শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ৩৪

0
3656

#শেষ বিকেলের আদর ❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৩৪

🌼
বন্ধ রুম জুড়ে বিরাজ করছে নিস্তব্ধ নিরবতা।গুমোট এই পরিবেশকে ছাপিয়ে মাথার উপরে সিলিং ফ্যানটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে ক্লান্তিহীন। রুম জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আগরবাতির তীক্ষ্ণ গন্ধ।ঘড়ির কাটা পাঁচটার ঘরে পৌছাতেই টং করে আওয়াজ হলো।জয় এবার সচেতন চোখে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলো।বাইরের পরিবেশ আর রুমের পরিবেশ এই মুহূর্তে সম্পূর্ন ভিন্ন।বাইরে এখন হলুদের অনুষ্ঠান চলছে।সবাই ব্যস্ত নিজেদের মত।জয়ের ভাবনার সুতো কাটলো মিসেস আনোয়ারা চৌধুরির প্রশ্নে।

-কে তুমি? এই বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য কি তোমার?

জয় জানতো তাকে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।তাই খুব বেশি অবাকতার লক্ষন তার মাঝে দেখা গেলো না।আনোয়ারা চৌধুরির চোখে চোখ রেখে সোজা হয়ে বসলো সে।জয়ের শান্ত চাহনিতে কপালে দু তিনটে চিন্তার ভাজ পড়লো মিসেস অানোয়ারার।ঝুলে পড়া চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-তুমি যেমনটা দেখাও সেটা তুমি নও।তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্যও ভিন্ন।আমি জানতে চাইছি তুমি কে? কি তোমার পরিচয়? রোশনির সাথে তোমার সম্পর্ক কি? সব প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।

মিসেস আনোয়ারার শক্ত পোক্ত রাগি চেহারা দেখে মুচকি হাসলো জয়।এই বয়সেও কথার কত তেজ? সদ্য যৌবনে পা ফেলা কিশোরীর মত অবাধ্য প্রশ্নের ঝুড়ি দেখে খানিক অবাকও হলো সে।জমিদারের বউ বলেই হয়তো তেজটা নিজের ভেতরে এখনো যত্ন করে রেখেছে।চামড়ায় জড়োতা দেখা দিলেও কথায় কোনো জড়োতা নেই।মুক্ত কিশোরীর মত তপ্ত রাগে রাগান্বিত তার গলার স্বর।

-আমি জয় দাদি।এতো সহজে তো ভোলার মত বিষয় নয় এটা।তাহলে নতুন করে জানতে চাওয়ার কারন?

গলার স্বরটা আরো খানিকটা গম্ভির করলেন মিসেস আনোয়ারা চৌধুরি।বাম হাতে চশমাটাকে নাকের ডগা থেকে ঠেলে দিয়ে ক্রোধ দেখিয়ে বললেন,

-ভুলিনি কিছুই।শুধু আরো খানিকটা জানার আগ্রহ দেখাচ্ছি।তোমার এ বাড়িতে আসার কারনটা স্পষ্ট করতে চাচ্ছি।আশা রাখছি আমার মনে জমা হওয়া সব প্রশ্নের উত্তর তুমি দেবে।

জয় প্রতিউত্তরে হাসলো।শান্ত গলায় বললো,

-বলুন কি জানতে চান।

-রোশনিকে চেনো তুমি?

-জ্বি চিনি।

-কি হয় তোমার?

-সত্যিটা বললে সেটা কি আপনার ভালো লাগবে দাদি?

উনি তেজ নিয়ে বললেন,

-আমার কোনটাই ভালো লাগবে কোনটাই খারাপ সেটা দেখার বিষয় তোমার না।আমার শুধু প্রশ্নের উত্তর চাই।

-রোশনি আমার বন্ধু।না ঠিক বন্ধু বলা যায় না।বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু।

-বেশি কিছু বলতে?

-ভালোবাসি আমি ওকে।

-আর রোশনি?

-হয়তো বাসে। আবার হয়ত না।

অানোয়ারা চৌধুরি এবার বিছানায় গিয়ে বসলেন।কিছুক্ষন নিরব থেকে আবারো প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

-তোমরা যদি দুজন দুজকে ভালোইবাসো তাহলে রোশনি অধিরকে কেন বিয়ে করলো?

-বাধ্যে হয়েছে বিয়ে করতে।

-মানে?

-মানে অধির বাধ্য করেছে রোশনিকে বিয়েটা করতে।রোশনি ইচ্ছে করে করেনি বিয়েটা।

জয়ের কথা শেষ হতেই উনি বিষ্ময় নিয়ে তাকালেন।সন্দিহান চোখে চেয়ে বললেন,

-তুমি যে মিথ্যে বলছোনা তার প্রমান কি?

জয় হেসে ফেললো।বললো,

-প্রমান না থাকলেই কি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে দাদি? যদি প্রমান চান তাহলে রোশনিকে বা অধিরকে গিয়ে প্রশ্ন করুন।আশা করি উত্তর পেয়ে যাবেন।

-আর কিছু জানার আছে আপনার? থাকলে বলুন কি জানতে চান।

উনি এবার সরু চোখে তাকালেন।কেন জানি জয়ের চোখ দেখে তার মনে হচ্ছে ও মিথ্যে বলছে না।যার চোখ এতো নিষ্পাপ সে কখনো মিথ্যে বলতে পারে না।মাথার চুলগুলোতে এমনি এমনি তো আর পাক ধরেনি তার।মানুষ চেনার ক্ষমতা তার আছে।এই দির্ঘ জিবনে তিনি অনেক মানুষই দেখেছেন।মানুষের চোখ দেখেই তিনি বুঝে যান সেই মানুষটা কতোটা সঠিক।

-ঠিক আছে এক মুহূর্তের জন্য মেনে নিলাম তুমি যা বলছো সব সত্যি।কিন্তু তোমার এখানে আসার কারন কি?

-উত্তরটা আপনার পছন্দ হবে না দাদি।তবুও বলছি,,,,আমার এখানে আসার কারন রোশনি।ওকে এই খাঁচা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছি আমি।

-সেটা কি খুব একটা ভালো দেখাবে বলে তোমার মনে হয়?মানছি তুমি রোশনিকে ভালোবাসো কিন্তু রোশনি তোমাকে ভালবাসে কি না সেটা তুমি নিজেই জানো না।হতে পারে ও তোমাকে শুধু বন্ধুর নজরে দেখে।

-রোশনি আমাকে ভালবাসে দাদি।এটা আমি জানি।ওর চোখ বলে ও আমাকে ভালবাসে।আর আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে তবেই যাবো।

-আবেগের বশবর্তী হয়ে কেন ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো তুমি?বাস্তবতা মেনে নাও।রোশনির বিয়ে হয়ে গেছে।তুমি ওর সামনে না থাকলে ও হয়তো খুব তাড়াতাড়ি অধিরকে মেনেও নেবে।এই কয়দিনে বুঝে গেছি আমার নাতিটা মেয়েটাকে পাগলের মত ভালবাসে।এই প্রথম দেখলাম অধির কোনো মেয়ের জন্যে এতোটা পাগলামি করছে।নিজের মায়ের বিরুদ্ধে যেতেও দুবার ভাবছে না। রোশনিকে ছাড়া ছেলেটা বাঁচবে না। তুমি এমনটা করো না জয়।চলে যাও এখান থেকে।

-অধির আপনার আপন বলেই হয়তো এই কথাটা বলতে পারছেন দাদি।ওর চিন্তাটাই আপনার মাথায় আসছে।অধিরের প্রতি টানে আমার কষ্টটা আপনার চোখে পড়ছে না।রোশনিকে ছাড়া আমি যে গুমরে গুমরে মরছি সেটা কি আপনার চোখে পড়ছে না দাদি? আজ আমি যদি আপনার নাতি হতাম তাহলেও কি আপনি এই একই কথা বলতেন?

জয়কে উত্তর দেওয়ার মত আর কোনো শব্দ খুজে পেলেন না তিনি।গম্ভির চোখ জোড়া নামিয়ে নিলেন।জয় বাম হাতে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া গরম নোনা জলটুকু মুছে নিয়ে রুম ত্যাগ করলো।তার আর ভালো লাগছে না।বড্ড ক্লান্ত সে।মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে।তার এই একাকীত্ব জিবনে সাথে থাকবে নিকষ কালো কিছু ব্যর্থ স্মৃতি ।মন খারাপের সময়গুলোতে সেই স্মৃতি পাতা উল্টেই কাটিয়ে দেবে প্রতিটা যন্ত্রনাময় প্রহর।জয় ভাবে।মনকে প্রশ্ন করে তার কষ্ট গুলো বোঝার মত কি কেউ নেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?মন জবাব দেওয়ার আগেই জবাব দিলো সচেতন মষ্তিষ্ক। বললো,
‘না কেউ নেই।তুমি একা সম্পূর্ন রকম একা।’

প্রায় সাথে সাথেই মন বলে উঠলো,
‘ভুল।তুমি একা নও। খুজে দেখো কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবে।অধিরের ভালবাসা আর পাগলামির আড়ালে তোমার কষ্টটা ফিকে হয়ে গেছে।তাই তো কারো চোখে তোমার কষ্টটা ধরা পড়ছে না।রোশনির প্রতি অধিরের এই ভালোবাসা আর পাগলামোর কাছে তোমার কষ্ট গুলো চাপা পড়ে গেছে সেই অনেক আগেই।’

সাথে সাথেই গর্জে ওঠলো মষ্তিষ্ক। মেজাজ দেখিয়ে বললো,
‘কথাটা নিতার্থই যুক্তিযত নয়।অধির যা করেছে ওটাকে ভালবাসা বলে না।ওটা জিদ।জোর করে হাসিল করে নেওয়ার জিদ।রোশনি তোমাকে ভালবাসে।মুক্ত করো তাকে এই খাঁচা থেকে।’

মন আবারো জবাব দিলো,
‘এমনটা করো না।রোশনি যদি বন্দি থেকেও থাকে তবে সেটা ভালোবাসা নামক খাঁচায় বন্দি।তাকে সেখানেই থাকতে দাও।’

মষ্তিষ্ক আবারো জানান দিলো,
‘ভাঙা মনের কথা শুনে নিজের ভালবাসাকে হারিয়ে যেতে দিয়ো না তুমি।তুমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছো সেটা পূরন করো।’

মন আর মষ্তিষ্কের প্রশ্ন উত্তরের পালা শেষ হতেই দির্ঘশ্বাস ফেললো জয়।সে সব সময় মনের কথায় শুনে এসেছে। কিন্তু আজ তার মনের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।মন যখন ভেঙে যায় তখন মষ্তিষ্কইতো বেটার অপশন।

জয় চলে যেতেই চিন্তার পরিমান বাড়লো মিসেস অানোয়ারা চৌধুরির।এরপর কি হবে সেটা ভেবেই তিনি ভয় পাচ্ছেন।জয়কে তিনি শুরু থেকেই খেয়াল করেছেন। রোশনির দিকে মায়া মায়া চোখে তাকানোটা তার নজর এড়াতে পারে নি।তার সন্দেহ হয়েছিল কিছুটা।আজ যখন রোশনির ছবি জড়িয়ে জয়কে কাঁদতে দেখলো তখনই তিনি নিশ্চিত হলেন যে জয় রোশনিকে চেনে।তাইতো তিনি জয়কে রুমে ডেকে এনে সত্যিটা জানতে চাইলেন।কিন্তু এর পর কি হবে?

হলুদ আর সাদার মিশ্রনে ডিজাইন করা লেহেঙ্গা পড়েছে রোশনি।চোখ জুড়ে ঘন কালো কাজল,ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। আর সেই সাথে শরির জুড়ে দামি অর্নামেন্টস। লম্বা বেনীটাকে পেছন থেকে ঘুরিয়ে সামনে এনে রাখলো রোশনি।দুগালে হলুদ লেপ্টে চোখ মুখ কুচকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে।রোশনির প্রতিটা মুভমেন্ট খুব গভির ভাবে লক্ষ্য করছে অধির।মেয়েটা তাকে দিন দিন আরো উন্মাদ করে তুলছে।অধির কোনো দিন ভাবেও নি সে কোনো মেয়ের জন্যে এতোটা ডেসপারেট হয়ে যাবে।এতোটা উন্মাদ হবে ।যেখানে সবাই অধিরের পেছনে ছুটে সেখানে অধির এই মেয়ের পেছনে ছুটছে।সে নিজেও জানে না ঠিক কতোটা ভালবাসে সে এই মেয়েকে।এতোটা ভালবাসলো কবে সেটাও জানা নেই।অধির হাসলো।রোশনির অগোচরেই সেই হাসি মিলিয়ে গেলো। কালো রঙের পান্জাবির কলারটা ঠিক করে সামনের দিকে পা বাড়ালো।পান্জাবির হাতা দুটো কনুই অবধি গুটাতে গুটাতে রোশনির সামনে গিয়ে দাড়াতেই ভ্রু কুচকে তাকালো রোশনি।মিনিট খানিকের মত ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকেও যখন দেখল অধির কিছুই বলছে না তখন মুখ খুললো সে।চোখ ছোট ছোট করে বললো,

-কি সমস্যা? কি চাই?

অধির বাকা হেসে বললো,

-কিস চাই।

রোশনি চোখ মুখ কুচকে তাকালো।বললো,

-মানে?

রোশনির কোমর জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিতেই হকচকিয়ে গেল রোশনি।অধিরের চওড়া বুকে হাত লাগিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো।বললো,

-কি করছেন? ছাড়ুন আমায়।

অধির রোশনির ঠোটের দিকে গভিরভাবে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-হুশশশশশ…….ডোন্ট টক সুইটহার্ট। জাস্ট কিস মি।মাই লিপস নিড ইউর কিস।

অধির মুখ এগিয়ে আনতেই মাথাটা পিছিয়ে নিলো রোশনি।ভয়ার্ত চোখে তাকাতেই হেসে উঠলো অধির।রোশনির কোমরটাকে আরো একটু শক্ত করে ধরে বললো,

-রিল্যাক্স সুইটহার্ট। আমি তো মজা করছিলাম।তোমার এই ভয়ার্ত রুপটা দেখতে আমার ভিষন লাগে।আই জাস্ট লাভ ইট।

রোশনি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই হেসে দিলো অধির।রোশনি অধিরের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলে আরো কাছে টেনে নেয় অধির।রোশনি আশেপাশে দেখে নিয়ে বলে,

-দেখুন এখানে অনেক মানুষ।কেউ দেখে ফেলবে।প্লিজ ছাড়ুন।

-দেখলে দেখবে।অধির চৌধুরি কাউকে ভয় পায় নাকি? এখন এই নড়াচড়া বন্ধ করে স্ট্রেট দাড়াও আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

-মানে কি?কি করবেন আপনি?

-হুসসসসসস,,,,কথা বলো না।

অধির পকেট থেকে একটা বেলিফুলের মালা বের করতেই ভ্রু কুচকে তাকালো রোশনি।বেলি ফুলের গন্ধে সে বরাবরই মাতাল হয়।হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় সেই গন্ধের মাঝে।অধির খুব যত্ন নিয়ে রোশনির লম্বা বেনীতে মালা প্যাঁচাতে লাগল।প্যাচানো শেষে বেলি ফুলে মোড়া বেনিটাকে নাকের কাছে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো।রোশনির আরো একটু গা ঘেষে দাড়াতেই অধিরের শরিরের গন্ধ এসে বারি খেলো নাকে।রোশনি কাপলো। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা তুমুল গতিতে চলতে শুরু করলো।রোশনির মনে হচ্ছে অধিরের কান পর্যন্ত পৌছে যাবে এই ঢিপঢিপ শব্দ।রোশনি সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো দূরে জয় ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।রোশনির বুক কাপলো।মনের কোথাও একটা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব হলো।হলো অপরাধবোধ।জয় অসহায় মুখ করে চলে যেতেই ছিটকে সরে এলো রোশনি।অধিরের দিকে না তাকিয়েই হাটা দিলো সে। রোশনির বুক জ্বলছে।অধির কাছে আসলে এখন আর তার অস্বস্তি বা রাগ হয় না।অধিরের ছোঁয়াতে এখন সে লজ্জা পেয়ে শিহরিত হয়।অধিরের সঙ্গও এখন তার খারাপ লাগে না।সারাক্ষণ অধিরের আশেপাশেই থাকতে ইচ্ছে হয় এখন।কিন্তু জয়…? জয়কে দেখলেই যে তার বুকটা জ্বালা করে ওঠে।কলিজা পুড়ে যায়।ছেলেটার মায়াভরা মুখটা দেখে মরে যেতে ইচ্ছে হয়।ওই ছেলেটার তো কোনো দোষ নেই।দোষ না করেও সে কেন কষ্ট পাবে? এতো গুলো বছর অপেক্ষা করে কেন শূন্য হাতে ফিরতে হবে তাকে? রোশনি দৌড়ে চলে গেলো বাগানের অন্যকোনায়।এদিকটাই মানুষ নেই।রোশনি মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো।চোখ থেকে পানি পড়ে গাল ভিজে যাচ্ছে তার।অপরাধবোধ আর অসহায়ত্বের পাটাতনে সে পিষে যাচ্ছে ক্রমাগত। অনেক তো হলো।এবার একটু মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে চাই সে।এই বিষাদ ভরা জিবন থেকে মুক্তি চাই তার।নিস্তার চাই এই অসহ্য যন্ত্রনা থেকে।

“আর পারছি না,কোথায় লুকাবো
সত্যিই খুঁজে পাচ্ছি না।
আর পারছি না, কোথায় লুকাবো
সত্যিই খুঁজে পাচ্ছি না।

অন্ধকারের অতলে ডুবে যায়, যাই না?
এতোটুকু চাওয়া তবুও, কেন পাই না?

ভালোবেসে ভুল করিনি
ভুল করেও ভালোবাসি নি।
ভালোবেসে ভুল করি নি
ভুল করেও ভালবাসি নি।

পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ,করে বুঝি হবো শুদ্ধ
না হয় ভুল দিয়ে জিবন সাজাই না?
পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ,করে বুঝি হবো শুদ্ধ
না হয় ভুল দিয়ে জিবন সাজাই না?

অন্ধকারের অতলে ডুবে যায়, যাই না?
এতোটুকু চাওয়া তবুও, কেন পাই না?

ভালোবেসে ভুল করিনি
ভুল করেও ভালোবাসি নি।
ভালোবেসে ভুল করি নি
ভুল করেও ভালবাসি নি।

নিজের সাথে নিজেই ক্রুদ্ধ,কেন হল সব রুদ্ধ?
নিয়তির সাথে এই বোঝাপড়া,আমি চাই না।
নিজের সাথে নিজেই ক্রুদ্ধ,কেন হল সব রুদ্ধ?
নিয়তির সাথে এই বোঝাপড়া,আমি চাই না।

অন্ধকারের অতলে ডুবে যায়, যাই না?
এতোটুকু চাওয়া তবুও, কেন পাই না?

ভালোবেসে ভুল করিনি
ভুল করেও ভালোবাসি নি।
ভালোবেসে ভুল করি নি
ভুল করেও ভালবাসি নি।

কারো গলায় গানটা শুনে থমকে দাড়ালো রিয়া।আশেপাশে তাকিয়ে খুজতে লাগলো কে গাইছে এমন ছ্যাকা খাওয়া গান।কাউকে চোখে পড়লো না তার।হাতে ধরে থাকা কাচের পাত্রটার দিকে তাকাতেই দেখলো চিচি মনের সুখে সাঁতার কাটছে।আগের থেকে খানিক বড় হয়েছে চিচি।খানিক স্বাস্থ্যবানও হয়েছে।শরিরের রঙটাও আগের থেকে গাঢ় হয়েছে।গাঢ় কমলা রঙের মাছটার উপর অনেকেই নজর দিয়ে বসে আছে।রিয়া হাত উচু করে চিচির দিকে তাকিয়ে বললো,

-চিচি শুনেছিস? কে যেন গান গাইলো।এই আনন্দের দিনে কেউ এমন গান গাই তুই বল।ব্যাটা নিশ্চয় ছ্যাকা খেয়ে বসে আছে।চলতো খুজে দেখি কে সেই ব্যর্থ প্রেমিক।

রিয়া গানের আওয়াজ অনুসরন করে এগুতেই গেস্ট রুমের সামনে এসে দাড়ালো।

-চিচিরে,,,, এটা তো ওই ক্রাশটার রুম রে।ব্যাটা কি সত্যি সত্যিই ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছে নাকি?তাহলে আমার কি হবে রে চিচি? প্রেম শুরু না হতেই বোধহয় আমার কচি মনটা ভেঙে গেল রে।আল্লাহ,,,,,কোন বান্দরনির প্রেমে ডুবে আছে কে জানে।আমার কষ্ট এখন কই রাখি গো।তুই এখানেই থাক চিচি।আমি দেখে আসি ব্যাটা আমার কচি মনটাকে চটকে দিয়ে কি করছে।

রিয়া চিচিকে পাশে থাকা উচু টুলের উপর রেখে জয়ের রুমে উঁকি দিতে লাগলো।রুমের দরজাটা হালকা সরাতেই দেখলো জয় খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে চোখ বুজে।রিয়া আরও একবার ক্রাশ খেলো।প্রথম দেখাতেই সে চরম রকম ক্রাশড জয়ের উপর।এরপর জয় যেদিন এ বাড়িতে কাজের জন্যে এলো সেদিন তো খুশিতে পাগল হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার।যখন শুনলো পাক্কা একমাস জয় এখানে থাকবে তখন তো মনে লাড্ডু ফুটছিল তার।পুরো একমাস তার চোখের সামনে থাকবে ছেলেটা ভাবতেই বার বার লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো।।রিয়া যত বারই ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছে জয় ততোবারই হু হা তে জবাব দিয়ে এড়িয়ে গেছে।রিয়ার ভিষন রাগ হতো জয়ের এমন ব্যবহারে।কি এমন হয় একটু হেসে মিষ্টি করে কথা বললে? ব্যাটা খারুস। এরপর থেকে কতো বার লুকিয়ে লুকিয়ে জয়কে দেখেছে তার কোনো হিসেব নেই।ক্রাশটাকে যখন প্রেমিকে পরিনত করতে চাইলো,তখনই ব্যাটা তার নরম মনটাকে ভেঙে চুরচুর করে দিলো।এখন থেকে সে অরিজিতের গান শুনবে।এফবি,হোয়াটস আ্যাপে ছ্যাঁকা খাওয়া পোস্ট করবে।ব্রোকেন হার্টের স্ট্যাটাস দেবে।রিয়া ভাবনার মাঝেই ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে।কিন্তু ততোক্ষণে জয় চোখ মেলে রিয়াকে দেখে ফেলেছে।জয় দ্রুত রিয়ার আড়ালে চোখ মুছে উঠে দাড়ালো।রিয়ার সামনে সটান দাড়াতেই ভয়ে ঢোক গিললো রিয়া।এভাবে যে ধরা খেয়ে যাবে কল্পনাও করে নি সে। রিয়া হাসার চেষ্টা করলো।রিয়াকে পর্যবেক্ষন করে নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো জয়।

-এখানে কি করছো?কি দেখছিলে লুকিয়ে লুকিয়ে?

-কই কিছু না তো।আমি তো এমনিই এসেছিলাম।

জয় কথা বাড়ালো না।শুরু থেকেই সে খেয়াল করেছে মেয়েটা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।তার আশে পাশে থাকলে লজ্জা পায়।ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে চলে আসে হুটহাট।কিছুদিন ধরে মেয়েটা তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে।এটা মোটেও ভালো ব্যাপার না।এই বয়সি মেয়েরা প্রচুর আবেগপ্রবন হয়।এরা হুটহাটই প্রেমে পড়ে ।জয় বুঝে গেছে রিয়া তার প্রেমে পড়ে গেছে।তাই তো যতোটা সম্ভব সে মেয়েটাকে এড়িয়ে চলে।সে চাইনা তার মতো অন্যকেউ প্রেম ভালোবাসার আগুনে পুড়ে ধ্বংস হোক।এই যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না।জয় দির্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো রিয়ার দিকে।শান্ত গলায় বললো,

-আমার কিছু কাজ ছিলো। তুমি এখান থেকে গেলে আমি শুরু করতাম আর কি।

রিয়া একবার মনে করলো সে জয়কে জিজ্ঞাসা করবে সে কি সত্যিই কারো প্রেমে পড়ে ছ্যাঁকা খেয়েছে।আবার ভাবলো না,,,ব্যাপারটা বিশ্রী দেখাবে।হুটহাট কাউকে এমন প্রশ্ন করা যায় নাকি।কিন্তু জয়ের এমন করে শান্ত স্বরে চলে যেতে বলা কথাটায় তার রাগ লাগলো।ক্রাশ বলে কি ব্যাটা সব সময় তাকে ইগনোর করবে নাকি?ক্রাশ ট্রাশ বাদ। ব্যাটাকে সেও এখন থেকে ইগনোর করবে হুহ।ঠিকই হয়েছে ব্যাটা ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়েছে।রিয়া চোখ কটমট করে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো।জয় বুঝলো মেয়েটা রাগ করেছে।করলে করুক। জয় চাই না মেয়েটার সাথে ভালো ব্যবহার করে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তার প্রতি আরও আকৃষ্ট করতে।এমন আচরনে যদি মেয়েটা তার থেকে দূরে সরে যায় তাহলে সে এমন ভাবেই কথা বলবে মেয়েটার সাথে।

দিনের আলো শেষ হয়ে পৃথিবীতে অন্ধকার নামলেও চৌধুরি ম্যানশন আলোই ঝলমল করছে।লাইটসের আলো সুইমিং পুলের পরিষ্কার পানিতে পড়ে অদ্ভুদ সুন্দর দেখাচ্ছে।সেই পুলের পাশ ঘেষের দাড়িয়ে আছে দিদাম।শরিরে হলুদ রঙের লেহেঙ্গা। হাতে ড্রিংকের গ্লাস।দৃষ্টি কিছুটা দূরে দাড়ানো অধিরের দিকে।আদি অনেকক্ষণ ধরে দিদামকে লক্ষ্য করছে।অধিরের দিকে দিদামকে এমন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো সে।জুসের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে দিদামের পাশে এসে দাড়িয়ে হালকা কেশে উঠলো দিদামের মনোযোগ আকর্ষন করতে।কাজও হলো।দিদাম ভ্রু কুচকে তাকাতেই ফিচেল হাসলো আদি।

-অন্যের বরের দিকে লোভ করে লাই নেই মিস ইউনিভার্সের দোকান।অযথা নজর দিয়ো না।

দিদাম শক্ত চোখে তাকালো।বললো,

-অধির আগেও আমার ছিল।আর এখনোও আমারই আছে।আমার জিনিসে ওই থার্ডক্লাস মেয়েটা ভাগ বসিয়েছে।ওকে তো আমার রাস্তা থেকে সরিয়েই ছাড়বো।

-এই ভুলটা ভুলেও করতে যেও না ইউনিভার্সের দোকান।অধির ভাইয়া তোমাকে জিবিত ছাড়বে না।এই যে এখন তুমি এখানে দাড়িয়ে আছো না? সেটা রোশনি ভাবির জন্যেই।ভাবির জন্যেই ভাইয়া তোমাকে এখানে এলাউ করছে।নয়তো…

-আমিও দেখবো কত দিন ওই মেয়ে অধিরের জিবনে থাকে।উপড়ে ফেলো দেবো অামি ওকে। সারা জিবনের মত আলাদা করে দেবো অধিরের থেকে।

রোশনি তখন ওদের পাশ দিয়েই হেটে যাচ্ছিলো।এদিকে অধিরও রোশনিকে দেখে এদিকটাতেই আসছিল।কিছু বুঝে উঠার আগেই দিদাম রোশনিকে ধাক্কা দিয়ে পুলের পানিতে ফেলে দিয়ে বাকা হেসে আদির দিকে তাকালো।আদি চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়েই ফিচেল হাসলো।দিদাম সে হাসির কারন খুজে পেলো না।আদি অধিরের হাত ধরে টেনে তাকেও পুলের পানিতে ফেলে দিয়ে বাকা হেসে দিদামের দিকে তাকালো।অধির ততোক্ষণে রোশনির কোমর জড়িয়ে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে।হঠাৎ এমন হওয়ায় রোশনিও ভয় পেয়ে দুহাতে অধিরের গলা জড়িয়ে রেখেছে।দিদাম ওদের দুজনকে এভাবে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে আদির দিকে তাকাতেই দেখলো আদির মুখে বিস্তর হাসি।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here