সংগোপনে’ পর্ব-২৭

0
1830

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৭
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

গুড আফটার নুন মিস্টার শর্মা।

আলেখ খুব মনোযোগ সহকারে একটা ফাইল দেখছিল, আচমকা কারও কণ্ঠস্বর শুনে চোখ তুলে তাকাতেই বেশ অবাক হল। নিশীথ আগরওয়াল!! এভাবে না জানিয়ে!! আলেখ উঠে দাড়িয়ে ওর স্বাভাবিক হাসিটা বজায় রেখে বলল,

গুড আফটার নুন মিস্টার আগরওয়াল, প্লিজ হ্যাভ এ সিট।

নিশীথ বসল আর উমেশ কিছুটা দূরে দাড়িয়ে রইল। আলেখ সেই একইভাবে জিজ্ঞেস করল,

হাউ আর ইউ মিস্টার আগরওয়াল? আপনি তো আমাদের রিসেপশনেও আসতে পারেননি।

অ্যাম ফাইন, হ্যা, হঠাৎ করেই ইউ এসের মিটিংটা ফিক্স হয়ে গেল, যেতেই হল। সরি ফর দ্যাট, এগেইন।

ইটস ওকে, সো আজ হঠাৎ?

এবার নিশীথ একটু অবাক হল,

হঠাৎ মানে?

আলেখও বেশ অবাক হয়েই বলল,

মানে আপনি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তো আগাম বার্তা না দিয়ে এভাবে আসেন না। তাই…….

আলেখের কথা শেষ হল না, তার আগেই নিশীথ বলে উঠল,

ওয়েট, আগাম না জানিয়ে মানে! উমেশ, তুমি ওনাদের ইনফর্ম করনি?

শেষের প্রশ্নটা উমেশ কে করা হল, উমেশ ব্যস্ত হয়ে বলল,

নো স্যার, আমি কালকেই আপনি বলার সঙ্গে সঙ্গেই অঙ্কিত কে ইনফর্ম করে দিয়েছিলাম।

এবার সবার দৃষ্টি আলেখের পাশে দাড়ানো অঙ্কিতের দিকে গেল। সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আলেখের বুঝতে অসুবিধা হল না ভুলটা অঙ্কিতের। আলেখ সচরাচর রাগে না, কিন্তু কাজে গাফিলতি করাটা ওর বরাবরের অপছন্দের। বেশ গম্ভীর গলায় বলল,

হোয়াট ইজ দিস অঙ্কিত?

অঙ্কিত আমতা আমতা করে উত্তর দিল,

সরি স্যার, আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

ভুলে গিয়েছিলে!! এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা ব্যাপার তুমি এভাবে কীকরে ভুলে যেতে পার?

সরি স্যার।

হোয়াট সরি? এখন যাও, কুহেলিকে ডেকে নিয়ে এস।

অঙ্কিত কোনরকমে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আলেখ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, এরকম দায়িত্ব জ্ঞান হীনের মত আচরণ ওর একেবারেই পছন্দ নয়। নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল,

সরি মিস্টার আগরওয়াল।

নিশীথ হেসে বলল,

ইটস ওকে মিস্টার শর্মা, রিল্যাক্স। এত হাইপার হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, হতেই পারে, নট এ বিগ ডীল।

ওদের কথার মধ্যে কুহেলি নক করল, আলেখ ওকে ভিতরে আসতে বললে কুহেলি ভিতরে ঢুকে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল,

গুড আফটার নুন স্যার।

গুড আফটার নুন মিস বাসু….. সরি, মিসেস শর্মা।

কুহেলি একটু হেসে একটা চেয়ার টেনে বসল। অঙ্কিতের কাছে সবটাই শুনেছে, আলেখের দিকে তাকিয়ে বুঝল এখনও রেগে রয়েছে। অতিরিক্ত কথা না বলে ওরা মিটিং শুরু করল, এইবারের প্রজেক্টটা শেষ প্রজেক্টের থেকে অনেক বেশি বড়। এখনও পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে তাতে অন্তত এক বছরের সময় তো লাগবেই। ওদের মিটিং শেষ হতে হতে অফিস আওয়ার পেরিয়ে গেল, সবাই একসাথেই অফিস থেকে বেরিয়ে এল। নীচে এসে আলেখ কুহেলিকে অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি আনতে চলে গেল, নিশীথ কুহেলির দিকে একটু তাকিয়ে বলল,

ইউ আর লুকিং ভেরি ডিফরেন্ট টুডে।

কুহেলির এখন নিশীথের সাথে কথা বলতে কোনরকম অস্বতি হয় না। সে হেসে বলল,

তাই?

ইয়েস, আই থিঙ্ক বিয়ের পর সব মেয়েদেরই একটু আলাদা লাগে।

হয়তো।

আমি কিন্তু একটু রাগ করেছি।

কেন?

বিয়েতে এই বন্ধুটিকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, ভেবেছিলাম ইনভাইট করবেন।

কুহেলি হেসে বলল,

সরি, বাট আমি কাউকেই ইনভাইট করিনি, ওদিকটা মা সামলেছিল।

আরে ইটস ওকে, আমি তো এমনিই বলছিলাম।

ইতিমধ্যে আলেখ গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। আলেখ ভেবেছিল নিশীথ হয়তো এতক্ষণে চলে গেছে কিন্তু এভাবে কুহেলির সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করতে দেখে মেজাজটা হঠাৎ বিগড়ে গেল। কেন যেন হঠাৎ খুব রাগ হল, কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে মুখে স্বাভাবিক হাসিটা বজায় রেখে কুহেলির পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,

আপনি এখনও যাননি মিস্টার আগরওয়াল?

না, ভাবলাম আপনি যতক্ষণ না আসছেন ততক্ষণ একটু ওনাকে কোম্পানি দিই। এমনিতেও আমাদেরও তো তেমন সময় হয় না কথা বলার।

আলেখের রাগ টা ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু প্রকাশ করার উপায় নেই। অতি কষ্টে রাগটা চেপে রেখে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।

ওয়েলকাম, ওকে এবার তাহলে আসি। বাই মিস্টার শর্মা, বাই মিস বাসু…. ওহ, সরি.. মিসেস শর্মা। ডোন্ট মাইন্ড, একটু সময় লাগবে।

আলেখ কিছু বলল না, ওর এই মুহূর্তে কিছুই ভালোলাগছে না। নিশীথ কে এক কথায় সহ্যই করতে পারছে না। কুহেলি হেসে বলল,

নো প্রবলেম, তবে আপনি আমাকে শুধু কুহেলিও বলতে পারেন। তাহলে মনে হয় আর অসুবিধা হবে না।

কথাটা শুনে আলেখের রাগটা যেন সপ্তমে চড়ে গেল, কুহেলির কি প্রয়োজন ছিল এটা বলার! এত ফ্র্যাঙ্ক হওয়ার প্রয়োজন কি? আর এই একই কথায় নিশীথ দারুন খুশি হল, সঙ্গে একটু অবাকও হল। কুহেলি যে সত্যিই ওকে বন্ধু ভাবতে শুরু করেছে এটাই ওর অনেক বড় পাওয়া।

আর ইউ সিরিয়াস?

অফকোর্স।

দ্যাটস রিয়েলি গ্রেট। ফাইন, আজ থেকে তাহলে তাই হবে।

হুম।

ওকে এবার আমি আসি, অনেকটা লেট হয়ে গেল। বাই কুহেলি।

বাই।

নিশীথ হেসে চলে যেতেই আলেখও আবার গাড়িতে উঠে বসল, কুহেলিও উঠে আলেখের পাশের সিটে বসল। আলেখ কোনও কথা না বলে ড্রাইভ করতে লাগল, একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করছে। রাগও হচ্ছে ভিষন, কিন্তু ঠিক কেন যে এত রাগ হচ্ছে ওর জানা নেই! হয়তো নিশীথের কুহেলির প্রতি অনুভূতি গুলোই এর কারণ। নিশীথ অকপটে নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছিল আলেখের কাছে, তার জন্যই কি এমন হচ্ছে? আলেখ একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখল, বেশ খুশি মনেই তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কুহেলির হাসি মুখটা দেখে রাগটা যেন আস্তে আস্তে কমে এল, কিন্তু খারাপ লাগা টা রয়ে গেল। বাড়িতে পৌঁছে আলেখ কোনও কথা না বলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল, কুহেলির একটু অদ্ভুত লাগল। ভাবল এখনও হয়তো অঙ্কিতের ব্যাপারটা নিয়ে মুড অফ্ করে রয়েছে। আলেখ ওয়াশরুম থেকে বেরোলে কুহেলিও ফ্রেশ হয়ে নিল। আলেখ চুপচাপ বসে ওর ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল, কুহেলি এসে একটা পাশে বসে বলল,

কিছু খাবেন? নিয়ে আসব কিছু?

আলেখ নিয়মরক্ষা একটু হেসে বলল,

তোমার কিছু করতে হবে না, সবাই জানে। কিছুক্ষণ পরেই বৃন্দা দি পাঠিয়ে দেবে।

ও।

কুহেলি বেশ বুঝতে পারছে আলেখের মুড অফ, কিন্তু কিভাবে যে কথা বলবে বুঝতে পারল না। এর মধ্যেই একজন এসে ওদের জন্য দু কাপ কফি দিয়ে গেল, আলেখ ল্যাপটপ টা সরিয়ে রেখে কফির কাপ টা হাতে নিয়ে উঠে ব্যালকনিতে গেল। কথা বলতে ভালোলাগছে না ওর, জানে এখানে কুহেলির কোনও দোষ নেই কিন্তু তাও কেন যেন ওর সাথেও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কুহেলিও ওর কাপ টা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে আলেখের পাশে দাঁড়াল। আলেখ যেন দেখেও দেখল না, এবার আর কুহেলি চুপ করে থাকতে পারল না।

আপনার কি হয়েছে বলুন তো?

আলেখ কুহেলির দিকে না তাকিয়েই বলল,

কোথায়? কিছু হয়নি তো।

আপনি বললেন আর আমি মেনে নিলাম!! কিছু একটা হয়েছে বুঝতেই পারছি। আপনি কি অঙ্কিতের ব্যাপারটা নিয়ে রাগ করে আছেন এখনও?

আলেখ একবার কুহেলির দিকে তাকাল, ও ভাবছে আলেখ অঙ্কিতের ব্যাপারটার জন্য এরকম করছে। আসল কারনটা না জানাই হয়তো ভাল, আলেখ বলল,

হুম, এরকম ইরেস্পনসিবল বিহেভিয়ার আমি একদম পছন্দ করি না।

তার জন্য এখনও রাগ করে থাকার কি মানে?

আলেখের খুব ইচ্ছে হল বলতে, শুধু রাগ নয় কুহেলি, আমার মনটাও খারাপ। আর সেটা অঙ্কিতের জন্য নয়। কিন্তু মুখে বলল,

বাদ দাও ওসব, অফিসের কথা অফিসেই থাক।

আমি তো বলতামই না, আপনি এভাবে বসে ছিলেন তাই বললাম।

আলেখ কুহেলির দিকে তাকাল, সত্যি, কি করছে ও! একটু বেশিই ভেবে ফেলছে। নিশীথ তো বলেছিল সে কুহেলিকে দেওয়া কথা রাখবে, আর তার থেকে বড় কথা কুহেলির মনে নিশীথের জন্য তেমন কোনও অনুভূতি নেই, কোনোদিনই ছিল না। তাহলে ওর এত রাগ এত মন খারাপের কারণ কি? শুধু শুধু কেন সময় নস্ট করছে? নাহ, এই অবান্তর ভাবনা গুলোকে আর প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। একটু হেসে বলল,

ওকে সরি, আমারই ভুল হয়েছে।

দুজনে ব্যালকনিতে দাড়িয়েই কফি টুকু শেষ করল। তারপর ঘরে এসে আলেখ আবার ওর ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল, তার সঙ্গে কুহেলিও। অনেক কাজ বাকি, সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছিয়ে নিতে হবে। একটা জায়গায় এসে কুহেলির একটু আলেখের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ল। আলেখ সোফায় বসে ছিল আর কুহেলি বিছানায়, চোখ তুলে দেখল আলেখ এক মনে কাজ করছে। কিন্তু এটা না জিজ্ঞেস করলেও নয়, কিন্তু কীকরে করবে! স্যার বলে তো ডাকা যাবে না আর নাম ধরে বলতে এখনও কেমন যেন লাগে। হঠাৎ করে উঠে ওর কাছে যেতেও কেমন একটা লাগল, শেষে একটু ভেবে বলল,

শুনছেন?

আলেখ প্রথম ডাকেই শুনতে পেল কিন্তু সাড়া দিল না। ওর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আবার উকি দিচ্ছে। যেন শুনতে পায়নি এমন ভাবে নিজের কাজ করতে লাগল, কুহেলি আবার ডাকল,

শুনছেন? একটু দরকার ছিল।

আলেখ তাও কোনও সাড়া না দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগল। কুহেলি এবার একটু অধৈর্য্য হয়ে উঠে এসে আলেখের সামনে দাড়িয়ে বলল,

আমি কখন থেকে আপনাকে ডাকছি, আপনি সাড়া দিচ্ছেন না কেন?

আলেখ একটু অবাক হওয়ার মত করে বলল,

আমাকে! কই আমি শুনিনি তো?

এত কাছ থেকে ডাকছি আর আপনি শোনেননি?

না, কেউ আমার নাম ধরে ডাকলে নিশ্চয়ই শুনতে পেতাম।

কুহেলি একটু থতমত খেল, এতক্ষণে বুঝতে পারল আলেখ ইচ্ছে করেই এমন টা করছে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

না… ম..মানে.. আম.. আমি তো..

আলেখ এবার ল্যাপটপ টা বন্ধ করে অভিমানের সুরে বলল,

কুহেলি, দিস ইজ নট ফেয়ার। আমাদের কিন্তু কথা হয়েছিল তুমি আমাকে আলেখ বলেই ডাকবে, ইভেন একবার বলেওছো। তাহলে এখন কেন বলছ না? কখন থেকে সেই টিপিক্যাল ওয়াইফ দের মত শুনছেন শুনছেন করছ। লিসেন, আমি কিন্তু স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, এখন থেকে আমাকে নাম ধরে না ডাকলে আমি আর তোমার সঙ্গে কথাই বলব না।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

আরে, এরকম করলে হয় নাকি! কি ছেলেমানুষী কথা এগুলো?

নিশ্চয়ই হয়, আর এটা মোটেও ছেলেমানুষী কথা নয়। তুমি তোমার বন্ধুদের কি শুনছেন শুনছেন করে ডাক? তাহলে আমাকে কেন? আমরাও তো বন্ধু, নাকি এখনও আমাকে বন্ধু হিসেবে মানতেই পারনি?

উফ্, কি উল্টো পাল্টা বলছেন? আপনিও জানেন আমি আপনাকে অনেকদিন আগেই নিজের বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছি।

তাহলে আমাকে নাম ধরে বলো না কেন?

আরে বাবা, এটা অতটাও সহজ নয়।

কেন নয়? আমি তো তোমাকে কুহেলি বলেই বলি, আগে তো বলতাম না, কিন্তু এখন তো অভ্যাস করে নিয়েছি।

হ্যা, কিন্তু….

আমি কোনও কিন্তু শুনব না, আজ থেকে, না এখন থেকে তুমি আমাকে নাম ধরে না ডাকলে আমি সত্যি আর কথা বলব না তোমার সঙ্গে।

বলে আলেখ আবার ল্যাপটপ টা টেনে নিয়ে কাজ শুরু করল। কুহেলি হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইল, ওর মুখটা দেখে আলেখের বেশ মজা লাগছিল, ল্যাপটপের আড়ালে একটু আলতো হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটে। কুহেলি পড়ল মহা সমস্যায়, আলেখের সাহায্য একান্তই দরকার আর এটাও ভালোই বুঝতে পারছে যে কুহেলি যদি ওকে নাম ধরে না ডাকে তাহলে একটা কথারও উত্তর পাবে না। কি মুশকিলেই না পড়েছে বেচারি, আর কোনও উপায় না দেখে চোখ দুটো বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল,

আলেখ আমার একটু হেল্প লাগবে।

কুহেলির মুখে নিজের নামটা শুনে একটা অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে গেল। হেসে বলল,

গ্রেট, এবার বল কি প্রবলেম।

আলেখ কুহেলিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে কুহেলি আবার নিজের কাজে মন দিল। আলেখ একবার ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিল। দেখতে দেখতে ডিনারের সময় হয়ে এল, এবাড়ির সর্বক্ষণের দেখাশোনার লোক প্রভাত এসে ওদের ডিনারের জন্য ডেকে গেল। কিন্তু দুজনে কাজে এমন মত্ত যে প্রভাত ডেকে যাওয়ার আধাঘন্টা পরেও ওদের নীচে যাওয়ার সময় হল না। শেষে নভতেজ বাবু আবার ওদের ডেকে পাঠালেন, এবার উনি অপেক্ষা করছেন শুনে দুজনেই কাজ বন্ধ করে নীচে নেমে এল। ওদের দেখেই নভতেজ বাবু হেসে বললেন,

একটা কাজপাগল কম ছিল তো, তাই আরেকজন দোসর উপস্থিত হয়েছে। তোরা এত কাজ কীকরে করিস বলতো?

উত্তরটা আলেখ দিল,

ড্যাড, সবার আগে কাজ। আর এই কয়েক দিনে অনেকটা কাজ পিছিয়ে গেছে। সেগুলো কভার আপ করতে হবে, তাই…..

আলেখের কথা শেষ হওয়ার আগেই নভতেজ বাবু বললেন,

আরে সব ঠিক আছে, কিন্তু কাজের জন্য তো অফিস আছে, বাড়িতে কাজ করার কি প্রয়োজন?

এবার কুহেলি বলল,

আসলে ড্যাড, অনেকটা কাজ পেন্ডিং আছে তাই বাড়িতেও একটু কাজ করতে হচ্ছে।

বুঝলাম, তোমাদের বলে লাভ নেই, দুজনেই এক্কেবারে কাজপাগল।

সবাই এবার খাওয়ায় মন দিল, আজকের মেনুটা বেশ ভাল। নভতেজ বাবু আর আলেখ দুজনেই রাতে রুটি খান, কুহেলি ভাত পছন্দ করলেও রুটিতেও কোনও অসুবিধা নেই। গরম গরম রুটির সাথে পালক পনির, সঙ্গে ডাল আর একটা পাঁচ মিশেলী সব্জি। সবাই গল্প করতে করতে খেতে লাগল। কুহেলি ডাল খুব ভালো খায়, যে কোনও ডাল হলেই হল। আজকের ডাল টাও দারুন হয়েছে, কুহেলি আরেকটু ডাল নিতে গিয়ে দেখল ডালের পাত্র টা বেশ দূরে। আলেখকে বলল,

আমাকে একটু ডালটা পাস করুন না।

আলেখ ডালের পাত্র টা কুহেলির দিকে এগিয়ে দিল, কিন্তু কুহেলির ডাল নেওয়া আর হল না। কারণ নভতেজ বাবু তখন আবার অতি বিস্ময়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে আছেন। সেটা দেখে কুহেলি বলল,

কিছু হয়েছে ড্যাড?

কিছু হয়েছে মানে? তুমি কি মেয়ে বলো তো?

কুহেলি একটু ঘাবড়ে গেল, খাওয়া থামিয়ে বলল,

কেন ড্যাড?

কেন মানে? তুমি এখনও আলেখকে আপনি করে বলো? তোমাকে না আমি বারন করেছিলাম!

কুহেলি মনে মনে প্রমাদ গুনল, সত্যি উনি অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছিলেন এই আপনি আজ্ঞে করা চলবে না। কিন্তু বললেই কি আর হয় নাকি! তাও আলেখ সাপোর্ট করেছিল, সময় দিয়েছিল ওকে, কিন্তু এখন? কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

আসলে… ওই.. আমি আর কি…

কোনও বাহানা আমি শুনব না, আমি তো ভাবতেই পারছি না, তুমি আমার কথা রাখোনি।

নভতেজ বাবুর মুখ দেখে মনে হল উনি সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছেন। কুহেলির খুব খারাপ লাগল, এই মানুষটা ওর জীবনে এতদিনের পিতৃ স্নেহের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন, আর সে তার এইটুকু ইচ্ছে পূরণ করতে পারছে না! কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

সরি ড্যাড, প্লিজ এবারের মত ক্ষমা করে দাও। কথা দিচ্ছি, আর কোনদিনও এরকম ভুল হবে না।

বেশ, তবে এই শেষবার। আর একবারও যদি তোমার মুখে আপনি শুনেছি তাহলে কিন্তু তোমার সাথে আর কথা বলব না। বলে দিলাম।

কুহেলি অবাক হয়ে গেল, এরা পিতা পুত্র দুজনেই কি এক ধাচে গড়া!! একটু আগে আলেখ আর এখন নভতেজ বাবু। দুজনেই কথা না বলার ভয় দেখাচ্ছেন! কুহেলির মুখ থেকে যেন আপনা থেকেই বেরিয়ে এল,

তুমিও!!

এটা শুনে নভতেজ বাবু বললেন,

আমিও মানে?

মানে, তখন….

এবার এটা শুনে আলেখ বিষম খেল, কুহেলি তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস টা এগিয়ে দিল। জল খেয়ে একটু সামলে নিয়ে কুহেলির দিকে তাকাল, এই মেয়ে এমনিতে এত বুদ্ধিমতী, কিন্তু মাঝে মাঝে কি যে করে না! এক্ষুনি বলেই ফেলছিল আর কি, ভাগ্যিস বিষম টা লেগেছিল!! কথাটা চাপা পড়ে গেল। খাওয়ার শেষে ওরা তিনজন ড্রয়িংরুমে বসল, নভতেজ বাবু বললেন,

আলেখ কুহেলি তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আলেখ একটু অবাক হয়ে বলল,

সারপ্রাইজ!!

হুম, তোদের দুজনের জন্য।

বলে একটা খাম আলেখের দিকে এগিয়ে দিলেন, আলেখ একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে খামটা খুলল। ভিতরে দুটো ফ্লাইটের টিকিট, সুইটজারল্যান্ডের। আলেখ আর কুহেলি দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল নভতেজ বাবুর দিকে। উনি একটু হেসে বললেন,

এটা আমার তরফ থেকে তোদের ওয়েডিং গিফ্ট।

আলেখ আপত্তি করে বলল,

ড্যাড, এসব কি? আমরা এখন কোথাও যেতে পারব না। অফিসে কাজের ভিষন প্রেসার, নিউ প্রজেক্টের কাজ এমনিতেই অনেকটা ডিলে হয়ে গেছে।

কুহেলিও আলেখের কথায় সায় দিয়ে বলল,

ইয়েস ড্যাড, এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।

নভতেজ বাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,

উফ্, তোমরা বড্ড বেশি কথা বল। আর কি এত কাজ কাজ করছ বলতো? কাজ তো সারাজীবন করবে, কিন্তু এই সময়টা আর পাবে না। সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে, আর এখনই কাজের মধ্যে ডুবে গেছ দুজনে। বিয়ের পর মানুষ একটু ঘুরে ফিরে বেড়ায়, একটু লাইফটাকে এনজয় করে। আর তোমরা, সুযোগ পেয়েই কাজ নিয়ে বসে গেছ। হ্যা রে আলেখ, তুই আমার ছেলে হয়ে এরকম কীকরে হলি রে? কোথায় তুই নিজেই হানিমুনের ব্যবস্থা করবি, তা না উল্টে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তাতেও তোদের আপত্তি।

আলেখ একটু আপত্তি করে বলল,

ড্যাড, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু ড্যাড তুমিও একটু বোঝার চেষ্টা করো, এইমুহুর্তে কোনোমতেই যাওয়া যাবে না। প্রজেক্টের কাজ টা খুব ইম্পর্ট্যান্ট জায়গায় রয়েছে, এখন কিছুতেই সময় নস্ট করা যাবে না।

এটা তোর কাছে সময় নষ্ট বলে মনে হচ্ছে?

না, তা বলছি না, কিন্তু….

কোনও কিন্তু নয়, তোরা যাচ্ছিস এটাই ফাইনাল, আর কাজের চিন্তা তোর করতে হবে না। ওদিকটা আমি দেখে নেব।

তুমি?

হ্যা, আমি। কেন? কি মনে হয় তোর আমি হ্যান্ডেল করতে পারব না? তোর কি সন্দেহ আছে? তুই জয়েন করার আগে কিন্তু কোম্পানিটা আমিই সামলেছি।

অফকোর্স না ড্যাড। তুমি দায়িত্ত্ব নিলে যে সবটা খুব ভালো ভাবেই সামলাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু….

আবার কিন্তু কিসের? আমি আর কোনও বাহানা শুনব না। আগামী সানডে তোরা যাচ্ছিস এটাই ফাইনাল।

আলেখ বা কুহেলি কারোরই আর কিছু বলার রইল না। দুজনেই চুপচাপ নিজেদের ঘরে চলে এল। আলেখ ওর আর কুহেলির ল্যাপটপ দুটো জায়গামতো রেখে বিছানার নিজস্ব পাশটায় বসে কুহেলির দিকে তাকাল। কুহেলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলটা বাঁধছিল, তবে চোখ দুটো থেকে থেকেই আলেখের দিকে চলে যাচ্ছিল। দুজনের মনেই অনেক কথা ভিড় করে আসছে কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে। শেষে কুহেলিই শুরু করল,

আমাদের যাওয়াটা কি খুব প্রয়োজন?

তুমি তো ছিলে, সবই তো শুনলে, কি মনে হয়?

কিন্তু, আরেকবার বলে দেখলে হয় না?

লাভ নেই, ড্যাড কিছুই শুনবে না।

কুহেলি চুলটা বেনুনি করে খাটে এসে বসল। ওর মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে ওর ভিতরে কি পরিমান অস্বস্তি হচ্ছে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল কিন্তু এখন এই হানিমুন!! আলেখেরও যে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়, তবে ওর অস্বস্তি টা একটু অন্যরকম। এক দিকে কুহেলির সঙ্গে সম্পূর্ণ একা সময় কাটানোর কথা ভাবলেই মনটা একটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠছে, আবার অন্যদিকে একটা সংশয় উকি দিচ্ছে। এই কদিনে আলেখ বেশ বুঝতে পেরেছে কুহেলির প্রতি ওর একটা অজানা আকর্ষন কাজ করে, সেই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের টান উপেক্ষা করা মোটেও সহজসাধ্য নয়। আর এই আকর্ষণ যে ওদের নিভৃত মুহূর্তে আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তখন ওর মনে ধীরে ধীরে কুহেলির জন্য যে অনুভূতিরা জন্ম নিচ্ছে তাদের সংযত করতে পারবে তো? যদি না পারে! কুহেলি ওকে বিশ্বাস করে, ওর বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে সে পারবে না। কুহেলি নিজের সবটা ওকে বিয়ের আগেই জানিয়েছে, ও সব জেনে বুঝেই এই বিয়েটা করেছে। কিন্তু তখন তো বুঝতে পারেনি কুহেলি ধীরে ধীরে এতটা দুর্বল করে ফেলবে ওকে। কিন্তু এখন এসব ভেবে আর কি লাভ! যাওয়াটা কোনোমতেই আটকানো সম্ভব নয়, আলেখ নিজের মনকে বোঝাল, নিজেকে সংযত রাখতেই হবে। কুহেলির বিশ্বাসের মর্যাদাও রাখতে হবে আর তার সঙ্গে নভতেজ বাবুর কথাও রাখতে হবে। আলেখ নিজের ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,

আচ্ছা কুহেলি আমরা এটাকে হানিমুন মনে করছি বলেই আমাদের এত অড লাগছে। আমরা যদি এটাকে হানিমুন হিসেবে না মনে করি তাহলেই তো হয়।

কুহেলি একটু অবাক হল, নভতেজ বাবু পরিষ্কার ভাষায় ওদের বুঝিয়ে দিলেন এটা ওদের হানিমুন ট্রিপ। এখন হানিমুন কে হানিমুন না মনে করে আর কি মনে করবে!

মানে?

মানে ড্যাড আমাদের অ্যাজ এ নিউলি ম্যারেড কাপল হিসেবে হানিমুনে পাঠাচ্ছে আর আমরা অ্যাজ ফ্রেন্ডস ভ্যাকেশনে যাব। এমনিতেও শেষ কবে যে কাজের সুত্রে ছাড়া কোথাও শুধু ঘুরতে গিয়েছিলাম মনে পড়ে না। বেশ ভালই হবে, মাইন্ড টাও ফ্রেশ হবে, কি বল?

আইডিয়া খারাপ নয়, কুহেলিও যে শেষ কবে সেইভাবে ভ্যাকেশনে গেছে মনে নেই। কোথাও একটু ঘুরে এলে মন্দ হয় না, আর বেড়ানোর পক্ষে সুইটজারল্যান্ড অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। বরফে ঢাকা পাহাড়গুলোর কথা মনে হতেই কুহেলির মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটুকরো মিষ্টি হাসি। আলেখ ডানহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে ছিল, ওকে হাসতে দেখে বলল,

কি হল? প্ল্যান টা পছন্দ হল?

হুম, সত্যিই অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়নি।

ব্যাস, তাহলে আর কি, প্রবলেম সলভ।

আলেখ সোজা হয়ে দুটো হাত মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কুহেলি একটু হেসে বিছানা থেকে নামতেই আলেখ বলল,

কোথায় যাচ্ছ?

জল শেষ হয়ে গেছে, নিয়ে আসি।

ওহ, ওকে নিয়ে এস, আমি ওয়েট করছি।

আপ….তোমার ওয়েট করতে হবে না, শুয়ে পড়। আবার ভোরে উঠে জগিংয়ে যাবে তো।

কুহেলি আপনি বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে তুমি বলেছে, একটু বাধো বাধো লাগলেও শেষ পর্যন্ত বলেছে। আলেখ এটা শোনা মাত্র সোজা হয়ে উঠে বসল, ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে কুহেলি ওকে তুমি বলেছে। একটু বিস্ময়ের সুরে বলল,

তুমি সত্যিই আমাকে ‘তুমি’ বললে!!

কুহেলি অল্প হেসে বলল,

ড্যাড কে কথা দিয়েছি, রাখতে তো হবেই।

কুহেলি চলে চলে যাওয়ার পরেও আলেখ কিছুক্ষণ সেইভাবেই বসে রইল। আজ দিনটা বড্ড ভাল, প্রথমে এত মিষ্টি একটা সকাল তারপর কুহেলির ওকে নাম ধরে ডাকা আর অবশেষে তুমি। এত খুশির মাঝে আলেখ নিশীথ আগরওয়ালের কথা ভুলেই গেল, ওর কারণে হওয়া রাগ মন খারাপ এসব যেন ঘটেইনি। কুহেলির যাওয়ার আগের ঈষৎ লাজুকতার ছোয়া মেশানো হাসিটা যেন আলেখের মন তোলপাড় করে দিল। কিছুটা চেনা কিছুটা অচেনা অনুভূতি গুলো একটা অনন্য সুন্দর ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে দিল ওর সারা শরীর মন জুড়ে। এই মিষ্টি ভালোলাগার আবেশে টুকু গায়ে মেখে আলেখ পাড়ি দিল ঘুমের দেশে। কুহেলির ফেরার প্রতীক্ষা করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ঠিক সাহস পেল না, যদি অনুভূতি গুলো বাঁধনহারা হয়ে পড়ে। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, আলেখ রোজ ঠিক সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠে, ফ্রেশ হয়ে ঠিক পাঁচটায় জগিংয়ে যায়। কিন্তু আজ আর জগিংয়ে যাওয়া হল না, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর শোয়া যায় না, আলেখ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল কুহেলি কোলবালিশটা জড়িয়ে কুকড়ে শুয়ে আছে। কালকে রাতে বেশ গরম ছিল তাই এসির তাপমান টা অনেকটাই কমানো ছিল, এখন বৃষ্টি হওয়ায় গরম অনেকটা কমে এসেছে। আলেখ এসিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে একটা হালকা চাদর কুহেলির গায়ে তুলে দিল। কুহেলি ঘুমের ঘোরেই চাদরটা আরও একটু জড়িয়ে নিল, আলেখ একটু হেসে বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে বসল। একভাবে বসে চেয়ে রইল কুহেলির ঘুমন্ত মুখটার দিকে, কারও ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েও যে এত আনন্দ অনুভব করা যায় সেটা আজ নতুন করে উপলব্ধি করল আলেখ। ঠিক কতক্ষন যে এভাবেই কেটে গেল বলা যায় না, হঠাৎ কুহেলি একটু নড়ে ওঠায় আলেখ উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কুহেলি একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল, ঘুমের রেশ টা কাটতেই গায়ের চাদর টা দেখে একটু অবাক হল। কালকে রাতে গায়ে চাদর দিয়ে শুয়েছিল বলে তো মনে পড়ে না, আর এত গরমে চাদর নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এখন তো সত্যিই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে, এসির দিকে তাকিয়ে দেখল তাপমান অনেকটাই বাড়ানো। কুহেলি উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল তখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, আশপাশটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ অনেক্ষণ ধরেই মুষলধারায় বৃষ্টি হয়েছে। কুহেলি ঘরে ফিরে এসে বিছানা টা পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলল, চাদরটা হাতে নিতেই ঠোঁটে একটা আলতো হাসি খেলে গেল। এটা যে আলেখের কাজ সেটা আর বুঝতে বাকি নেই ওর, কিন্তু আলেখ ঘরে নেই কেন! এই বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই জগিংয়ে যায়নি। কুহেলি চাদরটা জায়গামত রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল, একেবারে স্নান সেরে তৈরি হয়ে বেরিয়ে দেখল আলেখ এখনও ফেরেনি। আশ্চর্য্য তো! গেল কোথায়? কুহেলি চটপট ড্রেস আপ করে নিয়ে নীচে নামল, আশেপাশে কোথাও আলেখকে দেখতে পেল না, নভতেজ বাবু ড্রয়িং রুমে বসে নিউজ পেপার পড়ছিলেন। কুহেলি ওনার কাছে গিয়ে বলল,

গুড মর্নিং ড্যাড।

গুড মর্নিং বেটা। এত তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেছ?

না এখনও পুরো রেডি হইনি, আচ্ছা ড্যাড আলেখকে দেখেছেন?

আলেখ, কই না তো, এখনও দেখিনি আজকে। কেন রুমে নেই?

না।

তাহলে এখনও জগিং থেকে ফেরেনি হয়তো।

কিন্তু বাইরে তো বৃষ্টি পড়ছে।

ও হ্যা, তাই তো। তাহলে নির্ঘাৎ জিমে আছে।

জিম?

হ্যা, জিম। ওর মিনি জিম, তুমি জান না?

কুহেলি একটু অবাক হয়ে মাথা নাড়ল। নভতেজ বাবু হেসে বললেন,

টেরিসে ওর পার্সোনাল জিম আছে। ওখানেই আছে নিশ্চয়ই, তুমি দেখো গিয়ে।

কুহেলি এই বাড়ির টেরিসে আগে মাত্র একবারই এসেছে, সেই এনগেজমেন্টের দিন। সেই রাতে অত খেয়াল করে দেখেনি, আজ দেখল একটা পাশে একটা মাঝারি মাপের ঘর। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল আলেখকে, ট্রেডমিলে বেশ ভালই দ্রুত গতিতে দৌড়চ্ছে। একমুহুর্তের জন্য যেন কুহেলির হৃদযন্ত্র টা স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। আলেখের উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত, পরনে শুধু একটা ব্ল্যাক ট্র্যাকস্যুট। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে শরীরের আনাচে কানাচে, এমন নিয়মিত জিম করা সুঠাম দেহ যেকোনো নারীর হৃদয়ে ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে কুহেলি তো ওর বিবাহিতা স্ত্রী, নিজের স্বামীর এমন অপরূপ সৌন্দর্য্য যদি ওর বুকের মাঝে ঝড় তোলে তাতে বাধা কোথায়! কুহেলি অপলক নেত্রে তাকিয়েছিল আলেখের দিকে, আলেখ বেশ কিছুক্ষণ আগেই লক্ষ্য করেছে কুহেলিকে। কিন্তু কোনও কথা বলেনি এমনকি ও যে কুহেলির উপস্থিতি টের পেয়েছে সেটাও বুঝতে দেয়নি। কারণ কুহেলির চোখে নিজের জন্য একরাশ মুগ্ধতা দেখতে আলেখের বেশ ভালোলাগছিল। ওয়ার্কআউট শেষ করে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে আলেখ হঠাৎ কুহেলির দিকে না তাকিয়েই বলল,

এভাবে কতক্ষন দাড়িয়ে থাকবে? কিছু বলার থাকলে বলে ফেলতে পার।

কুহেলি যেন ধড়াম করে কোনও এক স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ল। ওর নিজেরই হুশ ছিল না এতক্ষণ কি করছে, খেয়াল হতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কোনও কথা না বলে একপ্রকার পালিয়ে এল ওখান থেকে, সোজা নিজের ঘরে এসে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেল। তারপর আপনমনে নিজেকে বকতে লাগল,

ইশ, কোনও মানে হয়! কি যে হয় আমার মাঝে মাঝে কে জানে! ওরকম নির্লজ্জের মত তাকিয়ে ছিলাম কেন কে জানে! আর ওরও বলিহারি! দিব্যি টের পেয়েছে অথচ আমাকে বুঝতেই দেয়নি! আচ্ছা, বুঝতে দেয়নি বুঝলাম, তা শেষ পর্যন্তও বুঝতে না দিলেই তো হত! এভাবে আমাকে বিব্রত করার মানে টা কি? উফ্, কি যে বলছি ভগবানই জানেন, ধুর।

ইতিমধ্যে আলেখ রুমে চলে এসেছে, এখন অবশ্য পরনে ব্ল্যাক ট্রাকস্যুটের সঙ্গে একটা রেড টি শার্টও রয়েছে। কিন্তু তাও কুহেলি ওর দিকে তাকাল না, সোজা উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তৈরি হতে লাগল। আলেখ কুহেলির অবস্থা দেখে কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারছে না। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তৈরি হতে হতে বলল,

তখন ওভাবে চলে এলে কেন?

কুহেলি হাতে ঘড়ি পরছিল, আলেখের প্রশ্ন শুনে ঘড়িটা হাত থেকে পড়ে গেল। আলেখ সেটা দেখে মুচকি হাসল, বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। কুহেলি ঘড়িটা তুলে নিয়ে পরতে পরতে বলল,

এম.. এমনিই, দেরী হয়ে যা..যাচ্ছিল, তাই।

হুম, কিছু বলতে গিয়েছিলে নিশ্চয়ই।

হ্যা? না, হ্যা, মানে না।

কি হল? এত কনফিউজড কেন?

আলেখ সবটা জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই বলল, কুহেলি স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে কোনরকমে বলল,

কোথায়? ঠিকই তো আছি।

হুম, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

কুহেলি ওর ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিল, হঠাৎ আলেখ ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

বাই দ্য ওয়ে, তোমার এত এম্ব্যারেসড ফিল করার কিন্তু কোনও প্রয়োজন নেই, আমাকে দেখার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। এমনকি তোমার কাছে তো রীতিমত লাইসেন্স আছে, সামাজিক আর আইনী, দুদিক দিয়েই। তবে হ্যা, এভাবে অন্য কারোর দিকে তাকালে কিন্তু মুশকিল, তখন সেটা আমার জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়াবে।

আলেখ কথা গুলো বলে একটু হেসে ওর ব্যাগটা নিয়ে নীচে নেমে গেল। কুহেলি ওখানেই স্থানুবৎ দাড়িয়ে রইল, আলেখের কথাগুলো ওর সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিল। হৃদযন্ত্র টা আবার অসম্ভব দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে, এই মানুষটা এত অদ্ভুত কেন! জেনে বুঝে ইচ্ছে করে ওকে এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, আজকাল বড্ড বেশি ইয়ার্কি করছে। কুহেলি একটু ধাতস্ত হয়ে ব্যাগটা নিয়ে নীচে নেমে গেল। দুজনেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছে, কুহেলিও গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল। আলেখ সমানে হেসেই চলেছে, আর সেটা দেখে কুহেলির ভিষন রাগ হচ্ছে। রাগ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক নাকি! এইভাবে যদি বেচারীকে বিব্রত করে তাহলে তো রাগ হবেই। কুহেলি আলেখের সাথে একটাও কথা বলল না, এমন কি ওর দিকে তাকালও না। নভতেজ বাবুর সাথে টুকটাক কিছু কথা বলে ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনেই বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। গাড়িতেও কুহেলি কোনও কথা না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল, আলেখ সবই বুঝতে পারছে। এই ছোট খাটো খুনসুটি গুলোতে এত আনন্দ লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আলেখের কোনও ধারণাই ছিল না। আলেখ একটু হেসে বলল,

কেউ রাগ করেছে মনে হচ্ছে।

কুহেলি যেন শুনেও শুনল না, আগের মতই বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আলেখ আবার বলল,

হুম, বেশ ভালই রাগ হয়েছে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেউ একজন বলেছিল তার সরি তে অ্যালার্জি আছে, না হলে আমি এক্ষুনি সরি বলতাম।

কথাটায় কুহেলির বেশ হাসি পেল, কিন্তু হাসল না। চুপচাপ যেমন ছিল তেমনই বসে রইল। আলেখ এবার বলল,

আচ্ছা, সম্পূর্ণ দোষটা কিন্তু আমার নয়। কেউ একজন সত্যিই আমাকে দেখছিল।

তীর টা মোক্ষম জায়গায় গিয়ে লাগল, কুহেলির গাল দুটোয় আবার রক্তিমের ছোয়া লাগল। কুহেলি চোখ দুটো নামিয়ে নিল, আলেখ হালকা হেসে বলল,

কাম অন কুহেলি আমি জাস্ট মজা করছিলাম, লুক অ্যাট মি।

কুহেলি ধীরে ধীরে আলেখের দিকে তাকাল, আলেখ হেসে বলল,

তুমি যে এত লজ্জা পাও জানা ছিল না।

কুহেলি আলতো করে বলল,

সেটাও আপনার.. সরি তোমার জন্যই, তুমি ইচ্ছে করে আমাকে এরকম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দাও।

আলেখ হেসে বলল,

ওকে সরি, এবার বল তখন কেন গিয়েছিলে? কোনও দরকারেই গিয়েছিলে নিশ্চয়ই।

হুম, সকালে উঠে তোমাকে ঘরে দেখতে পাইনি, বাইরে বৃষ্টিও পড়ছিল। তাই ভাবলাম জগিংয়ে নিশ্চয়ই যাওনি তাহলে কোথায় গেলে! ড্যাড কে বলতেই জানতে পারলাম তোমার মিনি জিমের কথা। তাই …..

চিন্তা হচ্ছিল বুঝি?

কুহেলি আলেখের দিকে একটু বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

আবার শুরু করেছ?

আলেখ হেসে বলল,

আচ্ছা সরি সরি।

আজকাল একটু বেশিই ইয়ার্কি করছ।

হুম, তবে সবার সাথে করি না।

কুহেলি একটু থেমে বলল,

থ্যাঙ্কস।

হঠাৎ থ্যাঙ্কস কেন?

চাদর টার জন্য।

চাদর?

হুম, সকালে উঠে দেখলাম আমার গায়ে চাদর দেওয়া, তুমিই দিয়েছিলে নিশ্চয়ই।

হুম, যেভাবে কুকড়ে শুয়ে ছিলে।

কথার মধ্যেই অফিস এসে পড়ল। আর অফিসে ঢুকতেই দুজনেই যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, যে যার কাজে ডুবে গেল। এভাবেই দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল মাঝখানের দিনগুলো, আগামীকাল ওরা রওনা হবে ওদের হানিমুনের উদ্দেশ্যে। সকাল আটটায় ফ্লাইট, আজ অফিস থেকে ফিরেই শুরু হয়ে গেছে প্যাকিং। এই সময়টা খুব একটা ঠান্ডা না থাকলেও গরম পোষাকের প্রয়োজন হবে। তাছাড়াও আরও অনেক রকম দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেই বেশ রাত হয়ে গেল। কুহেলি সব কাজ সেরে বাড়িতে ফোন করল, আগেই জানিয়েছিল ওদের যাওয়ার কথা। সবাই দারুন খুশি, শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী দুজনেই বারবার করে ওদের সাবধানে থাকার কথাই বললেন। এটা বোধহয় সব অভিভাবক দেরই ধর্ম, আজকে নভতেজ বাবুও কয়েকবার একই কথা বলেছেন। কুহেলি কথা শেষ করে যখন শুতে এল তখনও আলেখ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কুহেলি বলল,

এখনও হয়নি?

এই তো, এই কয়েকটা ডিটেলস অঙ্কিত কে পাঠিয়ে দিলেই হয়। ড্যাড সব ঠিকই সামলে নেবে আমি জানি, আফটার অল এত বছর ড্যাডই একহাতে সব সামলেছে। কিন্তু কিছু ডিটেলস তো এখনও অজানা, সেগুলোই অঙ্কিত কে মেল করে দিচ্ছি, তাহলে ওরও সুবিধা হবে ড্যাড কে অ্যাসিস্ট করতে।

হুম, তবে বেশি রাত করো না।

হুম, তুমি শুয়ে পড় আমার এক্ষুনি হয়ে কমপ্লিট হয়ে যাবে।

ওকে।

কুহেলি শুয়ে পড়ল, খুব বেশিক্ষণ লাগল না ঘুম আসতে। এখন আর অসুবিধা হয় না, অভ্যাস হয়ে গেছে। আলেখও একটু পরেই কাজ শেষ করে উঠে পড়ল। কুহেলি ততক্ষণে গভীর ঘুমের অতলে, আলেখ বিছানায় উঠে একবার তাকাল ঘুমন্ত কুহেলির মুখটার দিকে। যত বার ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে ততবারই ওর মনটা একটা অদ্ভুত ভাললাগায় ভরে ওঠে, নিজের অজান্তেই একটু এগিয়ে এসে আলতো করে কুহেলির কপালে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

গুড নাইট।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

তাহলে আলেখ আর কুহেলি এবার ওদের হানিমুনের উদ্দেশ্যে রওনা হতে চলেছে। যদিও ওরা এটাকে ভ্যাকেশন হিসেবে নিয়েছে, কিন্তু কখন যে কি হয়, কে বলতে পারে বলুন তো!! আজ তবে এইটুকুই থাক। পরের পর্বে আমরাও না হয় ওদের সঙ্গে একটু বিদেশ ভ্রমন করে আসব। আজকের পর্বটা কেমন লাগল আমাকে জানাতে ভুলে যাবেন না যেন!! অপেক্ষায় থাকব কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে, ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here