পারমিতা” পর্ব-৪৪

0
1890

#পারমিতা
পর্ব ৪৪
নীলাভ্র জহির

নিজের বাসায় এসে পারমিতাকে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাল রোদ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেটা খেয়াল করলেন রোদের মা। পারমিতা হঠাৎ মাথা তুলে সেদিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হল। মা সেই মুহূর্তে জানালা থেকে সরে এলেন। রোদের হাত ছেড়ে দিলো পারমিতা। এমনিতেই সে দুশ্চিন্তায় ভীষন নার্ভাস বোধ করছে। তাকে দেখার পর রোদের মায়ের রিয়েকশন কেমন হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা, আর অন্যদিকে রাসিফ তাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে কোন উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে কিনা সেটাও ভাবতে হচ্ছে পারমিতাকে। ভেতর থেকে পরিবর্তন এসেছে রাসিফের মাঝে। সে এখন কোন আজেবাজে কাজ করবেনা সত্য, কিন্তু তবুও সেই পুরনো সিমপ্যাথি রাসিফের জন্য মনের কোণে একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। সেই জায়গাটিতে নিজ দায়িত্বে তারা খুঁচিয়ে যেতে লাগলো।

ঝকঝকে বিশালাকার একটি বাড়ি। ভেতরে প্রবেশ করে পারমিতার চোখ কপালে উঠে গেল। নানা রকম বিদেশী কারুকার্যে ঠাসা। রোদের মা নিঃসন্দেহে একজন সৌখিন মহিলা। পুরো বাড়িটাকে তিনি রাজমহল বানিয়ে রেখেছেন।
রোদ পারমিতাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেল। এসি রুমে বসেও ঘামতে শুরু করেছে পারমিতা। মনে হচ্ছে সে একটা চাকরির ইন্টারভিউতে এসেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই রাজমহল টাই হবে তার শ্বশুর বাড়ি। অস্বস্তি হচ্ছে পারমিতার। এমন সময় রোদ তার মাকে নিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল।
পারমিতা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাড়িয়ে সালাম জানালো ওনাকে। মুখে হাসি টেনে এনে পারমিতাকে বসতে বললেন রোদের মা। বাইরে থেকে দেখে ওনাকে এতটা অভিজাত মনে হয়নি। সামনাসামনি দেখতে তিনি ভীষণ অভিজাত এবং বিলাসী। পরনে কারুকার্য খচিত দামি শাড়ি। গলায় স্বর্ণের একটি চেইন ঝলমল করছে। দুই হাত খালি। তবে উনার চেহারায় লুকিয়ে থাকা এক ধরনের গাম্ভীর্যতা উনাকে অনেক উচ্চমাত্রা দান করেছে।
মহিলা জানতে চাইলেন কেমন আছো?
হাসিমুখে উত্তর দেয় পারমিতা, জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– এইতো আছি। বসো। তোমার ছেলে কোথায়? ওকে নিয়ে আসো নি যে।
পারমিতা বিব্রতবোধ করল। এই প্রথম কোথাও কেউ তাকে এমন প্রশ্ন করেছে। আড়চোখে একপলক রোদের দিকে তাকালো পারমিতা। রোদ তার মায়ের পাশে বসে সহাস্যে বলল, ওর একটা বান্ধবী আছে মা। ও নিয়ে গেছে ওকে।
মহিলা জানতে চাইলেন অফিসে গেলে বাচ্চাটাকে কোথায় রেখে যাও? বান্ধবীর কাছে?
পারমিতা মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, বাসায় দেখাশোনা করার জন্য লোক আছে। মাঝে মাঝে ডে কেয়ারে রেখে আসি। রেগুলার স্কুলে যায় তো। কোনো সমস্যা হয় না।
মহিলা বললেন, নিশ্চয়ই কোনো দিন অফিসে ওকে নিয়ে যাওনি।
– না,
– হুম বুঝলাম ।
মহিলা এমনভাবে মাথা ঝাঁকালেন যেন তিনি বোঝাতে চাইছেন প্রীতুলকে অফিসে না নিয়ে যাওয়ার কারণেই তার ছেলে পারমিতার প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এভাবেই ছেলেদের মাথা খাও, ওনার মাথা ঝাঁকানোর ধরনটা সেটাই বলে দিচ্ছে।
পারমিতা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আড়চোখে আরও একবার ওদের দিকে তাকালো। রোদ তার মাকে আলগোছে জড়িয়ে ধরে। আকারে-ইঙ্গিতে সে এটাই বুঝাতে চায় যেন পারমিতাকে এ ধরণের প্রশ্ন না করা হয়। মহিলা বেশ বুঝতে পারলেন রোদ মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে। তিনি বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি একটু আসছি।
পারমিতা উত্তর দিল, আন্টি আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
– তাই নাকি। আরো অনেক কথা বাকি আছে। কিছুক্ষণ বসো। রেস্ট নাও। এত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। তুমি চাকরির পরীক্ষা দিতে আসেনি।
কথাটা বলেই মহিলা উঠে ভেতরের দিকে গেলেন। রোদ ছুটে এল পারমিতার কাছে। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে সোফায় বসে থাকা পারমিতার হাত ধরে বলল, প্লিজ কিছু মনে করো না। মা একটু রাগী। তবে কিছুক্ষণ কথা বললেই দেখবে সব রাগ ভ্যানিশ। তুমি স্ট্রং থাকো।
পারমিতা কঠিন গলায় বলল, নিজের বাড়িতে এসেও এত আদিখ্যেতা না করলেই কি নয়? আপনি আমাকে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়েছেন সেটা দেখেই আপনার মা অনেক রেগে গেছে । কোন মা তার ছেলেকে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পছন্দ করেনা। ছেলের বউয়ের সঙ্গে ও নয়। আপনি দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকুন। হয়তো আপনারই আদিখ্যেতার কারণেই দেখবেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।

রোদ হতভম্ব হয়ে পারমিতার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে উঠে গিয়ে দূরে একটি সোফায় গিয়ে বসল। মোবাইল বের করে ফেসবুক চালাতে ঢুকে গেল সে।

রোদের মা দুই গ্লাস ঠাণ্ডা শরবত নিয়ে প্রবেশ করলেন। পারমিতা বলল, এত কষ্ট করার কোন দরকার ছিল না আন্টি।
– দরকার ছিল। পরে আবার আমার ছেলে বলবে তোমাকে কিছু না খাইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সে তো তোমাকে ছাড়া কিছু বোঝেনা। তোমার অযত্ন হলে তো চলবে না।
রোদ পারমিতার দিকে তাকালো। পারমিতার কথাটাই তার এখন সত্যি মনে হচ্ছে।
রোদ ঢকঢক করে এক গ্লাস সরবত খেয়ে বলল, তোমরা কথা বলো আমি একটু রুমে যাচ্ছি।
পারমিতার দিকে সে একটিবারও তাকালোনা অবধি। ছুটে নিজের রুমে চলে গেল। পারমিতা হাসিমুখে আন্টিকে বলল, ধন্যবাদ আন্টি।
শরবত খেয়ে হাসি মুখে বসে রইল পারমিতা।
আন্টি জানতে চাইলেন, তোমার বাবা মা কেমন আছেন?
– তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছেন মহিলা। তিনি জানতে চাইলেন, যোগাযোগ রাখো নি কেন?
– কারণটা কিছুটা ব্যক্তিগত।
– ও আচ্ছা।
পারমিতার মনে হল কারনটা লুকিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এতে করে আন্টি তাকে আরো ভুল বুঝবেন। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে পারমিতা বলল, আসলে আমার ডিভোর্সের পর যখন আমি বাসায় গিয়েছিলাম তখন মা আমাকে ও প্রীতুলকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রীতুল তখন অনেক ছোট। বাবা-মা কেউই আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রয়োজন বোধ আমি করিনি। এত বছরে তারা যে চেষ্টা করেনি তা নয়। আসলে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।
আন্টি বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশিদিন রাগ করে থেকো না। হয়তো রাগের বশে তারা তোমাকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু মা বাবা তো। তাদের মনটা তোমার জন্য পোড়ে।
– মনটা তো আমারও পুড়ছে আন্টি। স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন আমি ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নেই, তখন আমার বাবা-মা এক মুহূর্তের জন্য আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেনি। তাতে আমার কোন কষ্ট নেই। বরং আমার কষ্ট এখানেই যে, একটা ছোট্ট বাচ্চা সহ মা কিভাবে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। কোন মহিলা কি একটা মেয়ের প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারে। ছোট্ট একটা শিশু সহ একটা অসহায় মেয়েকে রাস্তায় বের করে দেয়া।

মহিলা আর কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না। ওনার মনটা কিছুটা নরম হলো মনে হচ্ছে। বললেন, সেই ছেলেটা তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি? ছেলের দাবি করেনি?
– করেছে। দাবি করাটাই তো স্বাভাবিক। আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি কি করব? আমার এমন কোন আপনজন নেই যার সঙ্গে কথাটা শেয়ার করলে তিনি আমাকে ভালো কোন পরামর্শ দিবেন। কোন গুরুজন নেই আমার।
এই কথাটায় বেশ কাজ হলো মনে হচ্ছে। মহিলা পারমিতার কাছাকাছি এসে বসলেন। নরম গলায় বললেন, মন খারাপ করো না। আল্লাহ সব সময় যা করেন আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন।
পারমিতা বেশ চমকে উঠলো। আন্টির গলার স্বর নরম হয়ে উঠেছে। ভেতরে এক ধরনের শান্তি পেল পারমিতা। আন্টি বললেন, আমি টেবিলে নাস্তা দিতে বলি।
– না, না আন্টি। এত ব্যস্ত হতে হবে না।
– ব্যস্ত হচ্ছি না তো। আমি সব কিছু রেডি করে রেখেছি। নাজমা কে বলি টেবিলে দিতে।
আন্টি ভেতরে চলে গেলেন। পারমিতা স্থির হয়ে বসে রইল। না চাইতেও চোখ চলে গেল পুরো ঘরের দিকে। অভিজাত রুচিশীল সাজসজ্জা মন হরণ করছে পারমিতার।
খাবার টেবিলে এসে পারমিতার চক্ষু চড়কগাছ। পুরো টেবিলজুড়ে নানান রকমের খাবার। আন্টি বললেন, সব আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। এখানকার প্রত্যেকটা খাবার আমার ছেলের পছন্দের। ভাবলাম ওর পছন্দের খাবারগুলো তোমাকে তৈরি করে খাওয়াই।
পারমিতার চোখে-মুখে ফুটে উঠল নিবিড় আন্তরিকতা। সে মুগ্ধ চোখে আন্টির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভীষণ ভালো। উনি যতটা বলে আপনি তার চাইতেও বেশি ভালো।
– তাই নাকি। তাহলে আমার ছেলে কি আমার সম্পর্কে আরও কম ভালোর কথা বলে?
পারমিতা ভড়কে গেলেও হেসে উঠলেন তিনি। হেসে ফেললো পারমিতা নিজেও। রোদ খাবারের টেবিলে এসে অবাক হয়ে বলল, একি মা! এত কিছু কেন করেছো?
– ভাবলাম পারমিতাকে খাওয়াই তোর সব পছন্দের খাবার।
– সেটা দেখেই তো আমার ভয় করছে মা।
– কেন রে?
– সব পছন্দের খাবার একদিনে খাওয়াতে চাও মানে পারমিতা আর কখনো না আসুক তুমি কি সেটাই চাও।
মা হতভম্ব হয়ে বললেন ধুর বোকা ছেলে। বিষয়টা কি এমন হতে পারে না, তোর সব পছন্দের খাবার পারমিতাকে খাইয়ে বুঝাতে চাইছি আমার ছেলের পছন্দকে আমি কতটা মূল্যায়ন করি।
রোদ উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জানি মা। তুমি তো আমার লক্ষী মা। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা।
– হয়েছে হয়েছে। এই মেয়েটার জন্য যখন আমার সঙ্গে রাগ করে দুইদিন কথা বলিস নি তখন এসব মাথায় আসেনি।
– মা এই মেয়েটাও তো পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো একটা মেয়ে। তার জন্য এইটুকু রাগ তো করাই যায়।
– তাই বলে মায়ের সঙ্গে রাগ,?
– সেদিন রাগ না করলে আজকে কি এত খাবার সাজিয়ে টেবিল ভড়াতে তুমি।
কথাটা শুনেই মা রোদের কান মুচড়ে দিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, খেতে বস। পারমিতা নিশ্চিন্ত বোধ করল। মায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার খুব ভালো লাগছে। বুকে চেপে থাকা ভার কমে গেছে।
নাস্তা শেষ হলে মা একটা ছবির অ্যালবাম নিয়ে এসে বসলেন। পুরোটা অ্যালবামের প্রত্যেকটা ছবি ধীরে ধীরে পারমিতাকে দেখালেন তিনি। ছবির পিছনের গল্পগুলো বলতে লাগলেন। কোন কোন গল্প বলতে গিয়ে তার চোখ ভিজে উঠতে লাগলো। রোদকে তিনি অসম্ভব ভালবাসেন সেটা বুঝতে পারছে পারমিতা। পারমিতার ইচ্ছে করলো আন্টির হাত চেপে ধরে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলতে , আপনার ছেলেকে আমি অনেক যত্নে রাখবো।

মা পারমিতাকে রোদের ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন। পিছুপিছু গেল রোদ। ভিডিও কলে রোদের বিছানাটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল পারমিতার। পুরো ঘরের সৌন্দর্য দেখে সে ভীষণ অবাক হল। মা আলমারির দরজা খোলার সময় রোদ পারমিতার কানে ফিসফিস করে বলল, এই ঘরটা তোমার। খুব শীঘ্রই তুমি এই ঘরে ঘুমাবে।

পারমিতা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মা পারমিতাকে বললেন, আরেকদিন তোমার ছেলেকেও নিয়ে এসো।
পারমিতা ও রোদ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পারমিতা। রোদ তাকে বাসায় নামিয়ে দিতে এসেছে। দুজনের মনটা আজ ভীষণ খুশি খুশি। কিন্তু সেই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পারমিতা আর বাসার সামনে গাড়ি থেকে নামতেই রাসিফ দুজনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here