#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৪
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
ভোর থেকেই শুরু হয়ে গেছে সব নিয়ম নীতি, দুই বাড়িতেই ব্যস্ততার শেষ নেই। ভোর বেলায় উঠে সবার আগে হল দধি মঙ্গল, এত ভোরবেলায় এমনিই কিছু খাওয়া যায় না, তার উপর দই খই! কুহেলি তো পড়ল মহা সমস্যায়। তবে কিছু বলতেও পারল না, জানে লাভ নেই। তবে দই খই টা বেশি খেতে হল না, চৈতালী দেবী চামচে করে খাইয়ে দিলেন কিছুটা। এখানেও আবার ঘটনা আছে, চৈতালী দেবী কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শুভ কাজে বিধবাদের নাকি থাকতে নেই, অমঙ্গল হয়! আজ ওনার কুহুর বিয়ে, এত শুভ দিনে উনি কোনরকম অমঙ্গলের ছায়া পড়তে দিতে চান না। কথাটা কুহেলির কানে যেতেই অসম্ভব রাগে ফেটে পড়ে, ও ভাবতে পারে না এগুলো কি রকম চিন্তা ধারা! বিশেষ করে চৈতালী দেবী নিজে একজন উচ্চ শিক্ষিতা পেশায় একজন নাম করা ডাক্তার হওয়ার পরেও এইসব কুসংস্কারে আমল দিচ্ছেন দেখে কুহেলি প্রচন্ড অবাক হয়েছিল। তবে চৈতালী দেবীকে কিন্তু সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না, আমাদের আশেপাশে এমন কুসংস্কারের ধ্বজাধারী মানুষের সংখ্যা তো নেহাৎ কম নয়। বারংবার যদি কেউ কানের কাছে মেয়ের ভবিষ্যৎ মঙ্গল অমঙ্গলের কথা বলতে থাকে, তাহলে মায়ের মন একটু বিচলিত তো হবেই। কুহেলি চৈতালী দেবীর কাছে গিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিল, এইসব অন্ধ কুসংস্কার সে মানে না। তাতে অবশ্য আশপাশ থেকে অনেকেই কুহেলিকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এগুলো নাকি ওর মঙ্গলের জন্যই করা হচ্ছে। শেষে কুহেলি তাদের সকলকে শুনিয়েই চৈতালী দেবীর হাত দুটো ধরে বলেছিল,
মা, তোমার স্পর্শে যদি আমার অমঙ্গল হয়, তাহলে আমি সেই অমঙ্গল কেই মাথা পেতে নেব। কারণ সেই অমঙ্গল আমার কাছে লক্ষ্য কোটি আশীর্বাদের সমান।
শৈলজা দেবী এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন, হয়তো একটু দ্বিধা ছিল মনে কিন্তু কুহেলির কথা শোনার পর উনিও সায় দিয়ে বললেন,
কুহু ঠিকই বলেছে চৈতালী, মা কক্ষনো তার সন্তানের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে না।
এরপর চৈতালী দেবী আর দ্বিধা করেননি, হাসিমুখে যোগ দিয়েছেন সব কাজে। এতে অবশ্য অনেকেই আড়ালে মুখ বেকাল, কিন্তু তাতে কুহেলির কিছু এসে যায় না। যাই হোক, এতকিছুর পরে দই খই খাওয়ার পর এবার আবার সেই কালকের মত আহারের আয়োজন দেখে কুহেলি না বলে পারল না।
এত কিছু এই ভোর বেলায় খাওয়া যায় নাকি!
উত্তরে শৈলজা দেবী বললেন,
খেয়ে নে, বিয়ে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কিচ্ছুটি মুখে দিতে পারবি না।
আজকেও কুহেলির আপত্তি ধোপে টিকল না, খেতেই হল, তবে সবটা পারল না। ওদিকে ও বাড়িতেও একই দৃশ্য, আলেখ বেচারা কিছু বলতে গেলেই নভতেজ শর্মা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে আবার স্বরূপ বাবুও যুক্ত হয়েছেন, একদিনেই স্বরূপ বাবু আর নভতেজ শর্মার বেশ আলাপ হয়ে গেছে। যাই হোক একের পর এক চলতে থাকল অনুষ্ঠান, আব্যদিক হওয়ার পর গায়ে হলুদের পালা যখন এল তখন বেশ দেখার মত দৃশ্য হল। আগে আলেখের গায়ে হলুদ হবে কারণ, ছেলের গায়ের হলুদ না আসা পর্যন্ত মেয়ের গায়ে হলুদ হবে না। তাই আলেখের গায়ে হলুদের পর্ব একটু তাড়াতাড়িই শুরু হয়ে গেল, সবাই মোটামুটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে গৌর বর্ণ আলেখকে পীতাম্বর বানিয়ে ফেলল। তারপর হলুদ নিয়ে হোলি খেলা তো আছেই, কুহেলিকে এদিকে নতুন শাড়ি পরিয়ে তৈরি করা হয়ে গেছে। এখন ছেলের গায়ের হলুদ এলেই শুরু হবে গায়ে হলুদ পর্ব, এই সময় টুকু কুহেলি একটু নিরিবিলি নিজের ঘরে বসার সুযোগ পেল। সকাল থেকে দু দন্ড স্থির হতে পারেনি, একের পর এক আচার অনুষ্ঠান হয়েই চলেছে। হঠাৎ ফোনে মেসেজ এল, স্ক্রীনে নাম ফুটে উঠেছে মামী, অর্থাৎ দেবাঞ্জলি। মেসেজ টা ওপেন করল কুহেলি,
“হোয়াটসঅ্যাপে দেখ তোমার হবু কর্তার ছবি পাঠিয়েছি।“
কুহেলি হোয়াটসঅ্যাপ অন করতেই অনেকগুলো ছবি দেখতে পেল। প্রথম দিকের ছবি গুলো বেশ ভালো, সাদা ধুতি আর গেঞ্জি তে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে আলেখকে। কিন্তু পরের ছবি গুলো দেখে কুহেলি হাসতে হাসতে শুয়েই পড়ল, বেচারার সর্বাঙ্গে হলুদ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোনও একটা জায়গা তিল মাত্র ফাঁকা নেই, পুরো হলুদের পুকুরে চোবানো হয়েছে মনে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ একা একা হাসার পর কুহেলি একটু দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারল না। বেছে বেছে সব থেকে মজাদার ছবিটা আলেখকে পাঠিয়ে লিখল,
“অসময়ের হোলি কেমন লাগল? তবে দারুন লাগছে কিন্তু আপনাকে।“
সঙ্গে দুটি দন্তবিকশিত ইমোজিও পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে যে রিপ্লাই আসবে না জানে, কারণ ওই পরিমাণ হলুদ তুলতেই বেচারার এক ঘন্টা লাগবে। কথাটা মনে হতেই আরেক দফা হেসে নিল কুহেলি, এরমধ্যেই গায়ে হলুদের ডাক পড়ল। ফোনটা রেখে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, গায়ে হলুদের আগে অবশ্য একটু ঢং করতে হল, মানে ওই ভিডিওর জন্য আর কি। আজ ভারী মিষ্টি লাগছে কুহেলিকে, হলুদ লাল শাড়ি সঙ্গে মেকি ফুলের গয়না। আসল ফুলেরই পরিকল্পনা ছিল কিন্তু কারনটা হয়তো মনে আছে, তাই এই মেকি ফুলের গয়না। বেশ কিছু ভঙ্গিমায় ছবি তোলার পর শুরু হল গায়ে হলুদ পর্ব, একে একে সবাই গায়ে হলুদ লাগাল এবং শেষে যেন অলিখিত নিয়ম পালন করার মতোই এখানেও শুরু হল হলুদের হোলি। তবে কুহেলি খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে এই হলুদ আক্রমণ থেকে রক্ষা করল। মুখ বাদ দিয়ে যেখানে খুশি হলুদ লাগানোর অনুমতি দিল, আর সবাই মেনেও নিল। অবশেষে গায়ে হলুদ পর্ব সম্পন্ন হলে কুহেলি স্নান সেরে নিল, ওর নিজেরও স্নান করতে বেশ সময় লাগল। মুখে না লাগালেও যে যেখানে পেরেছে প্রাণ ভরে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে। স্নান সেরে আবার একটা শাড়ি পড়ল, আজ নাকি সারাদিন শাড়িই পড়তে হবে। যাইহোক তাতে অবশ্য তেমন অসুবিধা কিছু নেই, আর এখন আর কোনও কাজও নেই ওর। বাকিরা সবাই ব্যস্ত, শুধু ওর এখন কোনও কাজ নেই। এরপরে অনেকক্ষণ বিয়ের আসরে বসতে হবে তাই এখন সবাই ওকে একটু আরাম করতে দিয়েছে। নিজের ঘরে একা একা শুয়ে ছিল কুহেলি, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে আলেখের নামটা। মুখে নাম ধরে না বললেও ফোনে কিন্তু স্যারের বদলে আলেখ নামটা সেভ করেছে বেশ কিছুদিন হল। কুহেলি আন্দাজ করতে পারল আলেখ কি বলার জন্য ফোন করছে, আর হলোও তাই। ফোনটা রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে আলেখ বলে উঠল,
কুহেলি হোয়াট ইজ দিস?
কুহেলি যেন কিছুই জানে না এমন ভাব করে বলল,
কেন? কি হয়েছে?
আলেখ বেশ বুঝতে পারছে কুহেলি ইচ্ছে করেই এমনটা করছে, একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,
কুহেলি, দিস ইজ নট ডান। এইরকম ছবি কে কখন তুলল? হাউ অ্যামম্ব্যারেসিং।
কুহেলি হেসে বলল,
কেন? কত সুন্দর লাগছে আপনাকে।
খুব মজা হচ্ছে তাই না?
হুম, হচ্ছেই তো। আপনার কি মনে হয়, শুধু আপনিই মজা করতে পারেন?
একদমই না। তবে তুমি যে হঠাৎ করেই এমন মজা করবে এটা আশা করিনি।
হুম, অনেকেই অনেক কিছু আশা করে না, বাট সেটা হয়ে তো যায়।
নিশ্চয়ই, কিন্তু কুহেলি প্লিজ ছবিগুলো অন্য কাউকে দেখিও না। আমাকে খুব বাজে লাগছে, মানে….
কুহেলি হেসে উঠল,
আরে বাবা রিল্যাক্স, আমি কাউকে দেখাইনি।
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
ওয়েলকাম।
উহু, শুধু ওয়েলকাম বলে এড়িয়ে গেলে হবে না। একটা ফেয়ার এক্সচেঞ্জ হওয়া চাই তো।
কিসের ফেয়ার এক্সচেঞ্জ?
ছবির।
কোন ছবির?
কেন! তুমি আমার ছবি দেখলে, নাও ইটস মাই টার্ন।
আপনার আবার কিসের টার্ন?
ছবি দেখার।
কার ছবি?
কুহেলি ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করতে লাগল, তবে আলেখও এত সহজে হার মানার পাত্র নয়।
অফকোর্স তোমার, অন্য কারোর ছবি দেখার ইচ্ছে আপাতত আমার নেই।
আমার ছবি দেখে কি করবেন? একটু পরেই তো দেখা হবে।
কুহেলি আই নো ইউ আর রিয়েলি ভেরি স্মার্ট, বাট আমিও কিছু কম যাই না কিন্তু।
তাই?
হুম, তুমি ছবি না দিলেও ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমার ছবি আমার কাছে চলে আসবে।
এত কনফিডেন্ট!
হুম।
ওকে, ডান। দেখি আপনার কত ক্ষমতা।
ওকে, বাট যদি আমি এই চ্যালেঞ্জ টা জিততে পারি তাহলে আমি কি পাব?
কি আবার পাবেন?
উহু, তা বললে চলবে না, যে জিতবে তার জন্য একটা রিওয়ার্ড তো থাকা উচিৎ। যেমন ধর আমি যদি চ্যালেঞ্জ টা কমপ্লিট না করতে পারি তাহলে তুমি যা করতে বলবে আমি তাই শুনব।
রিয়েলি?
ইয়েস। বাট যদি আমি জিতি তাহলে?
কুহেলি একটু ভেবে বলল,
আপনার যে কোনও একটা ইচ্ছে আমি পূরণ করব।
আর ইউ শিওর?
অফকোর্স।
ওকে, বি রেডি।
দেখা যাবে।
ফোনটা রেখে কুহেলি হাসতে লাগল, এখানে তেমন কাউকেই চেনে না আলেখ, সুতরাং এই চ্যালেঞ্জটা পুরো করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কুহেলিকে অবাক করে দিয়ে পাঁচ মিনিটের আগেই আলেখের নম্বর থেকে ওর গায়ে হলুদের অনেকগুলো ছবি এল। কুহেলি হা করে তাকিয়ে রইল ছবিগুলোর দিকে, এটা কীকরে হল? সঙ্গে সঙ্গে আলেখের ফোন এল, কুহেলি ফোনটা রিসিভ করে চুপ করে রইল। কি বলবে, বলার মত কিছুই তো আর নেই, আলেখ বলল,
কুহেলি, চুপ করে থেকে লাভ নেই, তুমি অলরেডি হেরে গেছ।
কিন্তু কীকরে?
ইচ্ছে থাকলে সব হয়।
বাট….
নো বাট… এখন তোমার কথা মত তুমি আমার যে কোনও একটা ইচ্ছে পূরণ করবে।
হুম, বলুন।
আলেখ একটু থেমে বলল,
সে মাই নেম।
কুহেলির হৃদযন্ত্র টা আবার হঠাৎ করেই বিদ্যুতের বেগে স্পন্দিত হতে লাগল, হয়তো বা তার থেকেও দ্রুত। আলেখ আবার বলল,
আই নো, আমি বলেছিলাম তুমি যতদিন ইচ্ছে সময় নিতে পার কিন্তু ইউ ক্যান অ্যাটলিস্ট ট্রাই, রাইট?
কুহেলি কিছুই বলল না। আলেখ বলল,
প্লিজ কুহেলি, একবার, জাস্ট একবার ট্রাই কর।
কুহেলির যেন গলা থেকে আওয়াজই বেরোচ্ছে না, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আলেখ বুঝতে পারল কুহেলির হয়তো অস্বস্তি হচ্ছে, হঠাৎ করে কেন যে এমন একটা ইচ্ছে ওর মনে এল নিজেও জানে না। কিন্তু কেন যেন কুহেলির মুখ থেকে নিজের নামটা শোনার একটা প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর আলেখ বলল,
সরি কুহেলি, আমার এমন একটা উইশ করাটা ঠিক হয়নি। ইটস ওকে, টেক ইওর টাইম।
আলেখের কণ্ঠে একটা হতাশার সুর, যেটা কুহেলির মনটাও হতাশায় ভরিয়ে দিল, সত্যিই তো, এমন কি আর চেয়েছে? এটুকু করতে পারছে না! ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আবার আলেখের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
রেস্ট কর কুহেলি, এরপর আর সেভাবে রেস্ট করার টাইম হবে না নিশ্চয়ই। আমি রাখছি, অ্যান্ড সরি এগেইন।
কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,
ওয়েট, আপনার সরি বলার কোনও প্রয়োজন নেই, আ..আ..আলেখ।
আলেখের যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হল না। কুহেলি সত্যিই ওর নাম বলল! আলেখ উত্তেজিত হয়ে বলল,
হোয়াট! হোয়াট ডিড ইউ সে! তুমি সত্যিই আমার নাম বললে! ক্যান ইউ সে ইট ওয়ান মোর টাইম? আই জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট।
বিশ্বাস তো কুহেলিরও হচ্ছে না। ও সত্যিই আলেখের নাম নিয়েছে! এটা সবার কাছে হয়তো এমন কিছু নয়, আজকাল কার মেয়েদের পক্ষে উড বি হাসবেন্ড কে নাম ধরে বলাটা কোনও ব্যাপার নয়, খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। কুহেলির ক্ষেত্রেও হয়তো ব্যাপারটা এতোটা কঠিন হত না, যদি আলেখ ওর বস না হত। কুহেলি বলল,
না, আপনি একবারই বলেছিলেন।
আলেখ হেসে বলল,
ফাইন, বলতে হবে না, কিন্তু একবার যখন নাম ধরে বলেছ তখন এবার থেকে নাম ধরেই বলতে হবে।
হুম।
ওকে, এবার সত্যিই একটু রেস্ট কর, খুব বেশি সময় নেই আর।
হুম।
ও, একটা কথা বলা হয়নি।
কি?
ছবি গুলো দারুন ছিল কিন্তু, খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে।
কুহেলি কোনও উত্তর না দিয়ে বাই বলে ফোনটা রেখে দিল। আলেখের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিল নিজেই খেয়াল করেনি। এখন ফোনটা রেখে দেখল আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে, গাল দুটো কি একটু লালচে মনে হচ্ছে! কে জানে! আজকাল অনেক কিছুই কুহেলি বুঝে উঠতে পারে না। তবে আলেখের গলায় খুশি অনুভব করে ওর মনটাও খুশিতে ভরে গেছে, ঠিক যেমন শৈলজা দেবী বা চৈতালী দেবীর খুশি দেখে হয় তেমন। কিছুক্ষণ পরেই কুহেলিরা রওনা হল আশীর্বাদ ব্যাঙ্কয়েট হলের উদ্দেশ্যে। সেখানেই বিয়ে হবে আর কুহেলির সাজ সজ্জার ব্যবস্থাও সেখানেই করা হয়েছে। শহরের বেস্ট বিউটি স্যালন অরুণিমা’স আজ কুহেলিকে সাজানোর দায়িত্বে রয়েছে। লগ্ন রাত আটটা সতেরো তে, কিন্তু নিমন্ত্রিত অভ্যাগতরা তার আগেই আসতে শুরু করবেন, সুতরাং সেইমতই কুহেলিকে তৈরি হতে হবে। তাই দুপুর থাকতে থাকতেই সাজানোর পর্ব শুরু হয়ে গেছে। ছটার আগেই কুহেলির সাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেল, যে দেখছে সেই যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, সাবেকি বাঙালি কনের বেশে এ যেন এক নতুন কুহেলি। আটপৌড়ে করে পরা ঐতিহ্যবাহী লাল বেনারসি শাড়ি সঙ্গে সোনার অলঙ্কার, মাথায় সাবেকি বাঙালি টোপর, শাখা পলা পরিহিতা হাতদুটো ধরে রেখেছে একটা গাছ কৌটো। সবার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে কুহেলি হঠাৎ ভীষণ লজ্জা পেল, তাই দেখে দিঠি এগিয়ে এসে কানে কানে বলল,
এখনই এত লজ্জা পেলে হবে! জিজু যখন তোকে দেখে পুরো ক্লিন বোল্ড হয়ে যাবে তখন করবি?
কুহেলি যেন আরও বেশি লজ্জা পেল, দিঠির দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল। সবাই ওকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দিল, এই মুহূর্তে কুহেলিকে কোনও এক বিরাট রাজ্যের মহারাণীর মত দেখাচ্ছে। অভ্যাগতরা সব আসছেন, কুহেলিকে দেখে সবাই ভিষন প্রশংসা করছেন। কিছুক্ষণ পরেই একটা শোরগোল শোনা গেল, বর এসেছে, বর এসেছে। দিঠি এতক্ষণ কুহেলির সঙ্গেই ছিল কিন্তু এই শোরগোল শুনেই উঠে চলে গেল। আলেখের বসার ব্যবস্থা একদম অন্যদিকে, কুহেলির দেখার কোনও উপায় নেই। তবে তাতে আর কি! একটু পরেই দিঠি এসে হাজির, কুহেলি তখন একজন অতিথির সঙ্গে কথা বলছিল, তিনি চলে যেতেই কুহেলির মুখের সামনে দিঠি নিজের মোবাইল টা মেলে ধরল। কুহেলির চোখ দুটো যেন মুহুর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে আলেখকে! ঘিয়ে রঙের উপরে মেরুন রঙের হালকা সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি আর লালচে মেরুন রঙের সোনালী জরির পাড় বসানো ধুতি। মাথায় সাবেকি বাঙালি টোপর, হাতে দর্পণ, ষোলো আনা বাঙালি বরের সাজে যে আলেখকে এতোটা আকর্ষণীয় লাগতে পারে এটা কুহেলি ভাবতে পারেনি। হঠাৎ দিঠি মোবাইল টা সরিয়ে বলল,
ব্যাস, অনেক দেখেছিস, আর দেখতে হবে না। এটুকু তাও দেখলাম কেন বলতো? কারণ গেট আটকে জিজুর পকেট থেকে কড়কড়ে কুড়িটি হাজার টাকা খসিয়েছি। তাই ভাবলাম, তোর জন্যই তো এসব হচ্ছে, তোকে একটু দেখিয়ে আনি।
কুহেলি কিছু বলল না, কারণ আরেকজন অতিথি এসেছেন। কুহেলি তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল আর দিঠি এই ফাকে আবার কোথায় যেন চলে গেল। চৈতালী দেবী চারিদিক সামলাচ্ছেন, প্রথমে তো আসবেন না ভেবেছিলেন। মেয়ের মায়ের বিয়ে দেখতে নেই, অমঙ্গল হয়। কিন্তু তথাকথিত সেই নিয়ম কুহেলি মানতে দেয়নি, শৈলজা দেবীও এসেছেন, উনি একেবারে মণ্ডপের কাছেই বসেছেন। দেখতে দেখতে সময় হয়ে এল, কুহেলির ডাক পড়ল বিয়ের আসরে। কুহেলির দুই পিসতুতো ভাই এল ওকে নিয়ে যেতে, কুহেলি পিড়িতে উঠে বসলে ওরা দুজন পিড়ি সমেত কুহেলিকে নিয়ে এগোতে লাগল মন্ডপের দিকে। কুহেলি পানপাতার আড়ালে ঢেকে রেখেছে মুখটা, আশেপাশে শুনতে পাচ্ছে সবার হৈ চৈ। যত মণ্ডপের কাছে এগোচ্ছে ততই যেন হৃদযন্ত্র টা আবার বিদ্যুতের বেগে স্পন্দিত হচ্ছে। অবশেষে পৌঁছে গেল ছাদনাতলায়, হৃদযন্ত্র এখনও স্বাভাবিক হয়নি, বরং আরও দ্রুত হয়েছে তার গতি। একে একে সাতপাক ঘোরাও হয়ে গেল, হঠাৎ শুনতে পেল,
আরে কুহু এবার তো মুখটা দেখা রে, এত লজ্জা কিসের!
চারিদিকে সবাই একই কথা বলছে, কুহেলি চোখদুটো বন্ধ করে ধীরে ধীরে পান পাতা দুটো সরাল। আর ওর সামনে দাড়ানো আলেখ তখন কুহেলিকে দেখে যেন নিজের সমস্ত বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কারোর কোনও কথা তার কানে যাচ্ছে না, চোখদুটো যেন স্থির হয়ে গেছে কুহেলির মুখের উপরে। এ কোন কুহেলি! এই অসামান্যা রূপের অধিকারিনী কি তার চেনা সেই কুহেলি! আর কত নতুন রূপে তাকে অভিভূত করবে কুহেলি! এদিকে কুহেলি চোখ বন্ধ করে রাখায় সবাই বলতে লাগল,
আরে এত লজ্জা পেতে হবে না, এবার ঝটপট চোখটা খুলে একটু ভালো করে তাকা দেখি। শুভদৃষ্টি টা সম্পন্ন হোক, আমরাও একটু দেখি।
পাশ থেকে দিঠির আওয়াজ পেল,
দি, কাম অন জিজু ওয়েট করছে তো।
আরও সবাই একই কথা বলতে লাগল, কুহেলি ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলতেই আলেখের মুগ্ধ চাহনি ওর অন্তর পর্যন্ত ছুয়ে গেল। আলেখের চোখের মুগ্ধতা ওর নজর এড়ায়নি, কুহেলির মনে হল সারা জগতের লজ্জা এসে যেন ওর ওপরে ভর করেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়েই আবার চোখ দুটো নামিয়ে নিল, আশেপাশে হাসি ঠাট্টা তখনও চলছে। এরপর এল মালাবদলের পালা, কুহেলি যখনই আলেখের গলায় মালা পরাতে যায় তখনই বিহান আর রাজীব ওকে পিছিয়ে নিয়ে যায়, আবার আলেখও যখনই কুহেলিকে মালা পরাতে যায় কুহেলির ভাইরা পিড়ি সমেত কুহেলিকে আরও উপরে তুলে ধরে। এইভাবে মোটামুটি অনেক কসরতের পর মালাবদল হওয়ার পর শুরু হল বিবাহ যজ্ঞ। একের পর এক নিয়ম চলতে লাগল, দেবাঞ্জলি ওদের গাঁটছড়া বেঁধে দিল। চিরন্তন কন্যাদান করছে, একসময় আলেখের হাতে কুহেলির হাত তুলে দিল সে। আলেখের স্পর্শ পেয়ে কেমন যেন কেঁপে উঠল কুহেলি, এতক্ষণ একবারের জন্যেও আলেখের দিকে তাকায়নি সে। পারেনি, বারবার একটা লজ্জার রেশ যেন ঘিরে ধরেছে ওকে, কিন্তু আলেখের মুগ্ধ চাহনি থেকে থেকেই ছুয়ে যাচ্ছিল কুহেলিকে। একসময় এল সিঁদুর দানের পালা, দিঠি কুহেলির টিকলি টা সরিয়ে দিল। আলেখের বা হাতটা সিঁদুর মাখানো আংটি সমেত এগিয়ে এল কুহেলির দিকে, কুহেলির চোখ দুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এল। মুহুর্তের মধ্যে আলেখের নামের সিঁদুর রাঙিয়ে দিল কুহেলির সিঁথি। একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল কুহেলির অন্তর, আজ থেকে তবে সত্যিই সে বিবাহিতা হল, শুরু হল ওর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের। সিঁদুর পরানোর সময় কুহেলির নাকে বেশ কিছুটা সিঁদুর পড়ল, সেটা দেখেই আশেপাশে সবাই বলতে লাগল।
কুহু তোর বর তোকে ভিষন ভালোবাসবে, দেখিস।
কুহেলির কান পর্যন্ত সেকথা পৌঁছল কিনা কে জানে! সে তো এখন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। যজ্ঞ কুন্ডে খই ফেলার সময় যখন আলেখ ওর পিছনে দাঁড়িয়ে দুইহাত দিয়ে ওর হাতের উপর হাত রেখে কুলোটা ধরল তখন যেন আরও একবার কেপে উঠল কুহেলি। অবশেষে সমস্ত নিয়ম নীতি মেনে সম্পন্ন হল ওদের বিয়ে, আজ থেকে আলেখ আর কুহেলি নাম দুটো একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গেল সারাটা জীবনের জন্য। একে একে ওরা উপস্থিত সকল গুরুজনদের আশীর্বাদ নিল। শৈলজা দেবী তো আনন্দে কেদেই ফেললেন, নভতেজ বাবুর অবস্থাও কিছুটা তাই। ওদের দুজনকে একজায়গায় বসিয়ে এবার শুরু হল ফটোশুট, নানারকম ভঙ্গিমায় তাদের বেশ কতগুলো ছবি তুলে তবে শান্ত হল ক্যামেরাম্যান। কুহেলির এখনও সবটা কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। এখন ওরা বিধিসম্মত স্বামী স্ত্রী, আইনত বিয়েটাও এইবার হবে, ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসার এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন। আইনি কাগজগুলোতে কয়েকটা মাত্র স্বাক্ষর, আর আইনত ওরা স্বামী স্ত্রী। সব দিক থেকেই এখন ওরা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস শর্মা, কি অদ্ভুত না! মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ওদের জীবনে কত বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। এখনও অতিথিরা আসছেন, নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন। আলেখ মাঝে মধ্যেই তাকিয়ে দেখছিল কুহেলির দিকে, সিঁদুরে রাঙানো সিঁথিটা দেখে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ওর মনে। কিন্তু কুহেলিকে কেমন যেন একটু জড়সড় মনে হচ্ছে, আলেখ একটু ফাক বুঝে কুহেলির একটা হাতের উপরে ওর একটা হাত রাখল। কুহেলি একটু কেপে উঠে আলেখের দিকে তাকাল, আলেখ একভাবে তাকিয়ে রইল কুহেলির দিকে। তারপর বলল,
কংগ্রাচুলেশন, উই আর ম্যারেড নাও। এখন যতই ভাব না কেন, আর কিছু করার নেই, সারাটা জীবন পস্তাতে হবে এখন।
আলেখের কথায় কুহেলি হেসে ফেলল, একটু ক্ষণ চেয়ে রইল আলেখের দিকে। মানুষটা কীকরে বোঝে কখন কিভাবে ওর মন ভালো করতে হয়! যখনই ওর মন খারাপ হয় বা অস্থির হয়ে ওঠে ঠিক তখনই কোনও এক অদ্ভুত জাদুবলে যেন নিমেষের মধ্যে ওর মনটাকে শান্ত করে দেয়। কুহেলিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলেখ বলল,
কি হল? তাকিয়ে থেকেও কিন্তু লাভ নেই আর, যা হওয়ার হয়ে গেছে।
কুহেলি আবার হেসে বলল,
জানি, আর জেনে বুঝেই সবটা করেছি। এখন তাতে যদি পস্তাতেও হয়, ক্ষতি নেই।
দেখতে দেখতে রাত বাড়তে লাগল, অভ্যাগতদের ভিড়ও কমে এল। এইবারে এল নবদম্পতির খাওয়ার পালা, সেই কোন ভোর বেলায় খেয়েছে দুজনে। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে দিঠি একবার ওদের জুস দিয়ে গিয়েছিল, ব্যাস ওই অবধি। দুজনের পেটেই মোটামুটি ছুঁচো দৌড়চ্ছে, ওদের সঙ্গে পরিবারের বাকিরাও খেতে বসল। গল্প সহযোগে খাওয়ার পর্ব মিটতে মিটতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেল। আলেখ আর কুহেলি আজ এখানেই থাকবে, ওদের সঙ্গে বাকিরাও থাকবে। মানে ওদের ভাই বোনেরা আর কি, বাকিরা ফিরে যাবে আবার কালকে সকালে আসবে ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। চৈতালী দেবী একটা হালকা সুতির শাড়ি দিয়ে গেলেন কুহেলিকে, এতক্ষণ এত ভারী শাড়ি পরে হাপিয়ে উঠেছে। দিঠি সহ বাকিরা ওদের একটু চেঞ্জ করার সময় দিয়ে নিচে চলে গেল আড্ডা দিতে। ওরা যেতেই কুহেলি শাড়িটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল কিন্তু একটু পরেই চেঞ্জ না করে বেরিয়ে এল। আলেখ বলল,
কি হল? চেঞ্জ করলে না?
না, আসলে ওয়াশরুমে এতকিছু খুলে রাখার মত জায়গা নেই।
আলেখ বুঝতে পেরে বলল,
ওহ, ওকে আমি বাইরে যাচ্ছি, তুমি এখানেই চেঞ্জ করে নাও।
বলে আলেখ উঠে ঘরের বাইরে যেতে গেল কিন্তু দরজা কিছুতেই খুলতে পারল না। একটু অবাক হয়ে বলল,
অদ্ভুত তো! দরজা টা খুলছে না কেন? জ্যাম হয়ে গেল নাকি?
কুহেলি আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। আলেখ তখনও দরজাটা খোলার চেষ্টা করে চলেছে, কুহেলি বলল,
ছেড়ে দিন, চেষ্টা করে লাভ নেই, দরজা খুলবে না।
কেন!
ওরা বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে।
আলেখ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, কুহেলির দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল,
তাহলে?
জানি না, এখন ওদের ফোন করেও লাভ নেই। ওদের মর্জি না হলে কিছুতেই দরজা খুলবে না।
আলেখ একটু ভেবে বলল,
আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি, তুমি চেঞ্জ করে নাও।
আমার তো একটু সময় লাগবে, আপনি এতক্ষণ ওয়াশরুমে থাকবেন!
হুম, আমিও একটু ফ্রেশ হয়ে নি এই ফাঁকে।
বলে আলেখ টাওয়েলটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল, ঢুকতে গিয়েও দাড়িয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
তুমি চাইলে বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিতে পার।
কুহেলি যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে, আর ততটাই শ্রদ্ধা বাড়ছে মানুষটার প্রতি। একটু হেসে বলল,
তার দরকার নেই।
আর মনে মনে বলল,
আপনার প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে।
কুহেলির অনুচ্চারিত কথাগুলোও যেন আলেখ শুনতে পেল, অল্প হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। কুহেলি যতটা দ্রুত সম্ভব শাড়িটা বদলে নিয়েই আলেখকে বেরিয়ে আসতে বলল। আলেখ বেরিয়ে দেখল কুহেলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। আলেখ বিছানার ওপরে হেলান দিয়ে বসে দেখতে লাগল কুহেলিকে, বেচারি সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই চুলটা খুলতে পারছে না, শেষে অধৈর্য্য হয়ে একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলে উঠল,
ধুর ছাই, ভালোলাগে না। এত কি যে কায়দা করে বাঁধে কে জানে! দিঠি টাও নেই, কখন আসবে তারও ঠিক নেই। আবার দরজা টাও বন্ধ করে রেখে গেছে, কি জ্বালা।
কুহেলি সব কথাটুকুই বাংলায় বলল, ফলে আলেখ সবটা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারল যে বেচারি চুল খুলতে না পেরে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। আলেখ একটু ইতস্তত করে কুহেলির কাছে গিয়ে বলল,
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি হেল্প করতে পারি।
কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,
আপনি! আপনি পারবেন? না মানে এসব আপনি…..
উম, চেষ্টা তো করতেই পারি।
কুহেলি আর কিছু বলল না, আলেখ ধীরে ধীরে ওর পিছনে এসে দাড়াল। আলতো হাতে খুলে দিতে লাগল ক্লিপ গুলো, এক এক সময় আলেখের আঙ্গুল গুলো ছুয়ে যেতে লাগল কুহেলির ঘাড় আর পিঠের কিছু অংশ। আলেখের স্পর্শে কেমন কেপে উঠল কুহেলি, চোখ দুটো কখন যেন আপনা থেকেই বুজে এসেছে। সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন ছড়িয়ে পড়ছে একটা অদ্ভুত শিহরন। তবে এই শিহরণ শুধু কুহেলি একাই অনুভব করছে না, আলেখেরও গোটা শরীর জুড়ে যেন এক নাম না জানা অনুভূতি জেগে উঠেছে। আয়নায় নিজের নব পরিণীতা স্ত্রীয়ের প্রতিচ্ছবি দেখে যেন একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছে। চুলটা খোলা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল, কিন্তু কুহেলি এখনও চোখ দুটো বন্ধ করেই রেখেছে, আর আলেখ…. সে এখন এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। ওর হাত দুটো কখন যেন নেমে এসেছে কুহেলির দুই কাঁধে, মন্ত্রমুগ্ধের মত অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কুহেলির দিকে।
ওহ হো, ভালই তো চলছে।
হঠাৎ কারো আওয়াজে আলেখ ছিটকে সরে এল, কুহেলিও ব্যস্ত হয়ে চুলটা বাঁধতে বাঁধতে উঠে দাড়াল। একটু আগের কথাটা দিঠি বলেছে, দরজা খুলেই এমন সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে ওর যেন মহা আনন্দ হয়েছে। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আবার বলল,
বিহান তোমার দরজা লক করার আইডিয়ার যে এমন সুন্দর ফল হবে ভাবিনি।
বিহান বেশ একটু কায়দা করে বলল,
আমার আইডিয়া সবসময়ই বেস্ট হয়।
থাক, একটু প্রশংসা করেছি বলে মাথায় ওঠার প্রয়োজন নেই।
লুক মিঠি….
ইটস দিঠি, একটা নাম পর্যন্ত মনে রাখতে পার না।
বিহান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রাজীব ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
স্টপ ইট ইয়ার, এখানে তোমরা নিজেরা ঝগড়া করতে এসেছ নাকি! যেটা করতে এসেছি সেটা হোক।
রাজীবের কথায় সবাই এবার আলেখ আর কুহেলিকে জোর করে পাশাপাশি বসিয়ে ওদের ঘিরে বসল, বাসর রাত বলে কথা, কতরকম কান্ড কারখানা করার থাকে। দিঠি অসম্ভব ফিল্মি, হিন্দী সিনেমা গুলো মোটে গুলে খেয়েছে। কোথা থেকে একটা পাত্রে দুধ আর গোলাপের পাপড়ি মিশিয়ে নিয়ে এসেছে। এই নিয়মটা বাঙালি মতেও আছে, তবে তার ধরন একটু আলাদা, যাইহোক কিছু ফের বদল তো চলতেই থাকে। এবার ওদের কথামত দুজন নিজেদের আংটি খুলে ওই পাত্রে ফেলে দিতেই দিঠি সেটা ভালো করে মিলিয়ে দিল। এবার শুরু হল খোজার পালা, বিহান আর রাজীব আলেখের পক্ষে আর দিঠি, কুহেলির দুই পিসতুতো ভাই আর একজন জেঠতুতো দিদি কুহেলির পক্ষে। মোটামুটি দুই পক্ষের সমর্থকদের উত্তেজনা এত তুঙ্গে যে বর বধূর দিকে কারো খেয়ালই নেই। দুজনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে অন্যজনকে স্পর্শ না করার কিন্তু অতটুকু একটা পাত্রে যদি আংটি খুঁজতে হয় তবে ছোয়া তো লাগবেই। আর যতবারই ওদের হাতদুটো ছুয়ে যাচ্ছিল ততবারই দুজনে যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিল, একটু আগের ঘটনার রেশটা দুজনের কেউই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যাইহোক এই আংটি খোজার তিনটে রাউন্ডের দুবারই কুহেলি জিতল, আর তাতে দিঠির আনন্দ দেখে কে। সে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল,
জিজু, সামলে চলতে হবে কিন্তু এবার থেকে, বাকি লাইফটা আমার দি রাজ করবে।
আলেখ একবার কুহেলির কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা অস্বস্তি মেশানো মুখটার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলল,
তাতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই।
এইভাবে মোটামুটি আরও ঘণ্টা দুয়েক নানারকম হাসি ঠাট্টা গান গল্পে কাটিয়ে প্রায় ভোর রাতের দিকে সবাই শুয়ে পড়ল, মানে আর না পেরে তবেই শুয়েছে, না হলে হয়তো এটুকুও ঘুমাতো না। কুহেলি সহ মেয়েরা সবাই বিছানায় আর ছেলেরা সবাই সোফায় আর এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সকাল হতেই চিরন্তন এসে ওদের কুহেলিদের বাড়িতে নিয়ে গেল। সবাই একটু ফ্রেশ হওয়ার পরে জল খাবারের পর্ব সারা হল। আজকেও বাড়িতে বেশ ব্যস্ততা চলছে, আসলে আজকেই আলেখ আর কুহেলি সোজা ব্যাঙ্গালোরে ওঙ্কার ভিলায় প্রবেশ করবে। নভতেজ বাবুর ইচ্ছে তার পুত্রবধূ পিতৃগৃহ থেকে সোজা তার নিজের বাড়িতে পা রাখবে, সেইমতই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, রীতিমত প্রাইভেট জেট বুক করা হয়েছে। ওনারা দুপুরের আগেই চলে এলেন, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটতে না মিটতেই শুরু হয়ে গেল যাত্রামঙ্গলের প্রস্তুতি। হৈ চৈ হাসি আনন্দে এতদিন মুখর হয়ে থাকা বাড়িটা যেন হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে এল। শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী সকাল থেকেই সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলেছেন। কুহেলির মনটাও একটা অব্যক্ত বেদনায় ভরে উঠল, আলেখ সব বুঝল আর তাই কোনও কথা বলল না। এই মুহূর্তে কোনও কথাই কুহেলির কষ্ট কমাতে পারবে না, শেষে ঘনিয়ে এল সেই আনন্দ মিশ্রিত চরম বেদনা দায়ক মুহূর্ত। আজ দিঠি সাজিয়ে দিয়েছে কুহেলিকে, আবার সেজে উঠেছে কুহেলি সেই লাল বেনারসি তে। কিন্তু আজ সেই মুগ্ধ করা রূপ ফুটে উঠল না, কুহেলির চেহারায় আজ মন খারাপের মেঘের ছায়া। শুরু হল বিদায় পর্ব, অরিন্দম বাবুর ছবির সামনে দাড়িয়ে কুহেলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, দু চোখ বেয়ে নেমে এল উষ্ণ জলের ধারা। আলেখের খুব কষ্ট হল ওকে এভাবে দেখে কিন্তু এখানে ওর কিছু করার নেই, দুজনে অরিন্দম বাবুর ছবিতে প্রণাম জানাল। এরপর একে একে সবার কাছে বিদায় নেবার পালা, শৈলজা দেবীকে প্রণাম করতে গেলে উনি কুহেলিকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললেন,
এমন শুভক্ষণে চোখের জল ফেলিস না কুহু, আজ তো আমার কত খুশির দিন, তুই নিজের নতুন জীবন শুরু করছিস মা। দেখিস, খুব সুখী হবি তুই, আমার নাতজামাই তোকে খুব সুখে রাখবে।
তারপর আলেখের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
আমার সবথেকে অমূল্য ধন আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম, ওর খেয়াল রেখো।
আলেখ ওনার হাতদুটো ধরে বলল,
তুমি চিন্তা করো না ঠাম্মু, কুহেলির কোনও অযত্ন হবে না। কথা দিলাম।
চৈতালী দেবী একটা কথাও বলেননি এতক্ষণ, নীরবে শুধু চোখের জল ফেলেছেন। এখন কুহেলি আর আলেখ ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বুকের মাঝে টেনে নিলেন ওনার কুহু কে, কুহেলিও বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মত ভেঙে পড়ল। কেউ কোনও কথা বলল না, এই অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করার মত শব্দ হয়তো পৃথিবীর কোনও শব্দ ভান্ডারেই নেই। তার বেচে থাকার সম্বল, তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় কুহু আজ এক নিমেষে পর হয়ে গেল। চৈতালী দেবীর মনে যখন এই চিন্তা গুলো ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই খুব অদ্ভুত ভাবে নভতেজ শর্মা বললেন,
আপনি ভাববেন না আপনার মেয়ে পর হয়ে গেল। মা মেয়ের সম্পর্ক কখনও পাল্টে যেতে পারে না, আপনি বরং একটা মেয়ের সঙ্গে একটা ছেলেও পেলেন, ঠিক যেমন আমি এত মিষ্টি একটা নতুন মেয়ে পেলাম।
ওনার কথা শুনে চৈতালী দেবী মনে মনে খুব খুশি হলেন, সত্যিই কুহেলি খুব ভাগ্যবতী। এমন একটা পরিবারে যাচ্ছে, যেখানে ওকে সবাই পুত্রবধূ নয় মেয়ের মর্যাদা দিয়ে আপন করে নিয়েছে।
এবার সত্যিই বিদায়ের পালা, নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করার পালা। বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে চৈতী দেবী একমুঠো ইদুরের মাটি কুহেলির হাতে দিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন,
কুহু, এটা দিদিকে দিয়ে বল তোমার সব ঋণ শোধ করে দিয়ে গেলাম।
কুহেলি অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, এইসব অদ্ভুত নিয়ম কে বানিয়েছে! এই একমুঠো ইদুরের মাটি দিয়ে মায়ের ঋণ শোধ করা যায়! যে মানুষটা নিজের জীবনের সবটা দিয়ে তাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে, তার ঋণ কি আদৌ শোধ করা সম্ভব! পৃথিবীর সমস্ত ধন দৌলত দিয়েও এই ঋণ শোধ করা যায় না। কুহেলি জল ভরা চোখেই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
আমি এই নিয়ম মানি না, এই ভিত্তিহীন নিয়ম আমি কিছুতেই পালন করব না।
সবাই অনেক বোঝাল কুহেলিকে কিন্তু ফল কিছুই হল না, সে কিছুতেই রাজি হল না। কুহেলি বলল,
মায়ের ঋণ শোধ করার সাধ্য আমার নেই, শুধু আমার কেন! পৃথিবীর কোনও সন্তানেরই সেই সামর্থ্য নেই। আমি পারব না, এই নিয়ম আমি কিছুতেই পালন করতে পারব না।
আলেখ প্রথমে বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি হচ্ছে, শেষে যখন দিঠি বুঝিয়ে বলল তখন সেও কুহেলির কথা সমর্থন করে বলল,
কুহেলি তো ঠিকই বলেছে, এভাবে কখনও মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না, এভাবে কেন! কোনও ভাবেই মায়ের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তাই আমার মতেও এই নিয়ম টা পালন করা অপ্রয়োজনীয়।
এরপর আর কেউ কোনও কথা বলল না, কুহেলি ধীরে ধীরে পা বাড়াল নিজের নতুন জীবনের দিকে। চিরন্তন আলেখ আর কুহেলিকে গাড়িতে তুলে দিল, জানালা দিয়ে কুহেলি তাকাল বাড়ির দিকে, দরজায় এখনও দাড়িয়ে আছে তার জীবনের সবথেকে প্রিয় মানুষ দুটি। তাদের চোখেও জল, কুহেলির চোখের জল আবার বাঁধ ভাঙল, ধীরে গাড়ির চাকা গড়াল এয়ারপোর্টের দিকে। একসময় মিলিয়ে এল কুহেলির চির পরিচিত সাদা বাড়িটা, চোখ দুটো বন্ধ করে ভেঙে পড়ল কান্নায়। আলেখের অন্তরটাও যেন একটা না বলা কষ্টে ভরে উঠল, সত্যিই এতদিনের নিজের পরিবার ছেড়ে এমন হঠাৎ করে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পরিবারকে আপন করে নেওয়া কতটা কঠিন। অথচ সব মেয়েরাই এই কঠিন কাজটা সম্পূর্ণ করে, ঈশ্বর বোধহয় এই বিশেষ ক্ষমতাটা শুধু নারী জাতিকেই দিয়েছেন। আলেখ কোনও কথা না বলে আলতো করে ওর একটা হাত কুহেলির হাতের উপর রাখল, সব সময় নিজের অনুভুতি গুলো ব্যক্ত করার জন্য শব্দের প্রয়োজন হয় না, সামান্য একটু স্পর্শই যথেষ্ট।
ক্রমশ___________________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
সম্পন্ন হল আলেখ আর কুহেলির বিবাহপর্ব। শুরু হল ওদের নতুন জীবন, একসাথে পথচলা। কেমন হবে ওদের আগামী দিনগুলো? আজ আর বেশি কিছু বলব না। কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন। আমি প্রতীক্ষায় থাকব। ততক্ষণে আমি যাই দেখি ওদের রিসেপশন পার্টির আয়োজন কতদূর হল। রিসেপশন পার্টিতেও কিন্তু আসতে হবে। দেখা হবে আগামী পর্বে অর্থাৎ রিসেপশন পর্বে, ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।