#পারমিতা
পর্ব ৩৬
নীলাভ্র জহির
– চুপ করে আছেন কেন? আপনি কি অন্য কারও কাছে দায়বদ্ধ?
– না। একদিন তোমার ফোনে আমার নাম্বার থেকে একজন মেসেজ পাঠিয়েছিল মনে আছে?
– কে পাঠিয়েছিল সেটা আমাকে বলেননি।
– বলিনি। কিন্তু আজকে সেটা বলতেই হবে। আমাকে ছুঁয়ে বলো এটা শোনার পর তুমি আমার লাইফ থেকে সরে যাবে না তো?
পারমিতা চমকে উঠলো। কে থাকতে পারে রোদের জীবনে? রোদেরও কি কোনো অতীত আছে? যার কারণে রোদ এতটা বিগলিত গলায় কথা বলছে। পারমিতাকে হারানোর ভয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ওর কণ্ঠে। কে পাঠিয়েছিল সেই মেসেজ!
পারমিতার চোখে অসংখ্য প্রশ্ন পড়তে পারলো রোদ। ও বলল- আমাকে ভুল বুঝবে না প্লিজ। আগে কথা দাও তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাব্বে না?
পারমিতা চুপ করে রইলো। তার অতীত শুনে রোদ সরে যায় নি। সেও কখনো কঠিন কোনো অতীতের কথা শুনে সরে যাবে না। সরে যাওয়াটাকে স্বার্থপরতা বলে। এতটা স্বার্থপরতা পারমিতা করবে না। কিন্তু এর বাইরে আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। যদি পারে, সেটা কি!
রোদ পারমিতার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো।
– পারমিতা। আমি তোমাকে বলতে চেয়েও পারিনি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। মুখ ফুটে তোমার কাছে এ কথা বলতে পারতাম না।
– এত ভূমিকা না করে প্লিজ বলে ফেলুন। আমি যেকোনো বিষয় খুব সহজে গ্রহণ করতে পারি। আমার সেই অভ্যাস আছে। আপনি বলুন।
– পারমিতা, মেসেজটা আমার মা পাঠিয়েছেন।
অনেক অবাক হলেও পারমিতা বিস্ময় প্রকাশ করলো না। অস্ফুটে কি বলল রোদ সেটা বুঝতে পারল না। মাথা নিচু করে আছে রোদ। পারমিতার বিষয়টা অনুমান করতে সময় লাগল না। ওরা বড়লোক। সেখানে পারমিতার ক্লাসের একটা মেয়েকে ছেলের বউ করতে ওনার আপত্তি থাকতেই পারে। আর তাছাড়া পারমিতার অতীতের ব্যাপারে জেনেও তিনি বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। তাই হয়তো চান না পারমিতা ছেলের জীবনে থাকুক। চুপিসারে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
রোদ বলল, আম্মুকে আমি সবকিছু খুলে বলেছিলাম। আমার সামনে কোনো রিয়েক্ট করেনি। শুধু বলেছিল, বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখ বাবা। এছাড়া আর একটা কথাও হয়নি। তোমার ব্যাপারে ভালো ভালো যত কথা আছে সব বলেছি। প্রীতুলের কথাও বলেছি। আমি ভেবেছিলাম মায়ের মানতে খারাপ লাগলেও আমার পছন্দকে বাঁধা দেবে না। কিন্তু আমাকে না জানিয়েই মা আমার ফোন থেকে তোমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন। মেসেজটা ডিলিটও করে দিয়েছেন। বিশ্বাস করো এটা আমিই প্রথমে ভেবে অবাক হয়েছিলাম। যেদিন তুমি বললে মেসেজের কথা, সেদিনই বাসায় ফিরে অনেক ভেবেচিন্তেও উদ্ধার করতে পারিনি। আমার ফোনের পাসওয়ার্ড শুধু মা জানে। আর এমন কেউ নেই যে জানে, আর আমার বাসায় বা আমার রুমে তেমন কেউ আসেও না। মাকে সন্দেহ করতে আমার খারাপ লেগেছিল। তবুও মা’র মুখোমুখি হই। নরম স্বরে জানতে চাইললাম, পারমিতাকে তোমার পছন্দ নয় আমাকে বললেই পারতে।
মা অকপটে স্বীকার করে নিলেন। বললেন, বাবা আমি তোর ভালো চাই। তোর জীবনে একটা হাসিখুশি মেয়ে আসুক, যে তোকে ভালবাসা আর হাসি আনন্দে ভরিয়ে রাখবে। আরও যা যা বলা দরকার। আমি মাকে অনেক বুঝিয়েছি। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই, এটা মা আগে থেকেই জানতেন। ভাবতেন একদিন বুঝবো। সেদিন হয়তো এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসবো। মা এখনো চান না আমি আমাদের স্ট্যাটাসের বাইরে গিয়ে বিয়ে করি। বাবা ম্যানেজার আংকেলকে বলেছিলেন শুনে মা ভয়ানক রেগে গেছিলেন। বাবাও মাকে বলেছেন, রোদ যাকে বিয়ে করতে চায় করুক না। মা তো মহিলা মানুষ। এত ব্রডলি চিন্তা করতে পারছেন না। সমাজের কাছে কী জবাব দেবে, এইসব নিয়ে ভাবছে। তাই তোমাকে আমার সঙ্গে বাসায় গিয়ে মার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তুমি পরিচিত হলে মার ভুল ভেঙে যাবে। উনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন, আমি তোমার সঙ্গে ভালো থাকবো।
পারমিতা স্তব্ধ হয়ে সব কথা শুনলো। তারপর ম্লান হেসে বলল, আপনি অনেক সাধাসিধা একটা ছেলে সেটা কি আপনি জানেন? অনেক সরল মন আপনার।
– কিভাবে বুঝলে?
– অন্য কোনো ছেলে হলে এইসব কথা আমাকে বলতো না। মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সবকিছু আড়ালেই মিটিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু আপনি বলে দিলেন। তাও এ টু জেড সবকিছু। তাই বলছি আপনি অনেক সরল।
রোদ থমকে গেল। কয়েক মুহুর্ত পারমিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে আমি আমারই একটা অংশ ভাবি। তাই সবকিছু বলেছি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। অপমানিত বোধ কোরো না। আমি তোমাকে সবসময় আমার বুকে আগলে রাখবো। যত ঝড় আসুক না কেন।
– কিন্তু আমাকে দেখার পরও যদি আপনার মা রাজি না হন?
– হবেন। আমার মন বলছে হবেন। আমি মাকে বারবার বোঝাবো। তবুও যদি না বোঝেন তাহলে কিছু করার নেই।
– কিছু করার নেই? আমরা তাহলে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবো?
– না। আমরা বিয়ে করবো। বাবার মত আছে। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে করে আমরা নিজেদের মতো থাকবো। আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। কিছুদিন গেলে মা ঠিকই আমাকে মেনে নেবেন।
– কিন্তু আমি নির্ভেজাল একটা জীবন চেয়েছিলাম রোদ। আবারও জীবনে একটা ঝড় আসবে, বিয়ে করেও সুখী হবো না আমরা। একই বাড়িতে থাকলেও শাশুড়ী আমাকে পছন্দ করবেন না। এইসব মেনে বাকি জীবন পার করতে হবে।
– পারমিতা, জীবনটাকে এত জটিল করে ভাবছো কেন? সবাই কি বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে পারে? বা সবারই কি ভালবাসাকে বাসা থেকে মেনে নেয়? তবুও সবাই ভালবেসে ঘর বাঁধে।
– আমাদের ভালবাসা সেই পর্যায়ে যায় নি। বা এখনো নেই।
আতংকে মুখ নীল হয়ে গেল রোদের। এই ভয়টাই পাচ্ছিল রোদ। পারমিতাকে হারানোর ভয়। পারমিতার দূরে সরে যাওয়ার ভয়। কঠিন স্বরে কথাগুলো সহজভাবেই বলেছে পারমিতা। ওর জন্য সবকিছু সহজ। কিন্তু রোদের জন্য নয়। তার ভাঙাচোরা জীবনে পারমিতার স্পর্শ ভীষণ প্রয়োজন।
রোদ গম্ভীর মুখে বলল, জানতাম এমনটাই হবে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম পারমিতা।
– আপনার মায়ের অমতে গিয়ে আমরা সুখী হবো না।
– আমার আসলেই ভুল হয়েছে কথাগুলো বলে দেয়াটা। তোমার কথাই ঠিক। আমি সরল। না না সরল নই। আমি বোকা। বোকা না হলে কেউ এসব বলে? অন্য কেউ হলে কখনোই বলত না। মায়ের সঙ্গে চুপিচুপি আলাপ করিয়ে দিতো। আমি সেটা করিনি। কারণ আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে তুমি কষ্ট পাও সেটা চাইনি। আমি চাই তুমি ভালবেসে আমার সঙ্গে থাকো। আমার মতো করে সবকিছু করো।
পারমিতা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ভীষণ মানসিক চাপ অনুভূত হচ্ছে। রোদকে নিয়ে ওর এই দ্বিধাদ্বন্দ আর ভালো লাগছে না ওর। উঠে এক দৌড়ে রুমে চলে এলো পারমিতা। রোদ বসে রইল স্তব্ধ হয়ে। এইমুহুর্তে ওর বুক ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে ওর।
রুমে এসে বালিশ বুকে চেপে শুয়ে রইল পারমিতা। ওর হু হু করে কান্না আসছে। কেন এই কান্না ও জানেনা। এখনো রোদকে ও পুরোপুরি ভালবাসতে পেরেছে কিনা সেই দ্বিধা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ভালবাসা থাকলে কি এত সহজে অভিমান আসে? ভালবাসা থাকলে কি এত সহজে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা যায়? ভালবাসা নয়, এটা ভালবাসা নয়। তাহলে রোদের জন্য কষ্ট, রোদের জন্য ব্যকুলতা এসবের নাম কি?
পারমিতা শুয়ে রইল। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেছে ও জানেনা। রাত বোধহয় অনেক। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া নেই কোনো সাড়াশব্দ। নির্জনতা বিরাজ করছে চারপাশে। পারমিতা শুয়েই আছে।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। রোদের গলা শোনা গেল, পারমিতা..
পারমিতা আস্তে আস্তে উঠে এলো। মুখ ধুয়ে এসে দএজা খুলে দিলো ও। রোদ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ হাসিহাসি। কিছুক্ষণ আগে পারমিতা ওকে কষ্ট দিয়েছে সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই।
রোদ বলল, বারবিকিউ বানাচ্ছে আমাদের জন্য। দেখবে?
পারমিতা উত্তর দিলো, হুম
– আসো।
দরজা আটকে দিয়ে বাইরে এলো ওরা। নিঝুম রাত। একটু পরপর সুন্দর আলো টিমটিম করে জ্বলছে। রোদ ও পারমিতা হাঁটছে পাশাপাশি। সরু একটা রাস্তা। ইট দিয়ে বাঁধানো। দুপাশে গাছের সাড়ি। দু একটা জোনাকি দেখা যায় দূরে। এতটাই নির্জনতা যে ভয় পেতে হয়। ওরা হাঁটছে আর পায়ের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
রোদ দূরে একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বলল, ওইযে ওইটা রেস্টুরেন্ট। কত ওপরে দেখেছ?
– আমরা ওখানে যাবো?
– যেতে চাও?
– না।
– সকালে ওখানে নাস্তা করবো। রুমে খাবার দিতে বলেছিলাম তাই রেস্টুরেন্টে যাইনি। রেস্টুরেন্ট দূরে অনেক। তোমার যেতে কষ্ট হবে।
– আমি কি একবারও বুঝিয়েছি আমার কিসে কষ্ট হয়?
– হ্যাঁ অনেকবার বুঝিয়েছো।
পারমিতা উত্তর দিলো না। রোদের এই স্বাভাবিক কথাবার্তা দেখে অবাক হচ্ছে ও। হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গায় চলে এলো ওরা। সেখানে বেশ কয়েকজন লোকজন জড়ো হয়েছে। বড় একটা টিনের বাক্সে বারবিকিউ হচ্ছে। আশেপাশে ঘিরে আছে কয়েকজন। সবাই দুজন দুজন করে। প্রত্যেকের মুখ হাসিহাসি। যেন ওরা এইমুহুর্তে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারও কোনো দুঃখ নেই।।মেয়েরা ছেলেদের হাত ধরে আছে। কেউ আবার রোমান্টিক গল্পে মুখর। কারও আবার বারবিকিউ নিয়ে হাসি তামাশা। পারমিতার সেখানে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগল।
রোদ এসে হৈ হুল্লোড় করে বলতে লাগল, মামা কদ্দুর?
বেয়ারা উত্তর দিলো, আপনারটা এখনো তুলি নাই। আপনি আসলে মাখাবো ভাবছিলাম।
– মাখান। পারমিতা, এদিকে আসো।
বেয়ারা ওদের সামনেই একটা আস্ত মুরগীর মাংস সাইজ করে সেখানে মশলা মাখাতে শুরু করল। মসলার আর বারবিকিউ এর ঘ্রাণে চারপাশ মুখর। এরমধ্যে দুজন ছেলে আবার গান ধরেছে।
পারমিতার মন ভালো হতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে মিলে গান গাচ্ছে রোদও। গানের সঙ্গে মুখে লেগে আছে হাসি। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি। পারমিতা অবাক হল। রোদের সহ্যক্ষমতা ওকে অবাক করছে। আগুনের আঁচে রোদকে ভয়াবহ মিষ্টি লাগছে দেখতে।
বাকিরা হাত তালি দিচ্ছে। নির্জনতারা নেই এখানে। সবাই মুখরিত গানে উল্লাসে। রোদ পারমিতাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসালো। বারবিকিউ হচ্ছে। পাশেই ওরা চেয়ার নিয়ে বসে গান ধরেছে। মুহুর্তটা দ্রুত সুন্দর হয়ে উঠল। পারমিতা এখন হাসছে। দু একজন একটু পরপর জোকস বলছিল। সেসব শুনে হাসি পাচ্ছিল ওর।
বারবিকিউ সেখানেই বসে খেল সবাই। দারুণ মজা হয়েছে খেতে। খাওয়ার ফাঁকে চললো আড্ডা। সবার সঙ্গে পরিচিত হল রোদ। তারা দুজন এমনভাবে সেখানে রইল যেন ওরা স্বামী স্ত্রী। পারমিতাও রোদের সঙ্গে সেভাবেই হেসে হেসে কথা বলে যাচ্ছিল। আড্ডা শেষে ফেরার পথে রোদ জিজ্ঞেস করল, নিঝুম আর আফতাবের জুটিটাকে ভালো লেগেছে। ওরা এত মিশুক, এত সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং দুজনের মধ্যে।
– হুম। আমার অবশ্য ফারিয়াদেরকে বেশি ভালো লেগেছে।
– ফারিয়া মেয়েটা ঝগড়াটে।
– ঝগড়াটে হলেও ওরা খুব হ্যাপী।
– কে হ্যাপি সেটা কি কারও মুখ দেখে বলা যায়? আমাদেরকে দেখেও ওদের মনে হতে পারে আমরা অনেক হ্যাপি। কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা দুজন দুজনের থেকে ভিন্ন। আমাদের মাঝে প্রেম নেই। নেই কোনো ভালবাসা। আমরা এখানে কেন আছি তাও জানিনা।
পারমিতা থমকে দাঁড়াল।
রোদ বলল, কি হল?
উচ্চস্বরে পারমিতা বলল, ভুল বলেছেন। আমি আপনাকে ভালবাসি। অনেক অনেক ভালবাসি।
– কী বললে!
– আমি আপনাকে ভালবাসি।
– আরেকবার বলো!
– আমি আপনাকে ভালবাসি রোদ।
এক দৌড়ে রোদ ছুটে এসে পারমিতাকে কোলে তুলে নিলো। কোলে নিয়ে উল্লাসের সঙ্গে বলল, I love you..
পারমিতা রোদের গলা জড়িয়ে ধরল। প্রশান্তিতে বুক ভরে যাচ্ছে ওর। আর কোনো দ্বিধা নেই। রোদকে সে সত্যিই ভালবাসে। পারমিতাকে কোলে নিয়েই রোদ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
পারমিতা কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
চলবে..
আগের সবগুলো পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=641896073477694&id=100029719223370