শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ৩৫

0
3885

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৩৫

🌼
আকাশে মেঘের হাতছানি। ঘন কালো মেঘে আকাশ গুমোট রুপ ধারন করেছে। চারপাশে শূনশান নিরবতা।দূর থেকে এক দল কুকুরের ডাক ভেসে আসছে মাঝে মধ্যেই।সোডিয়ামের নিচে দামি চার চাকার গাড়িটাতে হেলান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত অধির।সিগারেটের মতোই ধিকি ধিকি জ্বলছে তার বুক।তার মনে আজ অভিমানের মেঘ জমেছে।বিষাক্ত কিছু দির্ঘশ্বাসে ভোঁতা হয়ে আছে ভেতরটা।অভিমানি মনটা খুব করে চাইছে সে আসুক।শূন্য বুকটাতে ঝাপিয়ে পড়ুক।অভিমানের মেঘ সরিয়ে বৃৃষ্টি নামুক।ভোঁতা দির্ঘশ্বাসগুলোকে ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে দিক দূর অজানায়।অভিমানের পাল্লা সরিয়ে ভালোবাসায় পিষে দিক।অধির জানে এমনটা হবে না।তবুও আজ তার অভিমান করতে ইচ্ছে করছে।ঠোট ফুলিয়ে কাদতে ইচ্ছে করছে।ছোট বাচ্চারা চকলেটস না পেলে যেমন ভাবে কাঁদে তারও ঠিক তেমন করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

অধির আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো।ভেতর থেকে বিষাক্ত কিছু দির্ঘশ্বাস বের করে দিয়ে চোখ বুজে লম্বা শ্বাস নিলো।আঙুলের ভাজে অবশিষ্ট সিগারেটটা কালচে লাল রঙা ঠোট জোড়ার মাঝে চেপে ধরে ফুঁকতে লাগলো একের পর এক।আকাশে ততোক্ষনে গুড় গুড় মেঘ ডাকতে শুরু করেছে।কিছুক্ষণের মাঝেই বোধ হয় বৃষ্টি নামবে।অধিরের রোশনির খেয়াল এলো।এখন তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো অবশিষ্ট অংশ।পা দিয়ে পিষে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।গাড়ি চালাতে চালাতেই কিছুক্ষন আগের ঘটনা মনে পড়ে গেলো।

কিছুক্ষন আগে,,,,

রোশনি তখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভেজা চুল মুছছিল। হঠাৎ করেই কোমরে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে তাকালো সে।আয়নার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই স্পষ্ট হলো অধিরের মুখ। ভাবনায় এতোটাই ডুবে ছিলো যে অধির কখন এসেছে সে খেয়ালই করে নি।অধির রোশনির ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রান নিতে ব্যস্ত।অধিরের হাত রোশনির টি-শার্ট ভেদ করে পেটে পড়তেই চোখ বুজলো রোশনি।সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো জয়ের করুন মুখটা।রোশনি চট করে চোখ মেলে তাকালো।চোখ মুখ শক্ত করে অধিরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই ভ্রু কুচকে তাকালো অধির।রোশনিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পুরু ভ্রু জোড়া আরো খানিকটা কুচকে গেল তার।

-কি হয়েছে সুইটহার্ট? আজ সারাদিন কেমন অদ্ভুদ বিহেভ করছো। কিছু হয়েছে? কোনো প্রবলেম হলে আমায় বলো আমি সলভ করে দেবো।

রোশনি যেন হঠাৎ করেই ভায়োলেন্ট হয়ে গেলো।চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

-আমার জিবনের সবচেয়ে বড় প্রবলেম আপনি।এটাকে সলভ করে দিতে পারবেন? এতো কাছে কেন আসেন বারবার?দুরে থাকবেন আমার থেকে।
কাছে আসার চেষ্টাও করবেন না। বুঝতে পারেন না আপনার ছোঁয়া গুলো বিষাক্ত লাগে আমার কাছে।শরির জ্বালা করে।

অধির অসহায় চোখে তাকাল।করুন স্বরে বলে উঠলো,

-প্লিজ রিল্যাক্স হয়ে যাও সুইটহার্ট। আচ্ছা আমি সরি।এরপর থেকে এমনটা আর হবে না।প্লিজ শান্ত হয়ে যাও।আই প্রমিস দ্বিতীয় বার এই ভুল আর হবে না।প্লিজ শান্ত হও।

অধিরের কথা শুনতেই আবারো চেচিয়ে উঠলো রোশনি।

-আর কত শান্ত হতে বলছেন আমায়? এর থেকে তো মরে যাওয়াও ভাল হবে আমার পক্ষে।আমি এই খাচায় বন্দি থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।মুক্তি চাই আমার।শান্তিতে নিশ্বাস নিতে চাই একটু।হাসতে চাই আবার।ফিরে পেতে চাই সেই পুরোনো আমিটাকে।সেই হাসি খুশি আমিটাকে।আমার আমিটাকে।

অধির হতাশ চোখে তাকালো।এতো দিনেও তার প্রতি এতটুকু মায়া জন্মায় নি মেয়েটার মনে কথাটা ভেবেই বুকটা জ্বলছে তার।রোশনি আবারো বলতে শুরু করলো,

-সব সময় যে ভালোবাসার কথা বলেন না আপনি? এটাকে ভালোবাসা বলে না মিষ্টার চৌধুরি।এটাকে জিদ বলে।আপনার কাছে ভালবাসা মানে হাসিল করা।আপনার কাছে অন্য কারোর অনুভূতির কোনো মূল্যই নেই।
আপনার এই ভালোবাসা নামক অত্যাচারে ক্লান্ত আমি।আপনার ভালবাসা আজ পর্যন্ত দুঃখ আর কষ্ট ছাড়া আর কিই বা দিয়েছে আমায়? এ কেমন ভালবাসা আপনার?আপনার ভালবাসার কারনে আমার নিশ্বাস নেওয়াও মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে।আল্লাহর ওয়াস্তে প্লিজ আমাকে এই ভালোবাসা থেকে মুক্তি দিন।প্লিজ।আমি আপনার…..

রোশনির কথার মাঝেই টেবিলের উপর থেকে ফুলদানিটা তুলে দূরে ছুড়ে মারলো অধির।সাথে সাথেই প্রচন্ড শব্দ তুলে টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হলো সেটা।রোশনি চমকে তাকালো।অধিরের দিকে তাকাতেই ভয়ে কেপে উঠলো কলিজা।অধিরের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।চোখ দুটোও লাল হয়ে গেছে।অধির সিঙ্গেল সোফাটায় লাথি মারতেই ছিটকে উলটে পড়লো দূরে।রোশনি ভয়ে একপা পিছিয়ে গেলো।অধিরের চোয়াল শক্ত হল।গলার স্বর উচিয়ে বললো,

-মুক্তি মুক্তি…. মুক্তি চাই তোমার? আমার ভালবাসাকে তোমার জিদ মনে হয়? তোমার কি মনে হয় আমি ভালোবাসার মানে বুঝি না? আমার ভেতরে কোনো মন নেই? আমার কষ্ট হয় না?তুমি বলছো আমার ভালবাসা তোমাকে কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেয় নি।এই সম্পর্কে থেকে যদি তুমি কষ্ট পাও তবে আমি কি সুখে আছি?এক পৃথিবী ভালোবেসেও তোমার ভালোবাসা পেলাম না।এতে কি আমার কষ্ট হয় না?।এতো দিনেও আমার প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস তৈরি হয় নি।এটা কি কম যন্ত্রনার?কি করছিনা তোমার জন্যে? তোমার মুখে হাসি ফোটাতে সব কিছু করছি।তোমার বাবা মাকে পাগলের মত খুজে বেরাচ্ছি।শুধু মাত্র তোমাকে ভালো রাখার জন্যে।তোমাকে জোর করে বিয়ে করার জন্যে হাজার বার তোমার কাছে মাফ চেয়ে চলেছি।কিন্তু তুমি করো নি।বার বার মনে করিয়ে দিয়েছো আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি।আরে আল্লাহও তো তার বান্দার অসংখ্য ভুল মাফ করে দেয়। কিন্তু তুমি? তুমি আমার একটা ভুল মাফ করতে পারছো না?

অধির থামলো।টেবিলে আরো এতটা লাথি মেরে আবারো বলতে লাগলো,

-ইগো…?তোমার থেকেও বেশি ইগো আমার আছে।সেটা কখন কোথায় দেখাতে হবে সেটা বোঝার মত জ্ঞানও আমার আছে।যা তোমার নেই।তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছোঁয়ার জন্যে আমি মরে যাচ্ছি।তুমি নিজেকে কি ভাবো?দুনিয়ার সব থেকে সুন্দর মেয়ে তুমি? আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরি? তুমি এমন কিছুই না। অন্যান্য মেয়েদের মত তুমিও ব্যস এক অডিনারি মেয়ে।এর থেকে বেশি কিছু নও।তোমার সাথে শোয়ার জন্যে যদি মরেই যেতাম তাহলে বিয়ের দিন রাতেই স্বামির অধিকার নিয়ে নিজের পুরুষত্ব দেখাতাম তোমার উপর।কাটা যদি বুকের মাঝে বিঁধে যায় তবে সেটা মনের ভেতর লুকানো যায় না।সেটাকে ব্যস তুলে ফেলে দিতে হয়।না শখ না অভ্যাস।”প্রয়োজন”….. যা বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রয়োজনের খাতিরেই তুমি নামক কাটাটাকে উপড়ে ফেলতে পারছি না আমি।আর না পারছি নিজের ভেতরে লুকাতে।তোমার কাছে মনে হয় আমি হার্ড হার্টেড পারসোন। আমার মাঝে কোনো ইমোশনস নেই।কোনো ফিলিংস নেই।কঠিন হৃদয়ের মানুষ আমি। ইউ আর এবসুলেটলি রং মিসেস রোশনি।আমার মাঝেও ইমোশনস আছে ।কষ্ট আমারও হয়।বুকটা আমারও জ্বলে।তুমি চোখ থেকে পানি ঝরিয়ে তোমার কষ্টটা প্রকাশ করতে পারো যা আমি পারি না।তাই বলে কি আমার কষ্ট হয় না?আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি সেটা প্রমান করতে যদি চোখে পানি ঝরাতে হয় তবে আমি সারা জিবন কাঁদলেও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কতোটা সেটা প্রমান করতে পারবো না আমি।তুমি মুক্তি চাও না আমার থেকে?তবে শুনে রাখো।এটা তুমি কখনোই পাবে না।আমি না মরা পর্যন্ত তোমার মুক্তি নেই।

বর্তমানে……

মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে আছে রোশনি।বুকটা ভিষন ভারি মনে হচ্ছে তার।অনেক তো হলো নিয়তি নিয়তি খেলা।আর কত খেলবে সে? এবার না হয় সব ঠিক হয়ে যাক।নিয়তির সাথে আর কোনো বোঝাপড়া সে করতে চাই না।চোখের নিচের শুকিয়ে আসা নোনা পানিটুকু মুছে নিয়ে ছাদ থেকে নামলো রোশনি।দোতলা ধরে খানিক হাটতেই সামনাসামনি হলো জয়ের।রোশনি চোখ নামিয়ে নিলো।জয়কে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেও থেমে গেলো।জয়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,

-কেন এসেছো এখানে? কেন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছো না জয়? চলে যাও এখান থেকে।প্লিজ চলে যাও।

জয় শান্ত গলায় বলে উঠলো,

-কেন?

-কেনো না এখানে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।

-কেন?

-কারন তুমি এখানে থাকলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না।তোমাকে দেখলে বার বার অপরাধ বোধে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি আমি।শেষ হয়ে যাচ্ছি।

-কিন্তু কেন?

-আমার বিয়ে হয়ে গেছে জয়।সত্যিটাকে কেউ বদলাতে পারবে না।বাস্তবতাকে যতো তাড়াতাড়ি মেনে নেবে কষ্ট ততোটাই কম হবে তোমার।চলে যাও এখান থেকে।প্লিজ চলে যাও।নয়তো আমি সামলাতে পারছি না নিজেকে।চলে যাও প্লিজ।আমার অপরাধ বোধের পাল্লা আর বারিও না।প্লিজ চলে যাও।

কথাগুলো বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো রোশনির।জয় কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো,

-সেটাই তো জানতে চাইছি রোশনি।কেন নিজেকে সামলাতে পারবে না? তুমি তো আমাকে ভালবাসো না।তাহলে কিসের এতো অপরাধ বোধ?আমার এখানে থাকা না থাকা নিয়ে কেন এতো ফারাক পড়ছে তোমার? কেন বলছো এসব তুমি? উত্তর দাও রোশনি।দোষটা কার? দোষটা সত্যিই কি একা আমার ছিল? কার দোষে আজ আমি এতো কষ্ট পাচ্ছি? তোমাকে না পারছি ভুলে যেতে আর না পারছি আপন করে নিতে।তোমাকে ঘৃনা করতে চেয়েও পারছি না।এমনটা নয় যে চেষ্টা করিনি।চেষ্টা করেছি।অনেক চেষ্টা করেছি।কিন্তু কিছুতেই তোমার প্রতি ঘৃনাটা করে উঠতে পারলাম না।ভালোবাসি তোমায়।কি করে ঘৃনা করি বলো? বছরের পর বছর তোমার একটু ভালবাসার জন্যে অপেক্ষা করেছি।তোমার একটা ফোন কলের জন্য সারা রাত জেগে থেকেছি।এতো কিছুর বিনিময়ে আমি কি পেলাম?

রোশনি আর শুনতে পারছে না।বুকটা আটকে আসছে তার।নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।রোশনি জয়ের দিকে না তাকিয়েই দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলো।বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।

রোশনির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দির্ঘশ্বাস ফেললো জয়।পেছন ফিরে দাড়াতেই খানিক চমকালো।নিজেকে সামলে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও মিসেস অানোয়ারা চৌধুরির কথায় থেমে গেলো।

-তোমার সবাই ভুল করছো।অধির এবং তুমি দুজনেই মেয়েটাকে সমানে কষ্ট দিচ্ছো।তোমাদের থেকে ওই মেয়েটা বেশি কষ্ট পাচ্ছে জয়।তোমাদের থেকে ওই মেয়েটার কষ্টের পাল্লা ভারি।

জয় হতাশ চোখে তাকালো।ক্লান্ত গলায় বললো,

-আমি ওকে কষ্ট দিচ্ছি?

আনোয়ারা চৌধুরি জয়কে নিয়ে তার রুমের বারান্দায় নিয়ে এলেন।বারান্দায় পেতে রাখা সোফায় বসে জয়কে কাছে ডাকলেন।জয়ও বাধ্য ছেলের মত ওনার পাশে গিয়ে বসে পড়লো।আনোয়ারা চৌধুরি আদুরে গলায় বলে উঠলেন,

-আমার কোলে মাথা দিয়ে শুবি?আমার নাতি নাতনিরা বলে আমার কোলে মাথা রাখলে নাকি তাদের দুঃখ,কষ্ট চিন্তা নিমিষেই কমে যায়।তুই কি একবার চেষ্টা করে দেখবি?

জয় জবাব দিলো না।প্রায় সাথে সাথেই ওনার কোলে মাথা রেখে গুটুশুটি মেরে শুয়ে পড়লো সোফায়।আনোয়ারা চৌধুরি হাসলেন।জয়ের মাথায় হাত বুলাতেই চোখ বুজলো জয়।সত্যিই এখন ভালো লাগছে তার।নিজেকে হালকা লাগছে।তার মায়ের কোলে মাথা রাখলে যেমন শান্তি লাগর তেমনই শান্তি অনুভূত হচ্ছে এই মুহূর্তে।আনোয়ারা চৌধুরি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই বলে উঠলেন,

-ভালোবাসা পাপ নয় দাদুভাই।ভালবাসা তো পবিত্র জিনিস।ভালবাসা মানেই যে প্রাপ্তি তা কিন্তু নয়।ভালবেসে যে সবাই এক হয়েছে এমনও নয।আবার যারা ভালবেসে এক হতে পারে নি তারা কিন্তু একে অপরকে ভালবাসতে বন্ধ করে দেয়নি।দূর থেকেই তারা একে অপরকে ভালবাসে।ভালবাসাটা মনে থাকার পাশা পাশি কপালেও থাকতে হয়।যাদের ভালবাসা কপালে থাকে তাদের ভালবাসা পূর্নতা পায়।আর যাদের থাকে না তাদের টা অপূর্নই থেকে যায়।তাই বলে কি তাদের ভালোবাসা মরে যায়? কখনো নয়।নিজের মাঝে তারা জিন্দা রাখে তাদের অপূর্ন সুপ্ত ভালবাসাকে।যারা ভালবাসায় হেরে যায় তারা ভালবাসা বন্ধ করে না।শুধু দেখানোটা বন্ধ করে দেয়।রোশনির প্রতি তোর ভালবাসাটা যেমন সত্যি তেমন অধিরের ভালবাসাটাও সত্যি। তুই যেমন চোখের পানি ঝরিয়ে ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারিস সেটা অধির পারে না।তাই বলে তার ভালবাসাটা মিথ্যে নয়।

চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই বলে উঠলো জয়,

-উপরওয়ালা ভিষন চালাক দাদি।মিথ্যে বলার জন্যে মুখ দিয়েছে আর সত্যি বলার জন্যে চোখ।ভুলে যেতে চাই কিন্তু ভুলতে কোথায় পারি ?স্কুলের নিউটনস ল মনে থাকতো না।আর না ইন্টারের ওমস ল মনে থাকতো।আর না কোনো থিওরি মনে থাকতো।কিন্তু যেই মেয়েটে ভালবাসি তাকে কবে দেখেছি, কোথায় দেখেছি,কোন পোশাকে দেখেছি সব মনে থাকে।যেই পড়াকে মনে রাখবো ভেবে পড়ি সেটা ভুলে যায়।আর যেই মেয়েকে ভুলে যেতে চাই তাকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।শেষ নিশ্বাস অবধি ভুলতে পারবো কি না তাও জানা নেই।ভালবাসা না পাওয়ার পর অনেক কথায় মাথায় আসে।সেগুলো বুঝতেও পারি।কিন্তু রাতে শোয়ার পরে ঘুমোনোর ঠিক আগে যখন ওর কথা মনে পড়ে যায় তখন মায়ের থেকে লুকিয়ে কান্না করতে হয়।এটা অনেক কষ্টের দাদি।আমি এক মুহূর্তেই ওকে হারিয়ে ফেলেছি।তবুও ওর ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।ওর জন্যে অপেক্ষা করার মধ্যে কষ্ট আছে।ওকে ভুলে যাওয়ার মাঝেও কষ্ট আছে।তবে এর থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছি এই কনফিউশনে যে, ওর জন্যে অপেক্ষা করবো নাকি ভুলে যাবো?

-মন দিয়ে ভাবো।দেখো মন কি বলে।মনের কথা শোনো।

-মন যখন ভেঙে যায় তখন মষ্তিষ্কই তো বেটার অপশন তাই না?

-কিছু কিছু সময় ভাঙা মনও সঠিক হয়। তবে একটা কথা কি জানো।রোশনির প্রতি তোমার ভালবাসাটা সত্যি হলেও তোমার প্রতি রোশনির ভালোবাসাটা শুধু বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমার প্রতি ওর মায়া আছে।যেমন মায়া একটা বন্ধুর প্রতি থাকে।তুমি তেমনই ওর খুব কাছের একটা বন্ধু।আর সে কারনেই হয়তো মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।চেয়েও সামনে এগুতে পারছে না।

জয় এবার চোখ খুলে তাকালো।আনোয়ারা চৌধুরির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমার জন্যে? আমার জন্যে ও এগুতে পারছে না?

-হ্যা অনেকটা তোমার জন্যেই।ওর বার বার মনে হচ্ছে ও তোমাকে ঠকিয়েছে।ওর জন্যে তুমি কষ্ট পাচ্ছো সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।ওই যে তুমি ওর কাছের বন্ধু বলেই তোমার জন্যে ওর এতো মায়া।

-তাহলে আমার কি করা উচিত?

-তোমারও নিজেকে আরো একবার সুযোগ দেওয়া উচিত।সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।তুমি যদি নতুন করে জিবন শুরু করো তবে রোশনিও সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।তোমাকে খুশি দেখলে সেও তার কষ্ট ভুলতে পারবে।অপরাধ বোধ কমবে।অধিরকে মেনে নিতে পারবে।ভালবাসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তো এটাই।ভালোবাসার মানুষকে খুশি রাখা।সুখে রাখা।

অধির যখন বাড়ি ফিরলো ততোক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।অধির রুমে ঢুকেই দেখলো বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে রোশনি।অধির দির্ঘশ্বাস ফেলে এসিটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।রোশনির গায়ে চাদর টেনে দিয়ে কিছুক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো রোশনির ঘুমন্ত মুখের দিকে।রোশনির কপালে আঁলতো পরশ দিতে গিয়েও থেমে গেলো অধির।কানে বাজতে লাগলো রোশনির তখনকার বলা কথা। “”দুরে থাকুন আমার থেকে।আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করবেন না।আপনার ছোঁয়া গুলো বিষাক্ত লাগে আমার কাছে।শরির জ্বালা করে””। অধির দির্ঘশ্বাস ফেলে মুখ সরিয়ে নিলো। ডান হাতে রোশনির মুখে পড়ে থাকা চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,

-আই লাভ ইউ তিলোককন্যা।আজ অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি তাই না? কি করবো বলো?আমি এমনই।হুটহাটই রেগে যায়।রাগটাকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারি না।আই এম সরি সুইটহার্ট। এরপর থেকে এমনটা আর হবে না।আমার ভালবাসাট মিথ্যে নয় সুইটহার্ট। প্লিজ আমার ভালবাসাকে অপমান করো না।ভিষন কষ্ট হয় আমার।খুব কি খারাপ হতো বলো যদি তুমি আমায় ভালবাসতে।কি এমন হতো যদি তুমি আমার হতে আর আমি তোমার।

অধিরের গলা ধরে এলো।সোজা হয়ে উঠে দাড়িয়ে আলমারিতে এক কোনায় পড়ে থাকা গিটারটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।বৃষ্টির ঠান্ডা পানি শরির ভিজিয়ে দিতেই শিরশির করে উঠলো শরির।গাঁয়ের লোপকূপ দাড়িয়ে গেলো।অধির রেলিং এ হেলান দিয়ে বসলো।কিছুক্ষণ গিটারের তারগুলোতে অস্থির আঙুল চালিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো।গিটারে করুন সুর তুলে চোখ বুজে গাইতে শুরু করলো,

“আমি তোমার সাথেই আমাকে খুঁজে পাই
এখনো যত্ন করে যাই,যদিও তুমি বহুদূরে
আমি আজও পাগল তোমারই ওই প্রেমে
গেছি হারিয়ে রাতের আকাশে
তবে কি কাহিনি শেষ আমাদের?

আমি ভাবি যদি আবার
ছুঁতে পারতাম তোমাকে
সত্যিই বা স্বপ্নই হোক
এ দুরত্ব শেষ হয়ে যেত যে

ভাললাগা আর ভালোবাসায়
তফাৎ কি যে হয় জানতাম না
তবে কি আজ সব দোষটা আমার
দেরি করেছি বুঝতে তবু
ভয়…ভয় পেও না
আমি আছি তোমারই পাশে
দূরে যেওনা…..
রাখবো আমি জড়িয়ে তোমাকে।

এ বারাছ বারাছ কালি ঘাটা বারছে
হাম ইয়ার ভিগ যায়ে, ইচ চাহাত কি বারিশ মে
তেরি খুলি খুলি লাটোকো ছুলঝায়ু
ম্যা আপনি উঙলিও ছে, ম্যা তো হু ইচি খায়িশ মে

সার্দি কি রাতো মে, হাম সোয়ে রাহে এক চাদার মে
হাম দোনো তানহা হো, না কই ভি রাহে ইচ ঘার মে
জারা জারা বেহেকতা হে মেহেকতা হে
আজ তু মেরা তান বাদান
ম্যা পেয়াছা হু, মুঝে ভার লে আপনি বাহো মে
ম্যা তেরি কাসাম তুজকো সানাম, দূর কাহি না যা
এ দূরি কেহতি হে পাস মেরে আ যা রে।

অধিরের গান শেষ হতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো রোশনির।অধির যখন ওর গাঁয়ে চাদর দিয়ে দিলো তখনই ঘুমটা ভেঙে গেছে তার।তবুও চোখ মেলে তাকায় নি সে।অধির যখন রোশনির কপালে ঠোট ছোঁয়াতে গেল তখন রোশনি নিজেও খুব করে চাইছিল অধির তার কপালে ঠোট ছোঁয়াক। একটা বার বুকে টেনে নিক।অধির যখন আই লাভ ইউ বললো তখন অদ্ভুদ আনন্দে কেপে উঠেছিল বুক।কিন্তু পরের কথাগুলো তার কলিজায় গিয়ে লেগেছে।রোশনি জানে অধিরের ভালবাসা মিথ্যে নয়।শুধু প্রকাশ করার মাধ্যমটা ভিন্ন।রোশনির ইচ্ছে হয় নিজেকে অধিরের ভালবাসায় বিলিয়ে দিতে।কিন্তু কোথাও একটা জড়োতা রয়েই যায়।বার বার মনে হয় সে জয়কে ঠকাচ্ছে।তার জন্যে জয় কষ্ট পাচ্ছে।রোশনির মনে প্রশ্ন আসে, সে কি সত্যিই কখনো ভালবেসে ছিল জয়কে? নাকি সবটাই ছিল বন্ধুত্ব? অধির কাছে থাকলে সে যে টান অনুভব করে সেটা জয় কাছে থাকলে কেন অনুভব হয় না? জয়ের প্রতি কেন শুধু তার মায়াটাই আসে?রোশনি ভেবে পায় না জয়ের প্রতি তার ভালবাসা ছিল নাকি ভাললাগা? তাহলে কেন জয়কে না পাওয়ার থেকে জয়ের কষ্ট দেখে বেশি কষ্ট হয় তার?ভালবাসলে তো জয়কে না পাওয়ার কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করতো।কিন্তু এমনটা তো তার মনে হয় না।শুধু মাত্র জয়ের করুন মুখটা দেখলে তার নিজেকে অপরাধি মনে হয়।মায়া হয়।তবে কি সে জয়কে কখনো ভালোই বাসে নি? বন্ধুত্বটাকেই কি ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছে সে? তবে সে কাকে ভালবাসে? অধিরকে??? অধিরকে কি সত্যিই সে ভালবেসে ফেলেছে? নয়তো অধিরের কষ্টে তার কেন এত কষ্ট হচ্ছে? কেন অধিরের জন্য তার বুকটা জ্বলছে?রোশনি আর ভাবতে পারছে না।মাথা ফেটে যাচ্ছে এত এতো প্রশ্নে।মাথা ভর্তি প্রশ্ন অথচ একটাও উত্তর নেই।কোথায় পাবে সে এই প্রশ্নের উত্তর? কে দেবে তাকে উত্তর?

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here