#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৬
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
আলেখ রোজ ভোরে উঠে জগিংয়ে যায়, এটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। অ্যালার্ম ছাড়াই ঠিক সময়মত ওর ঘুম ভেঙে যায়, আজও একই সময়ে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ টা খুলেই যা দেখল সেটা সত্যি না স্বপ্ন বুঝতে একটু সময় লাগল। আলেখের বুকে মুখ গুজে ওকে জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কুহেলি, ঠিক যেন একটা বাচ্চা মেয়ে। কুহেলির ঘুমন্ত মুখটা দেখে আলেখের ঠোঁটে একটা হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল, ঘুমন্ত অবস্থায় কাউকে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে সেটা ওর জানা ছিল না। আলেখের এতদিনের জীবনে এত মিষ্টি সকাল বোধহয় আগে কখনও হয়নি। কুহেলির ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আলেখের অবচেতন মনের সুপ্ত অনুভূতি গুলো হঠাৎ করেই ওর চেতন মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল। আলেখ এতদিন লক্ষ্য করেনি, কুহেলির ঠোঁটের ঠিক ওপরে একটা ছোট্ট তিল আছে, ভালো করে নজর না করলে চোখে পড়ে না। ওই ছোট্ট তিল টা যেন কুহেলির গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট দুটোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কোনও এক অজানা শক্তিতে চুম্বকের ন্যায় তারা আলেখকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে লাগল। মস্তিষ্কের শাসন অগ্রাহ্য করে আলেখ ভেসে যেতে লাগল সেই দুর্নিবার আকর্ষণের টানে। নিজের হৃদস্পন্দনের গতির অস্বাভাবিকতা যেন ওকে আরও বেশি করে উত্তেজিত করে তুলল। ওদের মাঝের দূরত্ব টা যতই কমছে ততই যেন আলেখের মন বাঁধন হারা হয়ে পড়ছে, কুহেলির গোলাপি ঠোঁট দুটো যখন আর মাত্র সামান্যতম দূরে তখন আলেখ কিছুটা জোর করেই চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। যেন বেসামাল অনুভূতি গুলোকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, শেষ পর্যন্ত ওর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল না, বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করল। ধীরে ধীরে নিজের চোখ দুটো মেলে ঘুমন্ত কুহেলির কপালে আলতো করে ছুঁইয়ে দিল ঠোঁট দুটো। একটু যেন নড়ে উঠল কুহেলি, আলেখ সতর্ক হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে রইল। কুহেলিরও বেশ সকালেই ওঠা অভ্যেস, সময় প্রায় হয়েই এসেছে। একটু এদিক ওদিক করতেই ঘুমটা ভেঙে গেল, আর ঘুম ভেঙে নিজেকে আলেখের বুকে আবিষ্কার করে বাকি ঘুমের রেশ টুকুও কর্পূরের মত উবে গেল। প্রথমে কিছুক্ষণ তো বিশ্বাসই করতে পারল না, ও সত্যিই এভাবে আলেখকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে!! কুহেলি খুব সাবধানে আলেখের কাছ থেকে সরে এসে বিছানা থেকে নেমেই সোজা এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। কুহেলি চলে যেতেই আলেখ চোখ খুলে একটু হাসল, বেচারি ভারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, তার মধ্যে যদি জানতে পারত যে আলেখ জেগে ছিল তাহলে আর দেখতে হত না। একটু হেসে আলেখও উঠে পড়ল, এমনিই দেরী হয়ে গেছে আজ আর জগিংয়ে যাওয়া হল না। ওদিকে কুহেলি ওয়াশরুমে ঢুকে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষন, আপন মনে বকবক করতে শুরু করল।
এটা আমি কীকরে করতে পারি!! হাউ? ইশ, কি যা তা ব্যাপার। ভাগ্যিস উনি ঘুমিয়ে ছিলেন, নাহলে কি ভাবতেন! ছি ছি, কি যে এক বাজে অভ্যেস করেছি কোলবালিশ নিয়ে ঘুমানোর। সবকিছু এই জন্যই হয়েছে, কোলবালিশ থাকলে আর এমন টা হত না। ধুর, কি যে বলছি নিজেও বুঝতে পারছি না, উফ্, আমার সঙ্গেই যে কেন এমনটা হয়!!
বেচারির মাথাটা পুরো ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে, একটু শান্ত করা প্রয়োজন মস্তিষ্ক টাকে। অভ্যেস মত কুহেলি স্নান সেরে নিল, ঠান্ডা জলের স্পর্শে মাথাটাও একটু শান্ত হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আরেক বিপত্তি উপস্থিত হল, তখন এক ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে ঠিকই কিন্তু না টাওয়েল এনেছে আর না নিজের ড্রেস। তাও ভালো, একটা টাওয়েল আগে থেকেই ওয়াশরুমে ছিল, সেটাকেই কোনও রকমে পেঁচিয়ে দরজাটা অল্প ফাঁক করে রুমে উকি মারল কুহেলি। বিছানা টা খালি, তার মানে আলেখ উঠে পড়েছে, বেচারি তো আর জানে না আলেখ অনেক আগেই উঠে পড়েছে। যাই হোক, দরজার ফাঁক দিয়ে রুমের যেটুকু দেখা সম্ভব তার কোথাও আলেখকে দেখতে পেল না। আলেখ রুমে নেই মনে করে সবে বেরোবে ভাবছে এমন সময় শুনতে পেল,
কি হল কুহেলি? ওভাবে কি করছ? কোনও প্রবলেম?
আলেখ ব্যালকনিতে গিয়েছিল, ঘরে ঢুকতেই কুহেলিকে অমন উকি ঝুঁকি করতে দেখে এই প্রশ্ন করল। কুহেলি দরজাটা পুরো বন্ধ করে দিয়ে বলল,
না না, কোনও প্রবলেম নেই।
আলেখ ওয়াশরুমের দরজার সামনে এসে বলল,
কুহেলি ইউ ক্যান টেল মি, আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা প্রবলেম তো হয়েছেই।
কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,
আসলে আমি ড্রেস আনতে ভুলে গেছি।
আলেখ একটু হেসে মনে মনে বলল,
যেভাবে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকেছিলে তাতে ড্রেস নেওয়ার কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল আলেখের মাথায়, ও কুহেলিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে এক সেট চুড়িদার নিয়ে এসে দরজায় নক করতেই দরজাটা সামান্য ফাঁক হল। আর সেই ফাঁক দিয়ে কুহেলি ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিল, আলেখ কিন্তু চুড়িদারটা ওর হাতে দিল না। চুপচাপ দাড়িয়ে রইল, কুহেলি একটু অধৈর্য্য হয়ে বলল,
কি হল! দিন।
আলেখ এবারও ড্রেসটা ওকে না দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে হাসতে লাগল। কুহেলি কোনও সাড়া না পেয়ে এবার দরজাটা আরও একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাল। সামনেই আলেখ দাড়িয়ে আছে, হাতে ওর একটা চুড়িদার। কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
আরে আপনি তো এখানেই আছেন, তাহলে ড্রেসটা আমাকে দিচ্ছেন না কেন!!
আলেখ বেশ একটু চিন্তার ভাব করে উত্তর দিল,
ভাবছি।
ভাবছেন!! কি ভাবছেন? আর এখন কি ভাববার সময় নাকি!!
ভাবছিলাম এটা কোনও ট্র্যাপ নয় তো?
কুহেলি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
এখানে আবার ট্র্যাপ কিসের?
এই যে তুমি ড্রেস টা না নিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলে, এটা তো একটা ট্র্যাপও হতে পারে। এখন ধর আমি তোমাকে এই ড্রেসটা দিতে যাই আর তুমি আমার হাত ধরে এক টানে আমাকে ভিতরে টেনে নাও, তাহলে?
আলেখের ঠোঁটের কোনের দুষ্টু হাসিটা দেখে কুহেলির আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। মানুষটা পারেও বটে, এই পরিস্থিতি তেও নাকি ইয়ার্কি করছে। ও এদিকে টাওয়েল জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে আর উনি মশকরা করছেন!! কুহেলি একটু অস্থির হয়ে বলল,
উফ্, সাত সকালেই শুরু করে দিয়েছেন? প্লিজ আমার ড্রেস টা আগে দিন তারপর যতো ইচ্ছে মশকরা করুন।
আলেখ একটু হেসে চুড়িদার টা ওর হাতে দিয়ে দিল, কুহেলি সেটা নিয়েই দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। একটু পরেই কুহেলি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল, আর বেরিয়েই সোজা আলেখের কাচ্ছে গিয়ে বলল,
আপনি তো আচ্ছা মানুষ!! সাত সকালে উঠে মশকরা করছেন!! তাও আবার এমন?
আলেখ ওর এক সেট ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে কুহেলির দিকে ঘুরে বলল,
কে বলল আমি মজা করছিলাম! আমি তো সত্যি বলছিলাম।
থাক, আমি বুঝি।
কি বোঝ?
আপনি কখন মজা করেন সেটা বুঝি।
তাই?
হুম।
আমি কিন্তু সত্যিই মজা করে কথা গুলো বলিনি। কালকে কেউ একজন যেভাবে আমাকে কোলবালিশে পরিণত করেছিল, তাতে করে এমন চিন্তা হওয়াটা তো স্বাভাবিক তাই না?
আলেখের ঠোঁটের কোণে এখনও সেই দুষ্টু হাসিটা লেগে রয়েছে। সে যে এখনও মজাই করছে সেটা কুহেলি বুঝতে পারলেও তার লজ্জার আর শেষ রইল না। সে তো এটা ভেবেই শান্তি পেয়েছিল যে আলেখ কিছু টের পায়নি, কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সে সবটাই জানে। কুহেলির ইচ্ছে হল এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যেতে কিন্তু সেটা করলে ব্যাপারটা আরও বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াবে। কোনরকমে উল্টো দিকে তাকিয়ে মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
আসলে, আমার অনেকদিনের অভ্যেস কোলবালিশ নিয়ে ঘুমানোর। কালকে তো কোলবালিশ টা ছিল না তাই ঘুমের মধ্যে ভুল করে আপনাকে…… সরি।
কুহেলির মুখটা দেখে আলেখ হেসে ফেলল, ওর কাছে গিয়ে বলল,
তুমি না সত্যিই…. আরে আমি তো মজা করছিলাম। তুমি সরি কেন বলছ? ঘুমের ঘোরে আমরা যা করি তার উপরে আমাদের কোনও কন্ট্রোল থাকে না। তোমারও ছিল না, ইটস ওকে, এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়।
কুহেলি একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,
আমার কোলবালিশটা আনার ব্যবস্থা করা যায়? না মানে……
আলেখ ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,
থাক, আর মানে বলতে হবে না। এমনিতেও আমি ভাবছিলাম আজ তোমার ফ্ল্যাট থেকে তোমার সব জিনিসপত্র গুলো আনার ব্যবস্থা করব।
শুনে কুহেলি খুব খুশি হল, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আলেখ ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল,
কোলবালিশ না হলেও কিন্তু অসুবিধা নেই, আমি তো আছি। যে রকম পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলে তাতে তো মনে হয় কোলবালিশের অভাব টা মোটেই অনুভব করনি।
আলেখের বলা কথা গুলোর জন্যই হোক আর কুহেলির ঘাড় ছুয়ে যাওয়া আলেখের উষ্ণ নিঃশ্বাসের জন্যই হোক, কুহেলির সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। শিরায় উপশিরায় রক্ত প্রবাহ যেন দ্রুত হল, চোখ দুটো আপনা থেকেই বুজে এল। আলেখ কথাগুলো মজা করে বলেছে জেনেও কুহেলির মনে কেন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি উকি দিয়ে গেল। না কোনও অস্বস্তি নয় বরং একটা অদ্ভুত ভালোলাগা যেন ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা শরীর মন জুড়ে। কুহেলির এত কাছে এসে পড়ায় একটা মিষ্টি নেশা ধরানো গন্ধ আলেখের ঘ্রানেন্দ্রিয়ে অতর্কিতে আঘাত করে ওর মন তোলপাড় করে দিল। এই গন্ধটা আগেও অনুভব করেছে আলেখ, তখন বুঝতে পারেনি আজ বুঝল গন্ধটার উৎসস্থল কুহেলির ভেজা চুলগুলো। আলেখের ইচ্ছে হল ঐ ঘন কালো কেশ রাশিতে মুখ ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের অবাধ্য ইচ্ছে গুলোকে সংযত করে সরে এল কিছুটা। কুহেলি তখনও চোখ দুটো বন্ধ করেই রেখেছিল, আলেখ সেদিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
এখন বোধহয় নীচে গেলে ভালো হত, না হলে কিছুক্ষণ পরেই হয় বুয়া না হয় চাচিজী ডাকতে চলে আসবে আর তারপর কিন্তু তোমাকে আবার কালকের মত এমব্যারেসিং সিচুয়েশন ফেস করতে হবে।
কুহেলি যেন ঘোর কাটিয়ে চমকে উঠল। আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এই মানুষ টা তো ভারী অদ্ভুত! এখন কি রোজ রোজ এইরকম করে ওকে অপ্রস্তুত করে তুলবে নাকি! কুহেলি আর কোনদিকে না তাকিয়ে চটপট চুল গুলো আচড়ে সিদুরের কৌটোটা হাতে নিয়েই থমকে গেল। আয়নায় আলেখের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, সেইদিকে তাকিয়ে যেন স্থির হয়ে গেল কুহেলি। আলেখ একভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে, চোখে একরাশ মুগ্ধতা। ওর মুগ্ধ চাহনি যেন কুহেলির মন ছুয়ে যেতে লাগল। আলতো হাতে সিথি রাঙিয়ে দিতে দিতে কুহেলির মনে হল ওর গাল দুটোতেও যেন রক্তিমের ছোয়া লেগেছে। চোখ দুটো নামিয়ে কুহেলি আলেখের পাশ দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, ওর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আলেখ ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আলেখ স্নান সেরে এসে দেখল কুহেলি সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে, আর আলেখের চোখ জোড়া ওর অজান্তেই কুহেলির দিকে চলে যাচ্ছে। নিজের নব পরিণীতা স্ত্রী কে দেখে যে এমন তোলপাড় করা অনুভূতি হয় সেটা ওর জানা ছিল না। তাই তো এত সহজে ভেবে নিতে পেরেছিল বিয়ের পরেও ওর পরিকল্পিত ছকেই এগোবে সবকিছু। কিন্তু এখন যেন সব হিসেব গুলো গুলিয়ে যাচ্ছে, নিজের মনেই একটা সংশয় উকি দিল, কত দিন নিজের অনুভুতি গুলোকে এভাবে সংযত করে রাখতে পারবে কে জানে!! ব্রেকফাস্ট পর্বের পর আলেখ কুহেলিকে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে এল, এখনও বেশ কিছু জিনিসপত্র রয়েছে এখানে। শুধু ড্রেস গুলোতেই দুটো ট্রলি ভরে গেল, আলেখ হেসে বলল,
এত ড্রেস দিয়ে কি করো বলতো তোমরা?
কুহেলির মেজাজটা এমনিই বিগড়ে ছিল কারণ ওর সাধের গোলাপ গাছ দুটো শুকিয়ে গেছে। এতদিন অযত্নে পড়ে থাকায় গাছ গুলো প্রায় অর্ধমৃত হয়ে পড়েছে। আলেখ যদিও টব সমেত গাছ দুটো ইতিমধ্যে গাড়িতে রেখে এসেছে, তাও কুহেলির মনটা ভালো নেই, প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলল,
ভাতে দিয়ে খাই।
আলেখ হাসতে হাসতে বলল,
বাহ্, দারুন তো!! একদিন আমিও ট্রাই করে দেখব।
আলেখ সমানে কুহেলির মুড ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু তেমন ফল হল না, সব গুছিয়ে নিয়ে আবার ওরা ফিরে এল ওঙ্কার ভিলায়। কুহেলি ওর লাগেজে হাতও দিল না, আগে গোলাপের টব দুটো নিয়ে এবাড়ির মালী হরিশের কাছে গেল। পিছন পিছন আলেখও এল, তাকে গাছ দুটো দিয়ে তবে যেন একটু শান্ত হল কুহেলি। লাগেজ ইতিমধ্যেই ওদের রুমে পৌছে গেছে, কুহেলি ফ্রেশ হয়ে সেগুলো জায়গা মত গুছিয়ে রেখে আবার নীচে গেল। আজ মেহের আর হর্ষিতারা চলে যাবেন, তাই বাকি সময় টুকু ওদের সাথেই কাটাবে ভাবল। বাকি সময়টা বেশ ভালই কাটল, কুহেলির একবারের জন্যও মনে হচ্ছিল না যে এখানে সে সবেমাত্র দুদিন হল এসেছে। শেষে যখন ওনাদের যাওয়ার সময় হয়ে এল তখন কুহেলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেহের আর হর্ষিতা দুজনেই ওকে জড়িয়ে ধরে প্রান ভরে আশীর্বাদ করলেন, বারবার যাওয়ার কথা বলে গেলেন। আলেখ নিজে ওনাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এল, কুহেলি নিজের ঘরে বসেই ছিল। আলেখ ওকে দেখেই বুঝল এখনও মন খারাপ করে বসে আছে, এই অল্প সময়েই সবার সঙ্গে বড্ড মিলেমিশে গিয়েছিল। কিন্তু ওকে এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখতে আলেখের একদম ভালোলাগে না। কিন্তু ঠিক কি করলে যে ওর মুডটা ভালো হবে সেটা বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎ বিছানার দিকে চোখ পড়তেই একটা হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল আলেখের ঠোঁটে। কুহেলি বিছানার উপরেই বসে ছিল, চোখটা বন্ধ করে হেলান দিয়ে ছিল তাই আলেখ কখন এসেছে বুঝতে পারেনি। আলেখ বিছানার উল্টো দিকটায় বসে কোলবালিশটা হাতে নিয়ে বলল,
আজকে মনে হচ্ছে ঘুমটা একটু আরাম দায়ক হবে।
কুহেলি চমকে উঠে বলল,
আপনি কখন এলেন?
এই তো, জাস্ট এলাম।
ও, আপনি বসুন আমি জল নিয়ে আসছি।
কুহেলি উঠতে গেলে আলেখ বলল,
দরকার নেই, তুমি বস।
কুহেলি আবার বসে পড়ল। আলেখ ওর দিকে তাকিয়ে কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
তাহলে এনার স্থানটা কালকে তুমি ভুল করে আমাকে দিয়ে ফেলেছিলে?
আলেখের উপায়টা বেশ সফল হল, কুহেলি মন খারাপের কথা ভুলে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কোলবালিশটা আলেখের কাছ থেকে টেনে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। আলেখের বেশ মজা লাগল দেখে, মেয়েটাকে লজ্জা পেলে বড্ড বেশি ভালো লাগে। ডিনারের সময় হয়ে এসেছে, নীচ থেকে খেতে যাওয়ার ডাক এলে দুজনেই নীচে নেমে এল। তিনজনে একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ডিনার সেরে আবার ঘরে ফিরে এল। আলেখ নিজের পাশে শুয়ে বলল,
দেরী না করে শুয়ে পড়, কালকে থেকে আবার অফিস।
হুম, অনেকদিন অফিসে যাওয়া হয় না। কত কাজ যে বাকি পড়ে রয়েছে কে জানে!
সেটা কালকে অফিসে গিয়ে দেখো এখন ঘুমিয়ে পড়।
আলেখ আলো টা নিভিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কুহেলিও অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ল, আজ ওর কোলবালিশটা থাকায় বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে। না হলে কাল যা কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল, ইশ এখনও মনে পড়লে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। নতুন জায়গায় ঘুম আসতে একটু সময় লাগল, কাল তো ক্লান্তির ভারে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আলেখ অনেকক্ষণ হল ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কুহেলির মনটা একটা অদ্ভুত ভাললাগায় ভরে গেল। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেন হারিয়ে গিয়েছিল ঘুমের অতলে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখল আলেখ ঘরে নেই, বুঝল জগিংয়ে গেছে। কুহেলি উঠে স্নান সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিল, আবার কতদিন পরে সেই ফর্ম্যাল পোশাকে নিজেকে সাজাল। মনটা একটা অব্যক্ত খুশিতে ভরে উঠল, কাজ পাগল কুহেলি এতদিনে যেন আবার সেই পুরনো ছন্দে ফিরছে। আলেখ জগিং সেরে ফিরে দেখল কুহেলি একদম তৈরি, একটু হেসে বলল,
বাহ্, একদম রেডি?
হুম, আপনি রেডি হয়ে নিন আমি ততক্ষণে একটু নীচে যাচ্ছি।
ওকে।
কুহেলি নীচে এসে কিচেনে ঢুকল, গীতার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। রোজ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই গীতা ওর ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির হয়ে যেত। বৃন্দা ওকে দেখেই একগাল হেসে গুড মর্নিং উইশ করল, কুহেলিও পাল্টা উইশ করে বলল,
গুড মর্নিং বৃন্দা দি, কি বানাচ্ছ?
বানানো হয়ে গেছে ম্যাডাম।
বৃন্দা দি প্লিজ তুমি আমাকে ম্যাডাম বলো না।
তাহলে কি বলব?
উম, দিদি বলতে পার। নাম ধরেও বলতে পার কিন্তু জানি তুমি রাজি হবে না।
বৃন্দা হেসে বলল,
আচ্ছা।
তাহলে বলো দেখি কি বানালে?
বড় স্যার আর আলেখ স্যারের পছন্দ অপছন্দ তো এতদিন জেনে গেছি। আপনার টা জানতাম না তাই নিজের মন থেকেই ব্রেড অমলেট বানিয়েছি।
খুব ভালো করেছ। ব্রেড অমলেট আমি ভালই খাই আর ড্যাড কি খাবে?
উনি রোজ সকালে শুধু কর্নফ্লেক্স আর এক গ্লাস জুস খান।
ও, আর আলেখ?
নামটা নিয়ে নিজেরই কেমন একটা অনুভুতি হল, গাল দুটো অকারনেই কেমন গরম হয়ে এল। বৃন্দা বোধহয় সেটা বুঝতে পেরে একটু হেসে বলল,
আলেখ স্যার এমনিতে সবই খান, শুধু মিষ্টি টা একটু এড়িয়ে চলেন। আজকে ওনার জন্য স্যান্ড উইচ বানিয়েছি।
আচ্ছা, তুমি তাহলে ওগুলো দাও আমি টেবিলে সাজিয়ে রাখছি।
আপনার এসব করতে হবে না, এসব করার লোক আছে। আপনি গিয়ে বসুন, স্যারও এসে পড়বেন এক্ষুনি।
কুহেলি ডাইনিং রুমে এসে দেখল নভতেজ বাবুও আসছেন। কুহেলিকে দেখে হেসে বললেন,
গুড মর্নিং বেটা।
গুড মর্নিং ড্যাড।
সো, অফিসের জন্য রেডি?
হ্যা।
বেশ, আলেখ কোথায়?
এই তো এসে গেছি।
উত্তরটা আলেখ নিজেই দিল, কুহেলির পাশে বসে বলল,
গুড মর্নিং ড্যাড।
গুড মর্নিং।
টুকটাক কথার মধ্যে দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনে বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুদিন পর অফিস যাচ্ছে, মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে কুহেলির। অফিসে পা দিতেই কিন্তু কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। আগের থেকে কি যেন একটা আলাদা, প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারল না। আলেখ ইতিমধ্যে নিজের কেবিনে চলে গেছে, কুহেলিও নিজের সিটে এসে বসল। রুহি এখনও আসেনি, কুহেলি নিজের কাজে মন দিল, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। একটু পরেই রুহি এসে গেল, কুহেলিকে দেখেই জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণে যেন অফিসটা আগের মত মনে হল কুহেলির, রুহি বেশ খুশি হয়ে বলল,
ওয়াও দি, কি দারুন লাগছে তোমাকে। একদম অন্যরকম।
তাই?
হুম, রিসেপশনের দিনও তোমাকে দারুন লাগছিল। বিয়েটাই যা দেখতে পেলাম না, কিন্তু জানি সেদিনও নিশ্চয়ই দারুন লাগছিল তোমাকে। পরে পিক দেখাবে কিন্তু।
ঠিক আছে দেখাব, কিন্তু তুমি আগে বল তো অফিসে কি কিছু চেঞ্জ হয়েছে?
চেঞ্জ মানে? কি চেঞ্জ হবে?
না, মানে আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আলাদা।
রুহি একটু হেসে বলল,
সেটাও বুঝতে পারছ না?
না, সেইজন্যই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
আরে দি, চেঞ্জ টা অফিসে হয়নি, হয়েছে অফিসের মানুষ গুলোর ব্যবহারে।
কুহেলি এবার যেন বুঝতে পারল, তাই তো, সবাই সত্যি কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। একটু আগেই একটা মেয়ে যার নামটাও কুহেলি জানে না, কোনদিনও কথা বলেছে বলেও মনে পড়ে না, সেও ওকে গুড মর্নিং উইশ করে গেল। বাকিরাও কেমন যেন অন্যরকম আচরণ করছে, আগে এমনটা ছিল না। কুহেলি বলল,
হুম, কিন্তু ওরা এরকম কেন করছে বলতো?
কেন আবার! কেউ হিংসায় আর কেউ ভয়ে।
দুটোর একটারও কোনও যুক্তি নেই, ওকে হিংসা করারও বা কি আছে আর ভয় পাওয়ারও বা কি আছে! শুধু বিয়েই তো হয়েছে, ও তো আর রাতারাতি পাল্টে যায়নি। রুহিকে কথাটা বলতেই রুহি হেসে উঠল,
তুমি যে কি বলোনা দি! তুমি এখন এই কোম্পানির বসের ওয়াইফ, মানে এক কথায় তুমিও বস। সুতরাং তোমাকে একটু আধটু ভয় তো পাবেই আর হিংসার কথা যদি বলো তাহলে সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। স্যার কতজনের হার্টথ্রব ছিলেন বলতো!! সেখানে তুমি হঠাৎ ওনার ওয়াইফ হয়ে গেলে, সাথে আমাদের নতুন বস, হিংসে তো হবেই।
রাবিশ! এগুলো কোনও যুক্তি হল?
হলো দি, এগুলোই সবথেকে বড় রিজন।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন কাজ কর, আমিও দেখি কত কাজ পেন্ডিং।
কুহেলি কাজে মন দিল, কিন্তু রুহির কথাগুলো বারবার মনের মধ্যে ঘুরছে। সত্যিই তো বলেছে, এর আগেও যখন ওদের এনগেজমেন্টের কথা সবাই জেনেছিল তখনও তো কতজনে কত রকম কথা বলেছিল। ওর সামনে বলার সাহস হয়তো কারোরই নেই, কিন্তু আড়ালে যে ওকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই সেটা কুহেলিও বেশ ভালো করেই জানে। কিছু মানুষের মন যে কেন এত সংকীর্ণ হয় কে জানে! যাই হোক এইসব অবান্তর বিষয়ে বেশিক্ষণ নষ্ট করার মত সময় ওর কাছে নেই। কুহেলি মুহুর্তের মধ্যে ডুবে গেল কাজে, ধীরে ধীরে ফিরে এল সেই পুরনো কুহেলি, যার কাছে কাজ সবার আগে। কখন যে লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেছে কুহেলি খেয়াল করেনি, অঙ্কিত এসে ডাকতে হুশ হল। আলেখ ওকে ডেকে পাঠিয়েছে, কুহেলি উঠে গিয়ে কেবিনের দরজাটা একটু ফাঁক করে বলল,
মে আই কাম ইন?
আলেখ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
কাম অন কুহেলি, তোমার পারমিশন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এস, ভিতরে এস, হ্যাভ এ সিট।
কুহেলি ভিতরে ঢুকে বলল,
প্রয়োজন অবশ্যই আছে, এটা অফিস। আর এখানে আপনি আমার বস আর আমি আপনার এমপ্লয়ী।
কুহেলি, এত ফর্ম্যাল হওয়ার সত্যিই কোনও প্রয়োজন নেই। এখানে সবাই জানে আমরা ম্যারেড।
তা হলেও, প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফটা আলাদা রাখাই ভাল।
উফ্, তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। আচ্ছা বেশ যা ভাল মনে করবে তাই করো, কিন্তু এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে, এখন নিশ্চয়ই আমরা এই ফরমালিটি গুলোকে সাইডে রাখতে পারি।
হুম, তা পারি কিন্তু…..
আর কোনও কিন্তু নয়, চল এবার আমার ভীষন খিদে পেয়েছে।
বলে আলেখ উঠে গিয়ে সোফায় বসে সামনের সেন্টার টেবিলে রাখা লাঞ্চ বক্স টা খুলে দুটো প্লেটে খাবার সাজাতে লাগল। কুহেলি উঠে গিয়ে একটু দূরত্ব রেখে আলেখের পাশে বসে বলল,
আপনার লাঞ্চ কি রোজ বাড়ি থেকেই আসে?
হুম।
আগে কোনোদিন খেয়াল করিনি।
আলেখ একটা প্লেট কুহেলির হাতে দিয়ে হেসে বলল,
কীকরে করবে? তুমি তো ম্যাক্সিমাম দিনই লাঞ্চ টাইমেও কাজ নিয়েই পড়ে থাকতে।
কুহেলি হেসে খাওয়ায় মন দিল। টুক টাক গল্প আর কিছু কাজের কথার মধ্যে দিয়ে লাঞ্চটা বেশ ভালই কাটল। লাঞ্চ শেষে আবার দুজনে যে যার কাজে মন দিল, সব কিছু একদম ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ অফিসে নিশীথ আগরওয়ালের আগমনে যেন আচমকা ছন্দ পতন হল। নিশীথ আর উমেশ সোজা আলেখের রুমের দিকে এগিয়ে গেল, যাওয়ার সময় নিশীথ কুহেলির দিকে তাকিয়ে ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা ছুড়ে দিয়ে গেল। কুহেলি বেশ অবাক হয়েছে, আজ কি নিশীথ আগরওয়ালের আসার কথা ছিল নাকি? কিন্তু আলেখ তো তাকে কিছু বলেনি, কোনও মিটিং থাকলে আলেখ নিশ্চয়ই ওকে জানাতো। কিন্তু তাহলে নিশীথ আগরওয়ালের এই হঠাৎ আগমনের কারণ কি? এর আগেও যদিও একবার আগাম বার্তা না দিয়েই এসেছিল কিন্তু তার একটা কারণ ছিল। কিন্তু এখন তো তেমন কোনও কারণ কুহেলি খুঁজে পাচ্ছে না, তাহলে?
ক্রমশ___________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
কেমন লাগল আজকের পর্ব? এনগেজমেন্ট, বিয়ে, রিসেপশন সব পেরিয়ে আবার শুরু হয়েছে ওদের কর্ম জীবন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা। কি মনে হয় বলুন তো, এরপর কেমন হতে চলেছে ওদের আগামী দিনগুলো? আমাকে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। প্রতিবারের মত এবারও অপেক্ষা করে থাকব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।