সংগোপনে’ পর্ব-২০

0
1804

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২০
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলি আর আলেখ এইমুহুর্তে শ্যামবাজারের ‘মঞ্জরী’র ড্রয়িংরুমে পাশাপাশি বসে আছে। মঞ্জরী মানে কুহেলির মামাবাড়ি। স্বরূপ রঞ্জন বাবু ঠিক ওদের উল্টো দিকে বসে আছেন। আগেই বলেছি কুহেলির দাদু শ্রী স্বরূপ রঞ্জন ঘোষ এককালে নামকরা অ্যাডভোকেট ছিলেন, যাকে বলে দুদে উকিল। মানুষ চিনতে ওনার দুমিনিটের বেশি সময় লাগে না। আলেখের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ওনার যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। কিন্তু এত সহজে উনি নিজের মনের ভাবটা আলেখ বা কুহেলি কাউকেই বুঝতে দিলেন না। নিজের রাশভারী ব্যক্তিত্ব টা বজায় রেখেই কথা বলতে লাগলেন। কুহেলি ওর দাদুকে খুব ভালো করেই চেনে, আলেখকে যে ওনার পছন্দ হয়েছে সেটা ও বেশ বুঝতে পারছে, মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করল। দেবাঞ্জলির সঙ্গে আজকেও দেখা হল না, কুহেলিরা যখন এসে পৌঁছেছে তার অনেক আগেই দেবাঞ্জলি বেরিয়ে গেছে। যাই হোক, মোটামুটি ঘণ্টা খানেক কথা বলার পর স্বরূপ বাবুর চেহারার গাম্ভীর্য টা ধীরে ধীরে কমে এল, এমন কি ওনার মুখে একচিলতে হাসিও দেখা গেল। শেষে তো এমন ভাবে গল্প করতে লাগলেন যেন কত দিনের পরিচিত, নানারকম বিষয় নিয়ে গল্প একদম জমে উঠল। কুহেলির তো একসময় মনে হল ও এখানে নেই, দুজনের কেউই ওকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। তাতে অবশ্য কুহেলির একদমই খারাপ লাগছে না বরং এত সহজে আলেখ আর স্বরূপ বাবুকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে বেশ ভালই লাগছে। ওদের কথার মধ্যেই এবাড়ির রাধুনি রেবা দি এসে বলে গেল দুপুরের খাবার তৈরি। খুব একটা বেলা হয়নি সাড়ে বারোটা বাজে সবে কিন্তু স্বরূপ বাবু প্রতিদিন এই সময়েই লাঞ্চ করেন। গল্প থামিয়ে উনি বললেন,

চল আলেখ খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক, আয় কুহু।

আলেখ একটু ইতস্তত করে বলল,

আজকে লাঞ্চটা থাক, অন্য একদিন এসে খেয়ে যাব।

সেকি! ওসব হবে না, লাঞ্চ না খাইয়ে আমি ছাড়ছি না। কিরে কুহু, তুইও কিছু বল।

কুহেলি কিছু বলার আগেই আলেখ আবার বলল,

প্লিজ স্যার, আমি আজকে লাঞ্চ করতে পারব না। কিছু মনে করবেন না, আমি কথা দিচ্ছি অন্য একদিন এসে লাঞ্চ ডিনার সব করে যাব।

সে তো পরের কথা, একবার কেন বহুবার আসবে। কিন্তু আজকে কি অসুবিধা?

আসলে ড্যাড হোটেলে ওয়েট করছে আমার জন্য।

তাই তো, এটা তো খেয়ালই হয়নি। আমারই ভুল, তবে কুহু দোষটা কিন্তু তোর।

কুহেলি অবাক হয়ে বলল,

আমি আবার কি করলাম?

কি করলি মানে? ওনাকে না নিয়ে এলি কেন? কি আশ্চর্য্য! ওনার সঙ্গে আলাপ টাও হয়ে যেত। এগুলো আলাদা করে কি বলে দিতে হয়? আমারও বা এতক্ষণ এটা খেয়াল হল না কীকরে কে জানে? শুরুতে খেয়াল হলে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যেত। ছি ছি, খুব বাজে ব্যাপার হল এটা।

কুহেলিরও এখন মনে হল সত্যিই ওনাকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল, ব্যাপারটা ঠিক হল না। কিন্তু আলেখ ব্যস্ত হয়ে বলল,

স্যার প্লিজ, এত ব্যস্ত হতে হবে না, আমি ড্যাড কে নিয়েই একদিন আসব।

সেই, এছাড়া তো আর উপায়ও নেই এখন।

আলেখ আর কুহেলি ফেরার জন্য উঠল, আলেখ স্বরূপ বাবুকে প্রণাম করল। স্বরূপ বাবু আলেখের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন,

জীবনে আরও অনেক উন্নতি কর।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

উহু, আর স্যার নয়। এখন থেকে কুহুর মত তুমিও আমাকে দাদান বলেই ডাকবে।

আলেখ হেসে বলল,

ঠিক আছে, দাদান।

স্বরূপ বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল হোটেলের উদ্দেশ্যে। কুহেলি আজকে চৈতালী দেবীর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, চৈতালী দেবীই বলেছেন। কুহেলি নিজেই ড্রাইভ করছে, এর আগে কুহেলি বেশ কয়েকবার আলেখের গাড়িতে উঠেছে, আজ যাকে বলে রোল রিভার্স।

এইসময় কলকাতায় ভালো জ্যাম থাকে, একটা জায়গায় ওদের প্রায় দশ মিনিট মত দাড়িয়ে থাকতে হল, যদিও কলকাতার জ্যামের পক্ষে এই সময়টা তেমন কিছুই নয়। সেই সুযোগে আলেখ বলল,

আপনার দাদান কিন্তু ভিষন ইন্টারেস্টিং পারসন।

হুম, একসময় ডাকসাইটে উকিল ছিলেন। লোকে ওনার সাথে কথা বলতেও ভয় পেত, ইভেন এখনও পায়।

সেটা বুঝতে পেরেছি, শুরুতে আমারও বেশ ভয় হচ্ছিল।

তাই?

হুম, তবে ওনাকে ভয় পাওয়ার মত তেমন কিছু নেই কিন্তু। উনি একটা টাফ ইমেজ তৈরি করে রেখেছেন, হয়তো প্রফেশনের স্বার্থেই। সেটা এখনও রয়ে গেছে, বাইরের ইমেজটা সরালেই কিন্তু ওনার আসল ব্যক্তিত্ব টা দেখা যায়।

কুহেলি হেসে বলল,

বাহ্, খুব ভালো করেই চিনে গেছেন দেখছি।

হুম, বলতে পারেন।

কথার মধ্যেই জ্যাম সরে গেলে কুহেলি আবার ড্রাইভিং এ মন দিল। আলেখও আর কথা বলল না, এতক্ষণ সেভাবে কুহেলিকে লক্ষ্য করেনি, এখন দেখল। একদম সাধারণ সাজ আজকে, একটা হালকা হলুদ রঙের লং স্কার্ট আর কালো রঙের টপ। চুলটা উচু করে পনি করা, প্রসাধন খুবই সামান্য, তাতেও কত সুন্দর লাগছে। আলেখের ঠোঁটে আপনা থেকেই একটা হাসি ফুটে উঠল। মিনিট পনেরোর মধ্যে ওরা হোটেলে পৌঁছে গেল, দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল। আলেখ বলল,

আপনি চাইলে কয়েকদিন থেকে যেতে পারেন, কোনও অসুবিধা নেই। অফিসের দিকটা আমি সামলে নেব।

কুহেলি প্রবল আপত্তি করে বলল,

না না, তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন আমার এখানে আর কোনও কাজ নেই, যা করার সব ঠাম্মু আর মাই করবে। আমি তো আজকেই ফিরব ভাবছিলাম কিন্তু টিকিট পেলাম না। কালকের সকালের ফ্লাইটে অলরেডি টিকিট বুক করে নিয়েছি।

ওকে, অ্যাস ইউ উইশ।

ওকে স্যার, আমি তাহলে এখন আসি।

হুম, সাবধানে যাবেন।

কুহেলির বাড়ি ফিরতে দুটো বেজে গেল, শৈলজা দেবী ইতিমধ্যেই খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কুহেলিও স্নান সেরে খেয়ে নিল, দুপুর বেলায় ওর আর কিছু করার থাকে না। চুপচাপ বসে বই পড়েই কাটিয়ে দিল দুপুরটা, সন্ধ্যেবেলায় চৈতালী দেবী ফেরার পর তিনজনে মিলে গল্প করতে বসল। চৈতালী দেবী আগে ওবাড়ির কথা শুনলেন, স্বরূপ বাবুর যে আলেখকে পছন্দ হবে এটা উনি জানতেন। এদিকে কালকের পর থেকে শৈলজা দেবী সুযোগ পেলেই আলেখের প্রশংসা করছেন, এখনও তাই করছেন। কুহেলি এবার একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

ঠাম্মু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, এইতো সবেমাত্র কালকে আলাপ হল। তুমি তো প্রশংসা বন্ধই করছ না, এখানে জলজ্যান্ত আমি বসে রয়েছি তাও তুমি আমার কথা বলছ না।

শৈলজা দেবী হেসে বললেন,

ও বাবা, দেখেছ চৈতালী, এই মেয়ে তো ভারী হিংসুটে। এখন থেকেই কেমন হিংসে করছে দেখ একবার।

চৈতালী দেবী হাসলেন, কুহেলিও হেসে বলল,

বেশ করব, একশো বার হিংসে করব, তুমি আগে আমার ঠাম্মু।

পাগলী কোথাকার, তুই তো সব। নাতনি আছে বলেই তো নাত জামাই আসছে।

হাসি ঠাট্টায় বেশ ভালই কাটল সন্ধ্যেটা। রাতের খাওয়ার পর্ব সেরে কুহেলি নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। কালকে সকালের ফ্লাইট, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। সকালে সময় মত উঠে তৈরী হয়ে নীচে নেমে এল, ব্রেকফাস্ট টেবিলে আবার তিনজন একসঙ্গে। চৈতালী দেবী বললেন,

এখন থেকে একটু রান্না বান্না গুলো শেখার চেষ্টা করিস, সময় পেলে মাঝেমধ্যে একটু ইউটিউব দেখে অন্তত কিছু কিছু ডিশ রান্না করিস। দুদিন বাদে শ্বশুর বাড়ি যাবি, একেবারে কিছু না জানলে চলবে কীকরে?

মা, আমি একেবারে কিছু না জানা নই। আর তাছাড়া ওঙ্কার ভিলায় গিয়ে আমাকে রান্না করতে হবে বলে মনে হয় না। মানে ওনারা করতে দেবেন বলে মনে হয় না, আর এত কাজের মধ্যে রান্না করার সময় পাবোও বা কীকরে?

ওসব বললে হয় না, আরে বাবা রোজ রোজ না করিস মাঝে মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে তো করবি। করতে হয়, নিজের পরিবারের লোকগুলোকে একটু নিজে হাতে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ানোর মধ্যেও একটা আলাদা সুখ আছে। বিয়েটা হোক ঠিক বুঝতে পারবি, আর এতে পারস্পরিক সম্পর্ক টাও আরও গভীর হয়।

কুহেলি কিছু না বলে খাওয়ায় মন দিল। শৈলজা দেবী বললেন,

অত ভেবো না চৈতালী, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই সব শিখে যায়। কুহুও ঠিক সব শিখে যাবে। ওসব কথা এখন থাক, আমি আজকে মান্তু কে গুরুদেবের আশ্রমে খোজ নিতে পাঠাচ্ছি। উনি যদি আশ্রমেই থাকেন তাহলে কালকেই একবার ওনার আশ্রমে যাব। তুমি একটু ব্যবস্থা করো চৈতালী।

ঠিক আছে মা, তবে আমি যেতে পারব না। এত ঘন ঘন ছুটি নেওয়া যাবে না, তাছাড়া বিয়ের সময় বেশ কিছুদিন ছুটি নিতে হবে। আমি বিকাশ কে বলে রাখব, ও আমাকে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবে।

তুমি গেলেও ভাল হত।

মা, তুমি যখন আছ তখন আমার কি দরকার বলত?

কুহেলির খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, সময়ও হয়ে এসেছে। উঠে নিজের হ্যান্ডব্যাগ টা নিয়ে শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবীকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ল। ক্যাব বুক করেই রেখেছিল, সকালের দিকে খুব একটা জ্যামে পড়তে হল না। সময়ের কিছুটা আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল, তারপর ঠিক সময়মত ফ্লাইট টেক অফ করল আর আড়াই ঘণ্টার জার্নি শেষে আবার ঠিক সময়মতোই ফ্লাইট টা ল্যান্ড করল। ফ্ল্যাটে ফিরে আগে বাড়িতে জানিয়ে দিল, তারপর ফ্রেশ হয়ে কিচেনে এসে দেখল কিছুই রান্না করা নেই। সেটাই স্বাভাবিক, গীতার জন্য নোট ছেড়ে গেলেও কবে ফিরবে জানিয়ে যেতে পারেনি। সুতরাং সেও বা কি বুঝে রান্না করবে, রান্না বাদে বাকি সব কাজ যে একদিনও বন্ধ হয়নি সেটা ঘরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। যাই হোক লাঞ্চের সময় ইতিমধ্যেই হয়ে এসেছে, একটু একটু খিদেও পাচ্ছে। এখন যা হোক কিছু একটা ওকেই বানাতে হবে, ফ্রিজে দেখল ডিম রয়েছে, ব্যাস আর কি চটপট ভাত তার সঙ্গে একটা আলু সেদ্ধ বসিয়ে দিল। তারপর বেশ জমিয়ে পেয়াজ আর লঙ্কা কুচি দিয়ে দুটো ডিম দিয়ে ডবল ডিমের অমলেট বানাল। গরম গরম ভাত, আলু সেদ্ধ, ডবল ডিমের অমলেট আর সঙ্গে ঘি। খাওয়াটা মন্দ হল না, খাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। নতুন প্রজেক্টটা নিয়ে অনেক কাজ বাকি, দুপুর পেরিয়ে বিকেল নামল, একসময় বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যেও হয়ে এল কিন্তু কুহেলির সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কাজের মধ্যে ডুবে গেলে কোনদিনই বা সময়ের জ্ঞান থাকে ওর। আরও কতক্ষন ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থাকত কে জানে, কিন্তু কুহেলি ক্লান্ত না হলেও ল্যাপটপ টা ক্লান্ত হল। তার উদর শূন্য হয়ে এসেছে এখন তাকে খেতে দিতে হবে, সুতরাং একরকম বাধ্য হয়েই কাজ বন্ধ করে ল্যাপটপ টা চার্জে বসাল। টানা এতক্ষণ কাজ করে ঘাড় টা ব্যথা করছে, ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। কাজ বন্ধ করলেও মাথায় প্রজেক্টের কথাই ঘুরতে থাকল, কে বলবে এই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে! এতটুকু মাথা ব্যথা নেই, সারাদিন শুধু কাজ। অবশ্য এই বিয়েটা নিয়ে ওর মনে অন্য মেয়েদের মত উত্তেজনা না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এটা তো আর ভালোবাসার বিয়ে নয়, আবার বাড়ি থেকে ঠিক করা বিয়েও নয়। ওর কাছে এটা অনেকটা কাজের মতই, নিজের প্রিয় মানুষ গুলোর খুশির জন্য ওর আর আলেখের মধ্যে হওয়া একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া। এই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে তৈরি হওয়া সম্পর্কটা পরিনয়ের পর কোন পরিণতির দিকে এগোয় সেটাই এখন দেখার। যাইহোক, সেই পরিণতির আপাতত এখনও দেরী আছে। কুহেলির হঠাৎ একটু কফি খেতে ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনে আবার সোফায় বসল। টিভিটা একটু অন করবে ভাবছিল কিন্তু তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রীনে আলেখের নামটা ভেসে উঠেছে।

গুড ইভনিং স্যার।

গুড ইভনিং মিস বাসু, আপনি ফিরেছেন?

ইয়েস স্যার, সকালের ফ্লাইটেই, কালকে বললাম না আপনাকে।

ওহ ইয়েস, ভুলে গিয়েছিলাম। তাহলে কালকে অফিসে আসছেন তো?

অফকোর্স।

গ্রেট, আসলে একটু আগেই আমাকে অঙ্কিত কল করেছিল, মিস্টার আগরওয়ালের সেক্রেটারি উমেশ ওকে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে কালকে মিস্টার আগরওয়াল একটা মিটিং করতে চান। আপকামিং প্রজেক্ট নিয়েই, কিন্তু এবারের মিটিংটা ওনার অফিসে হবে। আমরা আগামীকাল যেতে পারব কিনা সেটা আজকেই কনফার্ম করতে হবে। এইজন্যই আপনাকে কল করলাম, কনফার্ম করার আগে আপনার সঙ্গে কথা বলাটা দরকার ছিল। কারণ মিটিং অ্যাটেন্ড করার আগে…..

কুহেলি আলেখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল,

আপনি কনফার্ম করে দিন স্যার, আমি অলরেডি নিউ ফাইলটা স্টাডি করে নিয়েছি।

আলেখ একটুও অবাক হল না, কাজের ক্ষেত্রে কুহেলির অসাধ্য কিছুই নেই। কাজ সংক্রান্ত আরও কিছু কথা বলার পরে কুহেলি ফোনটা রেখে কিচেনের দিকে এগোল। দুপুরে তো সেদ্ধ ভাতে কাজ চালিয়ে দিয়েছে এবেলায় কিছু তো করতে হবে। চৈতালী দেবীর কথাও রাখা হবে, যাই হোক ফ্রিজে অল্প কিছু সবজি ছিল সেগুলো দিয়ে একটা তরকারি আর ডাল বানাল। রান্না সেরে আগে স্নান করল, গরমের মধ্যে রান্না করার পর যে কি অবস্থা হয় সেটা বলাই বাহুল্য। স্নান সেরে গরম গরম খাবার গুলো উদরস্থ করে সোজা শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য তৈরি হতে হতেই গীতা এসে পড়ল। এসেই তার একগাদা প্রশ্ন, এরকম হঠাৎ বাড়ি কেন গিয়েছিল, সব ঠিক আছে কিনা, বাড়িতে কারোর কিছু হয়নি তো। এইরকম নানা প্রশ্ন একসাথে কুহেলির দিকে ছুড়ে দিয়ে তবে শান্ত হল। কুহেলি চুপচাপ আগে সবটা শুনল, তারপর হেসে বলল,

একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে উত্তর টা দেব কীকরে! একটু দরকার ছিল তাই গিয়েছিলাম, সব ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না।

এমন হুট করে চলে গেলে চিন্তা তো একটু হবেই। আগেই তো সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসে।

আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে এখন তো শুনলে সব ঠিক আছে কিছুই হয়নি। এখন চিন্তা টা বাদ দিয়ে ব্রেকফাস্ট বানাও জলদি, দেরী হয়ে যাবে।

গীতা হেসে কিচেনে চলে গেল, কুহেলি ইচ্ছে করেই বিয়ের কথাটা চেপে গেল। কেন যেন ওর এখন এটা বলতে ইচ্ছে হল না, গীতা ঝটপট ব্রেকফাস্ট এনে দিল। কুহেলি ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। অফিসে ঢোকা মাত্রই রুহি দৌড়ে এল, আবার সেই এক প্রশ্ন। কুহেলি রুহিকেও একই উত্তর দিল, ওর মায়ের খবরও নিল। আলাপ পর্ব সেরে যে যার কাজে মন দিল, বারোটায় মিটিং সুতরাং কমপক্ষে সাড়ে এগারোটায় বেরোতে হবে। এখান থেকে আগরওয়াল অ্যান্ড সন্সের অফিস মিনিট কুড়ির রাস্তা। বেরোনোর আগে এদিকের কাজ বেশ কিছুটা গুছিয়ে নেওয়া যাবে। আলেখও প্রতিদিনের মতোই ঠিক আটটায় অফিসে এল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কেবিনে কুহেলির ডাক পড়ল। কুহেলি অনুমতি নিয়ে কেবিনে ঢোকার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আজকের মিটিং নিয়ে কিছু আলোচনা হল। তারপর সময় হলে আলেখ কুহেলি আর অঙ্কিত বেরিয়ে পড়ল আগরওয়াল অ্যান্ড সন্সের অফিসের উদ্দেশ্যে। বারোটার পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে গেল ওরা, উমেশ সোজা ওদের মিস্টার নিশীথ আগরওয়ালের কেবিনে নিয়ে গেল। নিশীথ ওদের দেখেই উঠে দাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল, প্রাথমিক সৌজন্য মূলক কুশল বিনিময়ের পরেই মিটিং শুরু হল। কুহেলি গতকালই সবটা ডিটেলে স্টাডি করেছে, কিছু ফল্ট রয়েছে প্ল্যানে যেগুলো পয়েন্ট আউট করল। মিটিং শেষে নিশীথ প্রত্যেক বারের মতই এবারেও কুহেলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

ইউ নো মিস বাসু, আমি এখন আর এই প্রজেক্টটা নিয়ে বেশি ভাবিই না। বিকজ আই নো, আপনার আন্ডারে সব পারফেক্ট হতে বাধ্য। আপনি যে পয়েন্টস গুলো বললেন, সেগুলো সত্যিই চেঞ্জ করতে হবে। আমি আজকেই আমার টিমকে ইনফর্ম করব। এগেইন, গুড জব মিস বাসু।

কুহেলি হেসে ধন্যবাদ জানাল। এরপর নিশীথ আলেখের সঙ্গে আরও কিছু আলোচনা করল, মিটিং এর মধ্যেই একজন বেয়ারা কফি দিয়ে গিয়েছিল। কাজের মাঝে খেতে পারেনি, এখন কাপটা হাতে নিয়ে বুঝল একেবারে জুড়িয়ে না গেলেও গরম আর বলা চলে না। খাদ্য বস্তু নষ্ট করা একদমই পছন্দ করে না কুহেলি তাই ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিল। আলেখ আর নিশীথ এখনও কথা বলছে, কুহেলির হঠাৎ নিশীথকে দেখে কেন যেন মনে হল ওকেও সবটা বলা দরকার। কোনও না কোনও ভাবে ওরও সবটা জানার একটা অধিকার আছে। কুহেলি ওকে ভালো না বাসলেও নিশীথের কথা অনুযায়ী সে কুহেলিকে ভালবাসে। নিজের কথা অনুযায়ী সেদিনের পর থেকে নিশীথ একদিনের জন্যও ওর ভালোবাসার কথা কুহেলিকে বলেনি, বন্ধুত্বের সন্মান রেখেছে, তাই ওরও অধিকার আছে সবটা জানার। সেইসঙ্গে আলেখেরও, নিজের সম্পর্কে সবটা জানালেও নিশীথের কথাটা এখনও বলা হয়নি। কুহেলি ঠিক করল আগে নিশীথকে সবটা জানিয়ে তারপর আলেখকে এই ব্যাপারটা জানাবে। আর সেটাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, নতুন একটা সম্পর্ক শুরু করার আগে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়াটাই ভালো। ওদের মিটিংটা শেষ হতে হতে লাঞ্চ টাইম হয়ে গেল এবং নিশীথের জোরাজুরিতে লাঞ্চটা ওনার সঙ্গেই করতে হল। লাঞ্চ সেরে ওরা যখন আবার ওঙ্কার গ্রুপসের উদ্দেশ্যে রওনা হল তখন পৌনে তিনটে বাজে। গাড়ি প্রত্যেকবারের মত আলেখ নিজেই ড্রাইভ করছে, অঙ্কিত ওর পাশের সিটে আর কুহেলি ব্যাক সিটে। নিশীথ কথায় কথায় বলছিল কালকেই আবার মুম্বাই চলে যাবে, ওখানেই ওদের মেইন অফিস। নবীন আগরওয়াল অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিশীথকেই সবটা সামলাতে হয় তাই কোনও জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারে না। এই যে কালকে মুম্বাই যাবে আবার কবে ব্যাঙ্গালোর আসবে তার ঠিক নেই, কুহেলি বেশি দেরি করতে চায় না। আজকেই কথাটা বলে নিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু নিশীথকে এভাবে মেসেজ করে দেখা করতে বলাটা ঠিক হবে কিনা সেটা বুঝে উঠতে পারল না। অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর কুহেলি মেসেজ টা পাঠিয়েই দিল।

“কিছু কথা বলার ছিল, যদি আপনার অসুবিধা না হয় তাহলে আজকে একটু দেখা করতে পারবেন? টাইম অ্যান্ড প্লেস আপনার সুবিধা মত সিলেক্ট করতে পারেন, আমার অসুবিধা নেই। আফটার ফাইভ, আই অ্যাম ফ্রী।“

ঠিক দুমিনিটের মধ্যে রিপ্লাই এল,

“আপনি সত্যি এই মেসেজ টা আমাকেই পাঠিয়েছেন? অন্য কাউকে পাঠাতে গিয়ে ভুল করে আমাকে পাঠিয়ে দেন নি তো?”

কুহেলি জানে নিশীথ এরকম কেন বলছে, আসলে নিজেও কোনোদিন ভাবেনি ও এইভাবে নিশীথ আগরওয়ালকে নিজে থেকে দেখা করতে বলবে। দ্রুত হাতে কিপ্যাডে আঙ্গুল চালাল কুহেলি।

“মেসেজটা আপনাকেই পাঠিয়েছি, আর সেটা ভুল করে নয়। আমার সত্যিই কিছু কথা বলার আছে।“

এবার সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এল,

“গ্রেট, তাহলে ঠিক ছটায় ক্যাফে ব্লু মুন।“

“ওকে”

অফিসে পৌঁছানোর পর, আবার যে যার কাজে লেগে পড়ল। আলেখের সঙ্গে কাজের বাইরে বাড়তি একটা কথাও হয়নি। পাঁচটা বাজতেই অফিস খালি হতে শুরু করল, কুহেলি হাতের কাজ টা গুছিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় আলেখ ওকে ডেকে পাঠাল। কুহেলি নক করে কেবিনে ঢুকল,

বসুন মিস বাসু।

কুহেলি একটা চেয়ার টেনে বসল। ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, পাঁচটা কুড়ি, এখনও কিছুটা সময় আছে। ক্যাফে ব্লু মুন এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, মিনিট দশেকের রাস্তা। আলেখ সেটা লক্ষ্য করে বলল,

কোথাও যাবেন?

হ্যা, মানে আসলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ছটায়।

ও, তাহলে আপনি বেরিয়ে পড়ুন, বেশি সময় তো নেই।

ইটস ওকে স্যার, খুব একটা দূরে নয়, আপনি বলুন।

শিওর?

ইয়েস স্যার।

ওকে।

আলেখ কুহেলিকে কয়েকটা ফাইল দিয়ে বলল,

এগুলো নিউ প্রজেক্টের সঙ্গে মার্জ হবে। ডিটেলস গুলো ভালো করে স্টাডি করে আমাকে জানাবেন। কোথাও কোনো ফল্ট থাকলে নেক্সট উইকের আগেই চেঞ্জ করতে হবে।

ফাইন স্যার।

ওকে, দ্যাটস অল। আপনি এখন আসতে পারেন, এরপর না হলে আপনার দেরী হয়ে যাবে।

কুহেলি একটু হাসল, মনে মনে বেশ অবাকও হল। আলেখ একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করল না ও কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। অবশ্য এতে ওর বেশ ভালই লাগল, অহেতুক কৌতূহল না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। কুহেলি একটু ভেবে জিজ্ঞেস করল,

আপনার কি আরও দেরী হবে?

হুম, একটু দেরী হবে।

ও, আমি আসছি তাহলে। এগুলো আমি দুদিনের মধ্যেই স্টাডি করে নেব।

গ্রেট। গুড নাইট মিস বাসু।

গুড নাইট স্যার।

কুহেলি কেবিন থেকে বেরিয়ে ওর ব্যাগটা নিয়ে সোজা নিচে নেমে এল, ক্যাব বুক করে নিয়েছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবে দেখাচ্ছে। পাঁচ মিনিট হওয়ার আগেই ক্যাব এসে পড়ল, ক্যাফে তে যখন পৌঁছাল তখনও ছটা বাজেনি। একটা ফাঁকা টেবিল দেখে কুহেলি বসল, একজন ওয়েটার এসে একগ্লাস জল আর মেনু রেখে গেল। ঠিক ছটায় নিশীথ এল, ক্যাফে তে ঢুকে একটু এদিক ওদিক তাকাতেই কুহেলিকে দেখতে পেল। এগিয়ে এসে কুহেলির মুখোমুখি বসে হেসে বলল,

আমার কিন্তু বিশ্বাসই হচ্ছিল না মিস বাসু, ইভেন এখানে আসার সময়ও মনে হচ্ছিল এসে হয়তো দেখব আপনি আসেননি। সবটাই আমার ইম্যাজিনেশন ছিল।

কুহেলি একটু হাসল। নিশীথ আবার বলল,

নো সিরিয়াসলি, আমি ভাবতেই পারিনি আপনি নিজে থেকে কোনদিনও আমাকে দেখা করতে বলবেন। মনে হয় আমার লাক চেঞ্জ হচ্ছে, ইটস আ গুড থিং।

কুহেলির হাসিটা এবার মিলিয়ে এল, নিশীথ হয়তো ভুল বুঝছে। কুহেলি বলল,

আপনি হয়তো ভুল ভাবছেন, আমি আসলে…..

নিশীথ মাঝপথেই কুহেলিকে থামিয়ে দিল, কথা পরে হবে। আগে কিছু অর্ডার করা যাক। বলুন কি খাবেন, ইটস মাই ট্রিট।

এনিথিং।

ওকে।

নিশীথ ওয়েটার কে ডেকে দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করল। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পরে বলল,

এবার বলুন, কি এমন কথা যার জন্য আপনি নিজে থেকে আমার সঙ্গে দেখা করলেন।

কুহেলি একটু সময় নিয়ে কোনরকম ভনিতা না করেই বলল,

আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

কথাটা শুনে নিশীথের মুখের হাসিটা নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুহেলির দিকে, কিছুক্ষণ সেইভাবেই তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বলল,

দেবার্ঘ্য?

কুহেলি শান্ত স্বরে জবাব দিল,

না, ওটা কোনদিনও সম্ভব নয়।

তাহলে? কে সে? কাকে বিয়ে করছেন আপনি?

কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

মিস্টার শর্মা।

নিশীথ যেন আকাশ থেকে পড়ল,

হোয়াট? মিস্টার শর্মা? ইউ মিন… মিস্টার আলেখ শর্মা?

ইয়েস।

নিশীথ কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল। এর মধ্যেই ওয়েটার এসে ওদের কোল্ড কফি দিয়ে গেল। নিশীথ আরও কিছুক্ষণ পর বলল,

হোয়াই?

কুহেলি কিছু বলল না, নিশীথের মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। নিশীথ আবার বলল,

দেখুন মিস বাসু আমি জানি এরকম একটা সিদ্ধান্ত আপনি এমনি এমনি নেন নি। কোনও না কোনও কারণ নিশ্চয়ই আছে, আর সেটা খুবই স্ট্রং।

কুহেলি খুব অবাক হল, নিশীথ কিছু না বলতেই এতোটা বুঝে যাবে সেটা আশা করেনি। কুহেলি একটু থেমে সবটা খুলে বলল, নিশীথ মন দিয়ে পুরোটা শুনল। কুহেলি সবটা বলে নিশীথের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে নিশীথের ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল, একভাবে কিছুক্ষণ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

মিস বাসু, আপনার এই প্রবলেম টার সলিউশন কি আমি হতে পারতাম না? আমি তো আপনাকে বলেছিলাম, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনদিনও আমার ভালোবাসার দাবি নিয়ে আপনার সামনে দাড়াব না। আমার ভালোবাসার উপর একটু ভরসা করে দেখতেই পারতেন, নিরাশ হতেন না।

আমার আপত্তিটা ওখানেই স্যার। আপনার ভালোবাসাটাই আমার আপত্তির মূল কারণ। আপনি নিঃস্বার্থ ভাবে আমাকে ভালোবাসবেন আর আমি দিনের পর দিন আপনাকে উপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারব না, এভাবে কোনও সম্পর্ক টেকে না।

হয়তো বা, কিন্তু আপনি কি শিওর মিস্টার শর্মার আপনার প্রতি কোনও ফিলিংস নেই?

এরকম একটা প্রশ্নের জন্য কুহেলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না, কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই নিশীথ আবার বলল,

মানে, এটা সত্যিই ভাবার বিষয় কিন্তু। মিস্টার শর্মা কি সত্যিই শুধুমাত্র ওনার বাবার খুশির জন্য বিয়ে করছেন। মানে আপনি যা বললেন, যে কারণ গুলো বললেন। আপনার মনে হয় সেগুলো পুরোপুরি সত্যি?

সত্যি না হওয়ার তো কোনও কারণ নেই স্যার। আমি তো নিজেই আমার পরিবারের খুশির জন্য বিয়ে করছি, আমার ক্ষেত্রে কারনটা সত্যি হতে পারলে ওনার ক্ষেত্রে হবে না কেন?

আমি বলছি না মিস্টার শর্মার কারনটা জেনুইন নয় কিন্তু…..

কুহেলি কথাটা শেষ করতে দিল না।

এখানে কোনও কিন্তু নেই, আমরা দুজনেই সব দিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছি।

কুহেলির কেন যেন আলেখের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে ইচ্ছে করল না। এরকম একটা বিষয়ে উনি মিথ্যে কথা বলতে যাবেনই বা কেন? নিশীথ খুব অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল,

বেশ, মেনে নিলাম কিন্তু আপনি ভেবে দেখেছেন, আপনাদের এই বোঝাপড়ার সম্পর্ক টা আজীবন এরকমই থাকবে তো? মানে ভেবে দেখুন, আপনি ভালোবাসাকে আর নিজের জীবনে আসতে দিতে চান না কিন্তু মিস্টার শর্মার ক্ষেত্রে তো তা নয়। উনি এখন ওনার বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত, এই মুহূর্তে উনি এইসব নিয়ে ভাবতে চান না। কিন্তু একটা সময় উনি ওনার লক্ষ্যে সাকসেফুল হবেন, ওনার ড্রিম কমপ্লিট হবে। তখন? তখন তো ওনার চাহিদা গুলো বদলাতেই পারে তাই না? তখন কি করবেন ভেবে দেখেছেন?

কথাগুলো যে নিশীথ খুব ভুল কিছু বলেছে তা নয়, কিন্তু কুহেলির খুব অসহ্য লাগছে। একটু বিরক্ত হয়েই বলল,

দেখুন স্যার সুদূর ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে এটাই সঠিক মনে হয়েছে।

নিশীথ একটু হেসে বলল,

অফকোর্স, আপনার সঠিক মনে হয়েছে বলেই তো ডিসিশন টা আপনি নিয়েছেন। আর আপনার ডিসিশন গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিকই হয়, অন্তত কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই। আই হোপ আপনার এই ডিসিশন টাও সঠিকই হবে। আর, অ্যাম রিয়েলি ভেরি গ্ল্যাড, আপনি আমাকে আপনার পার্সোনাল লাইফের কথা বলার যোগ্য মনে করেছেন।

কুহেলি কিছু বলল না, কোল্ড কফি তে একটা চুমুক দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। নিশীথ আবার বলল,

সরি, আমার কোনও কথায় যদি আপনার খারাপ লেগে থাকে দেন অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি। আমার যেটা মনে হয়েছে সেটাই বলেছি, আমি যে ঘুরিয়ে কথা বলতে ভালবাসিনা এটা তো আপনি জানেনই। একজন বন্ধুর কনসার্ন মনে করে ক্ষমা করে দেবেন।

কুহেলি একটু নরম হল,

ইটস ওকে, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু সে সরি।

নিশীথ এবার ওর কোল্ড কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল,

সো, বিয়ে টা কবে হচ্ছে?

ডেট এখনও ফিক্স হয়নি তবে মাস দুয়েকের মধ্যেই হবে।

দ্যাট ফাস্ট!

হুম।

ওকে, বন্ধু হিসেবে ইনভিটেশন পাব তো?

কুহেলি হাসল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না, দুজনেই কফিটা শেষ করার পরে নিশীথ ওয়েটারকে ডেকে বিল দিতে বলল। একটু পরেই ওয়েটার বিল নিয়ে এলে নিশীথ পে করে কুহেলিকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

চলুন আপনাকে ড্রপ করে দিই।

ইটস ওকে স্যার, আমি নিজেই চলে যেতে পারব।

কাম অন মিস বাসু, একজন বন্ধু হিসেবে এটুকু তো করতে দিন।

কুহেলি আর কিছু বলল না। কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে নিশীথ গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল, কুহেলি গাড়ি থেকে নেমে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ।

ফর হোয়াট? লিফটের জন্য? এতে থ্যাঙ্কস বলার কিছু নেই।

আমি লিফটের কথা বলছি না।

তাহলে?

সবকিছু এত সহজে বোঝার জন্য।

নিশীথ একটু থেমে বলল,

মিস বাসু, আমি যতটা আপনাকে ভালোবাসি তার থেকেও বেশি শ্রদ্ধা করি। আপনার প্রত্যেকটা ডিসিশন কেও আমি সমান শ্রদ্ধা করি, আপনি যা করবেন ভেবে চিন্তেই করবেন। ঠিক সেই কারণেই আমি আপনার এই ডিসিশন টাকেও শ্রদ্ধা করছি, কিন্তু এর মানে এটা মোটেই নয় যে আমি আপনাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেব, নেভার। আই কান্ট ডু দ্যাট, আমি আজও আপনাকে ভালোবাসি আগামীতেও বাসব, ইউ কান্ট স্টপ মি। বাট, এটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই, আমার ভালোবাসা শুধু আমার কাছেই থাকবে, একবার যখন কথা দিয়েছি তখন আর কোনোভাবেই আপনার সামনে নিজের ভালোবাসার দাবী নিয়ে দাড়াব না, আর এখন তো সেই পথ টাও আর খোলা থাকবে না। সো ডোন্ট ওয়ারি।

কুহেলি কিছু বলতে পারল না, শুধু হাসল। নিশীথ গুড নাইট উইশ করে চলে গেল, কুহেলি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর ফ্ল্যাটে চলে এল। ব্যাগটা রেখেই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল, স্নান সেরে বেরিয়ে বেশ ফ্রেশ মনে হল নিজেকে। ফোনটা বাজছে, হাতে নিয়ে দেখল শৈলজা দেবী, নিজের ফোন উনি খুব কমই ব্যবহার করেন। উনি তো ফোন নিতেই চাইছিলেন না, কুহেলি জোর করে দিয়েছিল। আজ শৈলজা দেবী নিজের ফোন থেকে কল করছেন দেখে কুহেলি বেশ খুশি হল।

হ্যালো ঠাম্মু, তুমি নিজের ফোন থেকে কল করছ, কি ব্যাপার?

আরে চৈতালীর ফোনে চার্জ নেই, আর আমার অত তর সইবে না।

কিসের এত তাড়া?

আরে তোর আর আলেখের বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে।

শৈলজা দেবীর গলায় আনন্দের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। উনি যে কতটা আনন্দিত, সেটা প্রকাশ করার মত ভাষা বোধহয় নেই। শৈলজা দেবী আবার বললেন,

আগামী ২১শে শ্রাবণ মানে ৬ই আগস্ট বৃহস্পতিবার। গুরুদেব নিজে দিন স্থির করেছেন। খুব ভালো দিন জানিস, গুরুদেব বললেন, এমন ভালো তিথি খুব কম পাওয়া যায়।

কুহেলি কিছু বলল না, চুপচাপ শুনতে লাগল। উনি অনেক কথা বললেন, এও জানালেন যে ইতিমধ্যে নাকি নভতেজ শর্মাকেও জানানো হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার ফোনটা রাখল কুহেলি। অবশেষে তাহলে বিয়ের দিনটাও স্থির হয়ে গেল, আর মাত্র কটা দিন, তারপরেই… নাহ বেশি ভাবতে আজকাল আর ভালোলাগে না। যা হচ্ছে হোক, নিজের আপনজন গুলো এত খুশি, এর থেকে বেশী আর কি চাই। কিছুক্ষণ টুকটাক অফিসের কাজগুলো সেরে সময়মত ডিনার সেরে শুয়ে পড়ল। নিশীথের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে, এখন আলেখকে নিশীথের ব্যাপারটা জানাতে পারলেই হয়। বেশি দেরি করে লাভ নেই, কুহেলি মনে মনে ঠিক করল কালকেই আলেখকে নিশীথের ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে।

ক্রমশ______________

তাহলে আলেখ আর কুহেলির বিয়ের ডেট কিন্তু ফাইনাল হয়ে গেল। আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম আপনাদের সবাইকে। সবাইকে আসতেই হবে। যাই হোক, নিশীথও সবটা জেনে গেল, খুব সহজ ভাবেই ব্যাপারটা নিয়েছে যদিও। তাও ওর মনে আলেখের প্রতি যে একটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কি এখানেই থেমে থাকবে নাকি….. থাক সে পরে দেখা যাবে। এবার আলেখের জানার পালা, নিশীথের ব্যাপারটা জানার পর আলেখের প্রতিক্রিয়া ঠিক কিরকম হতে পারে বলে মনে হয় বলুন তো? আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here