জেনে আমার কোন কাজ নেই। তা জানার কোন আগ্রহও আমার নেই। আমি শুধু একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি। আমার ছেলে প্রীতুলের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও। অন্তত সপ্তাহে একদিন আমি ওর সঙ্গে দেখা করব। প্রীতুলকে আমি সকালে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আবার বিকেলে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। ওর কোন ক্ষতি হবে না। তুমি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও নয়তো আমাকে অন্য কোন উপায় খুঁজতে হবে।

পারমিতার মনের রাসিফের জন্য যে সহানুভূতি জন্মেছিল আজকে মুহুর্তেই তা দূরীভূত হয়ে গেল। রোদের সঙ্গে তাকে দেখার পর রাসিফ আবারও অতিরিক্ত রিয়েকশন শুরু করেছে। হয়তো হিংসায় নয়তো কষ্টের তাড়নায়।
পারমিতা বলল, আমি রাতে তোমাকে জানাচ্ছি।
রাসিফকে আর এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে দ্রুত পায়ে পারমিতা উপরে উঠে এল। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে তার। দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছে সে। কারণ প্রীতুলকে রাসিফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া মানে আবারও নতুন করে কোন গল্প বোঝাতে হবে। তার বাবা কোথা থেকে এলো, এতদিন কোথায় ছিল এসব প্রীতুলকে বোঝানো অনেক কঠিন হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা রাসিফকে মেনে নেয়ার পর রোদকে পুনরায় বাবা হিসেবে মেনে নিতে পারবে না ও। সবকিছু মানিয়ে নিতে পারমিতাকে অনেক ধকল সইতে হবে।

বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতে পারমিতা বাসায় প্রবেশ করল। রোদ বসে আছে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পারমিতা নিজে থেকে বলল, আপনি যাকে দেখেছেন সে রাসিফ।
চমকে উঠল রোদ। অস্ফুট স্বরে সে বলল, রাসিফ!
– হ্যাঁ, প্রীতুলের বাবা। প্রীতুলের দাবী নিয়ে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে আমি আপনাকে বলতে চাইছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমি বলে উঠতে পারিনি। রাসিফ প্রীতুলের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সপ্তাহে অন্তত একদিন সে ওকে নিয়ে গিয়ে সারাদিন সময় কাটাতে চায়। কয়েকদিন ধরে আমাকে ভীষণ বিরক্ত করছে। কখনো ফোন করে আবার কখনো বাসায় চলে এসে।
রোদ চুপ করে রইলো। তার মুখটা গম্ভীর। পারমিতা সিক্ত গলায় বলল, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কয়েকদিন ধরেই রাসিফকে এভোয়েড করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। আজ সে অনেকটা ধমকের সুরে কথা বলেছে। মনে হচ্ছে কিছুতেই পিছু ছাড়বে না। ভালো ভালোয় প্রীতুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে না দিলে রাসিফ বলেছে অন্য উপায় খুজবে।

রোদ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। পারমিতার কষ্ট হচ্ছে। অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো ওকে। পারমিতা রোদের কাছে হাত জোড় করে বলল, আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি সরি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি রাসিফকে আসতে বলিনি। রাসিফের নাম্বার আমি ব্ল্যাকলিস্টে রেখেছি। আপনি চেক করে দেখুন। ওর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি কথাটা আপনাকে বলতে পারিনি আপনাকে হারানোর ভয়ে। আপনি যদি আমাকে ভুল বোঝেন তাই।

রোদ হাত বাড়িয়ে পারমিতাকে কাছে টেনে নিল। রোদের বুকে লুটিয়ে পড়ল পারমিতা। এবার রোদ বলল, আমি তোমাকে ভুল বুঝতাম না। বরং তুমি যদি রাসিফ যখন তোমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেছে সেদিনই আমার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করতে আমি আরও খুশি হতাম। ও কি শুধু প্রীতুলের দাবি নিয়ে এসেছে নাকি তোমাকেও তার জীবনে ফিরে পেতে চায়?

পারমিতা চমকে উঠলেও উত্তর দেয়, শুধু প্রীতুলকে। আমি বলেছি কিছুতেই আমি প্রীতুলের সঙ্গে তার দেখা করিয়ে দিবো না। তাইও বাধ্য হয়ে বলেছে অন্তত সপ্তাহে একদিন হলেও ও প্রীতুলের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। যে মানুষটা আমাদেরকে এভাবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এত বছর আমরা কত কষ্টে কাটিয়েছি তার কোন খোঁজ নেয় নি, সে কখনো প্রীতুলের বাবার অধিকার পেতে পারে না। আমি ওকে সেই অধিকার দেবো না।

রোদ বললো, দেখো পারমিতা রাসিফ অন্যায় করেছে সত্যি। কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্যি হলো আইন অনুযায়ী রাসিফ তোমার সন্তানের বাবা। তাকে প্রীতুলের সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দেয়া উচিত। তারপর প্রীতুল নিজেই ঠিক করে নেবে সে রাসিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় নাকি চায় না।

পারমিতা অনেকক্ষণ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল রোদের দিকে। সে প্রীতুলের দিক থেকে কখনো ভাবেনি।
রোদ বলল, পারমিতা প্রীতুল এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। তুমি ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বল। তার বাবার অতীতের সমস্ত ঘটনা এবং বর্তমানে তার বাবার চরিত্র কেমন সবকিছুই তাকে খুলে বল। যদিও সবটা তাকে বলা সম্ভব নয় যতটুকু বলা সম্ভব ততটুকুই বল। প্রীতুল নিজেই ভালো-মন্দ বিচার করতে পারবে। বাবার সঙ্গে সে দেখা করতে চায় কিনা সেটা প্রীতুল নিজেই ঠিক করুক। দেখা হওয়ার পর রাসিফকে প্রীতুলের কেমন লাগে সেটাও একটা দেখার বিষয়। প্রীতুলকে আমি চিনি। ও কখনই তোমাকে ছেড়ে রাসিফের সঙ্গে গিয়ে থাকবে না। ওকে হারানোর ভয় তুমি পেও না।

পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি বলছ রোদ? এত বছরেও আমি আমার ছেলেকে চিনতে পারিনি আর তুমি চিনে ফেললে? আমি তো মা। আমি জানি। বাচ্চারা একটু লোভ পেলেই সবকিছু ভুলে যায়।
– সবকিছু ভুলে যায়। কিন্তু মাকে নয়। তুমি ওর মা। তুমি প্রীতুলকে বোঝাও তাকে কত কষ্ট করে তুমি এত বড় করেছ। প্রীতুলের এসব জানা দরকার।
– ও তো ছোট মানুষ।
– বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সবকিছু খুলে বলার দরকার নেই। ওর বয়সী একটা বাচ্চা যতোটুকু বুঝবে ততটুকুই তুমি তাকে বোঝাও। প্রয়োজনে আমি প্রীতুলের সঙ্গে কথা বলব।

কিন্তু সবকিছু জানার পর প্রীতুল আমাকে খারাপ ভাববে না তো? তখন তোমাকে বাবা হিসেবে মেনে নিতে ওর কষ্ট হবে না তো?
-সেটা সময় বলে দিবে। যেহেতু পরিস্থিতিতে আমাদের কোন হাত ছিল না। ভবিষ্যতেও আমরা দুজন দুজনকে ছেড়ে আলাদা হতে চাই না।

পারমিতা রোদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। রোদ সবসময় তাকে খুব বোঝে। এমন একটা মানুষকেই তার জীবনে অনেক প্রয়োজন ছিল। পারমিতার চোখের জল মুছে দিয়ে রোদ বলল, এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি আর যাব না। আজকে থেকে যাব।
– থেকে যাও।
– থেকে গেলে তো সামলাতে পারবে না।
কথাটা বলেই রোদ পারমিতার মুখ ধরে গভীরভাবে চুমু খেলো।

লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো পারমিতা। রোদ পারমিতার রক্তিম দুই গালে আলতো করে কামড় দিতে লাগল। পারমিতার দুই ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে আদরের চুম্বন করতে লাগলো। এক অনন্ত সুখের জোয়ারে ভাসতে শুরু করল পারমিতা। রোদ পারমিতাকে কোলে তুলে নিল। তারপর রুমে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল তাকে। ছোট ছোট আলতো আদরে পারমিতাকে ভরিয়ে দিতে লাগলো রোদ। কেঁপে উঠতে লাগলো পারমিতা।
রোদকে থামিয়ে দিয়ে পারমিতা বলল, প্লিজ আজ আর নয় ।
রোদ বলল, আচ্ছা, তুমি যা বলবে তাই হবে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে। তুমি শুধু আমার। তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের মাঝখানে কেউ এলে তাকে উপরে ফেলে দিব।
পারমিতা হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে এখন আমার সিনেমার হিরো মনে হচ্ছে।
– আমাকে তোমার জীবনের হিরো বানিয়ে নাও। কথাটা বলেই আবারও পারমিতার বুকে মাথা ডুবিয়ে দিলো রোদ। উষ্ণ আবেশে চোখ বুজে ফেললো পারমিতা।

রাত নেমে এসেছে । সামান্তা প্রীতুলকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলেছে রোদ। রোদের কথা শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি পারমিতা । প্রীতুল এইটুকু বুঝেছে, রাসিফ তার বাবা । সে যখন ছোট ছিল রাসিফ তখন তাদেরকে ছেড়ে দূরে হারিয়ে যায়। চোর-পুলিশ খেলার মত। কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার পর সে আর ফিরে আসেনি। জীবনের খেলায় মানুষ অনেক দেরিতে ফেরে। রাসিফ ফিরেছে এত বছর পর। কিন্তু এত দিনে পারমিতা ভেবেছিল রাসিফ আর কখনো ফিরবে না। কারণ জীবনের গল্প থেকে কেউ হারিয়ে গেলে তারা আর কখনো ফিরে আসেনা । তাই নতুন করে রোদ ও পারমিতা জীবন বাধতে শুরু করেছে। তারপর হঠাৎ করেই ফিরে এসেছে রাসিফ । এখন প্রীতুলের দুইজন বাবা । একজন তার আগের বাবা, আর একজন তার এখনকার বাবা। যে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে ।
প্রীতুল রোদের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি আমার ভালো বাবা রোদ । ওই বাবাটা খারাপ বাবা । আমি উনাকে বলব আমি ওনাকে পছন্দ করিনা । যে মানুষ এতদিন আমাদেরকে ছেড়ে দূরে লুকিয়ে থাকতে পারে আমি তাকে কেন পছন্দ করব ?

প্রীতুলের কথা শুনে পারমিতা আস্থা ফিরে পায়। রোদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ওর মনটা ভরে ওঠে।

রাত এগারোটা ।
পারমিতা রাসিফকে কল দিয়ে পরের দিন দেখা করতে বলল। এর বেশি কথা বাড়াতে চায় নি পারমিতা। ফোন কেটে দিয়ে সে কল দিল রোদের নাম্বারে।
রোদ বলল, আম্মু বলেছে যত দ্রুত সম্ভব শুভ কাজটা সেরে ফেলতে।
হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল পারমিতার। চোখ ভিজে উঠতে লাগলো।
বলল, আর কি বলেছেন উনি ?
বলেছে , মেয়েটা অনেক একা । একটা আপনজনের বড়ই অভাব ওর । তখন আমি বলেছি, কে বলেছে ওর আপন জনের অভাব। আমিতো আছি । আর এখন থেকে তুমি ওর আপনজন। তখন মা উদাস গলায় বলল, ঠিক বলেছিস। মেয়েটার জন্য আমার মনটা কেমন যেন করছে। একটা সাধারণ ব্যাপার শেয়ার করার মত কেউ নাই। আহারে এত লক্ষী মেয়ে টা।
পারমিতা বলল, মা সত্যি সত্যিই এসব বলেছেন নাকি তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ।
– কি আজব? বানিয়ে বানিয়ে বলব কেন? মা সত্যিই এসব বলেছে। এখন বল শুভ কাজটা কবে সেরে ফেলতে চাও।
আমি আগে আগামীকাল রাসিফের সঙ্গে দেখা করব। তারপর এটা নিয়ে ভাব্বো রোদ। রাসিফ যেন আমার সন্তানকে কেড়ে না নেয়, শুধু সেটাই চাই মনেপ্রাণে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here