#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ২৫
লিখাঃসামিয়া খান
হিমাদ্রি আর মৃদুল পাশাপাশি বসে আছে।হিমাদ্রির কোলে ছোট্ট মাদিহা।হিমাদ্রি পরনে একটা রক্তজবা কালারের লাল শাড়ী।মায়ের সাথে মিলিয়ে মাদিহাও সেম লাল রঙের একটা বেবি ফ্রেক।আকাশে চাঁদ থাকলেও খুব বেশী আলোকিত না পরিবেশ।হয়তো অমাবস্যা নিকটে তাই।
হিমাদ্রির হাতে এক গাছি লাল রঙের এর কাঁচের চুড়ি।সেখানে হাত বুলিয়ে খেলা করে চলছে মাদিহা।হঠাৎ করেই হিমাদ্রি একটা আর্তনাদ করে উঠলো।তার চিৎকার শুনে মৃদ ব্যাস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”
“তোমার মেয়ে কামড় দিয়েছে। নতুন নতুন দাঁত উঠছে তাই সবাইকে কামড় দেয়।”
“তাই নাকী?ভালো হয়েছে।বাবার উপর জুলুমের প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
“বাহ রে!কীরকম?”
“কেনো, তুইও তো ছোট বেলায় অনেক কামড়িয়েছিস আমাকে।মনে নেই?”
“কই না তো।”
“এখন অস্বীকার করলে চলবে?একবার তো আমার নাকে কামড় দিয়ে নাকে ঢিবি তৈরী করে দিয়েছিলি।তিনদিন আমি বাড়ীর বাহিরে যেতে পারিনি।”
“অবশ্যই তোমার দোষ ছিলো কোনো।আমি তো শুধু শুধু আর কামড় দেয়নি?”
“তাইনা!”
“হুম।একটা কবিতা শুনবে।কাজী নজরুল ইসলামের?”
“শুনি বল।”
আমি চির তরে দূরে চলে যাবো
তবু আমারে দিবোনা ভুলিতে,
আমি বাতাস হইয়া, জড়াইবো কেশ
বেনী যাবে যবে খুলিতে।
তোমার সুরের নেশায় যখন
ঝিমাবে আকাশ, কাঁদিবে পবন,
রোদন হইয়া আসিব তখন
তোমারো বক্ষে দুলিতে।
আসিবে তোমার পরম উৎসব
কত প্রিয়জন, কে জানে
মনে পড়ে যাবে কোন সেই ভিখারী
পাইনি ভিক্ষা এখানে।
তোমার কুঞ্জ পথে যেতে হায়
চমকে থামিয়া যাবে বেদনায়
দেখিব কে যেন মরে পড়ে আছে
তোমার পথের ধূলিতে।।
কবিতাটা শেষ করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো দুজনে।শুধু পরিবেশে হিমাদ্রীর কাঁচের চুড়ির টুংটাং শুনা যাচ্ছে।
“হিম আমাকে আর মাদিহাকে রেখে কখনো চলে যাস না।”
“যাবোনা।কিন্তু যদি তুমি আমাকে কখনো যেতে বলো তখন?”
“আমি কখনো তোকে আমার থেকে দূরে সরাতে চাইনা।তুই আমার জীবনে একমাত্র আলো।”
“হুম জানি।”
“তোকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে।চল এই মূর্হুতটাকে ক্যাপচার করে রাখি।আমাদের ভালোবাসার মূর্হুত।”
মাদিহাকে কোলে নিয়ে হিমাদ্রি দাড়ালো।তার পাশেই হাস্যজ্জোল মুখ নিয়ে মৃদ দাড়িয়ে পরপর কয়েকটা সেলফি ক্লিক করে নিলো।
“হুম নাইস ক্যাপচার।”
এটুকু বলে মৃদ নিজের মুখটা এগিয়ে মাদিহার কপালে একটা উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলো।
“তোর একটা জিনিস পাওনা রইলো হিম।”
“কি?”
“একটা বৈধ চুম্বন।”
,
,
বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো মৃদুল।এতোক্ষণ ধরে অতীতে বিচরণ করছিল সে।কিন্তু অতীত হাতড়েও ফলাফল সেই শূন্য।
মৃদুলের বাম হাতে ব্যান্ডেজ করা।দুদিন আগে একটা এট্যাক হয় ওর উপর।খুব সম্ভবত তার বিজনেস রাইভালের মধ্যে কেও।অথবা কোন পলিটিক্যাল ইস্যু।কারণ ভবিষ্যতে রাজনীতিতেও একটা বড় সম্ভাবনার নাম হচ্ছে মৃদুল।তো এট্যাক হওয়া স্বাভাবিক।বাম হাতের কনুইয়ের একটু উপরে বুলেট এসে লেগেছিল।ভাগ্য ভালো ছিল।তাই হয়তোবা বুকে লাগেনি।
মৃদুলে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে।পাশেই মাদিহা নিজের রোজকার বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।তার মধ্যে ড্রয়িং করার জিনিসই অত্যাধিক।মাদিহার ড্রয়িং করা বড্ড পছন্দ।আবার সাথে সময় কাঁটানোও তার পছন্দ।অনেকদিন পরে বাবার কাছে এতো সময় পেলো সে।তাইতো ড্রয়িং ও করছে আবার বাবার সাথে সময় কাঁটাচ্ছে।
“মাদিহা সোনা।তোমার মা আজকে তোমাকে কল দেয়নি?”
ছোট ছোট হাত দিয়ে রং পেন্সিল চালাতে চালাতে ভাঙা ভাঙা বুলিতে মাদিহা জবাব দিল,
“না।আজকে দেয়নি।কালকে রাতে দিয়েছিল।”
মাদিহার কথাটা শুনে মৃদুল ঘড়ির দিকে তাঁকালো।বিকাল পাঁচটা বাজে।তার মানে এখন আমেরিকাতে সকাল।আর একটু পরেই হয়তো হিমাদ্রি কল দিবে।ইদানীং হিমাদ্রির কথা অনেক মনে পরে মৃদুলের।মন চায় ওকে কল দিয়ে ওর সাথে কথা বলতে।কিন্তু পারেনা।চাইলেই সবসময় সবকিছু পারা যায়না।এজন্যই তো যখন মাদিহাকে কল করে হিম তখুনি ওর একটু কণ্ঠ স্বর শুনে আত্নতৃপ্তি করে মৃদুল।অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাবার মতো।
“আমার কথা বলেনা তোমার মা কখনো?”
“বলে তো।”
“আচ্ছা!কী বলে এতো?”
“তুমি কেমন আছো?আমাকে বকো কীনা বা মারো কীনা এগুলো।”
“আর কিছুনা?”
“না তো।”
মাদিহার না তো বলার সময় মুখ ভঙি দেখে হেসে দিল মৃদুল।ঠিক হিমাদ্রির মতো হয়েছে মাদিহা।মাঝেমধ্যে তার কাছে মনে হয় মাদিহা হয়তো হিমাদ্রির মেয়ে।ভুল করে রোদসী ওকে জন্ম দিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ করেই অনেকবড় স্টার গিজার্স ফুলের তোড়া নিয়ে কেও ভিতরে প্রবেশ করলো একটা মেয়ে অবয়ব। মুখের একপাশে তার বুকে দিয়ে ঢাকা থাকার কারণে মৃদুল বুঝতে পারলোনা অবয়বটি কার।কিন্তু পারফিউম এর স্মেল নিয়েই বুঝতে পারলো এটা নূপুর।কারণ নূপুর এক ধরণের কড়া পারফিউম ব্যাবহার করে যা মূলত প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরী।
“সো মিস.এহসান।আবার দেখা হয়ে গেলো।”
মুখের একপাশ থেকে বুকেটা সরিয়ে লিপস্টিক দিয়ে লেপ্টে থাকা ওষ্ঠাধর প্রসারিত করল নূপুর।
“স্ট্রেঞ্জ স্যার।আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি?মুখটা তো ঢাকা ছিল।”
মৃদু হাসলো মৃদুল।
“আপনার পারফিউম এর স্মেল পেয়েছি।আর এই পারফিউমটা ভেরী প্রেশিয়াস। সহজে কেও ইউস করতে পারেনা।ইউস করতে হলে অবশ্যই চড়া মূল্য দিতে হবে।আর বাংলাদেশের মানুষ এখনো এতোটা আভিজাত্যপূর্ণ হয়নি।তাদের কাছে সামান্য পারফিউম এর জন্য এতো খরচ করার থেকে আইফোন কেনা ভালো।”
“তা অবশ্য ঠিক।”
নূপুর খেয়াল করলো মৃদুলের পাশে বসে আছে একটা সাড়ে তিন বা চার বছরের ছোট্ট মেয়ে।একমনে সে ড্রয়িং করে চলেছে।
“সি ইজ মাদিহা রাইট?”
“হুম।”
“ও মাই।সি ইজ সো এডোরেবল।”
কথাটা বলে নূপুর গিয়ে মাদিহার গাল টেনে দিলো।গালে কারো হাতের আভাস পেয়ে মাদিহা চোখ তুলে তাঁকালো।
অচেনা মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তোতলা কণ্ঠে মাদিহা নূপুরকে প্রশ্ন করল,
“তোমার হাতে এটা কী ফুল?”
“এটা?এটার নাম স্টার গিজার্স। ”
নূপুরের কথা হয়তো মাদিহার বোধগম্য হলোনা।প্রশ্নবোধক চোখে মৃদুলের দিকে তাঁকালো সে।নূপুর হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারলো।হাল্কা হেসে মাদিহার গালে আবার ও হাত বুলিয়ে বলল,
“এটার নাম অপরাজিতা।”
মাদিহা মনে হয় এবারও বুঝতে পারলোনা।মুখ ভঙি ঠিক আগের ন্যায় করে রাখলো।
“ও বুঝবেনা।বাদ দিন।”
মাদিহার থেকে সরে এসে নূপুর মৃদুলের সামনে দাড়ালো।তারপর হাত বাড়িয়ে বুকেটা মৃদুলের দিকে এগিয়ে দিলো।
“দিস ইজ ফর ইউ স্যার।”
“থ্যাংক ইউ মিস।আপনি সামনের কাউচে বসতে পারেন।”
“ওকে।বাট আমি যদি বিছানার এদিকটায় বসি তাহলে কী কোনো সমস্যা হবে?”
“নো।ইউ ক্যান সিট।”
নূপুর বেশ সাবলীলভাবে মৃদুলের পায়ের কাছে বসে পরলো।
“হাউ আর ইউ স্যার?”
“গুড।”
“আপনি কি জানেন আপনার উপর এই এট্যাকটা কে করিয়েছে?”
“সিওর না ঠিক কে করাতে পারে।”
“তারপরও কারো উপর সন্দেহ?”
“মিস.এহসান আপনি কি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন?”
“প্রোবাবলি নট।আসলে আমি আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।যদি এ ফাঁকে একটা ছোটখাটো ইন্টারভিউ হয়ে যায়।তাহলে তো তা আমার চ্যানেলের জন্যই লাভ।”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“আচ্ছা আপনার মেডিকেল রিপোর্ট স্টাডি করার একটা সুযোগ মিলেছে আমার।তো সেখান থেকে একটা জিনিস সম্পর্কে অবগত হতে পারলাম আমি।”
“কোন বিষয়?”
“আপনার কি কোনো কিডনিজনিত সমস্যা ছিল নাকী?”
“নাহ!”
“তাহলে আপনার একটা কিডনি কেনো?”
“কারণ আরেকটা কিডনি আমি হিমাদ্রিকে দিয়েছি।”
মৃদুলের মুখ থেকে একথা শুনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো নূপুর।
“সত্যি?”
“হুম।”
“মানে কবে?আর কীভাবে?”
“হিমের যখন বার বছর বয়স তখন ওর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।আহনাফের সাথে টিস্যু ম্যাচ করলেও আহনাফের শরীরের কন্ডিশন ভালো ছিলনা।আবার হিমের বাবার ডায়াবেটিস ছিল।টিস্যু ম্যাচ না হলে তো কিডনী দেওয়া যায়না।কাকতালীয়ভাবে অনেকটা আমার সাথে ম্যাচ করে।আর আমি তো আমার হিমকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিতে পারি।”
“হিমাদ্রি ম্যাম কি তা জানে?”
“নাহ।ও অপারেশনের কথা জানলেও আমার কিডনি দেওয়ার ব্যাপারে কিছু জানতোনা”
“স্যার একটা কথা বলি?”
“জ্বী বলেন।”
“আপনি ভালোবাসা মানে বুঝেন না।যদি বুঝতেন তাহলে বলতে পারতেন।আপনি কখনো রোদসী ম্যামকে ভালোবাসেননি।আপনি তো ভালোবেসেছিলেন হিমাদ্রি ম্যামকে।”
,
,
,
ভৌমিকের বাড়ীর ব্যাক ইয়ার্ডে বসে আছে হিমাদ্রি।এখানেই সকালের ব্রেকফাস্ট করবে তারা।কালকে রাতে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল তাদের।এতো রাতে হিমাদ্রির ডরমিটরি অফ করে দিয়েছিল।এজন্য বাধ্য হয়েই তাকে ভৌমিকের সাথে তার বাড়ীতে আসতে হয়।ভৌমিক যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ।তার জন্য হিমাদ্রি নির্দ্বিধায় তার বাড়ীতে রাত্রীযাপণ করতে এসেছে।
“কফি ওর টি মিস. হিমাদ্রি?”
“কফি।”
কোনো কথা না বলে ভৌমিক কফি বানানো শুরু করলো।আর হিমাদ্রি চারপাশের পরিবেশ অবলোকন করা শুরু করলো।ভৌমিকের বাড়ীটা দেখতে রাজপ্রাসাদের থেকে কম না।কালকে রাতে অন্ধকারে তেমন একটা বুঝতে পারেনি বাড়ীটার অবয়ব কেমন কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছে।
“আরাধ্যার কথা বললেন না যে?”
“বলবো মিস।যখন প্রকৃতি চাবে তখন ঠিক বলব।”
“এখন কি প্রকৃতি চায়না?”
“নাহ।”
“ওকে।আচ্ছা আপনার মেয়ে কুঞ্জনের বয়স কতো?”
“থার্টিন।”
থার্টিন শব্দটা শুনে একটা আর্তনাদ করে উঠলো হিমাদ্রি।
“থার্টিন?তাহলে আপনার বয়স কতো?”
“থার্টি নাইন।”
“হোয়াট।আপনার বয়স থার্টি নাইন কীভাবে হয়?আপনাকে দেখে তো মনে হয় এখনো ত্রিশও হয়নি।”
হিমাদ্রির এরকম বোকা বোকা কথায় হেসে দিলো ভৌমিক।এবং তা বেশ উচ্চ স্বরে।ভৌমিকের হাসি দেখে হিমাদ্রি বেশ বিরক্ত হলো।
“হাসছেন কেনো?”
“আমার বয়স সত্যিই থার্টি নাইন।বাট দেখে বুঝা যায়না আমাকে।”
“সত্যিই বুঝা যায়না।”
“হুম।এখন খাওয়া শুরু করেন মিস.হিমাদ্রি। ”
“আচ্ছা আরেকটা কোয়েশ্চেন।কুঞ্জন এখন কোথায় থাকে?”
“আরাধ্যার সাথে শিকাগোতে রয়েছে।”
“ওহ আচ্ছা।আপনাদের ডিভোর্স হলো কীভাবে?”
“মিস.হিমাদ্রি আপনি ভুল করছেন।আমাদের এখনো ডিভোর্স হয়নি।”
চলবে,,