একটুখানি
#লামিয়া চৌঃ
পর্ব: ২
কুহু লাগেজ নিয়ে এগিয়ে যায় ট্রেনের দরজার দিকে। একটু একটু করে সামনে এগুতেই দেখে কুহুর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। কুহু তার বাবাকে দেখেই হাসি মুখে আব্বু বলে কিছুটা জোরেই ডাকে। কুহুর বাবা ট্রেনের দরজার কাছে এসেই মেয়ের লাগেজটা হাতে নিয়ে নামিয়ে রাখে। তারপর হাত ধরে কুহুকে নামতে সাহায্য করে।
এক হাতে লাগেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর আরেক হাতে মেয়ের হাত ধরে স্টেশনের বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছেন কুহুর বাবা। রিকশায় বসেই কুহুকে তিনি বললেন,
– আমার বড় কলিজাটাকে কতদিন পর দেখলাম।
– কেনো তোমার ছোট কলিজাটা ছিল না তোমার চোখের সামনে?
– বড় কলিজাটা তো আর ছিল না।
– আমাকে দিয়ে আর কি দরকার তোমার?তোমার আদরের মেয়ে পিহু তো আছেই।
– তোকে আমি আরো বেশি আদর করি।
– দাহা মিথ্যা! রাস্তা পর্যন্ত কাঁপা শুরু করে দিয়েছে তোমার কথা শুনে।
– হাহ্হাহা। আচ্ছা এবার বল লিপি তোকে আদর করেছে তো? কেমন লেগেছে সেখানে?
– ছোট ফুফি অনেক আদর করেছেন। আর ফুফাকে তো চিনোই তুমি আব্বু। ফুফার মতো ভালো মানুষই নেই এখনকার যুগে।
– তা ঠিক বলেছিস।
– আর প্রিয়র সাথে জম্পেস আড্ডা দিয়েছি।
– হুম প্রিয়র সাথে তো তোর সেই ছোটকাল থেকেই কি দারুণ জমে।
– খুব ভালো লেগেছে।
– হুম বারো দিন তো বেরিয়ে আসলি এখন পড়াশুনায় মন দে। নেশনালে পড়ছিস দেখ ট্রাই করে বিসিএস হলেও হতে পারে।
– উহু এতদূর ভাবছ কেনো? সময় আছে আরো অনেক। মাত্র তো অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনালটা দিলাম। আর চিন্তা করো না তো ইংরেজীতে পড়ছি তো চাকরি না পেলেও টিউশনি অন্তত করতে পারবো।
– হুম একদম ডিপেনডেন্ট হবি না কারো উপর। আজকালকার ছেলেরা যা খারাপ হয়!
..
কুহু রিকশা থেকে নেমেই এগুলো বাড়ির দিকে। দোতালা বাড়ি। বাইরের দেয়ালে কিছুটা শ্যাওলা পড়ে আছে। নীচ তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন আর দুতালার একটা ফ্ল্যাটে থাকে কুহুরা আর অপর ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে তিনটা ব্যাচেলর ছেলে। কুহুদের ফ্ল্যাটে দুইটা ব্যাডরুম। একটায় থাকে মা- বাবা আর অপরটায় কুহু আর পিহু। ড্রয়িংরুমে অবশ্য তোশক ফেলে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে কুহু। সেখানে মেহমান এলে থাকতে পারে। কুহু কলিংবেল চাপতেই কুহুর মা দরজা খুলে দেয় আর কুহু মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আম্মু!
– আমার মেয়েটা কেমন আছে? বেড়াতে গেলে তো ভুলেই যাস মায়ের কথা।
– মোটেও ভুলিনি বরং তুমি কোথাও বেড়াতে গেলে আমাদের কথা ভুলে যাও।
– মা মেয়ের আবার শুরু হয়েছে।
– তুমি যখন তোমার ছোট মেয়েকে নিয়ে এমন করো তখন কি আমি কিছু বলি? বলিনা। তাহলে তুমি কেনো আমাদের মা মেয়েকে দেখে হিংসে করো?
– ঘাট হয়েছে।
– আম্মু পিহু কোথায়?
– রুমেই আছে।
– আচ্ছা আমি যাই।
পিহু পিসিতে বসে বেশ আগ্রহ নিয়ে ইংলিশ গান শুনছে আর নিজেও সাথে সাথে গাইছে।
” বি ইচ আদার কম্প্যানি ওওও”
কুহু পিহুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেই বলে,
– এসে পড়েছি তোকে কম্প্যানি দিতে।
– উফ্ আমি কি তোর কম্প্যানির কথা বলছি? আমি জাস্টিন বিবারের কম্প্যানি পাওয়ার প্রত্যাশা করছি।
– ওরে বাবা তোর মুখে এসব বাংলা শব্দ মানায় না। হাসি পায় হিহিহাহা্হাহা।
– কেনো ভুল হয়েছে? প্রত্যাশার জায়গায় কি হতো?
– আরে না পাগল ঠিকই আছে। তবে তোর মুখে এসব মানায় না।
– হুম এসব হাবিজাবি তোর মুখেই মানায়।
– দাঁড়া তোকে একটা শুনাই।
– এই না একদম না।
– শুনতে হবে শুনতে হবে।
– আপুণি তুই এতো ইমমেচিউর কেনো?
– কারণ তুই মেচিউর।
এখন শোন।
“হৃদয় থেকে হৃদয়ে,
স্পন্দন স্পন্দনে,
ভালোবাসি! ভালোবাসি!
এই হাহাকার।
তবুও তুমি নির্বিকার।
নাই বা বললে ভালোবাসার কথা
নাই বা শুনলে এই হাহাকার।
তাই বলে একটুখানি
চোখের ঝিলিক হয়ে,
তারা গুণার সাথী হয়ে,
পাশে বসা যায় না?
হাসিমাখা মুখখানি আমার চোখের ফ্রেমে
বন্দি করা যায় না?”
– শেষ হয়েছে তোর?
– না আরো বাকি আছে তো।
– আমি আর শুনতে পারবো না।
– প্লিজ! প্লিজ!
– যা এখান থেকে।
– মর তুই।
– তুই মর।
– তোর জাস্টুকে নিয়ে মর।
– তুই তোর বাংলা শব্দগুলো নিয়ে মর। তাহলে বইয়ের কিছু পড়া কমবে।
– হাহ্হাহা।
– ইমমেচিউর।
– হুহ।
– যা সত্যি তা বলেছি।
– আরে আমার সত্যবাদীরে।
– যা তো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে তারপর তোকে একটা কথা বলবো।
– কোনো কথা শুনতে চাই না তোর। আবার তোর কলেজের প্যাচাল পারবি আমার কাছে।
– আরে না কলেজের প্যাচাল না।
– তাহলে?
– রাতে শুয়ে শুয়ে বলবো।
– ঠিক আছে।
..
কুহু বিছানায় শুয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে পিহুর জন্য। পিহুর পড়া কখন শেষ হবে আর কখন পিহুর কাছ থেকে সেই কথাটা শুনবে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। কুহুর বেশ ঘুম পাচ্ছে। সারাটা দিন জার্নি করে এসেছে সে। সেই গাজীপুর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে আবার ফেণী। দুচোখে ঘুম ভর করছে তারপরো কোনোরকম চোখ মেলে শুয়ে আছে। কথাা না শোনা পর্যন্ত কুহুর আর শান্তি হবে না। কুহুর ইচ্ছে করছে পিহুকে ডেকে কথাটা এখনই জেনে ফেলতে কিন্তু এখন পিহুকে ডাকাডাকি করলে পিহু খুব রেগে যাবে। পড়াশুনায় তার এতো মনোযোগ কোথা থেকে আসে তাই কুহু ভেবে পায় না। কুহু আর কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকলে নিশ্চিত সে ঘুমিয়ে যাবে তাই উঠে বসে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পিহুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– পিহু প্লিজ আগে কথাটা বলে ফেল তারপর আবার পড়তে বসিস।
– একদম চুপ ডিস্টার্ব করবি না।
কুহু বিছানা ছেড়ে উঠে উড়নাটা ভালোভাবে মাথায় দিয়ে তার ঘরের সাথে এটাচড্ বারান্দাটায় যেয়ে দাঁড়ায়। দিনের বেলায় হোক আর রাতই হোক না কেনো কুহু বারান্দায় খুব একটা যায় না। কুহুর যে ভালো লাগে না ব্যাপারটা তা না। আসলে তাদের বারান্দার ঠিক পাশেই অপরপাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা। ঔ ফ্ল্যাটে তিন তিনটা ছেলে থাকে তাই বারান্দাটায় কুহু বেশি একটা আসে না। কিন্তু আজ ঘুম না আসার জন্য সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদ দেখতে খুব ভালেবাসে কুহু কিন্তু রাতে সে না যায় বারান্দায় না যায় ছাদে তাই সে এভাবে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে পারে না
তবে মাঝে মাঝে পিহু ঘুমিয়ে পড়ার পর সে জানালা খুলে বিছানায় শুয়ে চাঁদ দেখতে থাকে। পিহুটা বড্ড ভয় পায় রাতে জানালা খুলে ঘুমোতে।
কুহুর হঠাৎ মনে হলো পাশের বারান্দায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আড়চোখে তাকাতেই দেখতে পায় একটা ছেলে মোবাইলে কথা বলছে। কথা শুনে কুহুর মনে হচ্ছে সম্ভবত গার্লফ্র্যান্ডের সাথে কথা বলছে। কুহু চুপচাপ ঘরে ফিরে আসে।
পিহু হলে জীবনেও চলে আসতো না বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনতো আর পরে এসে কুহুর কাছেও সব ডিটেইলসে্ বলতো। কুহুরও বেশ ইচ্ছে হচ্ছে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে। বেশ মজা লাগে এধরনের কথাগুলো তার কাছে আবার বিরক্তও লাগে। কুহু আর পিহুর কাজই হচ্ছে এধরনের কথাগুলো শুনে শুনে হাসহাসি করা। তবে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা শোনাটাও অড দেখায় তাই সে চলে এসেছে।
– এই পিহু বলবি কিনা বল?
– পড়া শেষ হোক তারপর।
– আরে বলে ফেল না। আমিও তোকে আজকের কাহিনীটা বলবো।
– আজ আবার কি হয়েছে?
– ট্রেনে আমার পাশে একটা অদ্ভুত ছেলে বসেছিলো।
– তুই নিজেই পিকুলিয়ার তাই তোর সাথে সব আজব আর অদ্ভুত মানুষদেরই দেখা হয়।
– এই এখন তোর পড়ার ডিস্টার্ব হয় না?
– তুই আমাকে ডিস্টার্ব করছিস।
– যা মর!
– আচ্ছা বলছি।
– হুম বল।
– গত শুক্রবারে আমি ফিজিক্স প্রাইভেট থেকে বাসায় ফিরছিলাম। রিকশা থেকে নামার সাথে সাথে একটা মেয়ে হুট করে দৌড় দেয় আর আমার সাথে সে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়।
– তারপর?
– তারপর আর কি সরি বলে মেয়েটা চলে যায়।
– এই তোর কাহিনী?
– না আরো আছে। বিকেলের দিকে সেই মেয়েটা আমাদের বাসায় আসে।
– কেনো?
– ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিলাম না তখন আমার হাতে তিনটা খাতা ছিল। আমি ভুলে একটা ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। তাই সে এটা দিতে এসেছিল।
– বাসা কীভাবে চিনলো?
– ইরিন নাকি আমাকে দেখেছিল এই বাড়িতে ঢুকতে আর তাছাড়া ইরিন আমাদের পাশের বিল্ডিংটায় থাকে।
– ওহ্ মেয়েটার নাম ইরিন।
– তুই চিনিস নাকি?
– না তো।
– কিন্তু মেয়েটা তোকে চিনে।
– আমাকে?
– হ্যা তোকে চিনে।
– কীভাবে চিনে?
– এই ইরিন হচ্ছে সেই আজব প্রাণীর বোন। সেভাবেই হয়তো তোকে চিনে।
– ও মাই গড।
– আমার কি মনে হয় জানিস মেয়েটা ইচ্ছে করে সেদিন দৌড় দিয়েছিল নাহয় রাস্তায় শুধু শুধু কেউ এমনভাবে দৌড় দেয়?
– কি বলতে চাচ্ছিস?
– দেখ আমার মনে হচ্ছে ইরিন ইচ্ছে করেই আমার বই খাতা ফেলে দিয়েছিল। তারপর আমার খাতা লুকিয়েছিল।
– তোর খাতা দিয়ে ঐ মেয়ে কি করবে?
– খাতা দিতে আসার নাম করে তোর খোঁজ করবে।
– সত্যি সত্যি খাতাটা দিতেও তো এসে থাকতে পারে।
– তুই আসলেই কিছু বুঝিস না আপুণি।
– তো বুঝিয়ে বল।
– ইরিন সেদিন আমায় সরি বলেই উঠে চলে যায় তার মানে সে আগেই আমার খাতা নিয়ে ফুরুৎ করে উড়াল মারে। আর সবচেয়ে সন্দেহজনক হলো তাহলে সে আমার বাসা চিনলো কীভাবে? তার কথা মতে তো সে আমাকে এই বাড়িটায় ঢুকতে দেখেছে।
– আগে হয়তোবা কখনো দেখে থাকতে পারে।
– তা ঠিক।
– আচ্ছা তুই কীভাবে জানলি ইরিন ঐ আজবের বোন?
– ইরিন মেয়েটা প্রচন্ড বকবক করে। বাসায় এসে যে আমার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল শেষ করার নামই নিচ্ছিলো না। কথায় কথায় বলে সে নাকি বাস্কেটবল খেলতে ভালোবাসে।
– তাতে কি হয়েছে?
– ইরিন বলেছে সে তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে বাস্কেটবল খেলা শিখেছে।
এখন তুই মিলিয়ে নে। তার উপর আবার ইরিন বারবার তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তুই কোথায়? অনেকদিন ধরে নাকি তোকে দেখে না। আসলে ইরিনকে ইরিনের ভাই পাঠিয়েছিল।
– আমারো তাই মনে হচ্ছে।
– তুই শুয়ে পড় তো আমার আরো পড়া বাকি। কাল তোর অদ্ভুতের কাহিনী শুনবো।
– ঠিক আছে।
কুহু বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। কুহু পাঁচ ছয় মাস ধরে চিন্তা করছে এই ছেলেটা এভাবে কুহুর পিছনে লেগে আছে কেনো? কুহুর বেশ ভয় হয় ছেলেটার কথা মনে পড়লে। কুহুরা এই বাড়িতে আছে প্রায় সাত আট বছর ধরেপ্রায় ছয় সাত মাস আগে কুহুদের বিল্ডিং এর পাশের বিল্ডিংটায় ঐ ছেলেটা তার ফ্যামিলি নিয়ে ভাড়া থাকা শুরু করে। কুহু প্রতিদিনকার মতো বিকেলে গিয়েছিল ছাদ থেকে কাপড় আনতে। হঠাৎ একটা বাস্কেটবল এসে কুহুর পাশে পড়ে। কুহু ভয় পেয়ে আস্তে করে একটা চিৎকার দেয়। সাথে সাথেই একটা ছেলে বলে উঠে,
– সরি! বলটা একটু এখানে পাস করুন তো।
কুহু কিছুটা ধাতস্হ হয়ে তারপর আবার বাকি কাপড় নামাতে থাকে। ছেলেটা আবার বলে,
– বাস্কেটবলটা একটু পাস করুন তো। নইলে আবার কষ্ট করে আপনাদের বাসার ছাদে যেতে হবে।
কুহু কিছুটা ইতস্তবোধ করার পর বাস্কেটবলটা তুলে পাশের বিল্ডিং এ ছুঁড়ে ফেলে।
– উহু আপনি তো ভালো পারেন না। আর একটু হলেই নীচে পড়ে যেত। এখন থেকে প্রতিদিন আপনি আমাকে বল পাস করবেন তাহলে একটুখানি করে করে শিখে যাবেন। ঠিক আছে?
– আজব!
– উহু কলরব।
চলবে…