#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৩
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
পার্টি শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল, সমস্ত অতিথিরা ফিরে যাওয়ার পর এবার চৈতালী দেবীও ফেরার কথা বলতেই নভতেজ শর্মা প্রবল আপত্তি করে বললেন,
একদম না, আপনারা আজ এখানেই থাকবেন।
কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই কালকে সকালে ফ্লাইট। আমাদের লাগেজ সব ফ্ল্যাটেই রয়েছে, যেতে তো হবেই দাদা।
লাগেজের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না, কালকে সকালে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে লাগেজ নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব কিন্তু আজ কোনমতেই আপনাদের ছাড়ছি না।
ওনার সঙ্গে মেহের আর হর্ষিতাও যোগ দিলেন, অগত্যা থেকেই যেতে হল। নভতেজ শর্মা নিজে সবার ঘর দেখিয়ে দিলেন, একতলায় একটা ঘরে শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবীর থাকার ব্যবস্থা হল। দোতলায় চৈতী দেবী আর দেবাঞ্জলি একটা ঘরে আর অন্য একটা ঘরে কুহেলি আর দিঠি। সবাই আগে ফ্রেশ হতে চলে গেল, বিশেষ করে কুহেলি। এতকিছু পরে আর থাকতে পারছে না, লেহেঙ্গা আর গয়না গুলো খুলে একটা হালকা সুতির চুড়িদার পড়ল। চুড়িদারটা অবশ্য ওর নিজের নয়, দিঠির, দিঠি কি মনে করে ওর দুসেট ড্রেস সঙ্গে করে এনেছিল। ভাগ্যিস এনেছিল, নাহলে এখন হয় বুয়াজি আর নাহয় চাচিজির ড্রেস পরতে হত, যেমন বাকিদের পরতে হচ্ছে। দিঠি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বলল,
সে কিরে! এখনও চুল নিয়েই বসে আছিস!
কুহেলি একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
ধুর, আর বলিস না তো, কোথায় কোথায় কিভাবে যে কি করেছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
দাড়া, আমি হেল্প করছি।
দিঠি ওর চুল খুলে দিতে দিতে বলল,
দি, জানিস পার্টি তে সবাই তোর খুব প্রশংসা করছিল।
তাই?
হুম, আর করবে নাই বা কেন? তোকে আজকে যা লাগছিল না, জাস্ট অসম। তোকে আর জিজুকে একসঙ্গে যে কি ভালো লাগছিল কি বলব। সবাই বলেছিল, একসাথে দারুন মানিয়েছে তোদের দুজনকে।
কুহেলি অল্প হেসে বলল,
হয়েছে, এবার তাড়াতাড়ি চুলটা উদ্ধার কর তো, আর পারছি না।
দিঠি ধীরে ধীরে কুহেলির চুল টা খুলে দিতেই কুহেলি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
উফফ, বাঁচলাম। দাড়া, এবার চট করে ফ্রেশ হয়ে আসি, মেকআপ তুলতে না জানি আরও কতক্ষন লাগবে।
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কুহেলি দেখল দিঠি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, পার্টিতে এত লাফালাফি করেছে, না ঘুমিয়ে যাবেই বা কোথায়। কুহেলিও ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল, নিচে থেকে তখনও টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসতে শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সব শান্ত হয়ে গেল, গোটা বাড়িটায় কোথাও কোনও শব্দ নেই। সবাই ক্লান্ত, হয়তো এতক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কুহেলিও যথেষ্ট ক্লান্ত, কিন্তু ওর একটা বড় সড় সমস্যা আছে, নতুন জায়গায় সহজে ঘুম আসে না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ঘুম এল না, শুয়ে খালি এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ঘুম না আসলে এইভাবে শুধু শুধু শুয়ে থাকা আরও বিরক্তি কর, কুহেলি উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গোটা বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় হালকা আলো জ্বলছে। কুহেলি একবার আলেখের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা পুরো অন্ধকার, ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। সেটাই তো স্বাভাবিক, ওর মত বাকিদের তো আর ঘুমের সাথে আড়ি হয়নি। কুহেলি ধীর পায়ে এগোতে লাগল, কিছুটা এগোতে একটা সিড়ি নজরে এল, নির্ঘাৎ ছাদে যাওয়ার সিড়ি। কুহেলির হঠাৎ খুব ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে হল, যতটা সম্ভব শব্দ না করে কুহেলি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। ছাদের দরজা খোলা থাকবে কিনা, সেটা নিয়ে সংশয় থাকলেও এখানে পৌঁছে দেখল দরজাটা বন্ধ ঠিকই, কিন্তু লক করা নেই। কুহেলি আস্তে করে দরজাটা খুলে ছাদে পা রাখল, বেশ বড় ছাদ টা। ছাদ না বলে অবশ্য টেরিস বলাটাই ভালো, কার্নিশ বরাবর নিয়মিত পরিচর্যা করা ফুলের গাছ। একটা পাশে একটা ছোট ডিম্বাকৃতি টেবিলের সঙ্গে দুটো চেয়ার রাখা। বেশ হালকা হালকা হাওয়া বইছে, আকাশে একফোঁটাও মেঘ নেই, চাঁদটা স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে কালো আকাশের বুকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে রয়েছে অজস্র নক্ষত্র, সব মিলিয়ে বেশ মনোরম পরিবেশ। কুহেলি এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল চাঁদ টার দিকে। একটু বেশিই উজ্জ্বল মনে হচ্ছে, জোৎস্নায় যেন ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা।
আচমকা পিছনে কারও কণ্ঠস্বর শুনে কেপে উঠল কুহেলি, চমকে উঠে পিছনে ফিরে দেখল আলেখ দাড়িয়ে আছে। তারও দৃষ্টি চাঁদের দিকেই, ঠোঁটে লেগে আছে সেই হাসিটা। জোৎস্নার আলোর সঙ্গে মিশে হাসিটা বড্ড মায়াবী মনে হল কুহেলির। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন, তারপর হঠাৎ মনে হল, আলেখ এত রাতে এখানে কেন? প্রশ্নটা মনে আসতেই কুহেলি বলল,
আপনি এত রাতে এখানে?
আপ…. তুমিও তো এতরাতে এখানে।
আমার তো নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল না, তাই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি।
আর আমি তোমাকে দেখে।
আমাকে!
হুম, তোমাকে।
কিন্তু আমি যখন রুম থেকে বেরোলাম তখন তো আপনার রুম অন্ধকার ছিল।
আলেখ একটু হেসে এগিয়ে এসে কুহেলির পাশের চেয়ারটায় বসল, কুহেলি আচমকা শব্দে উঠে দাঁড়িয়েছিল এখন আবার বসল। আলেখ বলল,
আসলে আমারও ঘুম আসছিল না, তাই একটু লনে হাটতে গিয়েছিলাম। যখন রুমে ফিরছিলাম তখন দেখলাম তুমি সিড়ি দিয়ে উঠছ, তাই চলে এলাম।
দুজনেই বেশকিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, আলেখ অনেক কিছু বলতে চাইছে কিন্তু ঠিক কীকরে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ওর চোখ গেল কুহেলির বা হাতের অনামিকায়, কয়েক ঘণ্টা আগেই সে নিজে ওই আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। চাঁদের আলো পড়ে আংটির ছোট্ট হীরে টা চকচক করছে। আলেখ একটু হেসে বলল,
তোমার আংটিটা পছন্দ হয়েছে?
কুহেলি একবার আংটিটায় হাত বুলাল, খুবই সাধারণ, কারুকার্যের আধিক্য নেই, ঠিক যেমন ওর পছন্দ। প্লাটিনামের রিংয়ের ওপর একটা ছোট হার্ট, আর ঠিক সেই হার্টের মাঝখানে একটা ছোট্ট ডায়মন্ড বসানো। কুহেলি হাসিমুখে বলল,
খুব, ভিষন সুন্দর। আঙ্কেলের পছন্দ নিশ্চয়ই, আঙ্কেলের পছন্দ খুব ভাল।
আলেখ একটু কপট মন খারাপের ভাব এনে বলল,
শুধু ড্যাডের পছন্দই বুঝি ভাল? আমার পছন্দ ভাল না?
আমি তাই বললাম নাকি! কিন্তু আঙ্কেলের চয়েস তো আমি নিজে দেখলাম সেদিন আর তাছাড়া আমি তো এখনও আপনার পছন্দ সেভাবে দেখিনি।
এখন দেখে নিতে পার।
এখন! কীকরে?
আমার পছন্দ এইমুহুর্তে তোমার আঙ্গুলে শোভা পাচ্ছে।
কুহেলি একটু বিস্মিত হয়ে বলল,
এটা! এটা আপনার পছন্দ!
হুম, কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?
না, তা নয়… এইসব জুয়েলারির বিষয়ে আপনার পছন্দ এতটা ভালো হবে আশা করিনি।
তাই বুঝি! তাহলে তোমার আশা ভঙ্গ করলাম?
কুহেলি হেসে বলল,
এমন আশা ভঙ্গে ক্ষতি নেই।
আলেখও হেসে বলল,
বেশ, তবে এই আংটিটা এখন যার আঙ্গুলে অবস্থান করছে সেও কিন্তু আমারই পছন্দ। এখন এই পছন্দ টা ভালো না মন্দ সেটাও তো তাহলে ভেবে দেখতে হচ্ছে।
কুহেলি হেসে বলল,
নিজে না দেখলে বিশ্বাসই হত না আপনি এত মজা করতে পারেন।
কেন? তোমার কি আমাকে গোমড়া মুখো মনে হত নাকি?
উহু, মোটেই না। তবে এতটাও মনে হয়নি।
দুজনেই বেশ গল্পে মজে উঠল, এদিকে রাত যে ক্রমেই গভীর হচ্ছে সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাওয়ায় একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল, কুহেলি বলল,
এটা কি ফুলের গন্ধ? চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না।
বলে আলেখের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে নিজেই গন্ধের উৎসের সন্ধানে লেগে পড়ল। আলেখও ওর পিছন পিছন এগোল, ছাদের একদম অন্যদিকে এসে কুহেলির কৌতূহলের অবসান হল। একটা মাঝারি মাপের গাছে ফুটে রয়েছে সাদা সাদা ফুল গুলো, তাদেরই এমন মন মাতানো ঘ্রাণ। কুহেলি হেসে বলল,
হাসনুহানা।
আলেখ বলল,
বাহ্, নামটা ভারী সুন্দর তো।
আপনি জানতেন না?
না, এটা তো বেঙ্গলি নেম নিশ্চয়ই। আমি অবশ্য ইংলিশ নেম গুলো জানি। কুইন অফ্ দি নাইট, নাইট ব্লুমিং জাসমিন, লেডি অফ্ দি নাইট।
হুম, সবকটা নামই যথার্থ। এমন মাতাল করা ঘ্রাণ খুব কম ফুলেরই হয়।
কুহেলি একটু ঝুঁকে ফুল গুলোর কাছে গিয়ে বুক ভরে একটা ঘ্রাণ নিল। ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি খেলে গেল, আলতো হাতে ছুয়ে দিতে লাগল ফুল গুলো। আলেখ একভাবে দেখছিল কুহেলিকে, চাঁদের নরম আলো যেন পিছলে পড়ছে কুহেলির শরীরে। হালকা হাওয়ায় গভীর কালো চুল গুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে। কুহেলির স্নিগ্ধ রূপের সৌন্দর্য্যে আলেখ যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। ওর মনে হল লেডি অফ্ দি নাইটের সামনে দাড়িয়ে আছে ওর জীবনের নারী। ‘ওর’.. কথাটা নিজেরই কেমন লাগল আলেখের। ওর… কুহেলি ওর! হ্যা, ওরই তো, এখন থেকে কুহেলি শুধুই ওর। কিছুদিনের মধ্যেই তো কুহেলি অফিসিয়ালি ওর হয়ে যাবে, আজ তো তার প্রথম পর্ব ছিল, ওদের হাতের আংটি তার প্রমাণ। ভাবনার জাল ছিড়ে হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরল অালেখ, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হল।
এসব কি ভাবছি আমি? কেন ভাবছি?
কিন্তু, ভুলটাই বা কি এতে? সত্যিই তো আমরা একে অন্যের হতে চলেছি।
কিন্তু… আমরা তো একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি।
হলেও, সম্পর্কটা তো আর মিথ্যে নয়।
না হলেও, সম্পর্কটা আর পাঁচটা সম্পর্কের মতও নয়।
হোক, অসুবিধা কি? আমি চেষ্টা করব সম্পর্কটাকে গভীর করে তোলার।
কিন্তু কুহেলি?
ও নাহয় ওর সময়মত এগোবে।
আলেখ নিজের মনের দ্বন্দ্ব গুলো কাটিয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
কুহেলি।
হুম।
তোমার সত্যিই পাইনঅ্যাপেলে অ্যালার্জি আছে?
এখন হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে কুহেলি একটু অবাক হল।
হ্যা।
বাট আই ক্লিয়ারলি রিমেম্বার দ্যাট প্রথম যেদিন তুমি এখানে এসেছিলে তখন তুমি পাইনঅ্যাপেল জুস খেয়েছিলে।
কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,
আসলে সেদিন আপনি আপসেট ছিলেন, আমি তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিলাম।
আলেখ যেন এতদিনে ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
সেইজন্যেই হঠাৎ তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল?
হুম।
কুহেলি, এটা কিন্তু তুমি ঠিক করনি, আমি না হয় একটু আপসেট ছিলাম কিন্তু তাই বলে তুমি এইভাবে নিজের হেলথের সাথে কীকরে রিস্ক নিলে?
আসলে তখন অত কিছু ভাবিনি।
নেক্সট টাইম যেন এমন কিছু না হয়।
কুহেলি কিছু না বলে ঘাড় নাড়ল। আলেখ বলল,
অনেক রাত হল, এবার আমাদের নিচে যাওয়া উচিৎ। একটু না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।
হুম, অফিস ও তো আছে কালকে।
তুমি কালকে অফিসে যাবে না।
কেন?
কেন আবার কি? আন্টিদের সি অফ্ করতে যাবে না?
হ্যা, কিন্তু তারপরে তো যেতেই পারি।
একদম না, ইভেন কালকে আমিও অফিসে যাচ্ছি না। বিকেলের ফ্লাইটে সবাই ফিরে যাবে, তাই ওদের সঙ্গে একটু সময় কাটাব।
এত ভালো কথা।
হুম।
কথা বলতে বলতেই ওরা নিচে নেমে এসেছিল, কুহেলি আলেখকে গুডনাইট উইশ করে নিজের ঘরে চলে গেলে আলেখও নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে সবাই সময়মত উঠে একেবারে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আরও একদফা গল্পের আসর বসল। গল্প না বলে অবশ্য আলোচনা বলাটা বোধহয় বেশি ভালো হবে। সবাই এখন সবিশেষ উত্তেজিত হয়ে আলেখ আর কুহেলির বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছে। ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেলে কুহেলিরা নভতেজ বাবুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ আর বিহান নেই সঙ্গে, বেচারার বড্ড মাথা ধরেছে তাই আলেখ নিজের গাড়িতে কুহেলি আর দিঠিকে নিয়ে রওনা হল আর অন্য একটা গাড়িতে বাকিরা ড্রাইভারের সঙ্গে। কুহেলির ফ্ল্যাট থেকে লাগেজ নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। কুহেলির আজ কেন যেন চোখ দুটো ভিজে এল, শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
আরেকটু বেশিদিনের জন্য আসতে পারলে না! ঠিকমত কথাই হল না।
চৈতালী দেবী হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
একথা তুই বলছিস! যে মেয়ে কিনা কাজের জন্য না পারতে বাড়ি যায় না সে এইকথা বলছে!
মাআআআআ!!
কেন? ভুল বললাম নাকি! আমারও তো কাজ আছে, সামনেই তোর বিয়ে তখন একটানা কতদিন ছুটি নিতে হবে। তোকে এইগুলো আলাদা করে বোঝাতে হচ্ছে! আমি তো ভাবতেই পারছি না।
কুহেলি কিছু বলল না, সত্যিই এগুলো সবই ওর জানা তাও কেন যে আজ এত মন খারাপ করছে বুঝতে পারল না। ফ্লাইটের টাইম হয়ে গেছে, চৈতালী দেবীরা চলে যাওয়ার পর আলেখ কুহেলিকে নিয়ে আবার রওনা হল। কুহেলি কথা বলছে না, মনটা একটুও ভালোলাগছে না। আলেখ সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তাই কুহেলিকে ডিস্টার্ব না করে চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর গাড়িটা এক জায়গায় থামল, এতক্ষণ কুহেলি খেয়াল করেনি ওরা কোথায় যাচ্ছে। এখন গাড়িটা থামতেই বাইরে তাকিয়ে দেখল ওরা আইসক্রিম পার্লারের সামনে দাড়িয়ে আছে। একটু অবাক হয়ে আলেখের দিকে তাকাতেই আলেখ একটু হেসে বলল,
হঠাৎ খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে, তোমার আপত্তি নেই নিশ্চয়ই?
আপত্তি!! এই একটা মাত্র জিনিস যেটা দেখলেই কুহেলির সমস্ত মন খারাপ ভালো হয়ে যায়, এমনকি প্রচন্ড রাগ হলেও আইসক্রিম দেখলেই সেই রাগও গলে জল হয়ে যায়। কুহেলি হেসে বলল,
নট অ্যাট অল, আই লাভ আইসক্রিম।
বলেই চরম উৎসাহের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পার্লারের দিকে এগোল। কুহেলিকে এত খুশি দেখে আলেখও খুব খুশি হল, ওর আইডিয়া টা কাজে লেগেছে। পার্লারে ঢুকে একটা টেবিলে বসে দুজনে মেনু দেখতে লাগল, কুহেলি ভিষন উত্তেজিত। ইচ্ছে করছে সব অর্ডার করে দেয়, ওদিকে আলেখ আবার এসব কিছুই জানে না। আসলে আইসক্রিম জিনিসটা ওর তেমন পছন্দের নয়, শেষ কবে খেয়েছে তাও মনে নেই। কুহেলি অনেক দেখার পর একটা হট ব্রাউনি উইথ চকোলেট ওভারলোডেড অর্ডার করল, আলেখ তখনও হাতে মেনু নিয়ে বসে আছে দেখে কুহেলি বলল,
কি হল? অর্ডার করুন।
হ্যা… করছি।
আলেখ বুঝেই পেল না কি অর্ডার করবে, কুহেলির একটু সন্দেহ হল।
আপনি এখানে ফার্স্ট টাইম এলেন তাই না?
আলেখ চমকে উঠল,
হ্যা?… না.. মানে..
কুহেলি কিছু না বলে একটা অরেঞ্জ সোডা পপ অর্ডার করে দিল আলেখের জন্য। ওয়েটার চলে যেতেই কুহেলি বলল,
আপনার এখন মোটেও আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই না? শুধু এখন কেন, আই থিঙ্ক আপনি আইসক্রিম খুব একটা ভালোবাসেন না।
আলেখ একটু আমতা আমতা করে বলল,
হ্যা, মানে… আসলে…
আপনি কীকরে জানলেন আইসক্রিম দেখলে আমার মুড ভালো হয়ে যায়?
আলেখ ভাবছিল কুহেলি হয়তো রাগ করবে কিন্তু উল্টে কুহেলিকে বেশ খুশি মনে হল। আলেখ হেসে বলল,
কিছু খবর আমিও জানি, তবে শিওর ছিলাম না, জাস্ট একটা চান্স নিলাম। আর তীর একদম সঠিক জায়গায় লাগল।
হুম, কিন্তু গেস করার জন্যও তো মিনিমাম ইনফরমেশন টুকু লাগে। আপনি কীকরে জানলেন আমার আইসক্রিম খুব ভালো লাগে?
আলেখ একটু হাসল, মনে পড়ল কয়েক মাস আগের কথা। এই পার্লারটার সামনে এসেই সিগন্যালে দাড়িয়েছিল আলেখ, সেদিনই চোখে পড়েছিল কুহেলিকে। একদম বাচ্চাদের মত খুশি মনে তৃপ্তি করে আইসক্রিম খাচ্ছিল। কুহেলিকে সেকথা বলতেই একটু যেন লজ্জা পেল। এরমধ্যেই ওদের অর্ডার এসে গেল, আইসক্রিম দেখে কুহেলি সব ভুলে সেইদিকে মনোনিবেশ করল। আলেখ নিজের গ্লাসটা নিয়ে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, দারুন দেখতে লাগছে। আইসক্রিম বলে মনেই হচ্ছে না, স্ট্রয়ে একটা চুমুক দিতেই বেশ ভালো লাগল। কুহেলি বলল,
কেমন?
দারুন।
আপনি সত্যিই কোনদিনও আইসক্রিম খাননি?
খেয়েছি দু এক বার। তাও এভাবে নয়।
আপনার সত্যিই আইসক্রিম ভালোলাগে না?
কুহেলির প্রশ্নে একরাশ বিস্ময়, যেন বলতে চাইছে, কেউ আইসক্রিম কীকরে ভালো না বেসে পারে! আলেখ একটু হেসে বলল,
হুম, ভাললাগত না তবে এখন লাগছে। দিস ইজ ড্যাম গুড।
কুহেলি একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
গ্রেট, এবার এটা একটু টেস্ট করে দেখুন, আরও ভালোলাগবে।
বলে নিজের প্লেট থেকে এক চামচ আইসক্রিম নিয়ে চামচ টা আলেখের দিকে এগিয়ে দিল। আলেখ কিন্তু চামচ টা নিল না, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চামচ সহ কুহেলির হাত টা ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এল। আলেখ এইভাবে আচমকা হাত ধরায় কুহেলি হতভম্ব হয়ে গেল, একভাবে আলেখের দিকে তাকিয়ে রইল। আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়েই আইসক্রিম টুকু খেয়ে ওর হাত টা ছেড়ে দিয়ে বলল,
গ্রেট।
কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে চুপচাপ মুখটা নীচু করে ওর আইসক্রিম টা খেতে লাগল। হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দন টা এত যে কেন বেড়ে গেল বুঝতে পারছে না, অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। আলেখ কুহেলিকে দেখে শুধু একটু হাসল, আর কেউ কোনও কথা বলল না। আইসক্রিম শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়ল ওরা, গাড়িতেও আর কোনও কথা বলল না কেউ। কুহেলিকে ওর ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়ে আলেখ বলল,
থ্যাঙ্কস, আপনার জন্য আজকে আইস্ক্রিমের একজন নতুন অনুরাগী যুক্ত হল।
আলেখের বলার ভঙ্গিতে কুহেলি না হেসে পারল না, আলেখ বিদায় নিয়ে চলে যেতেই কুহেলিও নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল। এরপর দেখতে দেখতে একের পর এক দিন পেরিয়ে যেতে লাগল। রোজকার নিয়ম মত অফিস আর তার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলেখের সঙ্গে একটু সময় কাটানো। ভালোভাবেই কাটছিল দিনগুলো, দুজনের বন্ধুত্ত্ব এখন আগের থেকে অনেক বেশি গভীর হয়েছে। কুহেলি এখন প্রাণখুলে কথা বলে আলেখের সঙ্গে, কিন্তু তাই বলে এমন না যে, সে আলেখকে তুমি বলতে শুরু করেছে। এখনও কুহেলি আপনিতেই আটকে আছে, চেষ্টা যে করেনি তা নয় কিন্তু কেন যেন এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়ে ওঠেনি। আলেখও জোর করেনি, কুহেলিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে, ওর যতদিন খুশি সময় নিতে পারে। তবে কুহেলি কিন্তু একটু উন্নতি করেছে, স্যার বলাটা বন্ধ করেছে। কিন্তু স্যার না বললেও এখন কিছুই বলে না, মানে নাম ধরে এখনও বলে উঠতে পারেনি। যাইহোক, ধীরে ধীরে সেটাও না হয় হয়ে যাবে। আর মাত্র দশ দিনবাকি আলেখ আর কুহেলির বিয়ের। আজ কুহেলি কলকাতায় ফিরছে, শৈলজা দেবীর হুকুম হয়েছে এবার ফিরতেই হবে। তাই এখন আলেখ কুহেলিকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে, ফ্লাইটের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে। কুহেলি আলেখের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগোতে গেলেই আলেখ পিছন থেকে ডাকল।
কুহেলি।
হুম।
একেবারে বিয়ের দিন দেখা হবে।
কুহেলি একটু যেন লজ্জা পেল, কেন পেল সেটা জানা নেই। আলতো হেসে ছোট্ট করে বলল,
হুম।
আর কোনও কথা হল না, দুজনে একটু হাসি বিনিময় করে এগিয়ে গেল যে যার পথে। কুহেলি বাড়ি ফিরেই দেখল, বাড়িটা গমগম করছে। অনেকেই ইতিমধ্যে চলে এসেছেন, এখনও অনেকেই আসবেন। কুহেলিকে দেখে সবাই যেন মহা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সে কি অ্যাপায়নের ঘটা। শৈলজা দেবী তো সোজা ফতোয়া জারি করে দিলেন, বাকি দিনগুলো বাড়ি থেকে এক পাও বেরেনো চলবে না। কুহেলিও বাধ্য মেয়ের মত সব কথা মেনে নিল। বাকি দিনগুলোও কেউ কুহেলিকে কোনও কাজ করতে দিল না, সারাদিন বসে থেকে থেকে বেচারি হাপিয়ে উঠল। কিন্তু কিছু করার নেই, তাও ভাগ্যিস দিঠি ছিল, ওর সঙ্গে গল্প করেই কেটে গেল দিনগুলো। বাকি কাসিনরাও বিয়ের দু তিন দিন আগে এসে পড়ল, তারপরে আর কি, ওদের সঙ্গে বেশ ভালই সময় কাটছিল। এরমধ্যে অবশ্য রোজ একবার আলেখের সাথে কথা হয়, আলেখ নিজেই ফোন করে। সারাদিনের টুকটাক কথা ভাগ করে নেয়, এই নিয়ে কুহেলির ভাই বোনেরা দিব্যি টোন কাটে। দেখতে দেখতে দিনগুলো পেরিয়ে যেতে লাগল, মাঝখানে আর মাত্র একটা দিন। আজ বাড়িতে পার্লার বসেছে, ফেসিয়াল থেকে শুরু করে পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ওয়াক্সিং কিছুই বাদ নেই। কুহেলির এত কিছু করানোর কোনো ইচ্ছেই ছিল না কিন্তু এখন ওর কথা কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। মোটামুটি ফুল বডি বিউটি ট্রিটমেন্ট শেষ হতে গোটা সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। পরদিন ভোর হতেই বাড়িতে মোটামুটি হুলুস্থূল পড়ে গেল, আজ কুহেলির আইবুড়ো ভাত। সবাই চরম ব্যস্ত, রান্নাঘরে মোটামুটি হৈ হৈ কান্ড চলছে, কতরকম পদ যে রান্না হচ্ছে তার ঠিক নেই। কুহেলি তো এমনিতেই সকাল সকাল স্নান সেরে নেয় তবে আজ আবার স্নান করতে হল। স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে সকলের মধ্যমনি হয়ে বসল। চৈতালী দেবী একে একে সামনে সাজিয়ে দিলেন নানারকম পদ। এতকিছু খাওয়া কুহেলির পক্ষে এককথায় অসম্ভব, সেকথা বলতেই শৈলজা দেবী একেবারে তেড়ে ফুড়ে উঠলেন। কিচ্ছু ফেলা চলবে না, সব খেতে হবে, অগত্যা কোনরকমে কষ্টে সৃষ্টে সবটা শেষ করল কুহেলি তবে আর নড়ার ক্ষমতা নেই। সোজা ঘরে গিয়ে শাড়ি ছেড়ে শুয়ে পড়ল। এমন সময় আলেখের ফোন এল,
কি করছ?
হাঁসফাঁস করছি।
কথাটা কুহেলি বাঙলাতেই বলল, ফলে আলেখের বোধগম্য হল না।
কি?
কিছু না, এত খাইয়েছে ঠেসে ঠেসে এখন আর নড়তে পারছি না।
আলেখ এক চোট হেসে নিয়ে বলল,
দেখো, অতি আহারের ফলে যেন আবার কোনও সাইড এফেক্ট না হয়।
আপনার খুব মজা হচ্ছে বলুন? একবার এসে পৌঁছান এখানে তারপর দেখবেন আচার অনুষ্ঠানের ঠেলায় আপনার কি হাল হয়।
কুহেলি কথাগুলো একটু রেগেই বলল, একে বলে হাঁসফাঁস করছে আর তারপরে যদি কেউ এমন করে হাসে, কার না রাগ হবে বলুন তো! আলেখ হাসতে হাসতেই বলল,
আচ্ছা সরি। আমরা একটু পরেই বেরোব, সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে যাব।
হুম, আঙ্কেল নিশ্চয়ই এতক্ষণে মাকে ইনফর্ম করে দিয়েছে।
হুম।
খুব ভালো কথা, বেশি হাসছিলেন তো আসুন একবার। দেখবেন আজ রাত থেকেই অত্যাচার শুরু হবে।
এবার কিন্তু ভয় দেখাচ্ছ।
কেন! খুব তো হাসছিলেন।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পরে, বলা ভাল খুনসুটি করার পরে ওরা ফোনটা রাখল। কুহেলি শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নিল, কারণ সন্ধ্যে বেলায় আবার মেহেন্দি লাগানোর প্রোগ্রাম আছে। এটা মোটেই বাঙালি রীতি নয়, কিন্তু তাও হচ্ছে, আজকাল সবাই করে। কিছুটা ফ্যাশনের মতই হয়ে গেছে, তাতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। ভালো কিছু আপন করে নিতে দোষ কোথায়? তবে এখানে শুধু ফ্যাশনের জন্য হচ্ছে না, আলেখের বুয়া অর্থাৎ মেহের জীর আবদারে হচ্ছে। ওনাদের মধ্যে এই মেহেন্দির গুরুত্ব অনেকখানি। সন্ধ্যে হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল উৎসব, নাচে গানে বাড়িটা একেবারে মেতে উঠল। কুহেলির দুহাত সেজে উঠল মেহেন্দি তে, সূক্ষ্ম নক্সার মধ্যে একটা ক্ষুদ্রাকৃতি ইংরেজি বর্ণমালার ‘এ’ অক্ষরটি সুনিপুণ ভাবে মিশে গেল। কয়েকঘন্টা পরে যখন হাত ধোয়ানো হল, দেখা গেল অসম্ভব সুন্দর রঙ ফুটেছে। ব্যাস, অমনি শুরু হয়ে গেল সবাই,
জিজু তার মানে তোকে ভিষন ভালোবাসে।
আরে সেটা আলাদা করে বলার কি আছে! প্রমাণ তো দেখাই যাচ্ছে।
কুহেলি একটু হাসল, ‘ভালোবাসা’ এই একটা জিনিসেরই অভাব ওদের সম্পর্কে। না ঠিক অভাব নয়, বন্ধুত্বের ভালোবাসায় কোনও অভাব নেই কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে ভালোবাসা থাকে সেই ভালোবাসার অভাব পুরোটাই। আর এই অভাব হয়তো কোনও দিনও মিটবে না, কারণ অভাবটা পূরণ করার চাহিদা টাই তো নেই। কুহেলির মতে তার দরকারও নেই, যেমন চলছে ভালই তো চলছে। আর কি দরকার। কিন্তু সবটা তো আর আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী হয় না, ওদের এই ভালোবাসার অভাব টা পূরণ হবে না অপূর্ণই রয়ে যাবে সেটা না হয় ভবিষ্যৎ বলবে। আপাতত বিয়ে টা তো হোক। আলেখদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ‘মঞ্জরী’ তে। ওনারা হোটেলে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু চৈতালী দেবী কিছুতেই রাজি হননি। এত বড় বাড়ি থাকতে হোটেলে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, তাছাড়া হোটেলে বসে সব আচার অনুষ্ঠান ঠিকমত পালন করাও যায় না। আলেখরা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে, ওবাড়ির দায়িত্বে এখন চৈতী দেবী আর দেবাঞ্জলি। ওনারা দুজনেই আপাতত এখন বরপক্ষের সদস্য, ছেলের বাড়ির যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান ওনারাই করবেন। আলেখরা বেশি কেউ আসেনি, মাত্র বাইশ জন, নভতেজ শর্মা আগেই বলেছিলেন ওনার পক্ষে তেমন কেউ নেই, সুতরাং, চৈতী দেবীই এখন সর্বেসর্বা। রাতের বেলা আবার আলেখের ফোন এল, কুহেলি এখানে আসার পর থেকে দিনে একবারই ফোন করে আজ হঠাৎ আবার ফোন কেন করছে! কোনও সমস্যা হল কিনা ভাবতে ভাবতেই কলটা রিসিভ করল কুহেলি।
হ্যালো।
কুহেলি, ইউ ওয়্যার রাইট।
আলেখ বেশ হাঁপাচ্ছে, কথা বলতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। কুহেলি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
আপনি এরকম করে কথা বলছেন কেন? কি হয়েছে?
কি আবার হবে? কি বলে যেন অনুষ্ঠান টা.. আই.. আই…
আইবুড়ো ভাত?
হ্যা, হ্যা, ওটাই। তুমি এত কিছু খেলে কিকরে?
কুহেলি বুঝল বেচারা আলেখের উপর ইতিমধ্যে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানের অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে বলল,
তাহলেই বুঝুন, আমার কেমন লাগছিল তখন।
বুঝতে পারছি, খুব ভালো করে বুঝতে পারছি। ওহ গড, এত কিছু আমি কীকরে খেলাম আমার তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না!
হুম, তবে আইবুড়ো ভাত তো সাধারণত দুপুরেই হয়, মানে আইবুড়ো ভাত খাওয়ার আগে কিছু খাওয়া যায় না। আপনি কি এতক্ষণ না খেয়ে ছিলেন নাকি!
হুম, ড্যাড বলেছিল কিছু একটা নিয়ম আছে যার জন্য আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে। সেটা যে এই পরিমাণ খাওয়ার জন্য বুঝতে পারিনি।
কুহেলির একটু খারাপ লাগল, বেচারা এতক্ষণ না খেয়ে ছিল। কি এমন হত একটা নিয়ম না মানলে? আর এমন কিছু তো নয়, আইবুড়ো ভাত। না করলেই হত, একটা নিয়মের জন্য শুধু শুধু একটা মানুষকে এত কষ্ট দেওয়ার কি মানে কে জানে!
কুহেলি অনেকক্ষণ চুপ করে আছে দেখে আলেখ বলল,
কুহেলি, কি হল?
আপনার খুব কষ্ট হয়ে গেল তাই না?
কুহেলির গলায় একটা চাপা কষ্ট অনুভব করল আলেখ। একটু হেসে বলল,
কুহেলি, আমার একটুও কষ্ট হয়নি, ট্রাস্ট মি।
হুম।
ডোন্ট বি আপসেট কুহেলি, আমি সত্যি বলছি আমার কোনও কষ্ট হয়নি।
হুম। আচ্ছা, এবার শুয়ে পড়ুন, অনেক রাত হল। ভোর থেকেই কিন্তু আবার একগাদা রীতি নীতি আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
হুম, সেই ভালো। ওকে, কালকে দেখা হচ্ছে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
ফোনটা রেখে দুজনেই শুয়ে পড়ল, দুজনের মনেই একটা অদ্ভুত অনুভুতির আনাগোনা চলছে। আর সেটা বোধহয় খুব অস্বাভাবিক নয়, রাত পোহালেই ওদের বিয়ে! আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধান। তারপরেই সূচনা হতে চলেছে ওদের দুজনের জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের। নতুন একটা অনুভূতির চাদর গায়ে জড়িয়ে দুজনেই ধীরে ধীরে পাড়ি দিল ঘুমের দেশে।
ক্রমশ__________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
শুরু হয়ে গেল আলেখ আর কুহেলির বিয়ের প্রস্তুতি। আইবুড়ো ভাতের পর্বও সারা হয়ে গেছে। এখন রাত পোহালেই শুরু হবে বিয়ের দিনের মূল আচার অনুষ্ঠান। আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু। কেমন লাগল আজকের পর্ব আমাকে জানাতে ভুলবেন না। অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের। আজ তবে এইটুকুই, দেখা হবে আগামী পর্বে, অর্থাৎ, আলেখ কুহেলির বিবাহ পর্বে। ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।