শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি
(৬)
নয়নের মাথা হ-য-ব-র-ল! চক্কর দিচ্ছে বারে বারে। এটা কী শুনলো সে! শিমুল কী সত্যি বলছে নাকি এটাও তার চক্রান্তের একটা অংশ? নয়ন দেয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে চুপচাপ ভাবতে লাগল। শিমুলের এক কথায় একদম বিশ্বাস করে ফেলবে- তা হয় না। অন্তত এতবড় ধোঁকা খাওয়ার পর বিশ্বাস নামক জিনিসটাই ফিঁকে হয়ে গেছে তার কাছে। কিন্তু যদি খবরটা সত্যই হয়, তবুও শিমুলকে এই সংসারে রাখার কোনো সিদ্ধান্ত সে নেবে না। বাচ্চা হবে, বাচ্চাকে নিজের কাছে এনে রাখবে। শিমুলের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। মা ছাড়া কী বাচ্চা বড় হয় না? হয়… তার বাচ্চাও না হয় মা ছাড়াই বড় হবে। কথায় আছে, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। সেরকমই, শিমুলের কাছে থাকার চাইতে মা ছাড়া বেড়ে ওঠাই ভালো। শিমুলের নষ্ট মানসিকতা তারই সন্তান বহন করে- এমনটা তো স্বপ্নেও কল্পনা করে না নয়ন!
হঠাৎ একটা আচানক ভাবনা খেলে গেল শূন্য মগজের ভেতর। যতদূর মনে পড়ে, বিয়ের পর মাত্র দুইবার শিমুলের কাছে গিয়েছিল সে। আর দুইবারই যথাসম্ভব প্রটেকশন নিয়ে গিয়েছিল। তাহলে বাচ্চাটা আসলো কোথাথেকে! এর মানে শিমুল মিথ্যে বলছে? আর আজকেই একেবারে জেনে গেল যে সে প্রেগন্যান্ট? নয়ন হাঁফ ছাড়ল। একটা মানুষ এত নিচে কীভাবে নামতে পারে! তাও এই যুগে এসে- বাস্তবে না দেখলে নয়ন কোনোদিন বিশ্বাস করতো বলে মনে হয় না।
বাহিরে ঝিঁঝিঁ পোকার তীব্র হৈচৈ। নয়নের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো। সে উঠে গেল জানালা আঁটকে দিতে। তখন গিয়ে চোখ পড়ল বাহিরে, খোলা বারান্দায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুঠোফোনে কথা বলছে সম্ভবত। আর এই কেউ একটা যে শিমুল, নয়ন স্পষ্ট বুঝতে পারল। এত রাতে কার সঙ্গে কথা বলছে শিমুল? তার পরিবারের কেউ? নয়নের খটকা লাগে।
.
“তুমি না বলেছিলে,কিছু হবে না? তাহলে এখন আমি প্রেগন্যান্ট কী করে হলাম? নিশ্চয়ই আকাশ থেকে বাচ্চাটা আসেনি!”
কম্পিত গলায় বলে উঠল শিমুল। রাগে তার গা কাঁপছে। ফোনের ওপাশ থেকে আগন্তুক হেসে উঠে কটাক্ষ করে বলল,
“বাচ্চাটা তোমার হাজবেন্ডেরও তো হতে পারে। আমাকেই দোষ দিচ্ছো কেন?”
“না,ওর না। আমাদের ভেতর এখনো বেবি নেওয়ার কোনো প্ল্যান হয়নি। আর বিয়েই তো হলো ক’দিন যাবত। আমি শিউর,এটা তোমারই বাচ্চা।”
“একতরফা দোষ দিও না তো। তুমি কী দোষী নও?”
“আহা, আমি সেকথা কখন বললাম! আমি শুধু জানতে চাইলাম যে তুমি শিউরিটি দিয়েছিলে, তারপরও আমি প্রেগন্যান্ট।”
“তাতে কী? এবরশন করাতে চাও? টাকা লাগলে বলো, দেই।”
শিমুল ক্যাটক্যাট করে বলল,
“তোমার টাকার গরম আমার ভালো লাগে না। এই কারণে তোমার সাথে আমার বনেনি। শোনো, এই বাচ্চা নষ্ট হবে না। ও জন্ম নেবে আর পিতৃ পরিচয়ে পাবে নেহালের। বুঝেছো?”
“মানে কী! তোমার হাজবেন্ডের নাম না নয়ন?”
শিমুল হাসল।
“তুমি এখনো বোঝোনি? তোমার মতো ধনবান ব্যক্তি রেখে আমি কেন এই জঞ্জালে এসে পড়লাম,তা এখনো বোঝোনি তুমি?”
ওপাশে নিরবতা। কয়েক সেকেন্ডের থম ধরা নিরবতা শেষে আগন্তুকের উত্তর,
“তোমার মতো মেয়ে আমি আগে দেখেনি। তুমি আসলেই একটা চিজ! এরকম মেয়েও যে বাস্তবে হয়, ভাবতেই পারছি না।”
“হয় হয়, খুঁজলে হাজারটা পাওয়া যাবে। কিন্তু খোঁজে কয়জন? এই যেমন, আমাকে দেখলেই কেউ ভাববে না, আমি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানি। বাট ইউ নো… আমি মাছের কাটা সুদ্ধ খেতে জানি! হা হা হা।”
শিমুল হেসে উঠল। তবে সবটাই চাপা স্বরে। রাত অনেক, এত রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এই ভেবেই সে বাহিরে এসেছে কথা বলার জন্য,যাতে কেউ শুনতে না পায়। তাদের ঘর গুলো ছোট ছোট এবং একটার সঙ্গে অন্যটা লাগানো। তাই একটু জোরে কথা বললেই অন্য রুমে সেই আওয়াজ চলে যায়।
আগন্তুক বলল,
“ভাগ্য ভালো, তোমার মতো মেয়ে আমার লাইফে বউ হয়ে আসেনি। নয়তো গেছিলাম। তুমি বেড পার্টনার হিসেবেই পারফেক্ট।”
“মাইন্ড করলাম কিন্তু! ইনসাল্ট করছো?”
“আরে না! যাকগে, বাদ দাও। রাখছি আমি। আর শোনো, তোমার দাওয়াত থাকবে।”
“কীসের?”
“আমার বিয়ের। হাজবেন্ড সহ এসো।”
“বাহ! বিয়ে অবধি পানি গড়িয়ে গেছে?”
“ওমা, তুমি বিয়ে করে ফেলতে পারলে আর আমি পারব না?”
শিমুল সেই কথার জবাব না দিয়ে হেসে বলল,
“আসবো।”
“রাখছি তবে।”
“ওকে।”
কল কেটে গেল। বাতাসে কিছু উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মিশিয়ে দিয়ে পেটের উপর আলতো ভাবে হাতটা রাখল সে। অনুভব করার চেষ্টা করল কিছু। তারপর বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করল,
“তুই আমার একমাত্র টোপ সোনা। আর এই টোপে শুধু নয়নই না, সবাই ফাঁসবে। একদম কারেক্ট টাইমে এসেছিস তুই।”
“আমিও একদম সঠিক সময়ে এসে গেছি। নইলে অনেক কিছু মিস করতাম!”
শিমুল ঝটকা খেয়ে পেছন ঘুরল। আরেকটু হলে টাল হারিয়ে পড়েই যেতো,পাশের খাম্বা ধরে নিজেকে সামলালো। চেয়ে রইলো সামনে হাসিমুখে দাঁড়ানো নয়নের দিকে। শিমুলের মস্তিষ্ক মুহূর্তেই ফাঁকা বনে গেল। সে ভুলে গিয়েছিল,এটা স্টার জলসার সিরিয়াল না যে,ভিলেন সেজে যা ইচ্ছে করবে আর সফল হবে একের পর এক, কেউ তাকে ধরতে পারবে না! এটা বাস্তবতা। এখানে অতি চালাকের গলায় দড়ি!
শ্বাস ঘন হয়ে গেল শিমুলের। নয়ন এরপর ঠিক কী কী করবে ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো। ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। নয়নের সামনে, পায়ের কাছটায় বসে পড়ল কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে। এবার অভিনয় নয়, সত্যি…
নয়ন জীবনে কোনোদিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি খারাপ দৃষ্টি নিয়ে। সবসময় মেয়েদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এসেছে। যার মন যত পরিষ্কার, লাইফে ধোঁকা ও বাঁশ তার জন্য ততই ফ্রি! এটাই চরম সত্য! নয়ন এগিয়ে এলো। ঝুঁকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঠাটিয়ে চড় লাগালো শিমুলের গালে। শিমুলের কান ঝিনঝিন করে উঠল। চোখেমুখে তারা দেখতে পেল সে। ঠিক কতক্ষণ পর কে জানে, সে শুনতে পেল নয়ন বলছে,
“আগামীকাল, আগামীকাল সকালের পর এই বাড়িতে তোর ছায়াটাও যেন না দেখি। নইলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”
শিমুল মাথা কাত করল। এখান থেকে ভালোয় ভালোয় বাঁচতে পারলেই হলো। আগামীতে ভাবা যাবে কী করা যায়। নয়ন খেঁকিয়ে বলল,
“ঘরে যা।”
শিমুল পড়িমরি করে ছুটলো। বাতাসে ঘন ঘন কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে চোখ ভেঙে কান্না করে ফেলল নয়ন। এসব আর সহ্য করতে পারছে না সে। জীবনে কী এমন ভুল করেছিল যার জন্য এতবড় খেসারত দিতে হচ্ছে! নিজের আঙুল নিজেই মুখে নিয়ে কামড়ালো। চোখ ডলে ডলে মুছে আকাশপানে তাকিয়ে আবার কেঁদে ফেলল। বিধাতার উপর বড় অভিযোগ হচ্ছে… কেন তার সাথেই এমন হলো!
.
জয়নাল এসেছেন। বসে আছেন নেহালের পাশে। নেহাল চোখ খুলেছে। সে চোখ খুলেই সবার আগে কুসুমকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কুসুম হাসপাতালে নেই। তাই অতিদ্রুত বাড়ি ফিরতে চায় সে। কুসুমের কাছে ক্ষমা চাইবে। উত্তেজনার মাথায় বড় ভুল করে ফেলেছে সে। নিজেকে হত্যা করার কথা ভেবেছে। অথচ একবারও ভাবেনি, কুসুমের কী হবে! এত বড় ঝটকাটা ও সইতে পারবে কী-না। নেহালের কারণে কুসুমের জীবনও বিপন্ন হতে পারতো। এখন হুশ ফিরে এসেছে এসব বিষয়ে। জয়নাল বারংবার নেহালের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলো। এও জানাল, নেহালকে সে আগে থেকে চিনত না। আর জানত না যে এর সঙ্গেই শিমুলের সম্পর্ক ছিল। জানলে শিমুল কখনোই এই বাড়ির বউ হয়ে আসতো না। জয়নালের রাগ শুধু শিমুলের উপরই না, তার বাবা-মায়েরও উপর। তারা তো জানতো সবকিছু, তারপরও জয়নালকে জানায়নি। আর এখানেই সম্বন্ধ করেছে! শিমুলকে মানাও করেনি। এখন যে সম্মান নিয়ে টানাটানি হলো, এর দায়ভার কার? জয়নাল ফোঁস ফোঁস করছে। নেহালকে রিলিজ দেওয়া হলে তার সঙ্গে বাসায় পৌঁছালো সে। শিমুল ভাইকে দেখামাত্র বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জয়নাল যমের মতোন। অন্যায় পছন্দ করে না। সবসময় নিয়ম-নৈতিকতার ভেতর থাকে। অন্যকেও রাখে। অপরদিকে শিমুল যেন পুরোই আলাদা। জয়নালকে পাঠানো হলো শিমুলের ঘরে। শিমুল বসে ছিল। ভাইকে দেখে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। জয়নাল অগ্নি চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো শুধু। তারপর গমগমে কণ্ঠটি নাড়িয়ে ‘রেডি হ’ বলে বেরিয়ে গেল। শিমুলের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল ঘামফোঁটা গড়িয়ে পড়ল। কপালে শনিই না, রবি, সোম, মঙ্গল সব আছে। বাসায় যাওয়া মাত্রই শুরু হয়ে যাবে!
শিমুল আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলল।
নেহাল ঘরে ঢুকেছে। সারা বাড়ি খুঁজেও কোথাও কুসুমকে পায়নি। দুরুদুরু বুক নিয়ে তাদের রুমে শেষবার এসে ঢুকল, যদি এখানেও না থাকে নেহাল হার্ট অ্যাটাক করবে সত্যি সত্যি। রুমটা ফাঁকা। উজ্জ্বল রোদে ঝকঝক করছে ঘরের মেঝে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সুন্দর আবহাওয়া। নেহালের কাছে তাও ভালো লাগছে না কারণ কুসুম এখানেও নেই! বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল সে। কুসুম কী তবে চলে গেল তাকে ফেলে? কাউকে কী জিজ্ঞেস করবে একটাবার কুসুমের কথা? নেহালের অভিমান হচ্ছে। নিজের উপর ক্ষুব্ধ সে। কেন ফাঁদে পা দিতে গিয়েছিল শিমুলের! কেন মাথায় আসলো না পরবর্তীতে কী হতে পারে এই নিয়ে। তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে। তা হলো, নেহালের আত্মশুদ্ধি। আর এও বুঝতে পেরেছে, কুসুম তার কতখানি! কুসুমকে ছাড়া দুটো দিনই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সারাজীবন কী করে বাঁচবে! কিন্তু কোথায় কুসুম?
নেহাল অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চোখ বোলাতে গিয়ে টেবিলের উপর নজর আঁটকে গেল। একটা কাগজ ফরফর করে উড়ছে। মগ দিয়ে চাপা দেওয়া নইলে উড়েই চলে যেতো। নেহালের আগ্রহ জাগে। সে উঠে গিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলো। প্রথম লাইন পড়তেই অধরে ফুঁটে উঠল হাসি। তাহলে কুসুম তাকে চিঠি লিখেছে!
(চলবে)
[আমি এই ক’দিন সিরিয়াস অসুস্থ ছিলাম। এখনো আছি। প্রথমে ভেবেছিলাম কোভিড আক্রান্ত হলাম কী-না। ডক্টরের পরামর্শ নিয়েছি। ডক্টর আশ্বস্ত করেছে,কোভিড না,আবহাওয়ার বদলে এরকমটা হচ্ছে। যাইহোক, আমি ৩ দিন যাবত একটু একটু লিখে একটা পার্ট লিখেছি। আগামী পর্ব পরশুদিন দিবো কেমন? একদিনে লিখা সম্ভব না। আমার জন্য সবাই একটু দোয়া করবেন।]