তৃষ্ণা
পর্ব ১৮
মিশু মনি
.
ভাতের দোকানদারের সাথে এক লোকের ঝগড়া লেগে গেছে। লোকটা ভাতে চুল পেয়ে কিছু একটা বলেছিলো, তাই নিয়ে মহিলা ও তার স্বামীর সাথে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেলো। মহিলার যুক্তি, ভাতে দুই একটা চুল পাওয়া যাইতেই পারে। কিন্তু লোকটা মানতে নারাজ। এই ঝগড়া চললো অনেক্ষণ ভর। অংশী পাশে বসে নিরবে দেখে যাচ্ছে এই অদ্ভুত শহরের মানুষদের। কারো কাছে এতটুকু স্নেহ মমতা আছে বলে মনে হয় না। সবার চাহনি নির্মম, কঠিন। দু একজন এমনভাবে অংশীর দিকে তাকায় যে অংশীর লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিতে হয়। এরই মধ্যে এক লোক অংশীর পাশে দাঁড়িয়ে প্যান্টের উপর দিয়ে নিজের যৌনাঙ্গে হাত বুলাচ্ছিলো আর লোলুপ দৃষ্টিতে অংশীর দিকে তাকাচ্ছিলো। লজ্জায়, ঘৃণায় চোখ নামিয়ে নেয় অংশী। আজ নিজেকে নর্দমার তুচ্ছ কীট ব্যতীত আর কিছুই ভাবার অবকাশ নেই।
ধীরেধীরে এই অদ্ভুত শহরে সন্ধ্যা নামলো। রাস্তায় জ্বলে উঠলো হলুদ বাতি। হলুদ আলোয় কিছুক্ষণ আগের চেনা সবকিছুও কেমন অচেনা হয়ে উঠলো অংশীর কাছে। দোকানী সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অংশী।
এক লোক এসে অংশীর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি রে যাবি নাকি? কত?’
অংশী বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কতক্ষণ করতে দিস? তোর শরীর যা দূর্বল, খুশি করতে পারবি তো? এক হাজার দিমু, যাবি?’
অংশী চোখ পিটপিট করলো কয়েকবার। লোকটা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বোবা নাকি? রেট কত কস না ক্যান?’
ধমক শুনে দোকানী মহিলা ছুটে এসে উদ্ধার করে অংশীকে। অংশীর হাত ধরে পাশে টেনে এনে বলে, ‘মাইয়া চুপ কইরা হুনতাছো ক্যান? হুনতে ভাল্লাগে? জবাব দিবার পারো না? উরাধুরা গাইল দিবা। বদমাইশ তোমারে খারাপ মাইয়া পোলা ভাবছে।’
অংশী হা করে তাকিয়ে রইলো। খারাপ মাইয়া পোলা বলতে কি বোঝাচ্ছে বুঝতে পারলো না। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় মহিলার মুখটাকে জল্লাদের মত ভয়ংকর দেখাচ্ছিলো। ভয় করতে লাগলো অংশীর। মহিলা ওকে নিয়ে অবশেষে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলো।
বস্তিতে ঢুকে বমি আসার উপক্রম হলো অংশীর। বিশ্রী রকমের নোংরা সব জায়গায়। যেখানে সেখানে ময়লার স্তুপ পড়ে আছে, ভকভক করে গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। উপরে উড়ছে মাছি। কয়েকটা ড্রেনের সংযোগ স্থলে পায়খানার চেয়েও বেশি দূর্গন্ধ। তারই পাশের প্লাস্টিকের ঘরে থাকে মানুষজন। সেসব পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অংশী। জীবনের নতুন অধ্যায়ে এসে জগতকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে। হলুদ আলোয় দেখতে পাচ্ছে কিছু মহিলা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে আর পাশেই ঝগড়া করছে দুজন পুরুষ মহিলা। এই শীতেও খালি গায়ে প্যান্ট পরে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই অংশীর মনে পড়ে গেলো, রাতে ঘুমাবে কি করে? ঘরের ব্যবস্থা নাহয় করা গেলো, কিন্তু রাত্রিবেলা ভীষণ কুয়াশা পড়ে। কোনো জামাকাপড় নেই, কাঁথা কম্বল নেই, তার উপর একা। কিভাবে ঘুম আসবে অংশীর? ক্লান্ত শরীরটাকে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে অংশীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিলো। মনে হলো এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। মাহিবের প্রতি মন থেকে অভিশাপ জন্মাচ্ছে অংশীর। ঘৃণায় মাহিবকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এরকম নরকের মত জীবনে কেন পতিত হতে হলো? একটুখানি আবেগ আজ জীবনটাকে কোন পর্যায়ে টেনে নিয়ে এসেছে তা ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট। সেইসাথে মাহিবের প্রতি জন্ম নিচ্ছে আকাশ সম ঘৃণা।
টিনের ঘরগুলো পেরিয়ে একটা হাফ বিল্ডিং ঘরের সামনে এসে পৌঁছল দোকানী মহিলা। চাচী বলে সম্বোধন করে একজনকে ডাকতে লাগলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক মধ্যবয়সী মহিলা। অংশীর দিকে এক পলক তাকিয়েই সে জানতে চাইলো, ‘আইজ এত তারাতাড়ি ফিরলা যে?’
– ‘এই যে মেহমান আনছি। ওনার একটা ঘর লাগবো।’
– ‘একা মাইয়া? বাপ মা কই? ভাতার নাই?’
অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দোকানী অংশীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উত্তর দেও। সওয়ামী নাই? বাপ মা নাই?’
অংশী কি বলবে ভেবে পেলো না। ডুকরে কান্না আসতে চাইলো ওর। নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদেই ফেললো। দোকানী মহিলাটি অংশীর কান্না দেখে কি বুঝলো কে জানে। বললো, ‘চাচী, হ্যার মনেহয় কেউ নাই। গ্রাম থাইকা পলাইয়া আইছে মনে হইতাছে। এতকিছু জাইনা কি করবা? তোমার বারাটিয়া দরকার, তুমি হ্যারে রাখো। পনেরশো টেহাই দিবো।’
মহিলা বললো, ‘ঘর দেইখবা না? আহো আমার লগে।’
অংশী নির্বাক ভঙ্গিতে মহিলার সাথে হাঁটতে লাগলো। মহিলা একটা ঘরের তালা খুলে ভিতরে ঢুকে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে অংশীকে রুম দেখাতে লাগলো। ভীষণ মশা মাছি উড়ছে ঘরে। পাকা মেঝেতে ধুলাবালি জমে আছে। মহিলা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কেউ নাই না? কামের লাইগা ঢাহা আইছো?’
অংশী মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বললো। মহিলার দয়া হলো অংশীর প্রতি। আফসোস করে বললো, ‘আহারে কি সুন্দরী মাইয়াডা। চিন্তা কইরো না, আমার মেলা পরিচিতি আছে। কাইল পশশু তোমারে গার্মেসে নিয়া যামু। চাকরির ব্যবস্থা কইরা দিমু চিন্তা কইরো না। আমারে কিন্তু পাঁশশো টেকা দেওন লাগবো।’
অংশী গার্মেস শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলো না। কিন্তু মহিলার কথা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে গার্মেস কোনো কাজের জায়গার নাম। ও কৃতজ্ঞতায় মহিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘টেকা দিমু চাচী, আমারে একটা কাম জোগাড় কইরা দেন। আমার কেউ নাই। বাপ মা নাই।’
কথাটা বলতে গিয়ে নিজেকে আর আটকাতে পারলো না অংশী। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। অন্ধকার ঘরে মশার ভনভনানির মাঝে নিজেকেও মশা মাছির মত মনে হচ্ছিলো ওর। কাঁদতে গিয়েও এখন কাঁদতে পারছে না। বোধহয় কাঁদতে কাঁদতে চোখ ক্লান্ত হয়ে গেছে।
মহিলা অংশীর প্রতি দয়াবান হলো। অংশীর মায়াবী মুখ দেখে বুকটা ভরে গেছে তার। অংশীকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘কাইন্দো না। আইজ রাইতে আমার এইহানে ভাত খাইয়ো। আর থাকবা কিসে? চকিও নাই, বিছনাও নাই, কম্বলও তো নাই তোমার।’
কথাটা বলে ওনার মনে হলো ঘর ভাড়ার টাকা দিতে পারবে তো? টাকা না দিলে তো মিছে মায়া দেখিয়ে লাভ নেই। একটা ঘর অযথা ফেলা রাখার মানেই হয় না। চিন্তিত মুখে বললো, ‘এহন আমারে পনেরশো টেহা দিয়া ঘরে উইঠ্যা যাও।’
অংশী ওড়নার কোণা থেকে গিট খুলে টাকাগুলো বের করলো। মহিলা উপুর হয়ে দেখতে লাগলো কত টাকা আছে অংশীর কাছে। অংশী গুণে গুণে দুই হাজার টাকা দিয়ে বললো, ‘এইটা রাইখা দেন।’
মহিলার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। অংশীকে আরেকবার জাপটে ধরে আনন্দ প্রকাশ করলো সে। তারপর বললো, ‘একটা লাইট কিইনা দিতাছি তোমারে।’
অংশীর শরীরে কোনো শক্তি ছিলো না। ও অন্ধকার ঘরের মেঝেতে বসে রইলো। কোলাহল পূর্ণ এই শহরের আজব পরিবেশে নিজেকে অন্য কোনো জগতের প্রাণী মনে হচ্ছিলো ওর। বেদনার চোখে আর জলে নেই। আর কান্না আসছে না। চোখে জ্বালা হচ্ছে, শরীরে জ্বালা হচ্ছে। প্রস্রাবের চাপ দিচ্ছে ভীষণ। টয়লেট কোথায় জানেনা বলে যাবার কথাও মুখে আনলো না। সমস্ত কষ্ট চেপে রাখতে গিয়ে কেবলই মনে হতে লাগলো, ‘যে মানুষটা আমারে এই ভয়ানক অবস্থায় ফেইলা দিছে, সে সুখে থাউক। আল্লাহ তারে ভালো রাখুক।’
জীবনটা আমাদের স্বপ্নের মত হয় না। চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো অংশী। নিষ্ঠুর শহরে পা দিতেই বুঝে গেছে জীবনকে আমরা যেরকম ভাবি জীবন সেরকম নয়। এটা কঠিনের চেয়েও কঠিনতর কিছু। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মানুষের নিষ্ঠুরতা, সমস্ত অভিজ্ঞতা আজ জীবন সম্পর্কে এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, কোনো মেয়ে যেন এমন ভুল না করে। নিজের জীবন জীবনের মতই সুন্দর। মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে একটা জীবন ধ্বংস করে দেয়ার কোনো মানেই হয় না।
রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর প্রয়োজন দেখা দিলো বিশেষভাবে। মহিলা দুটো কাঁথা ও একটা শীতল পাটি দিলো অংশীকে। শীতল পাটি মেঝেতে বিছিয়ে কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো অংশী। আজ থেকে এই ঘরেই থাকতে হবে ওকে। রাত বাড়লেও শহরের কোলাহল কমছে না, যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে। চিৎকার, হৈ চৈ, গাড়ির হর্ন সবকিছুর মাঝেও ক্লান্ত শরীরে ঘুম এসে গেলো অংশীর। কিন্তু কোনো পাশেই শুতে পারছিলো না। গায়ে ভীষণ ব্যথা। মায়ের পেয়ারার ডাল দিয়ে মারার দৃশ্য মনে হতেই অংশী ভাবলো, আমার জন্মদাত্রী মা ও আমাকে ভালোবাসতো না। সবসময় রাগারাগি করতো। জীবনের ভয়াবহতা স্মরণ করতে করতে একসময় ঘুমে ঢলে পড়লো অংশী।
২০
লোহায় আঘাত করলে যেমন ঝনঝন শব্দ হয়, সেরকম শব্দ হচ্ছে। ঝালাই করার ঝিঁঝিঁ শব্দ কানে আসছে। লোকজনের কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচি। ঘুমের ঘোরে এসব কানে আসছিলো অংশীর। ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করলো এই বদ্ধ ঘরে। ঘুম ভাঙার পর শরীর অনেকটা ঝরঝরে লাগছে। কিন্তু ঘুমের মাঝেও একটা সুক্ষ্ম ভোঁতা যন্ত্রণা ভেতরে ভেতরে বয়ে চলছিলো। অংশী কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলো মাহিব ওর পাশে নেই। সকাল সকাল মাহিবকে মনে পড়তেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। কেমন একটা যন্ত্রণা যেন। মাহিব নেই, কোথাও নেই। মাহিবের সাথে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এসব ভেবে কষ্ট বাড়তে লাগলো অংশীর। চিৎকার করে উঠলো মনটা, মাহিবের নাম ধরে।
মেঝেতে উঠে বসলো অংশী। হৃদয়ে আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মাহিবকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও পারতো না অংশী। সেই মাহিব আজ নেই, পাশে নেই, দূরেও নেই, কোথাও নেই। এমন সময় গা ঘুলিয়ে উঠলো অংশীর। বমি আসতে লাগলো। দরজার সামনে এসে ভকভক করে বমি করে ফেললো। দূর থেকে কয়েকজন মহিলা অংশীর বমি করা দেখছে আর কিসব বলাবলি করছে। সেদিকে কর্ণপাত না করে ঘরে এসে মেঝেতে বসলো অংশী। পেটের উপর হাত রেখে চাপা কণ্ঠে বললো, ‘সোনা রে, তুই আমারে এত কষ্ট দিতাছস ক্যান?’
কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। উঠতে হবে, একটা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, একটা কাজের খোঁজে যেতে হবে। এই শরীর নিয়ে চলাফেরা করার শক্তিও পাচ্ছে না অংশী। তবুও যেতে হবে। কেউ ঘরে এসে খাবার দিয়ে যাবে না। এ শহরে কেউ নেই মেয়েটার, কেউ না।
চলবে..