সংগোপনে’ পর্ব-১০

0
1809

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১০
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

আজ সকালে কুহেলির আর ঘুম থেকে ওঠার জন্য অ্যালার্মের প্রয়োজন হয় নি, আসলে ঘুম এলে তবে তো ঘুম থেকে ওঠার প্রশ্ন আসে। জীবনে এই প্রথমবার বোধহয় একটা গোটা রাত জেগে কাটাল, কোনও একটা সময়ে যেন চোখের জল গুলো আপনাথেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বোধহয় অবিরাম বর্ষণে তারাও ক্লান্ত। জানালার স্বচ্ছ কাচের সার্শি ভেদ করে যখন ভোরের প্রথম আলো কুহেলির চোখে এসে পড়ল, তখনও চোখের পাতাদুটো একে অপরের সংস্পর্শে আসেনি। দিনের আলোর আভাস পেয়ে চমকে উঠল, সারারাত জেগেও বোধহয় কুহেলির হুশ ছিল না যে গোটা একটা রাত পেরিয়ে গেছে। দেওয়ালে ঝুলন্ত ঘড়িটায় সাড়ে চারটে বাজছে, কুহেলি বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে এসে দাড়াল। আকাশের পূর্ব কোণে সবে সূর্য উকি দিচ্ছে, তাতেই রাতের আধার যেন মুছে গেছে, রাস্তা ঘাটে এখনও ব্যস্ততার ছোয়া লাগেনি সবে দু চারজনকে দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক। কুহেলির চোখ দুটো আপনা থেকেই গোলাপ গাছ দুটোর দিকে গেল, ফুলদুটোয় আর বিশেষ পাপড়ি অবশিষ্ট নেই সব ঝরে পড়ে রয়েছে নিচে। ঝরা পাপড়ি গুলো দেখে কুহেলির খারাপ মনটা আরো কেমন যেন বিষন্নতায় ভরে গেল। আজকে আর পাপড়ি গুলো কুড়িয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল না, টবের মধ্যেই গাছের গোড়ায় রেখে দিল, মুহ্যমান ফুলদুটোর অবশিষ্ট পাপড়ি গুলোয় সস্নেহে হাত বোলাতে গিয়ে কুহেলির নজর একজায়গায় গিয়ে থমকে গেল। সবুজ পাতাগুলোর আড়ালে উকি দিচ্ছে ছোট্ট একটা কুড়ি, গাছটা যেন খুব সাবধানে আগলে রেখেছে তার নতুন প্রাণ কে। কুড়িটায় আলতো করে আঙ্গুল ছোয়াতেই কুহেলির মনটা একটা অনাবিল আনন্দে ভরে গেল, কোনও এক আশ্চর্য জাদুবলে এক নিমেষে যেন ওর মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল। একচিলতে হাসি ওর ঠোঁটের কোণায় খেলে গেল, ধীরে ধীরে সকাল হচ্ছে, কালো আধারের শেষ কণা টুকুও কোথায় যেন মিলিয়ে গেল, কুহেলির মনের অন্ধকারও যেন সেই সঙ্গে ফিকে হয়ে আসছে। ব্যালকনির রেলিঙে হাত রেখে খোলা আকাশের দিকে তাকাল কুহেলি, নতুন দিনের নতুন আলোয় ঝলমল করছে নীল আকাশটা, সেদিকে তাকিয়ে আপন মনে বলল,

থেমে গেলে চলবে না, এখনও আমার অনেক কাজ বাকি। জীবনের একটা অপূর্ণ ইচ্ছে আমার বাকি স্বপ্ন গুলোকে ভেঙে দিতে পারে না, মা আর ঠাম্মুর জন্য যে এখনও অনেক কিছু করা বাকি। মিস কুহেলি বসু, তুমি স্বর্গীয় অরিন্দম বসু আর চৈতালী বসুর মেয়ে, ওদের মেয়ে হয়ে তোমার এইভাবে ভেঙে পড়া মানায় না। এখনও তো অনেকটা পথ বাকি, আরও কত আঘাত আসবে, তাতে থেমে গেলে তো চলবে না, আমার আসল স্বপ্নটাই তো এখনও বাকি।

সকালের মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল কুহেলি, হঠাৎ করেই অনেকটা হালকা লাগছে, মনে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হয়েছে সেটা সারতে হয়তো সময় লাগবে কিন্তু সেই ক্ষত টাকে সে আকড়ে ধরবে না। হঠাৎ কুহেলির মনে পড়ল কাল অঙ্কিত মেসেজ করেছিল আজ মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল আসবেন, এমনিতেই কালকে একদম কাজে হাত দেওয়া হয়নি, তারমধ্যে যদি আজকের মিটিংএ কোনরকম কমতি থেকে যায় তাহলে আবার হয়তো গোটা প্রজেক্টটা চেঞ্জ করতে বলবেন। কুহেলি তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে স্নান সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল, সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে এখনও হাতে অনেকটা সময় আছে। কাজ করতে করতে কখন যে সাতটা বেজে গেছে খেয়ালই করেনি, হঠাৎ গীতার ডাকে হুশ ফিরল,

আক্কা, সব খাবার যেমন তেমনই পড়ে আছে টেবিলে, তুমি খাওনি কালকে?

কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

ন..না মানে ওই একটা ফ্রেন্ড হঠাৎ ফোন করে ওর বাড়িতে ডাকল সেখানেই ছিলাম সারাদিন।

ও, কিন্তু খাবার গুলো তো ফ্রিজে রাখতে পারতে, সব নষ্ট হয়ে গেছে।

ভুলে গিয়েছিলাম গো, সরি, তুমি এত কষ্ট করে রান্না করলে।

আরে সরি বলার কি আছে, তুমি স্নান করে নাও আমি গিয়ে রান্না বসাই।

ঠিক আছে তুমি যাও, আমার স্নান হয়ে গেছে।

গীতা চলে যেতে গিয়েও থেমে গিয়ে ফিরে এসে বলল,

আক্কা, তুমি কি সারারাত জেগে কাজ করেছ নাকি?

কুহেলি কি উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, রাত তো জেগেছে কিন্তু কাজ করার জন্য নয়, না চাইতেও আবার মিথ্যের আশ্রয় নিতে হল।

হ্যা, আসলে কাজের বড্ড চাপ।

গীতা একটু রাগ করে বলল,

এটা কিন্তু একদম ঠিক নয়, চোখ দুটো একদম লাল হয়ে আছে, অত ওই কম্পুটারের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো হবেই।

কুহেলি গীতার কথা শুনে মনে মনে হাসল, গীতা ভাবছে সারারাত জেগে ল্যাপটপে কাজ করার জন্য ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, সত্যিটা কেউ জানে না। কুহেলি একটু হেসে বলল,

ঠিক আছে, আর রাত জাগব না, আচ্ছা শোনো, আজকে আর ব্রেকফাস্ট করো না, খিদে নেই।

ওমা, তাই বললে হয় নাকি! কিছু তো খাবে।

নাহ গীতা দি, সত্যিই কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, তুমি যাও বাকি কাজ গুলো সেরে নাও।

গীতা চলে গেলে কুহেলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিল, মোটামুটি কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বেরোনোর জন্য রেডি হল। হোয়াইট ফর্ম্যাল প্যান্ট আর লাইট ব্রাউন কালারের শার্ট টা পরে যখন আয়নার সামনে দাড়াল তখন নিজের মুখটা দেখে চমকে উঠল। একদিনেই কি অবস্থা হয়েছে, না এভাবে অফিসে যাওয়া যায় না, কুহেলি অফিসে খুব একটা সেজেগুজে যাওয়া পছন্দ করে না কিন্তু আজ মেকআপের সাহায্য নিতেই হল। যতটা সম্ভব নিজেকে সতেজ দেখানোর চেষ্টা করে কুহেলি অফিসের ব্যাগ টা নিয়ে বাইরে এল, গীতাকে বলে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল কুহেলি, ক্যাবে বসে আরও কিছুটা কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল, হঠাৎ প্যান্টের পকেটে রাখা ফোনটা জানান দিল মেসেজ এসেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি,

“গুডলাক”

এমনিই কুহেলি নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ছিল, নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কাজকে অবহেলা করেছে। তার মধ্যে এই বিরক্তিকর মেসেজ, কীকরে যে ওর এত খবর পায় কে জানে! মেসেজটা ডিলিট করে ফোনটা আবার পকেটে রেখে দিল। অফিসে ঢুকতেই দেখল সবাই আজকে অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ব্যস্ত, আসলে সবার কাছেই এই নিশীথ আগরওয়াল নামটা কেমন যেন আতঙ্কের মত। ওদের সিনিয়র ম্যানেজার পদ্মন শেট্টি তো চরকির মত এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কুহেলি নিজের জায়গায় বসে কাজ শুরু করল, একটু পরে রুহিও এসে পড়ল। ডট আটটায় আলেখ অফিসে এল, তার কিছুপরেই অঙ্কিত এসে সবাইকে মিটিং রুমে যেতে বলে গেল। কুহেলি জানে মিটিং নটায়, তাই এত আগে মিটিং রুমে যাওয়ার কথা শুনে একটু অবাক হল। ওরা সবাই মিটিং রুমে পৌঁছানোর একটু পরেই আলেখ এসে সোজা কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই বলল,

আজকের মিটিংটা এখানে হচ্ছে না, মিস্টার আগরওয়ালের সেক্রেটারি একটু আগে জানিয়েছেন ওনার শরীর টা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়েছে, তাই উনি আসতে পারবেন না, কিন্তু উনি রিকোয়েস্ট করেছেন মিটিংটা যেন পোস্টপন্ড না হয়। আমাদেরকে উনি নিজের বাংলোয় গিয়ে মিটিংটা করার অনুরোধ জানিয়েছেন, সবাই আশা করি বুঝতে পারছেন যে এখন আমাদের ওখানে যেতে হবে, কিন্তু এতজন মিলে যাওয়াটা আই ডোন্ট থিঙ্ক ঠিক হবে, তাই আমি ঠিক করেছি আমি, অঙ্কিত আর মিস বাসু মিটিংটা অ্যাটেন্ড করতে যাব। আর মিস্টার শেট্টি আপনি এদিকটা দেখে নেবেন।

মিস্টার শেট্টি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন, আলেখ মিটিং ডিসমিস করে রুম থেকে বেরোনোর সময় কুহেলি আর অঙ্কিত কে নিজের কেবিনে ডাকলেন। ওরা দুজন আলেখের সঙ্গেই কেবিনে এল, আলেখ ওদের বসতে বলে নিজেও বসল, তারপর বলল,

মিটিংটা দশটায় ফিক্স হয়েছে, ভিমানি ম্যানশন পৌঁছাতে হার্ডলি ফিফটিন টু টুয়েন্টি মিনিটস লাগবে, সো ততক্ষণে আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের একটু আলোচনা করে নেওয়া উচিত।

কুহেলিও মনে মনে এটাই চাইছিল, কিন্তু অঙ্কিত মাঝখান থেকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল,

স্যার, ভিমানি ম্যানশন কেন? আর আমি যতদূর জানি আগরওয়ালসরা তো মুম্বাইতে সেটলড।

আলেখ একটু মুচকি হেসে বলল,

ফেমাস রাইটার নন্দরাজ ভিমানির নাম শুনেছ?

ইয়েস স্যার, দুবছর আগে যিনি মারা গেলেন উনি তো? এই ব্যাঙ্গালোরেই তো থাকতেন।

হুম, নিশীথ আগরওয়াল ওনার একমাত্র মেয়ের একমাত্র পুত্র। আন্ডারস্ট্যান্ড?

ও।

তোমার কৌতূহল মিটলে আমরা কাজের কথা শুরু করি?

অঙ্কিত একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাসল, ওরা তিনজনে মিলে আলোচনা শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর আলেখ বলল,

মিস বাসু, আই থিঙ্ক এভরিথিং ইজ ফাইন।

তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

সাড়ে নটা, উই শুড লিভ নাও। মিস বাসু আপনি এই ফাইল গুলো আপনার কাছেই রাখুন। অঙ্কিত তুমি মিস্টার শেট্টি কে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আর মিস বাসুকে নিয়ে এগোও আমি আসছি।

কুহেলি আর অঙ্কিত আলেখের কথা মত সব প্রয়োজনীয় ফাইল গুলো নিয়ে নিচে চলে এল, আলেখও একটু পরেই চলে এল। গাড়িতে ভিমানি ম্যানশন পৌঁছাতে সত্যিই মিনিট পনেরোর বেশি লাগল না, বেশ বড় মাপের বাংলো। আলেখ গাড়িটা নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করার সঙ্গে সঙ্গেই নিশীথ আগরওয়ালের সেক্রেটারি উমেশ এগিয়ে এসে ওদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। একটা সুন্দর সাজানো গোছানো রুমে ওদেরকে বসিয়ে উমেশ মিস্টার আগরওয়ালকে ডাকতে চলে গেল, কুহেলি রুমটা দেখছিল, দামী দামী আসবাবের সঙ্গে এই ঘরটায় প্রচুর পেইন্টিংস রয়েছে। সবকটা পেইন্টিং যে একজনেরই আঁকা সেটা আলাদা করে বলে দিতে হয় না, প্রত্যেকটা পেইন্টিংএর মূল বিষয় বস্তু এক, ভারতীয় পুরাণ। কোনোটা গণেশের জন্ম, কোনোটা অমৃত মন্থন আবার কোনোটায় সতীর শবদেহ কাধে নিয়ে মহাদেবের প্রলয়ংকর তান্ডব। কুহেলি অবাক হয়ে ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, সেটা লক্ষ্য করে আলেখ বলল,

নন্দরাজ ভিমানির ওয়াইফ বৈশালী ভিমানি, শি ওয়াজ এ ফেমাস পেইন্টার। এগুলো সব ওনারই আঁকা, খুব অল্প বয়সে একটা কার অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, উনি বেঁচে থাকলে ইন্ডিয়ার নম্বর ওয়ান পেইন্টার হতেন।

কুহেলি অবাক হয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

আপনি তো অনেক কিছু জানেন এদের ব্যাপারে।

আলেখ একটু হেসে জবাব দিল,

জানতে হয়, যার সঙ্গে কাজ করছি তার সব খবর রাখতে হয়, অ্যান্ড আই বেট মিস্টার আগরওয়ালও আমার এবং আমার ফ্যামিলির সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন।

ওদের কথার মধ্যেই মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল ঘরে ঢুকলেন, তাকে দেখে কুহেলি চমকে উঠল, কি অবস্থা হয়েছে! ঠিক মত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছেন না, মুখটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। গায়ে একটা মোটা হাউস কোট চাপানো, এই গরমে অত মোটা একটা হাউস কোট পরা দেখে কুহেলি আন্দাজ করল হয়তো জ্বর হয়েছে। নিশীথ আগরওয়াল একটা সোফায় বসে ওদেরকেও বসতে বললেন, নিশীথ ঘরে ঢুকলে ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। ওরা সোফায় বসতেই আলেখ বলে উঠল,

মিস্টার আগরওয়াল, আমার মনে হয় আজকের মিটিং টা পোস্টপন্ড করা উচিৎ, আপনার শরীর বেশ খারাপ।

কুহেলিও বলে উঠল,

আই থিঙ্ক স্যার ঠিকই বলছেন, আপনার এখন রেস্ট নেওয়া উচিৎ, মিটিং টা পরে করলেও কোনও অসুবিধা হবে না।

নিশীথ একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি ছুড়ে দিয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

থ্যাঙ্কস ফর ইওর কনসার্ন, বাট ট্রাস্ট মি আই অ্যাম ফাইন। ইটস জাস্ট এ ফিভার, ডক্টর এসে দেখে গেছেন, ওষুধও দিয়ে গেছেন। মিটিং টা আজই হবে, এখনই হবে, হাতে একদম টাইম নেই, প্রোডাক্ট লঞ্চের ডেট ফাইনাল হয়ে গেছে, এখন একদিনও টাইম ওয়েস্ট করা যাবে না।

কুহেলি অবাক হয়ে দেখছে নিশীথ কে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওর সোজা হয়ে বসতেও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তাও নিজের কাজের প্রতি ডেডিকেশনের কোনও অভাব নেই। সত্যি এরকম ডেডিকেশন না থাকলে জীবনে সফল হওয়া যায় না। নিশীথ উমেশকে কিছু একটা বলতেই উমেশ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আলেখ কুহেলিকে স্টার্ট করার নির্দেশ দিতেই কুহেলি ওর ল্যাপটপ টা অন করে কাজের অগ্রগতি বোঝাতে শুরু করল। আগামীতে আর কি কি বাকি আছে, কিভাবে সবটা হবে সবকিছু একভাবে বলার পর যখন থামল তখনও নিশীথের দৃষ্টি ল্যাপটপের দিকেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নিশীথ কুহেলির দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর ভাবে বলল,

ইউ ওয়্যার রাইট, আজকে মিটিংটা না করলেই হত।

এটা শুনে কুহেলির গলা শুকিয়ে গেল, আবার কোথায় কি ভুল করে ফেলেছে! আলেখও বিস্মিত হয়ে গেছে, এখানে আসার আগে ও নিজে সবটা দেখেছে, কুহেলি যেভাবে সবটা তৈরি করেছে তার থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিশীথ হেসে উঠল, ওর এই আচমকা হাসিতে সবাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হাসতে হাসতে হঠাৎ নিশীথের কাশি শুরু হয়ে গেল, উমেশ একগ্লাস জল এগিয়ে দিল, একটু জল খেয়ে কাশিটা কমলে নিশীথ আবার বলতে শুরু করল।

সরি ফর দ্যাট, আসলে ঠান্ডা টা বেশ ভালই লেগেছে। কীকরে লাগল জানি না, শুধু জ্বর হলেও কথা ছিল না কিন্তু সঙ্গে এই কাশিটা বড্ড বিরক্ত কর।

আলেখ বলল,

মিস্টার আগরওয়াল আপনি বেশি কথা বলবেন না, বেশি কথা বললেই কাশিটা আবার শুরু হয়ে যাবে।

ওহ লিভ দ্যাট, বাট মিস্টার শর্মা ডু ইউ নো, দেয়ার ইজ এ রিয়েল ট্যালেন্ট ইন ইওর কোম্পানি।

তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

ইটস হার, ইউ নো মিস বাসু, আপনি নিজেও জানেন না আপনার ট্যালেন্ট ঠিক কতটা। আজকের মিটিংটা না করলেও সত্যি কোনও অসুবিধা হত না, বিকজ ইওর ওয়ার্ক ইজ জাস্ট পারফেক্ট। মিস্টার শর্মা, আই উইশ এই লাস্ট কটা দিন আমি নিজে প্রেজেন্ট থাকতে পারতাম, বাট কালকেই আমাকে লন্ডন যেতে হবে।

কুহেলি হঠাৎ মুখ ফস্কে বলে ফেলল,

আপনি এই শরীরে লন্ডন যাবেন!

কথাটা বলেই বুঝতে পারল কাজটা ঠিক করেনি, কিছুটা অনধিকার চর্চা করে ফেলেছে। আলেখ আর অঙ্কিত দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কুহেলি মাথাটা নামিয়ে বলল,

সরি, আমার এটা….

ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে নিশীথ বলল,

ইটস ওকে, নট এ বিগ ডীল। বাট মিস বাসু, আই মাস্ট গো, ওয়ার্ক কামস ফার্স্ট ইউ নো।

কুহেলি একটু হেসে চোখটা নামিয়েই রাখল। এরমধ্যে একজন এসে কফি রেখে গেল, নিশীথ বলল,

প্লিজ হেল্প ইওর সেলফ।

ওরা সবাই একটা করে কাপ হাতে নিল। এই সময়টুকু কেউ আর কোনো কথা বলল না, সবার খাওয়া হয়ে গেলে আলেখ বলল,

সো মিস্টার আগরওয়াল এবার আমরা আসি, আপনারও রেস্টের প্রয়োজন আর আমাদেরও অফিসে অনেক কাজ বাকি।

ওকে, আমি একেবারে প্রোডাক্ট লঞ্চের আগের দিন আসব। তার আগে ইচ্ছে থাকলেও আসার উপায় নেই। আসলে এই প্রজেক্টটা তো আমার হ্যান্ডেল করার কথা ছিল না, হঠাৎ ড্যাড অসুস্থ হয়ে পড়ায়… আগে থেকেই লন্ডনের ডীল টা সাইন করা রয়েছে তাই আই হ্যাভ নো চয়েস।

আলেখ ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হেসে বলল,

আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড, আপনি চিন্তা করবেন না, প্রতিদিনের আপডেট ঠিক সময়মত আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। মিস্টার আগরওয়াল এখন কেমন আছেন?

ড্যাড মোটামুটি ভালোই আছে কিন্তু ডক্টর এখন ওনাকে কমপ্লিট রেস্টে থাকতে বলেছেন। কোনরকম মেন্টাল স্ট্রেস চলবে না, সেইজন্যই তো জোর করে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছি। কাজ করলে স্ট্রেস এমনিই হবে, তাই একদম অফিসে আসতে দিই না।

খুব ভালো করেছেন, ওকে আমরা আসছি আজকে, গেট ওয়েল সুন।

নিশীথ ধন্যবাদ জানিয়ে ইশারায় উমেশকে কুহেলিদের এগিয়ে দিতে বলল। কুহেলি ঘর থেকে বেরোনোর সময় এমনিই একবার পিছন ফিরে নিশীথের দিকে তাকাতেই দেখল, নিশীথ সেই অদ্ভুত হাসিটা ঠোঁটের কোণায় এনে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। জ্বরে ম্লান হয়ে যাওয়া মুখটায় ওই হাসিটা কেমন যেন রহস্যময় দেখাল। ভিমানি ম্যানশন থেকে ওঙ্কার গ্রুপসের অফিসে যখন ওরা পৌঁছাল তখন বারোটা বাজে, অফিসে ফিরেই যে যার কাজে লেগে গেল, কাজের মধ্যে ডুবে যেতেই কুহেলি ঠিক আগের মতই সব ভুলে গেল, দেবার্ঘ্য, অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি, তার মেসেজ, আর শেষে একটু আগে দেখা নিশীথ আগরওয়ালের রহস্যময় হাসি, সব যেন উধাও হয়ে গেল। এমনকি সেই আগের মতই লাঞ্চ করতেও ভুলে গেল, কাজ শেষ করতে করতে আজকে বেশ দেরী হল, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। অফিসের বাকিরাও ওভারটাইম করছে কিন্তু সবাই মোটামুটি সাড়ে ছটা, সাতটার মধ্যে বেরিয়ে গেছে, এখন শুধু কুহেলি বাকি, বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম করা প্রয়োজন, দুপুরের পর থেকেই শরীরটা কেমন যেন দুর্বল লাগছে। কুহেলি ওর ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাড়াতেই মাথা টা কেমন যেন ঘুরে উঠল, চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। শরীরটা কেমন অবশ লাগছে, কুহেলির মনে হল ও যেন পড়ে যাচ্ছে, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ হওয়ার আগে কুহেলির মনে হল কেউ যেন ওকে ধরে নিল, একবার যেন ওর নামটাও শুনতে পেল মনে হল, তারপর…. তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। অনেকক্ষণ পরে যখন ধীরে ধীরে কুহেলি চোখ মেলে তাকাল, প্রথম কিছুক্ষণ তো এটা বুঝতেই কেটে গেল যে ও কোথায় আছে, একটু পরে বুঝতে পারল এটা অফিস আর ও আলেখের কেবিনের সোফায় শুয়ে আছে। মনে পড়ল অফিস থেকে বেরোনোর জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠেছিল, কিন্তু তারপরে আর কিছু মনে পড়ছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না, আস্তে আস্তে উঠে বসে ভাবার চেষ্টা করল, এখানে কীকরে এল, যতদূর মনে পড়ছে ও নিজের ডেস্কের সামনে ছিল, তাহলে এই কেবিনে এল কীকরে! আর কিছু মনেই বা পড়ছে না কেন! উঠে দাড়াতে গিয়ে কুহেলি বুঝতে পারল এখনও বেশ দুর্বল লাগছে। কিন্তু এখানে বসে থাকলে তো আর চলবে না, বাড়ি ফিরতে হবে। কুহেলি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের ব্যাগটা খুঁজতে লাগল, এমন সময় আলেখ কেবিনে ঢুকল, কুহেলিকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে ওর দিকে একরকম ছুটে এসে বলে উঠল,

মিস বাসু, ফাইনালি আপনার জ্ঞান ফিরেছে।

জ্ঞান ফিরেছে কথাটায় কুহেলি একটু অবাক হল, মনে মনে ভাবল,

তাহলে কি আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু হঠাৎ করে অজ্ঞান কেন হব?

আলেখ কুহেলিকে ধরে এনে আবার সোফায় বসিয়ে দিল, কুহেলির কাছে ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ল, মাথাটা ঘুরে ওঠার পরই মনে হচ্ছিল ও পড়ে যাচ্ছে কিন্তু তার আগেই কেউ ওকে ধরে নিয়েছিল, তাহলে তখন আলেখ ওকে ধরেছিল!

আলেখ ওর মনের ভাবটা আন্দাজ করে বলল,

আমি কাজ শেষ করে যখন বেরোচ্ছিলাম দেখলাম আপনি একহাত দিয়ে চেয়ারটা ধরে দাড়িয়ে আছেন, দেখেই বুঝেছিলাম সামথিং ইজ রং। তারপর হঠাৎ দেখলাম আপনি পড়ে যাচ্ছেন, আমি গিয়ে আপনাকে ধরতেই আপনি সেন্সলেস হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পরেও আপনি সাড়া দিচ্ছিলেন না, তখন আপনাকে আমার কেবিনে এনে শুইয়ে দিই।

কুহেলির খুব অস্বস্তি হতে লাগল, এইভাবে নিজের বসের সামনে এইরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়লে অস্বস্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কুহেলি ঠিক কি বলবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত করতে লাগল,

আসলে.. ওই একটু.. মানে..

আলেখ বাধা দিয়ে বলল,

আপনাকে কিছু বলতে হবে না, আর সময় নস্ট না করে চলুন।

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

কোথায়?

কোথায় মানে? সারারাত কি অফিসেই থাকবেন নাকি!

কুহেলি আবার অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, তারপর হঠাৎ চোখ গেল হাতের রিস্ট ওয়াচের দিকে। পৌনে নটা! সময় দেখেই একলাফে সোফা থেকে উঠে দাড়াল কুহেলি, এতোটা দেরী হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। আলেখ উঠে দাড়িয়ে বলল,

কি হল?

অনেকটা লেট হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরেও কিছু কাজ করতে হবে।

মিস বাসু, আজকের জন্য কাজের কথাটা মাথা থেকে বাদ দিন। ডক্টর স্ট্রিকটলি বলে দিয়েছেন আজকে আর কোনরকম স্ট্রেস না নিতে।

কুহেলি অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,

আপ..আপনি ডক্টর ডেকেছিলেন?

হ্যা, আপনি হঠাৎ ওভাবে সেন্সলেস হয়ে গেলেন, ডক্টর তো ডাকতেই হত।

কুহেলির মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল, এইরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জানলে আজকে ওভারটাইম করতই না, বাড়িতে বসেই বাকি কাজ করলে হত। আলেখ কুহেলির ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে বলল,

চলুন আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

না না স্যার, ইটস ওকে। আমি চলে যাব, অলরেডি আমার জন্য আপনার অনেক অসুবিধা হয়ে গেল।

আলেখ এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল,

মিস বাসু, হোয়াই আর ইউ সো স্টাবর্ন? একটা কথা একবার বললে শুনতে কি প্রবলেম হয়? ঠিক মত তো নিজে দাড়াতেই পারছেন না, তাও তর্ক করছেন। আমি যখন বলেছি আপনাকে ড্রপ করব দেন ইটস ফাইনাল।

আলেখের গলায় যেন একটু রাগের আভাস পেল কুহেলি। আলেখকে এইভাবে এতোটা গম্ভীর হতে বোধহয় খুব একটা কেউ দেখেনি, কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে আলেখের সঙ্গে নীচে নেমে এল। কুহেলির বাড়ির রাস্তা আলেখ চেনে, গাড়ি স্টার্ট করে আলেখ কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের রাস্তা ধরল। কুহেলি জড়সড় হয়ে বসেছিল, হঠাৎ আলেখ রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,

আপনি ঠিক কতক্ষন না খেয়ে আছেন?

হঠাৎ এই প্রশ্নের জন্য কুহেলি মোটেই তৈরি ছিল না,

মানে?

মানে টা খুবই সিম্পল মিস বাসু, ডক্টর আপনাকে চেক করে বলেছেন, আপনি অন্তত চব্বিশ ঘন্টা কিছু খাননি, আমার সামনে আপনি ভিমানি ম্যানসনে শুধু এককাপ কফি খেয়েছিলেন, সেটাও ডক্টর কে বললাম, তাতে উনি বললেন ওটাতেই আরো বেশি প্রবলেম হয়েছে। এতক্ষণ খালি পেটে থাকার পর শুধু কফি খাওয়ায় অ্যাসিডিটি হয়ে গেছে, না খাওয়া আর মেন্টাল স্ট্রেস এই দুটোই আপনার অজ্ঞান হওয়ার মেইন রিজন। আপনাকে কতবার বলেছি নিজের হেলথের দিকে খেয়াল রাখতে, কিন্তু আপনি শুনলে তো, কারেন্টলি কাজের প্রেসার বেশি সেটা আমিও জানি কিন্তু তারজন্য এইভাবে না খেয়ে কাজ করার কি যুক্তি? মিস বাসু, কাজ আমিও করি, ইনফ্যাক্ট আপনার থেকে আমার প্রেসার অনেক বেশি কিন্তু আমাকে তো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে হয় না!

আলেখকে সত্যিই এভাবে রেগে যেতে কখনও দেখেনি কুহেলি। মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোল না, আলেখ আবার বলতে শুরু করল,

কি লাভ টা হল এভাবে না খেয়ে কাজ করে? এইভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়লেন, তাও তো অফিসের মধ্যে ছিলেন, যদি রাস্তায় হতেন? আমি আগেও বলেছি শরীরটাই যদি ঠিক না থাকে তাহলে কাজটা করবেন কীকরে? এইভাবে চললে আপনার মনে হয় আপনি প্রোডাক্ট লঞ্চের দিন পর্যন্ত সুস্থ থাকবেন?

এতদূর বলে আলেখ থামল, পাশে তাকিয়ে দেখল কুহেলি মাথা নিচু করে বসে আছে। আলেখ একটু থেমে শান্ত হয়ে বলল,

সরি মিস বাসু, আমি একটু বেশিই রুডলি বলে ফেলেছি কথা গুলো, তাছাড়া আপনার পার্সোনাল লাইফে কথা বলাটাও আমার উচিৎ নয়, সরি।

কুহেলি এমনিতেই অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে ছিল, ওর নিজের গাফিলতির জন্যই আজকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আলেখের একটা কথাও অযৌক্তিক নয়, সেখানে আলেখ ওকে সরি বলছে এটা ওকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিল, ব্যস্ত হয়ে বলল,

আপনি সরি কেন বলছেন? ঠিকই তো, আমি সত্যিই খুব কেয়ারলেস।

কথার মধ্যেই কুহেলির অ্যাপার্টমেন্ট এসে গেল, আলেখ গাড়ি থামিয়ে একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল, কুহেলিও নামল। তারপর আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

সরি স্যার, আমার জন্য আপনার অনেক অসুবিধা হল, আর থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে এতোটা হেল্প করার জন্য। আই প্রমিজ স্যার, নেক্সট টাইম থেকে আপনাকে আর কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেব না।

আলেখ একটু হেসে বলল,

হুম, দ্যাটস বেটার। এখন চলুন।

কুহেলি আবার অবাক হল, ওরা ইতিমধ্যেই ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাড়িয়ে আছে আর কোথায় যাবে! স্বভাবতই কুহেলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

কোথায়?

আলেখ কিন্তু খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল,

আপনার ফ্ল্যাটে।

কুহেলি এটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল, আলেখ ওর ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা বলছে! আলেখ ইতিমধ্যে এগিয়ে গেছে, কুহেলিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

কি হল মিস বাসু? চলুন।

স্যার, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, আমি চলে যাব।

আমি জানি আপনি চলে যাবেন, আমি সেই জন্য যাচ্ছি না।

তাহলে?

ডক্টর আপনাকে অ্যাস সুন অ্যাস পসিবল কিছু খেতে বলেছেন, আপনাকে কোনও রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু আপনি আপনার বাড়ির খাবার ওয়েস্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলতেন, তাই সোজা আপনার ফ্ল্যাটেই নিয়ে এলাম, আর আপনার ওপর আমার এতটুকু ভরসা নেই, আমার সামনে আপনি ডিনার করবেন তারপর আমি যাব।

কুহেলির মনে হল আজ যেন ওর অস্বস্তিতে পড়ারই দিন, এতকিছুর পরে এখন আবার এই… কুহেলির যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না, আলেখ শর্মা ওর জন্য এতোটা করছেন। কুহেলি আরেকবার একটু মৃদু আপত্তি করার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। শেষে বাধ্য হয়ে আলেখকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এল, আলেখকে সোফায় বসিয়ে নিজে ঘরে চলে এল। কি যে করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না, ফ্রেশ না হয়ে ডিনার করার কোনও ইচ্ছেই ওর নেই, একদমই অপছন্দের কাজ এটা কিন্তু এখন আলেখকে কতক্ষন অপেক্ষা করাবে, তাই কোনরকমে হাত মুখ ধুয়ে কিচেনে চলে গেল। খাবার গুলো চটপট গরম করতে গিয়ে দেখল আজ গীতা শুক্ত রান্না করেছে, ওর অত্যন্ত প্রিয় পদ, তাই সবার আগে গীতাকে এটাই রান্না করা শিখিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, আলেখের সামনে বসে একা একা কীকরে ডিনার করবে! সেটা কীকরে সম্ভব! আবার এইভাবে আলেখকে ডিনার করতে বলাটা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারল না। আর বললেও খেতে দেবে কি? ও তো খাটি বাঙালি, ভাত ছাড়া ঘুম আসে না, তার উপর আজ আবার একেবারে ষোলআনা ঘরোয়া বাঙালি খাবার রান্না করেছে গীতা। শুক্ত, ডাল আর আলু পোস্ত, এগুলো নির্ঘাৎ আলেখ খায় না, চরম সমস্যায় পড়ল কুহেলি। শেষে দোনা মোনা করতে করতে আলেখের কাছে এসে বলেই ফেলল। আলেখ একটা ম্যাগাজিন দেখছিল, কুহেলিকে দেখে সেটা বন্ধ করে জায়গা মত রেখে ওর দিকে তাকাল।

স্যার, বলছিলাম যে… মানে..

কুহেলিকে ইতস্তত করতে দেখে বলল,

কিছু বলার থাকলে বলুন মিস বাসু। ডোন্ট হেজিটেট।

মানে, বলছিলাম যদি আপনি আজকে ডিনার টা এখানে করতেন..

কুহেলির কথায় আলেখ ব্যস্ত হয়ে বলল,

নো নো মিস বাসু, ইটস ওকে। আপনাকে আমার জন্য শুধু শুধু ব্যস্ত হতে হবে না।

স্যার, আসলে আমার মাও কিন্তু একই কথা বলেন, বাড়িতে কেউ এলে তাকে শুধু মুখে ফেরাতে নেই, আর এখন তো এমনিতেই ডিনার টাইম, তাছাড়া আমি আপনার সামনে বসে ডিনার করব আর আপনি শুধু বসে দেখবেন, এটা খুবই অড।

এই কথার পর আলেখ আর আপত্তি করল না, কুহেলি আলেখকে ডাইনিং টেবিলে এনে বসিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। একটা সমস্যার সমাধান হল বটে কিন্তু এখন খাবারের কি করবে? এইগুলো কীকরে আলেখকে খেতে দেবে! কিন্তু এখন আর ভেবে লাভ নেই, তাই দুটো প্লেট আর খাবার গুলো এক এক করে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসল। খাবার সার্ভ করার আগে কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

স্যার, আসলে…

কুহেলিকে আবার ইতস্তত করতে দেখে আলেখ বলল,

ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?

না, ঠিক প্রবলেম না, আসলে এই ডিশ গুলো আপনি বোধহয় ঠিক পছন্দ করবেন না।

আলেখ হেসে বলল,

মিস বাসু, আমি কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে মোটেই পিকি নই, শুধু টেস্টি হলেই হবে, আর আমি ট্রাই করার আগেই আপনি কীকরে বলছেন যে আমার এগুলো পছন্দ হবে না!

কুহেলি হেসে খাবার গুলো সাজিয়ে পরিবেশন করল, শুক্ত টা যে আগে খেতে হয় সেটাও বলে দিল। আলেখ এই পদ গুলো সত্যিই আগে কোনও দিনও খায়নি, খুবই সাধারণ পদ, কিন্তু অসম্ভব ভালো লাগল খেতে। বেশ তৃপ্তি করে খেল, আলেখকে এত তৃপ্তি করে খেতে দেখে কুহেলির খুব ভালোলাগল। ভাবতেও অবাক লাগছে এত বড় একটা কোম্পানির সি ই ও হয়ে কত সহজে ওর ফ্ল্যাটে বসে এত সাধারণ খাবার এত আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছে। খাওয়া হয়ে গেলে আলেখ উঠে গিয়ে একটা ওষুধ এনে কুহেলির হাতে দিয়ে বলল,

নিন, এটা ডক্টর দিয়েছেন, ডিনারের পরে খেতে বলেছেন।

কুহেলি কোনরকম কথা না বলে চুপচাপ ওষুধটা খেয়ে নিল। আলেখ বেরোনোর সময় কুহেলিকে বলল,

মিস বাসু, আজকে আর কোনরকম কাজ করবেন না, একটু রেস্ট নিন। একটা ভালো ঘুমের প্রয়োজন আপনার, আর হ্যা, ডিশ গুলো সত্যিই দারুন ছিল, বেঙ্গলি ডিশের প্রতি একটা লোভ জাগিয়ে দিলেন।

কুহেলি উত্তরে শুধু হাসল, আলেখ চলে গেলে কুহেলি নিজের রুমে এসে আগে ফ্রেশ হয়ে নিল। আজ আর সত্যিই কোনও কাজ নিয়ে বসল না, শরীরটা সত্যিই দুর্বল লাগছে। ঘরের আলো টা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল, আজকের কথা ভেবে খুব অদ্ভুত লাগছে, কয়েকটা ঘণ্টার মধ্যে কতকিছু হয়ে গেল। আলেখের একটা অন্য রূপ আজ দেখেছে সে, এই প্রথম এতোটা রাগতে দেখেছে। আবার সেই সঙ্গে ওকে কতটা সাহায্য করেছে, এমনকি ওর ফ্ল্যাটে এসে ওর সাথে ডিনার পর্যন্ত করে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম আসছে না দেখে সময় দেখার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই হঠাৎ করেই দেবার্ঘ্যর কথা মনে পড়ল, এতদিনে রোজ শোয়ার আগে ওর সাথে কথা বলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু না, ওর কথা ভেবে আর দুর্বল হবে না, ফোনটা পাশে রেখে চোখ দুটো একরকম জোর করেই বন্ধ করল, ঘুমের সত্যিই খুব প্রয়োজন ওর।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

সত্যিই একদিনে কতকিছু হয়ে গেল। নিশীথ আগরওয়ালের হাসিটা কি সত্যিই রহস্যময়! নাকি নিছকই কুহেলির ধারণা? কি মনে হয় আপনাদের, জানাবেন। আর সর্বোপরি সমগ্র গল্প টা কেমন লাগছে অতি অবশ্যই জানাবেন। আপনাদের কমেন্ট গুলো পড়লে একটা আলাদা উৎসাহ পাই। আপনাদের মূল্যবান মতামতের অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু। খুব তাড়াতাড়ি ফিরব আগামী পর্ব নিয়ে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন আর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here