সংগোপনে’ পর্ব-২৫

0
1744

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৫
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

আজ ওঙ্কার ভিলা সেজে উঠেছে এক নতুন সাজে, নববধূকে বরণ করে নিতে। বধূবরণ পর্ব শুরু হতে চলেছে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই বরণ করে নিতে হবে। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে, মেহের হর্ষিতা সহ আরও কয়েকজন মিলে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। চৈতী দেবী বারবার করে বলে দিয়েছেন সূর্য ডোবার পর আলেখ আর কুহেলিকে আলাদা রাখার কথা, বাঙালি মতে এই সময়টা কালরাত্রি। পরের দিন সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত ওরা দেখা করতে পারবে না। কুহেলি এখন অনেকটাই শান্ত হয়েছে, কিন্তু মন খারাপের কিছুটা রেশ রয়ে গেছে। মেহের আর হর্ষিতা একটা চাল ভর্তি ঘট আর একটি পাত্রে দুধের সঙ্গে আলতা মিশিয়ে নিয়ে এলেন। কুহেলি আর আলেখকে একসঙ্গে বরণ করে মেহের কুহেলিকে প্রবেশ করতে বললেন। ডান পায়ের আলতো ছোয়ায় ঘটটা ফেলে আলতায় পা রাঙিয়ে নিজের পদচিহ্ন এঁকে দিতে দিতে কুহেলি প্রবেশ করল নিজের নতুন জীবনে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছতেই মেহের কুহেলির কাছে এসে ওর গালে একটা হাত রেখে বললেন,

একদম মন খারাপ করবে না বেটা, আজ থেকে ওই বাড়ির মত এটাও তোমার বাড়ি। তোমার নিজের সংসার, এখন থেকে তোমার একটা নয় দুটো পরিবার।

কুহেলি ওনাকে প্রণাম করল, উনি আশীর্বাদ করে বললেন,

সুখী হও, আর এবার একটু হাসো তো দেখি। এত মিষ্টি মুখ খানায় হাসি না থাকলে মানায় না।

কুহেলি একটু হাসল, এবার নভতেজ শর্মা বললেন,

ঠিক আছে, অনেক ধকল গেছে সবার। এখন সবাই একটু রেস্ট করে নাও, আবার কালকের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মেহের তুমি কুহেলিকে গেস্ট রুমে নিয়ে যাও, আজ তো ওরা আলাদা থাকবে। সূর্য ডুবে এসেছে প্রায়, আলেখ তুইও যা একটু রেস্ট করে নে।

হর্ষিতা এখানে বাধা দিয়ে বললেন,

সে কি ভাইসাব! আপনি আসল নিয়ম টাই তো ভুলে যাচ্ছেন।

কি?

আরে, আমাদের ফ্যামিলির বিশেষ রীতি।

তুমি কোন রীতির কথা বলছ হর্ষিতা, আমি মনে করতে পারছি না।

সেই রীতি, যে রীতি অনুযায়ী আলেখকে কুহেলিকে কোলে করে নিজের রুম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।

ও হ্যা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।

মেহেরও সায় দিয়ে চরম উৎসাহের সঙ্গে হেসে বললেন,

আরে তাই তো, এটা তো মনেই ছিল না, থ্যাঙ্কস ভাবি। চলো আলেখ বেটা কুহেলিকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে নিয়ে চলো।

কথাটা শোনার পর থেকেই কুহেলি একভাবে মাটির দিকেই তাকিয়ে ছিল, এসব আবার কি নিয়ম! এইভাবে সবার সামনে…. কি বিব্রতকর ব্যাপার। ওদিকে আলেখও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, ক্ষীণ স্বরে একটু আপত্তি করার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না। সবাই নাছোড়বান্দা, শেষে কোনও উপায়ন্তর না দেখে আলেখ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কুহেলির কাছে। বেচারি চোখ দুটো বন্ধই করে ফেলেছে, আলেখ আর বেশি ভাবনা চিন্তা না করে দুহাতে কুহেলিকে কোলে তুলে নিল। কুহেলি একটা হাত দিয়ে আলেখের কাধটা আঁকড়ে ধরল আর অন্যহাত টা দিয়ে নিজের শাড়ির একটা অংশ চেপে ধরল, চোখ দুটো এখনও বন্ধই রয়েছে। বিহান আর রাজীব তো রীতিমত চিয়ার করতে লাগল, আলেখ কুহেলিকে নিয়ে দোতলায় নিজের রুমে এসে আস্তে করে ওকে নামিয়ে দিল। মেহের হেসে কুহেলির কাছে এসে বললেন,

হয়েছে হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। এবারে চোখ টা খোলো, আজ তো আর এই ঘরে থাকবে না। অন্য ঘরে যেতে হবে, তা চোখ বন্ধ করে তো আর যেতে পারবে না। নাকি আলেখকে বলব ওই ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে!

কুহেলি কিছু না বলে ধীরে ধীরে চোখটা খুলল কিন্তু কারোর দিকেই তাকাল না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত রকমের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে ওর। মেহের কুহেলিকে নিয়ে গেস্ট রুমে এলেন, এটা সেই ঘরটা যেটায় কুহেলি আর দিঠি আগেরবার এসে থেকেছিল। কুহেলির লাগেজ আগে থেকেই রাখা আছে এখানে, মেহের ওকে পৌঁছে দিয়ে বললেন,

তুমি এখন একটু রেস্ট কর, চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিছু লাগলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলবে কেমন?

কুহেলি অল্প হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

মেহের রুম থেকে বেরোনোর সময় বললেন,

আর শোনো, একদম কান্নাকাটি করবে না কিন্তু। তাহলে খুব বকব বলে দিলাম।

কুহেলি এবারও শুধুই হাসল। মেহের হেসে চলে গেলেন, কুহেলি ওর ট্রলি টা খুলে একটা হালকা চুড়িদার বের করল। ঠান্ডা জলে স্নান করে চুড়িদারটা পরে যেন একটু হলেও হালকা মনে হল নিজেকে। ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে এল কুহেলি, কিছুক্ষণ হল সন্ধ্যে হয়েছে। কি অদ্ভুত না! মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও সে কোথায় ছিল আর এখন কোথায় আছে! ও বাড়ির কথা মনে হতেই আবার চোখ দুটো জলে ভরে এল, কুহেলি ঘরে এসে বিছানায় বসে পড়ল। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবল একবার ফোন করে কিন্তু করল না, ফোনটা আবার পাশে রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। কুহেলি সব জানে, সব বোঝে কিন্তু মানিয়ে নিতে একটু তো সময় লাগেই। হঠাৎ পাশে রাখা ফোনটা টুং টুং শব্দে জানান দিল কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, আলেখ।

“মন খারাপ করো না, আন্টি ঠাম্মু বাকি সবাই কালকেই আসবে। খুব বেশি হলে তেরো চোদ্দ ঘণ্টা, তারপরেই আবার তুমি ওদের দেখতে পাবে।“

কুহেলি বিষন্ন মনেই টাইপ করল,

“হুম, কিন্তু তারপরে আবার চলেও তো যাবে।“

“হ্যা, সে তো যেতেই হবে কিন্তু এর আগেও তুমি ওদের ছেড়ে একাই থাকতে।“

“ওটা সম্পূর্ণ আলাদা।“

“উহু, মোটেও আলাদা নয়, আগেও তোমার যখন ইচ্ছে হত ওদের কাছে চলে যেতে এখনও যখনই ইচ্ছে হবে তখনই যাবে।“

কুহেলি কিছুক্ষণ কোনও রিপ্লাই দিল না, কি উত্তর দেবে! এটা ঠিক যে ও যখন ইচ্ছে তখনই ওর মা আর ঠাম্মুর কাছে চলে যেতে পারবে। কিন্তু তাও….. এইগুলো ঠিক বলে বোঝানো যায় না। কিছুক্ষণ পর আবার আলেখের মেসেজ এল।

“আই নো, এটা এতটাও সহজ নয়, বাট আমি এটাও জানি তুমি ঠিক পারবে। শুধু তুমি কেন, তোমরা সব মেয়েরাই এই বিষয়ে পারদর্শী, শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন।“

কুহেলি আবারও অবাক হল, এই মানুষটা এত ভালো করে সবটা কীকরে বোঝে! কীকরে পারে ওর অশান্ত মনটাকে নিমেষের মধ্যে শান্ত করে দিতে! কুহেলি ধীরে ধীরে আঙ্গুল চালাল কি প্যাডে, ছোট্ট করে উত্তর দিল,

“ধন্যবাদ”

মেসেজটা পড়ে নিজের ঘরে বসা আলেখের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। দ্রুত হাতে রিপ্লাই দিল,

“আমার কিন্তু ধন্যবাদে অ্যালার্জি আছে, একটু বুঝে শুনে।“

মেসেজটা দেখে কুহেলির মুখেও একটু হাসি ফুটে উঠল। ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। রাতের খাবারটা আজ মেহের ওকে ঘরেই দিয়ে গেলেন, দিয়ে গেলেন বললে অবশ্য ভুল বলা হবে, নিজে হাতে খাইয়ে দিয়ে গেলেন। কুহেলি নীচে সবার সঙ্গেই খেতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই যে কালরাত্রি। আলেখ আর কুহেলি আজ মুখোমুখি হতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা। রাতে ঘুমানোর আগে আবার একটা মেসেজ এল, এবারও প্রেরক আলেখ। তেমন কিছুই না, ছোট্ট একটা গুডনাইট, কিন্তু তাতেই যেন কুহেলি একটা অদ্ভুত উষ্ণতার ছোয়া পেল। উত্তরে সেও একটা ছোট্ট গুডনাইট লিখে পাঠিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল, নতুন জায়গা ঘুম সহজে আসবে নাই ধরে নিয়েছিল কুহেলি। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে সারাদিনের ক্লান্তি যেন দুচোখের পাতায় ঘুম হয়ে নেমে এল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস মত স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল। আজকেও একটা চুড়িদার পড়েছে, চুলটা আঁচড়ে দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছে এমন সময় হর্ষিতা ঘরে ঢুকলেন।

আরে, এত তাড়াতাড়ি উঠে তৈরিও হয়ে নিয়েছ! আমি তো আরও এখন তোমাকে ঘুম থেকে ওঠাতে এলাম।

কুহেলি একটু হেসে ওনাকে প্রণাম করে বলল,

আমি এমনিতেই সকাল সকালই উঠি, অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে তো, সেই অভ্যাসটাই হয়ে গেছে।

বেশ, তবে এত কথায় কথায় প্রণাম করতে হবে না, বুঝেছ?

কুহেলি মাথা নাড়ল। হর্ষিতা ওকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন, নিচে আজ সকাল থেকেই প্রবল ব্যস্ততা। বিকেলের রিসেপশন পার্টির প্রস্তুতি চলছে। বিয়েতে ইচ্ছে করেই মিডিয়া কে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি, আজকে তাই একটা ছোট খাটো প্রেস কনফারেন্স হতে চলেছে বলা যায়। দেশের সেরা বিজনেসম্যান দের মধ্যে অন্যতম দ্য আলেখ শর্মা অবশেষে তার মোস্ট এলিজিবেল ব্যাচেলর এর তকমাটা পরিবর্তন করে বিবাহিত জীবনে পদার্পণ করেছেন, এটা তো একটা বিরাট বড় খবর, তাই মিডিয়ার নজর আজ ওদের উপরেই থাকবে। আজকের পার্টি টা বাড়ির মধ্যেই হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে, নভতেজ শর্মা এবং বাকিরা ডাইনিং রুমে বসে পার্টির আলোচনা করছিলেন। কুহেলি এগিয়ে গিয়ে সবাইকে প্রণাম করল, সবাই ওকে আশীর্বাদ করার পর নভতেজ শর্মা হেসে বললেন,

আজ করেছ ঠিক আছে কিন্তু এবার থেকে এত ঘন ঘন সবাইকে প্রণাম করবে না।

হর্ষিতা বললেন,

আমিও ওকে একটু আগে এই কথাটাই বলছিলাম।

নভতেজ শর্মা আবার বললেন,

তুমি এখন এই বাড়ির মেয়ে, আমার ঘরের লক্ষ্মী, আর ঘরের লক্ষ্মীর জায়গা পায়ে নয়। মনে থাকবে?

কুহেলি হেসে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। হর্ষিতা আর মেহের ওকে নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন, আজ কুহেলির পেহলি রসোই। নিয়ম অনুযায়ী আজ কুহেলিকে কিছু না কিছু রান্না করতে হবে। কুহেলি তেমন একটা রান্না না করলেও একেবারে না পারা নয়, কিন্তু এইমুহুর্তে চট পট কি বানানো যায় সেটাই ভাবছিল। মেহের বললেন,

কুহেলি, বেটা তোমার বেশি কিছু বানানোর প্রয়োজন নেই। এটা শুধুমাত্র একটা রীতি, তাই যা হোক একটা কিছু বানালেই হবে। এমনিতেও ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে গেছে, তাই তুমি অল্প করে নিয়ম রক্ষা কিছু একটা বানালেই চলবে।

এই নিয়মরক্ষা জিনিসটা কুহেলির একেবারেই পছন্দ নয়, যা করবে সেটা ভালো করেই করবে। তাই একটু ভেবে বলল,

বুয়াজী আমি পায়েস মানে ক্ষীর বানাই?

মেহের খুশি হয়ে বললেন,

তুমি ক্ষীর বানাতে পার?

হুম, ঠাম্মুর কাছে শিখেছিলাম।

বাহ্, তাহলে আর কি লেগে পড়। সকাল সকাল জল খাবারের সঙ্গে ক্ষীর, উফ্ ভাবতেই এত ভালোলাগছে। বল বেটা কি হেল্প লাগবে, আমি করে দিচ্ছি।

আমার কোনও হেল্প লাগবে না বুয়াজী, আপনি বাইরে সবার সাথে গিয়ে বসুন। আমি একাই করে নিতে পারব, চাচিজী আপনিও যান।

এবার হর্ষিতা বললেন,

তুমি সত্যিই একা পারবে তো?

কুহেলি হেসে বলল,

হ্যা, আপনারা বাইরে গিয়ে সবার সাথে গল্প করুন। আমি ঝটপট বানিয়ে ফেলছি।

মেহের আর হর্ষিতা দুজনেই হেসে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলেন, রয়ে গেল এবাড়ির কুক বৃন্দা। কুহেলির কথামত সে সব এগিয়ে দিতে লাগল তাকে, এই বাড়ির সবই কুহেলির অচেনা তাই এটুকু সাহায্য তো প্রয়োজন। তবে রান্নায় কোনও সাহায্য নিল না কুহেলি, শৈলজা দেবীর শেখানো পদ্ধতিতে পায়েস রান্নায় মন দিল। রান্না হয়ে গেলে যত্ন করে আলাদা আলাদা বাটিতে তুলে ট্রে তে সাজিয়ে রাখল। এই মুহূর্তে বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই, গেস্ট যারা এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই বিদেশে থাকেন। তারা বিয়ের দিনই কোলকাতা থেকেই ফিরে গেছেন, আসলে বর্তমানে এই বিপুল কর্মব্যস্ত জীবনে সময়ের বড় অভাব সবার। কুহেলি কিচেন থেকে বেরোতেই সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাকাল ওর দিকে। নভতেজ শর্মা বললেন,

মিশন কমপ্লিট?

কুহেলি হেসে বলল,

হ্যা।

তাহলে আর দেরি কিসের, বৃন্দা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সার্ভ করতে বল। আর সবার আগে যেন আমার কুহু বেটার হাতের ক্ষীর টা সার্ভ করা হয়।

কুহেলি বলল,

কিন্তু আঙ্কেল, সুইট ডিশ তো শেষ পাতে খেতে হয়।

একথার উত্তরে উনি বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন,

তোমার কথা শুনে আমার খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল।

কুহেলি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

কেন আঙ্কেল, আমি কি কিছু ভুল করেছি?

ভুল! তুমি ভুল নয়, অন্যায় করেছ।

নভতেজ শর্মার গাম্ভীর্য কুহেলির মনে ভয়ের সঞ্চার করল, কিন্তু ঠিক কি অন্যায় করেছে সেটা বুঝতে পারল না। কুহেলির গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোল না, বাকি সবাইও কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। নভতেজ শর্মা আগের মতই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

তুমি এখনও আমাকে আঙ্কেল বলছ, এত বড় অন্যায় কিন্তু আমি মেনে নেব না।

এটা শোনা মাত্র যেন কুহেলি ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল, উপস্থিত বাকিরাও হেসে ফেলল। কুহেলি যে কি ভয় পেয়েছিল সেটা একমাত্র ওই জানে। নভতেজ শর্মা এবার হেসে বললেন,

এখনও সত্যি সত্যি রাগ করিনি বটে, কিন্তু আর একবারও যদি আঙ্কেল বলতে শুনেছি তাহলে কিন্তু সত্যিই রাগ করব।

কুহেলি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাসল। সার্ভেন্ট রা ইতিমধ্যেই ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিয়েছে, আর নভতেজ বাবুর কথা মত সবার প্লেটের পাশেই রাখা আছে পায়েসের বাটি। নভতেজ বাবু সহ বাকিরাও আগে পায়েস টাই টেস্ট করলেন, কুহেলির একটু নার্ভাস লাগছিল, সবার পছন্দ হবে কিনা, কেমন কি হয়েছে। এক চামচ মুখে দিতেই সবার আগে মেহের বললেন,

বেটা, তুমি এত সুন্দর ক্ষীর বানাতে পার! আমি তো ভাবতেই পারছি না! সত্যি বলতে আমি একদমই আশা করিনি।

কুহেলি হাসল, একে একে সবাই ওর বানানো পায়েসের প্রশংসা করলেন, নভতেজ বাবু ওকে কাছে ডেকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন। তারপর ওর পেহলি রসোইয়ের উপহার হিসেবে একজোড়া বালা ওর হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন,

এটা আমাদের পরিবারিক কঙ্গন, বংশ পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে শোভা পেয়েছে। শেষবার আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমার মা নন্দিনীকে মানে তোমার শাশুড়ি মাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ নন্দিনী থাকলে নিজে হাতে তোমাকে পরিয়ে দিত, কিন্তু…..

কথা বলতে বলতে গলাটা কেমন ধরে এল ওনার, পরিবেশটা হঠাৎ করেই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, নভতেজ বাবু হেসে কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

এতদিন পরে আবার আমার শুন্য ঘরে লক্ষ্মী এসেছে, আজ আমি একদম মন খারাপ করব না। আজ থেকে কেউই আর মন খারাপ করবে না, এখন চল বেটা তুমিও খেয়ে নাও।

কুহেলি একটু আশেপাশে তাকাল কিন্তু কোথাও আলেখকে দেখতে পেল না। এখানে সবাই আছে শুধু আলেখই নেই, সকাল থেকে দেখাও হয়নি ওর সাথে। ওকে এভাবে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে বিহান একটু গলা ঝেড়ে বলল,

ভাবি, তোমার দু চোখ যাকে খুঁজছে তিনি এখন নিজের রুমে রয়েছেন। জগিং সেরে ফ্রেশ হতে গেছেন, এই এলেন বলে।

কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, বেচারির অবস্থা দেখে মেহের বিহানকে একটু ধমক দিয়ে বললেন,

আহ্, কি হচ্ছে টা কি? এভাবে ওকে বিরক্ত করছিস কেন? তুমি ওর কথায় কান দিও না বেটা, এস তুমি বস আলেখও চলে আসবে এক্ষুনি।

শেষের কথাটা কুহেলির উদ্দেশ্যে বললেন। কিন্তু হর্ষিতা হঠাৎ বললেন,

জিজি, আমি বলছিলাম আজ আলেখ আর কুহেলি নাহয় ওদের রুমেই ব্রেকফাস্ট টা সারুক। কি বল?

একটা দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল ওনার মুখে, মেহেরও ইঙ্গিত টা বুঝে বললেন,

হ্যা, হ্যা একদম ঠিক বলেছ ভাবি। কুহেলি বেটা এক কাজ কর, তোমার আর আলেখের ব্রেকফাস্ট টা তুমি উপরে নিয়ে যাও।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

না না, তার দরকার নেই, আমি এখানেই সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করে নিচ্ছি, আর…….

ওর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বিহান তড়াক করে উঠে দুটো প্লেট সাজিয়ে একটা ট্রে তে রেখে সেটা কুহেলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে একপ্রকার ঠেলতে ঠেলতে সিড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

ভাবি, আপাতত আমাদের কারোরই তোমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করার ইচ্ছে নেই বুঝলে তো। তাই তুমি এখন চুপচাপ এটা নিয়ে উপরে যাও আর হ্যা, কোনও তাড়া নেই বুঝলে তো, খাবার সবসময় ধীরে সুস্থে খেতে হয়।

কুহেলি আর কোনও পথ না পেয়ে অগত্যা উপরে উঠে এল। আলেখের রুমের সামনে এসে দেখল দরজা টা খোলাই আছে কিন্তু তাও নক না করে ঢোকা উচিৎ হবে না মনে করে কুহেলি একহাতে কোনরকমে ট্রে টা সামলে অন্যহাতে দরজায় মৃদু টোকা দিল। আলেখ সদ্য ফ্রেশ হয়ে তৈরি হচ্ছিল, পরনে একদম ক্যাজুয়াল একটা হোয়াইট ট্রাউজার আর লাইট গ্রে কালারের প্লেন টি শার্ট। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলটা ঠিক করছিল, দরজায় আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাড়াতেই কুহেলিকে দেখে যেন হঠাৎ ওর আশেপাশের সবকিছু স্থির হয়ে গেল। আকাশ নীল চুড়িদার টায় কি অসম্ভব মানিয়েছে ওকে, আলেখের মনে হল যেন এক টুকরো নির্মল আকাশ হঠাৎ ওর ঘরে এসে পড়েছে। আলেখ মনে মনে প্রমাদ গুনল, কুহেলি কি রোজ রোজ এইরকম নতুন নতুন রূপে ওর সামনে এসে ওকে এইভাবেই স্তম্ভিত করে তুলবে নাকি! আলেখের পূর্ব পরিকল্পিত ছবিটা এখন থেকেই কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে, পরবর্তীতে তাহলে কি হবে! আলেখ একরকম জোর করেই নিজের ভাবনার গতির রাশ টানল। কুহেলি এখনও সেভাবেই দরজায় দাড়িয়ে আছে, আলেখ নিজেকে স্বাভাবিক করে হেসে বলল,

তুমি ওখানে দাড়িয়ে আছ কেন? ভিতরে এস, আর নিজের ঘরে ঢোকার জন্য কি অনুমতি নিতে হয় নাকি?

ওর ঘর! হ্যা, ওরই তো, এখন থেকে তো এটাই ওর ঘর। একটু ভুল হল, ওদের ঘর। কত তাড়াতাড়ি কত কিছু বদলে গেল। কুহেলি ধীর পায়ে ভিতরে প্রবেশ করল, সেন্টার টেবিলে ট্রে টা নামিয়ে রেখে বলল,

আপনার ব্রেকফাস্ট।

আলেখ একবার সেদিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,

আমার খিদে পেয়েছে ঠিকই, তাই বলে দু প্লেট কিন্তু একটু বেশি হয়ে যাবে।

কুহেলি এমনিতেই বড্ড অস্বস্তিতে রয়েছে, নিচে সবাই জোর করে ওকে এখানে পাঠিয়ে দিল। ইস্ কোনও মানে হয়! তার মধ্যে আলেখ মজা করছে, কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল,

আসলে একটা প্লেট আমার, সবাই জোর করে পাঠিয়ে দিল। আমি আসতে চাইছিলাম না, সত্যি, ওনারাই জোর করে…..

আলেখ হঠাৎ জোরে জোরে হাসতে শুরু করায় কুহেলি কথা টা আর শেষ করতে পারল না। আলেখ সবটাই আন্দাজ করতে পেরেছে আর তাই এত হাসির ঘটা। একটু পরে হাসি থামিয়ে বলল,

ওহ গড, কুহেলি তুমি এইটুকুতেই এরকম করছ! সবে তো শুরু, এরপর তাহলে কি করবে?

কুহেলি অবাক হয়ে বলল,

মানে!!

মানে এইরকম পরিস্থিতি এখন পদে পদে আসবে, আর তাতে তুমি যদি এরকম রিয়্যাক্ট কর তাহলে কীকরে চলবে বলতো?

কিরকম পরিস্থিতি?

নিচে যে পরিস্থিতির মধ্যে তুমি পড়েছিলে একটু আগে।

কুহেলি কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসে পড়ল, আলেখও কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ওর পাশে বসে বলল,

কাম অন কুহেলি, তুমি এই ছোট ছোট ব্যাপারের জন্য আমার সাথে এরকম ফর্ম্যাল বিহেভ করছ? উই আর ফ্রেন্ডস রাইট? আর এখন তো আমরা ম্যারেড ফ্রেন্ডস। জাস্ট টেক ইট ইজি, আমরা এর আগেও অনেকবার একসাথে বসে লাঞ্চ ডিনার করেছি এটাও জাস্ট লাইক দ্যাট।

আলেখের কথায় কুহেলির অস্বস্তি টা যেন কমে গেল, একটু হাসিও পেল। ম্যারেড ফ্রেন্ডস এটা আবার কিরকম নাম হল! অনেকটা সহজ হয়ে বলল,

হুম কিন্তু সবাই নিচে আর আমরা এভাবে উপরে, হাউ এমব্যারিসিং।

আলেখ ইতিমধ্যে ওর প্লেট টা তুলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, কুহেলির কথা শুনে ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,

নিউলি ওয়েড কাপলদের এরকম অনেক এম্ব্যারেসিং সিচুয়েশন ফেস করতে হয়।

আলেখ হঠাৎ করেই ওর এতোটা কাছে চলে আসায় কুহেলি যেন একটু থমকে গেল, একটা মিষ্টি অথচ কড়া ঘ্রাণ ওর নাকে এসে লাগল। কিসের ঘ্রাণ এটা! কোনও পারফিউমের এরকম ঘ্রাণ হয় বলে তো মনে হয় না, এটা কি তবে আলেখের নিজস্ব ঘ্রাণ! কোথাও যেন শুনেছিল প্রতিটা মানুষেরই নাকি একটা নিজস্ব ঘ্রাণ থাকে। তখন বিশ্বাস হয়নি, আজ এই অবশ করে দেওয়া ঘ্রাণে হারিয়ে যেতে যেতে মনে হল কথাটা কতটা সত্যি। হঠাৎ কুহেলি ঘোর কাটিয়ে উঠে ভাবল,

এগুলো আমি কি ভাবছি? আর কেনই বা ভাবছি?

আলেখের দিকে তাকাতেই দেখল সে একমনে খাচ্ছে, একটু যেন স্বস্তি পেল। ওর এইসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা গুলো দুর করার জন্যই যেন কুহেলি বলে উঠল,

আপনি কীকরে জানলেন বলুন তো, নিউলি ওয়েড কাপলদের কি কি ফেস করতে হয়? পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে নাকি!

আলেখ খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি ঠোঁটের কোনায় এনে বলল,

ফার্স্ট নাইটে কি হয় জানা আছে?

কুহেলি সবে ওর প্লেট টা হাতে নিয়ে এক টুকরো লুচি মুখে দিয়েছিল, আলেখের কথা শুনে বিষম খেল। তাড়াতাড়ি একটু জল খেয়ে সামলে নিয়ে বড় বড় চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আলেখের দিকে। কোথায় ভেবেছিল ওর প্রশ্ন শুনে আলেখ অপ্রস্তুত হবে কিন্তু তার বদলে উল্টে এমন একটা প্রশ্ন করে ওকেই অস্বস্তিতে ফেলে দিল। কি অদ্ভুত মানুষ! ওদিকে আলেখ তখন আবার খাওয়ায় মন দিয়েছে, যেন কিছুই হয়নি! খেতে খেতেই বলল,

তোমার রিয়্যাকশনই বলে দিচ্ছে তুমি খুব ভালো করেই জানো ফার্স্ট নাইটে কি হয় না হয়, আর আমি এটাও জানি তোমার এ বিষয়ে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

ব্যাস, আলেখ আর কিছু বলল না। কুহেলিরও যা বোঝার বুঝে নিয়েছে, ওর প্রশ্নের এমন অভিনব উত্তর কস্মিন কালেও আশা করেনি। আর কোনও উদাহরণ পেল না! এই উদাহরণটাই দিতে হল! কুহেলি আর কোনও কথা না বলে চুপচাপ খেতে লাগল, আলেখ একবার আড় চোখে কুহেলির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আলেখের খাওয়া শেষ, প্লেট টা টেবিলে রেখে উঠে পড়ল, কুহেলি দেখল আলেখ পায়েস টা খায়নি। হয়তো ভুলে গেছে মনে করে কুহেলি বলল,

আপনি ক্ষীর টা খেলেন না?

নাহ, আসলে আমি ক্ষীর অতটা পছন্দ করি না। আর এতদিন কোনও ওয়ার্ক আউট করা হয়নি, ক্যালরির দিকেও তো একটু খেয়াল রাখতে হবে তাই না?

আলেখ খুব সহজ ভাবেই বলল কথা গুলো, একটা কথাও ভুল বলেনি কিন্তু কেন যেন কুহেলির মন টা খারাপ হয়ে গেল। আলেখ ওর ল্যাপটপ টা এনে আবার কুহেলির পাশে বসে নিজের কাজ করতে লাগল। কুহেলি চুপচাপ নিজের খাবারটা শেষ করে প্লেট দুটো ট্রে তে নিয়ে উঠে পড়ল। আলেখ বলল,

নীচে যাচ্ছ?

হুম।

ওকে, আর আমার কথাটা মনে রেখ কিন্তু।

কুহেলি ছোট্ট করে ঘাড় নেড়ে নীচে চলে এল। কিচেনে এসে পায়েসের বাটি দুটো ফ্রিজে তুলে রাখল, ওর নিজেরও আর খেতে ইচ্ছে করেনি। মেহের আর হর্ষিতা এসে যথারীতি একটু মজা করতে লাগলেন, কুহেলিও হেসেই সব কথার উত্তর দিচ্ছিল কিন্তু মনের একটা কোনায় খারাপ লাগার রেশটুকু রয়েই গেল। এদিকে আলেখ মন দিয়ে ল্যাপটপে একটা ফাইল দেখছিল, হঠাৎ বিহান ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ টা ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধ করে একপাশে রেখে বলল,

কাজটা দুদিন পরে করিস, আমরা যে কদিন আছি একটু আমাদেরও টাইম দে।

বিহান তুই কি আর বড় হবি না?

না, ওসব ছাড় বল ভাবির হাতের ক্ষীর কেমন খেলি?

আলেখ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল, কথাটা শোনা মাত্রই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সোজা হয়ে বসে বলল,

হোয়াট? কুহেলি ক্ষীর বানিয়েছিল?

হ্যা, তুই জানিস না? ওহ্, তুই তো ছিলি না তখন। আরে আজকে ভাবির পেহলি রসোই ছিল তো, কি দারুন হয়েছিল ক্ষীর টা। তাই না?

আলেখের যেন বাকি কথা গুলো কানেই ঢুকল না। নিজের অজান্তেই এটা সে কি করে ফেলেছে! এত কষ্ট করে নিজে হাতে ক্ষীর বানাল আর ও টেস্ট পর্যন্ত করল না! উপরন্তু তখন কুহেলি জিজ্ঞেস করায় কি যে সব বলে বসল! ওর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে। আলেখ একলাফে উঠে নীচে চলে গেল। বিহান বেচারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না, আলেখ নীচে এসে দেখল সবাই একসাথে বসে গল্প করছে সেখানে কুহেলিও আছে। কিন্তু সবার মাঝখানে কীকরে কথা বলবে! তবে বেশি ভাবতে হল না, সুযোগ আপনা থেকেই এসে গেল। মেহের বললেন,

কুহেলি বেটা, একবার আমার সঙ্গে ঠাকুর ঘরে এস। আলেখ তুইও আয়, দরকার আছে।

ওরা দুজনেই মেহেরের সঙ্গে ঠাকুরঘরে এলে, মেহের একটা মঙ্গলসূত্র ঠাকুরের পায়ে ছুইয়ে আলেখের হাতে দিয়ে বললেন,

এটা কুহেলিকে পরিয়ে দে, বিয়েটা বাঙালি মতে হলেও আমাদের মধ্যে মঙ্গলসূত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আলেখ কুহেলির পিছনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলসূত্র টা ওর গলায় পরিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে খুব নিচু স্বরে বলল,

সরি, আমি জানতাম না ক্ষীর টা তুমি বানিয়েছ।

কুহেলি চমকে আলেখের দিকে তাকাল, চোখ দুটোয় যেন একটু অনুতাপ দেখতে পেল কুহেলি। এটা ঠিক যে ওর খারাপ লেগেছিল কিন্তু আলেখের তো কোনও দোষ নেই এখানে। একটু হেসে কুহেলিও নীচু স্বরে বলল,

আপনার যেমন ধন্যবাদে অ্যালার্জি আছে আমারও কিন্তু তেমন সরিতে অ্যালার্জি আছে।

আলেখ হেসে ফেলল, কুহেলি যে রাগ করে নেই এটাই ওর সব থেকে বড় শান্তি। এরপর যে কোথা থেকে সময় পেরিয়ে গেল কেউ টেরই পেল না। চৈতালী দেবীরাও পৌঁছে গেছেন, বিহান আর রাজীব ওদের কুহেলির ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বিকেল থেকেই আবার শুরু হয়ে গেছে কুহেলির সাজ সজ্জার পর্ব। কুহেলি সাজতে ভালোবাসলেও এইকয়েক দিনে এত সাজতে সাজতে বেচারি হাপিয়ে উঠেছে। আজকে কুহেলির পরনে গোল্ডেনের উপরে মাল্টিকালারের এমব্রয়েডারি আর স্টোনের কাজ করা একটা লেহেঙ্গা, তার সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী। আর আলেখের পরনেও ম্যাচিং শেরওয়ানি। সন্ধ্যে থেকেই নিমন্ত্রিত অভ্যাগতদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। চৈতালী দেবীরাও চলে এলেন, কুহেলি ওনাদের দেখে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরল যেন কত যুগ পর দেখেছে। ধীরে ধীরে শুরু হল প্রেস কনফারেন্স, কুহেলি এইসবে এতোটা অভ্যস্ত নয় কিন্তু আলেখ খুব দক্ষতার সঙ্গে সবটা একাই সামলে নিল। আজ নিশীথ আগরওয়াল আসেনি, ওর পক্ষ থেকে উমেশ এসে গিফটের প্যাকেট টা কুহেলি আর আলেখের হাতে দিয়ে জানিয়েছে নিশীথ কে আর্জেন্টলি বিজনেসের জন্য ইউ এস যেতে হয়েছে তাই আসতে পারেনি এবং তার জন্য সে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। নিশীথ না আসায় আলেখ যে মনে মনে কিছুটা হলেও খুশি হয়েছে একথা সে নিজেও অস্বীকার করতে পারবে না। এত অতিথি সমাগমের মধ্যে সময় যেন ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেল, চৈতালী দেবীরা চলে যাওয়ার সময় কুহেলির চোখ দুটো আবার ভিজে উঠল। একসময় সব অভ্যাগতরাই ফিরে গেলেন, মেহের আর হর্ষিতা কুহেলিকে আলেখের ঘরে পৌছে দিয়ে চলে গেলেন। কুহেলি এতক্ষণ ভালো করে লক্ষ্য করেনি, ঘরটা ফুলে ফুলে ভরে আছে, চারিদিকে শুধু ফুল আর সুগন্ধি মোমবাতির রোশনাই। ঘরের মেঝেতে বিরাট আকৃতির একটা হার্ট বানানো হয়েছে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে, তার মাঝখানে লেখা আলেখ আর কুহেলির নাম। বিছানাতেও বিছানো রয়েছে ফুলের চাদর, এইসব দেখে কুহেলি ফুল ছেড়ার দুঃখ ভুলে গেল। বরং একটা অদ্ভুত অনুভুতির অস্তিত্ব টের পেল, লজ্জা-ভয়-সংকোচ-অস্বস্তি সব মিলে মিশে যেন একটা নতুন অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। কুহেলি সোফার একটা পাশে জড়সর হয়ে বসেছিল, কিছুক্ষণ পরে আলেখ ঘরে এল। আলেখকে দেখা মাত্র কুহেলির হৃদযন্ত্র টা যেন নিজের স্বাভাবিক ছন্দ ভুলে গিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হতে লাগল। আলেখ দরজা টা বন্ধ করে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল কুহেলির দিকে, আলেখ যতই ওর দিকে এগিয়ে আসছে ততই যেন কুহেলির হৃদযন্ত্রের গতি বাড়ছে। আলেখ এগিয়ে এসে কুহেলির পাশে বসল, এই প্রথম যেন আলেখের মুখেও কথা নেই, এই সময়ে ঠিক কি বলা যায় সেটা ওরও জানা নেই। বেশ কিছুক্ষণ ঘরে একটা অসম্ভব নিস্তব্ধতা বিরাজ করল, শেষে আলেখ বলল,

তুমি.. তুমি আগে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি ততক্ষণ ব্যালকনিতে আছি।

কথাটা বলে আলেখ আর এক মুহূর্তও না দাড়িয়ে সোজা ব্যালকনিতে চলে গেল। কুহেলি কিছুক্ষণ ব্যালকনির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে চেঞ্জ করে নিল। এত কিছু চেঞ্জ করতে সময় তো একটু লাগেই, সেইসময় টুকু আলেখ ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারটায় বসে ভাবতে লাগল,

আমি কি কুহেলির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি? আজকাল একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করি ওর প্রতি। যতবার কুহেলি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ততবারই আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই, একটা অচেনা অনুভূতি যেন আমার সারা মন আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না, আমি যা ভেবেছিলাম বাস্তব টা যেন তার থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। নাহ, এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না, আমার লক্ষ্যের কথা ভুললে চলবে না আর তাছাড়া কুহেলির দিকটাও তো ভাবতে হবে। ওর বিশ্বাসেরও একটা মূল্য আছে, সেটাকে অসন্মান করা উচিত হবে না, নিজেকে সংযত করতেই হবে।

কুহেলির ডাকে ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল, আলেখ নিজেকে ঠিক আগের মতই স্বাভাবিক করে ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলিয়ে প্রবেশ করল ঘরে। কুহেলি একটা চুড়িদার পড়েছে, ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

এবার আমি একটু চেঞ্জ করে নিই, তুমি বস আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।

আলেখ একসেট ট্রাউজার আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল, ওকে আগের মত স্বাভাবিক দেখে কুহেলিও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করল। আলেখ চেঞ্জ করে বেরিয়ে বলল,

অনেক রাত হল এবার শুয়ে পড়া উচিৎ, তুমি বেডে শুয়ে পড় আমি সোফায় শুয়ে পড়ছি।

কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

তার দরকার নেই।

মানে?

মানে আমার বিশ্বাস আছে আপনার প্রতি।

আলেখ একটু অবাক হল, কুহেলি ওকে এতোটা বিশ্বাস করে সেটা ভাবেনি হয়তো। মনে মনে বলল,

তোমার এই বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখব কুহেলি, অচেনা অনুভূতি গুলো নাহয় আপাতত অচেনাই থাক।

তারপর একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি ঠোঁটের কোনায় এনে বলল,

তোমার তো না হয় আমার প্রতি বিশ্বাস আছে, কিন্তু আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস আছে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে, তাই না?

আলেখের এই মজা গুলো কুহেলি আজকাল খুব ভালো করেই বোঝে। কিন্তু তাও কেন যেন মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত অনুভূতি হয়, যেমন এখন হচ্ছে। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল,

বেশ, বিশ্বাস না থাকলে আপনি সোফাতেই শুয়ে পড়ুন, আমি বরং একটু আরাম করে শুতে পারব।

আলেখ হেসে বলল,

যাহ, কোথায় ভাবলাম তুমি আরও দু চারবার বলবে তা না করে একবারেই সোজা নির্বাসন দিয়ে দিলে!

আমি কোথায় দিলাম! আপনি তো যেচে নির্বাসন নিলেন।

হুম, যেচে নিয়েছিলাম এখন আবার যেচে পরিত্যাগ করলাম।

বলে কুহেলি বিছানার যে পাশটায় বসে ছিল তার উল্টো দিকটায় গিয়ে বসল।

কুহেলি শুধু একটু হাসল, আলেখ খুব সন্তর্পনে গোলাপের পাপড়ি গুলো তুলে পাশের সাইড টেবিলে রেখে বলল,

আজকের ব্যাপারটা কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না তাই এত ফুলের আয়োজন। জানলে কিছুতেই করতে দিতাম না, এরা কখন যে এসব করল সেটাই তো টের পেলাম না।

কুহেলি কিছু না বলে একটু হেসে বলল,

শুয়ে পড়ুন রাত হয়েছে।

আলেখ ঘরের লাইট টা অফ করে শুয়ে বলল,

তুমিও শুয়ে পড়, আজ অনেক ধকল গেছে।

কুহেলি আলেখের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়ল। সারা ঘরে সুগন্ধী মোম আর গোলাপ ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। মোমের হালকা নরম আলো ঘরে একটা আলো আধারি পরিবেশের সৃষ্টি করল। আলেখ একবার তাকাল ওর পাশে শুয়ে থাকা কুহেলির দিকে, কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থেকে সেও কুহেলির দিকে পিঠ দিয়ে পাশ ফিরে শুলো। দুজনেরই মনে চলছে নতুন কিছু নাম না জানা অনুভূতির আনাগোনা। একজন কিছুটা হলেও সেই অচেনা অনুভূতি গুলোকে অনুভব করতে পেরেছে আর অন্যজনের কাছে তারা এখনও অজানা। আজকে তারা অজানা থাকলেও আগামীতেও কি তাই থাকবে! মনের গহীন থেকে উঠে আসা অনুভূতি গুলোকে কি এত সহজে নিয়মের শাসনে বেঁধে রাখা যায়? আগামী দিনগুলো কি আলেখ আর কুহেলির পূর্ব পরিকল্পিত ছকে অতিবাহিত হবে নাকি এই নতুন অনুভূতির আনাগোনায় পাল্টে যাবে সব হিসেব?

ক্রমশ______________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব? আমাকে জানাবেন কিন্তু, আমি অপেক্ষা করব আপনাদের মতামতের জন্য। আজ আর বিশেষ কিছু বলব না, দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here