সংগোপনে’ পর্ব-২৮

0
1739

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৮
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

আলেখ আর কুহেলি কিছুক্ষণ হল ফ্লাইট বোর্ড করেছে, টেক অফ্ করতে এখনও কিছুটা দেরী আছে। কুহেলির সিট টা একদম জানালার পাশে, উইন্ডো সিট দেখেই দারুন খুশি হয়েছিল। যদিও টিকিট অনুসারে সিটটা আলেখের, কিন্তু তাতে আর কি! কিছুক্ষণ পরে ঠিক সময়মত ফ্লাইট টেক অফ করল। প্লেন টা যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। কুহেলির হঠাৎ করেই ওর প্রথমবার প্লেনে ওঠার কথা মনে পড়ল, আর সে কথা মনে হতেই আপনমনে হাসতে শুরু করল। আলেখ সেটা দেখে বলল,

কি হল? হঠাৎ হাসছ কেন?

কুহেলি হাসতে হাসতেই বলল,

কিছু না, আমার প্রথম ফ্লাইটে ওঠার কথা মনে পড়ে গেল।

কেন? কি হয়েছিল?

এই যে ফ্লাইট টেক অফ্ করার সময় একটা অদ্ভুত ফিলিংস হয় না, সেটা আমার সেদিন বড্ড বেশিই হয়েছিল।

আলেখ একটু কৌতূহলী হয়ে বলল,

মানে?

মানে আমি রীতিমত ভয় পাচ্ছিলাম, লাইফে প্রথম বার ফ্লাইটে উঠেছিলাম তাও আবার একা। আমার পাশে একটা ছেলে বসেছিল, সে বেচারা আজীবন আমাকে ভুলতে পারবে না।

বলে কুহেলি আবার হাসতে শুরু করল, আলেখ এবার আরও একটু কৌতূহলী হয়ে উঠল।

কেন? এমন কি হয়েছিল?

কি আবার হবে! ছেলেটা বেশ আরাম করে আর্ম রেস্টারে হাত রেখে বসেছিল, ফ্লাইট টেক অফ্ করতেই আমি ভয়ের চোটে ছেলেটার হাত এত জোরে চেপে ধরেছিলাম যে বেচারা ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। আশেপাশের সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়েছিল, ভাবছিল কি না কি!! শেষে যখন আমার হুশ ফিরল, তার হাত টা ছাড়তেই দেখি বেচারার হাতে আমার নখ বসে গিয়ে কেটেই গিয়েছিল। রীতিমত রক্ত বেরোচ্ছিল, ভাবতে পার! আমার তো তখন যাচ্ছেতাই অবস্থা, একনাগাড়ে যে কতবার কত ভাবে সরি বলেছিলাম তার ঠিক নেই। তবে ছেলেটা খুব ভালো ছিল, একটুও রাগ করেনি, উল্টে হাসি মুখে বলেছিল সে ঠিক আছে। নিজে ছেলেটার হাতে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিয়েছিলাম, বেশ ভালই আলাপ হয়ে গিয়েছিল, নাম টা এখন আর মনে পড়ছে না, তবে এখনও দেখলে চিনতে পারব। কি যাচ্ছেতাই ব্যাপার না বলো, এখন ভাবলে হাসি পায় কিন্তু তখন যে আমার কি অবস্থা ছিল।

কুহেলি আবার হাসতে থাকে, আলেখও হাসল তবে নিয়ম রক্ষা। কেন যেন অচেনা ছেলেটির প্রতি মারাত্মক হিংসা হচ্ছে। অবশ্য অমন একটু আধটু হয়, জীবনে নতুন রং ধরলে এমন অনেক কিছু হয়। আলেখ বলল,

ছেলেটির সাথে আর যোগাযোগ করনি?

নাহ, ওই ফ্লাইটের সময় টুকুই যা, কেউই কারও কনট্যাক্ট ইনফো জানার চেষ্টাও করিনি।

আলেখ যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

তুমি না হয় করনি বুঝলাম, ছেলেটাও জানতে চায়নি?

না, স্বল্প সময়ের আলাপে আবার কনট্যাক্ট ইনফো চাওয়ার কি আছে?

না চাওয়ারও কিছু নেই। না মানে ভেবে দেখ, তোমার মত এমন এক সুন্দরীর সাথে না চাইতেই আলাপ হয়ে গেল, সেখানে অন্য কেউ হলে কিন্তু নিদেন পক্ষে ফোন নম্বরটা চাইতই। আমি হলে তো চাইতামই।

কুহেলি চোখ দুটোকে সরু করে একটা ভ্রূ কিঞ্চিৎ উপরে তুলে বলল,

তাই বুঝি! তা এখনও পর্যন্ত এরকম কজনের কাছে নম্বর চেয়েছ?

উম, এখনও পর্যন্ত সেই ছেলেটির মত আমার এত সৌভাগ্য হয়নি। তবে হলে যে হাতছাড়া করতাম না সে বিষয়ে নিশ্চিত।

কুহেলি কিছু না বলে জানালার স্বচ্ছ কাচের ওপারে তাকিয়ে রইল। ওর কি খারাপ লাগছে নাকি! মনে তো হয় না, এটাকে ঠিক খারাপ লাগা হয়তো বলা যায় না। তাহলে কি রাগ হচ্ছে!! নাহ, রাগ বলেও তো মনে হচ্ছে না, তবে কি হিংসা হচ্ছে!! আলেখের মজার ছলে বলা কথা গুলোয় ওর ঈর্ষা বোধ হচ্ছে!! কিন্তু কেন? কুহেলি নিজেই যেন বোঝার চেষ্টা করতে লাগল, আলেখ একটু হেসে কুহেলির কানের কাছে মুখটা এনে বলল,

পাক্কা দশটি ঘণ্টা লাগবে প্যারিস পৌঁছতে, এতক্ষণ কি মুখ ঘুরিয়েই বসে থাকবে?

কুহেলি তাও মুখ ঘুরিয়েই বসে রইল, তবে বেশিক্ষণ নয়, একটু পরেই আবার নিজে থেকেই নানা কথায় মেতে উঠল। ভারতীয় সময় সন্ধ্যে ছটা বাইশে ওরা প্যারিসে পৌঁছাল, প্যারিসে তখন সবে দুটো বাহান্ন। এখানে আপাতত প্রায় পাঁচ ঘণ্টা থাকতে হবে, তার পর সুইটজারল্যান্ডের ফ্লাইট। অর্থাৎ এখানকার সময় অনুযায়ী পাঁচটা বিয়াল্লিশে ওদের ফ্লাইট। হাতে অনেকটা সময়, আশেপাশে একটু ঘুরে ফিরে দেখা যাবে। নভতেজ বাবু সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছেন, ওরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই মিস্টার অ্যান্ড মিসেস শর্মা লেখা একটা প্ল্যাকার্ড নজরে এল। ওদের দেখে প্ল্যাকার্ড ধারী ছেলেটি হেসে স্পষ্ট ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল,

মিস্টার অ্যান্ড মিসেস শর্মা ফ্রম ইন্ডিয়া?

আলেখ হেসে সম্মতি জানাতেই ছেলেটি ওদের লাগেজ একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে ওদের নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে দিল। ছেলেটি এখানকার স্থানীয়, নাম ভিক্টর। ভারী মিশুকে ছেলে, এই সামান্য সময়ে বেশ ভালই আলাপ হয়ে গেছে ওদের সঙ্গে। ওদেরকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ভিক্টর বলে গেছে এক ঘন্টা পরে আবার আসবে, আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরিয়ে একেবারে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। হোটেলেও আগে থেকেই রুম বুক করাই ছিল, দুজনে একটু ফ্রেশ হয়ে আগে লাঞ্চ টা সেরে নিল, প্যারিসের সময় অনুযায়ী লাঞ্চের টাইমই বটে কিন্তু ওরা তো সেই কখন ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছে। ফ্লাইটে তেমন কিছু খেতে ইচ্ছে হয়নি, শুধু জুস খেয়েছে, ফলে পেটে ছুঁচো গুলো দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রুম সার্ভিসে ফোন করে রুমেই লাঞ্চ আনিয়ে নিল, পিওর ফ্রেঞ্চ কুইজিন এই প্রথম খেল কুহেলি। বেশ ভাল লাগল, অন্যরকম, বিশেষ করে ডেসার্টের লেমন টার্ট টা। দেখতে দেখতে একটা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, ভিক্টর এসে গেছে। ওরাও লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্যারিস ভ্রমণে, খুব একটা যদিও দেখা হবে না তাও যতটা সম্ভব। ভিক্টর প্রথমেই ওদের নিয়ে গেল প্যারিসের প্রধান আকর্ষণ আইফেল টাওয়ারে। খুব একটা দূরেও নয়, সি ডি জি এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ছাব্বিশ কিলোমিটার ভিক্টর পঁচিশ মিনিটের মধ্যে ওদের পৌঁছে দিল। কুহেলি এতদিন শুধুই ছবিতে দেখেছে, আজ হঠাৎ করে সেই নিষ্প্রাণ ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে ওর কাছে। কুহেলি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল একসময়ের পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইমারত টিকে। আলেখ এর আগেও ফ্রান্সে এসেছে কর্মসূত্রে, কিন্তু প্যারিসে এই প্রথম, ওরও বেশ ভালোলাগছিল। আশেপাশে অনেক লোকের ভিড়, কেউ টুরিস্ট আবার কেউ স্থানীয় বাসিন্দা। সবার মধ্যেই একটা হালকা খুশির মেজাজ, অনেকেই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ক্যামেরা বন্দী করে নিচ্ছে এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো। আলেখ হঠাৎ গাড়ির দিকে এগোল, কুহেলি আশপাশে দেখতেই ব্যস্ত ছিল তাই খেয়াল করল না। হঠাৎ একটা খুট শব্দে ফিরে তাকাতেই দেখল, আলেখ একটা ডি এস এল আর হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কুহেলি একটু অবাক হয়ে হেসে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

তোমার ক্যামেরা আছে?

মনে তো হচ্ছে।

তুমি ছবি তুলতে পার!!

এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, একটু আধটু ফটোগ্রাফি সবাই পারে। এখন তোমার যেখানে যেমন ইচ্ছে দাড়াও, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি। সময় কিন্তু একদম মাপা, তাড়াতাড়ি করতে হবে।

কুহেলি ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু জায়গায় ছবি তুলল, এরপর আলেখের কাছে এসে বলল,

আমার ছবি তো অনেক হল, তোমার তো একটাও হল না।

এইবার হবে তো।

কে তুলে দেবে, দাড়াও ভিক্টর কে বলি।

কুহেলি ঘুরে ভিক্টর কে ডাকতে যেতেই আলেখ ওর হাতটা ধরে বলল,

ভিক্টর কে ডাকার দরকার নেই।

তাহলে ছবি কে তুলবে?

কেন, তুমি আছ তো।

আমি!! আমার দৌড় কিন্তু ওই স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা পর্যন্ত।

এবার তাহলে দৌড়ের পরিধিটা আরেকটু বাড়াও।

বলে ক্যামেরাটা কুহেলির গলায় ঝুলিয়ে দিল আলেখ। সব বুঝিয়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাড়াল, কুহেলি প্রথম অপটু হাতে কয়েকটা ছবি তুলল। বিশেষ ভালো হল না, কিন্তু কুহেলি কি আর ছাড়ার পাত্রী! কয়েকটা ছবি তুলতে তুলতেই বেশ ভালই হাত এসে গেল। নানা জায়গায় বিভিন্ন ভাবে আলেখের বেশ কত গুলো ছবি তুলে দিল। আলেখ বেশ প্রভাবিত হল ছবিগুলো দেখে, হঠাৎ ভিক্টর এসে বলল,

স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড একটা কথা বলতে পারি?

ইয়া শিওর।

এটা আপনাদের হানিমুন ট্রিপ রাইট?

কুহেলি আর আলেখ একবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। আলেখ হেসেই উত্তর দিল,

ইয়েস।

তাহলে আপনারা সোলো পিক তুলছেন কেন? দিস ইজ দ্য সিটি অফ লাভ। জাস্ট লুক অ্যারাউন্ড, লাভ ইজ এভরি হ্যোয়ার।

সত্যিই আশেপাশে দেশি বিদেশি কাপল ঘুরে বেড়াচ্ছে, উপভোগ করছে এই সুন্দর মুহূর্ত টাকে, এই মনোরম পরিবেশ টাকে। কেউ নিজের প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে মন্থর গতিতে হাটতে হাটতে এগিয়ে চলেছে। কেউ আবার নিজের প্রিয় মানুষটার কাধে মাথা রেখে বসে আছে সবুজ ঘাসের গালিচায়। ভিক্টর আবার বলতে শুরু করল,

এনজয় দিস মোমেন্ট স্যার, আপনি ম্যামকে নিয়ে দাড়ান, আমি আপনাদের ছবি তুলে দিচ্ছি।

কুহেলি বা আলেখ কেউই বাধা দিতে পারল না। ক্যামেরাটা ভিক্টরের হাতে দিয়ে কুহেলির পাশে গিয়ে দাড়াল। ভিক্টর পাকা ক্যামেরা ম্যানের মত ওদের পোজ বুঝিয়ে দিতে লাগল। কুহেলির একটু অস্বস্তি লাগছিল, আলেখের একটু অস্বস্তি লাগলেও বেশ ভালও লাগছিল। একবার ভিক্টরের কথা মত কুহেলির কোমরে হাত দিয়ে ওকে নিজের বেশ কিছুটা কাছে টেনে নিল। কুহেলির হাত দুটো যেন নিজে থেকেই আলেখের বুকে উঠে এল। আলেখের চোখে চোখ রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এতদিন সেভাবে লক্ষ্য করেনি কুহেলি, আলেখের চোখের মণি দুটো ঈষৎ সবুজ, কি একটা অদ্ভুত টান আছে ওই চোখ দুটোয়। আর আলেখ… সে তো কবেই ডুব দিয়েছে কুহেলির কাজল কালো চোখের গভীরে। ভিক্টর ওদের এই সুন্দর মুহূর্ত টাকে বন্দী করে নিল ক্যামেরায়। ওরা হয়তো এভাবেই দুজন দুজনের চোখের অতলে হারিয়ে যাওয়ার খেলায় ভেসে যেত, কিন্তু ভিক্টরের ডাকে যেন দুর কোনও স্বপ্নলোকের মায়াজাল ছিড়ে বাস্তবের ভূমিতে পা রাখল। নিজেদের অবস্থান টা বুঝেই যেন দুজনে একটু সরে দাড়াল, এমনিতেই বিব্রতকর একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ভিক্টর একটা এমন বেয়াড়া রকমের একটা প্রস্তাব করল যেটা শুনে ওরা দুজনেই এক কথায় চমকে উঠল।

স্যার, আমাদের মধ্যে অনেকেই একটা কথা খুব মানে, বলতে পারেন একটা অন্ধ বিশ্বাস। শুধু আমরা নই আপনাদের মত যারা বাইরে থেকে ঘুরতে আসেন তাদেরকেও মানতে দেখেছি। এই আইফেল টাওয়ারের নীচে দাড়িয়ে যে কাপল কিস করে তারা সারা জীবনের জন্য এক হয়ে যায়। তাদের জীবনে ভালোবাসার কখনও অভাব হয় না, দেখুন একবার ওদিকে।

এটা শোনা মাত্রই কুহেলির চোখ জোড়া যেন ওর অজান্তেই ঘুরে গেল সেই দিকে। এতক্ষণ নজরে পড়ে নি, হয়তো খেয়াল করেনি কিন্তু এবার সত্যিই দেখল টাওয়ারের নীচে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু কাপল প্রগাঢ় চুম্বনে মত্ত। কুহেলির কান দুটো গরম হয়ে এল, পশ্চিম আকাশের পড়ন্ত বেলার রক্তিম আভা যেন কুহেলির গাল দুটোতেও নিজের পরশ বুলিয়ে দিল। আলেখের মনের অবস্থাও কিছুটা একই, তবে কুহেলির লজ্জা আর অস্বস্তি মেশানো মুখটা দেখে বেশ ভালোলাগল। চোখ দুটো নামিয়ে রেখেছে, যেন পৃথিবীর সব লজ্জার ভারে নুইয়ে পড়েছে। আলেখের ঠোঁটের কোণে একটা স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। একটু এগিয়ে এসে কুহেলির একটা হাত ধরল, আলেখের স্পর্শে কুহেলি আলতো করে চোখ তুলে তাকাল। আলেখ একটু হেসে ওর হাতটা আরও একটু শক্ত করে ধরে বলল,

বিশ্বাস টা মন থেকে আসে ভিক্টর। আর আমাদের দুজনের মনেই দুজনের প্রতি অটুট বিশ্বাস আছে। আর ভালোবাসা… বিশ্বাসের ভিত্তিতেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ভালোবাসার ইমারত। তার জন্য আমাদের অন্য কোনও অবলম্বনের প্রয়োজন নেই।

আলেখের বলা প্রত্যেকটা কথা কুহেলির অন্তর ছুয়ে গেল। আর কত ভাবে ওকে অভিভূত করবে আলেখ! আলেখের কথার ঠিক কতটা ভিক্টরের বোধগম্য হল বলা যায় না, তবে সে আর কিছু বলল না। ইতিমধ্যে পাঁচটা বেজে গেছে, এবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া প্রয়োজন। ভিক্টর ওদের সাড়ে পাঁচটার বেশ কিছু আগেই সি ডি জি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল। ওরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ফ্লাইট বোর্ড করল, ঠিক পাঁচটা বিয়াল্লিশেই ফ্লাইট টেক অফ করল, গন্তব্য সুইটজারল্যান্ডের ফ্লুঘাফেন জুরিখ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। দূরত্ব খুব একটা নয়, একটা ঘণ্টা পনেরো মিনিটের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল ওদের গন্তব্যে। ফ্রান্স আর সুইটজারল্যান্ডের মধ্যে সময়ের কোনও পার্থক্য নেই, ওরা যখন কাস্টমসের চেকিং সেরে বেরোল তখন সন্ধ্যে সাতটা পনের। এখানেও সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা রয়েছে, প্যারিসের মতই এখানেও এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই মিস্টার অ্যান্ড মিসেস শর্মা লেখা প্ল্যাকার্ড টা নজরে এল। এই ছেলেটিও বেশ মিষ্ট ভাষী, নাম লিয়াম। তবে লিয়াম ভিক্টরের মত স্পষ্ট ইংরেজি বলতে পারে না, কিছুটা ইটালিয়ান আর কিছুটা ইংরেজি মিশিয়ে যা বলছিল সেটা বুঝতে একটু অসুবিধা হলেও কাজ চলে যাচ্ছিল। হোটেল টা এয়ারপোর্ট থেকে একটু দূরে, জুরিখের সবথেকে নাম করা হোটেল পার্ক হায়াত। হোটেলে চেক ইন করে ফাইনালি যখন ওরা রুমে পৌঁছালো তখন আটটা বাজে, ভারতীয় সময় অনুযায়ী রাত সাড়ে এগারোটা। অর্থাৎ, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় থেকে ধরলে সাড়ে ষোলো ঘণ্টার জার্নি। মাঝখানে প্যারিসে একটু যা ফ্রেশ হয়েছিল, দুজনের শরীরেই যেন রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে। রুমটা বেশ সুন্দর, ডিল্যক্স হানিমুন সুইট, একটা প্রমান সাইজের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটের সমান আয়তন। গোটা রুমটা লাল গোলাপ আর সুগন্ধী মোমবাতি দিয়ে সাজানো। কুহেলি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল রুমে, আলেখ বেল বয়কে কিছু টিপস দিয়ে দরজাটা লক করে ভিতরে ঢুকে এল। কুহেলি এক ভাবে চারপাশটা দেখছিল, তারপর থেকে এতক্ষণ কুহেলি একটাও কথা বলেনি। আলেখও ভালো করে রুমটা দেখে বলল,

এটাও কিন্তু আমি কিছু জানতাম না, সব ড্যাড করেছে। আর হানিমুন প্যাকেজ হলে কিছুটা হোটেলের তরফ থেকেই করে থাকে। তুমি একটু ওয়েট কর, আমি রুম সার্ভিসে বলে দিচ্ছি এগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে।

কুহেলি ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

থাক, এখন আর কিছু করতে হবে না।

আলেখ ফোনের রিসিভারটা তুলেছিল, সেটাকে আবার নামিয়ে রেখে কুহেলির দিকে এগিয়ে গেল। কুহেলি কাচের স্লাইডিং ডোর টা ঠেলে ব্যালকনিতে এসে দাড়াল, বেশ ভালোলাগছে দেখতে, এখান থেকে গোটা শহরটা দেখা যাচ্ছে। আলেখ ওর পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,

এভাবে বাইরে দাড়িও না, টেম্পারেচার কমতে শুরু করেছে, ঠান্ডা লেগে যাবে কিন্তু। ভিতরে চল, আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।

হুম, তবে এখানে দাড়াতে বেশ ভালোলাগছে।

ভালোলাগলেও আমি আর তোমাকে এখানে দাড়াতে দেব না, চলো।

আলেখ কুহেলির হাত ধরে ভিতরে এনে দরজাটা বন্ধ করে দিল। কুহেলিও আর কিছু না বলে লাগেজ থেকে একটা নাইট ড্রেস বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আলেখ ততক্ষণে বেড থেকে সমস্ত ফুল তুলে যত্ন করে টেবিলের উপরে রেখে দিল। কুহেলি স্নান সেরে বেরিয়েই ঠক ঠক করে কাপতে লাগল, ওকে এভাবে কাপতে দেখে আলেখ ব্যস্ত হয়ে ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

কি হল? এভাবে কাপছ কেন?

কুহেলি কাপতে কাপতেই উত্তর দিল,

ঠান্ডা.. ঠান্ডা জলে…

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আলেখ বলল,

হোয়াট? ওয়াশরুমে গরম জল নেই? হোয়াট ইজ দিস!! আমি এক্ষুনি কমপ্লেন করব।

আলেখ দ্রুত গতিতে একটা জ্যাকেট বের করে কুহেলির গায়ে চাপিয়ে দিয়ে ওকে বিছানায় বসিয়ে রুম টেম্পারেচার টা আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিল। ফোনটা তুলে নম্বর ডায়াল করতে যাবে তার আগেই কুহেলি বলল,

কোথাও ফোন করতে হবে না, ওয়াশরুমে গরম জলের ব্যবস্থা আছে।

আলেখ রিসিভার টা নামিয়ে রেখে একটু অবাক হয়ে বলল,

মানে!! গরম জল ছিল? তাহলে তুমি ঠান্ডা জলে স্নান করলে কেন?

কুহেলির কাপুনি বেশ কিছুটা কমেছে, জ্যাকেট টা একটু ভাল করে জড়িয়ে বলল,

আসলে বড্ড টায়ার্ড লাগছিল, তাই ভাবলাম ঠান্ডা জলে স্নান করলে হয়তো ফ্রেশ লাগবে। তাই….

আলেখ ভেবে পেল না ও রাগ করবে না হাসবে। শেষ পর্যন্ত একটু হেসেই বলল,

মাঝে মাঝে এমন এমন কাণ্ড ঘটাও না!! কি বলব। তবে আজ করেছ ঠিক আছে আর কিন্তু ফ্রেশ হওয়ার জন্য ভুলেও ঠান্ডা জলে হাত দিও না।

আলেখ কথা বলতে বলতেই একটা টাওয়েল এনে কুহেলির সামনে দাড়িয়ে ওর ভিজে চুল গুলো মুছে দিতে লাগল। কুহেলি একটু বাধা দিয়ে বলল,

আমি করে নিচ্ছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।

চুপ করে বসো তো, হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে রাখো।

আলেখ কথাগুলো বেশ শাসনের সুরে বলল, কুহেলি আর কথা বাড়াল না। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলির লম্বা চুলগুলো মুছে দিল, তারপর রুম সার্ভিসে ফোন করে দুকাপ কফি অর্ডার করে নিজে ফ্রেশ হতে চলে গেল। কুহেলি এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কাপুনি টা আর নেই, সত্যি কি ভেবে যে ঠান্ডা জলে স্নান করতে গিয়েছিল! উঠে গিয়ে চুলে হালকা করে ব্রাশ চালিয়ে সিদুর টা পরে আবার বিছানায় উঠে বসল। ফোনটা হাতে নিয়ে আগে নভতেজ বাবু আর তারপর চৈতালী দেবীকে ফোন করে ওদের পৌঁছানোর সংবাদ জানিয়ে দিল। আলেখ ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর আগেই কফি চলে এল, আলেখ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে বলল,

বাড়িতে কথা বললে?

হুম, ড্যাড আর মা দুজনকেই জানিয়ে দিয়েছি।

হুম, কফি দিয়ে গেছে?

হ্যা, এই তো। তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।

কুহেলি পট থেকে দুটো কাপে কফি ঢেলে, একটা কাপ আলেখের দিকে এগিয়ে দিল। রুমে বোঝা যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু বাইরে ওয়েদার বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম কফিতে চুমুক দিয়ে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল কুহেলির। কফি শেষ করেই আলেখ বলল,

ডিনারটা অর্ডার করে দিই? একটু তো সময় লাগবে।

হুম, আমার এমনিতেও ভিষন টায়ার্ড লাগছে। তাড়াতাড়ি শুতে পারলে বাচি।

আলেখ উঠে টেবিলে রাখা মেনু টা এনে কুহেলিকে দিয়ে বলল,

বল, কি খাবে?

কুহেলি মেনু টা আবার আলেখের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

আমি জানি না, তোমার যা ভালো মনে হয় অর্ডার করে দাও। আমি সব খাই শুধু তেতো না হলেই হল।

আলেখ হেসে ওর পছন্দ মত অর্ডার করে দিল, ওরা জানাল আধঘন্টার মধ্যেই ডিনার পৌঁছে যাবে। আলেখেরও বেশ ক্লান্ত লাগছে, এতক্ষণের জার্নি টায়ার্ড লাগাটাই স্বাভাবিক। আধঘন্টাও লাগল না, পনেরো মিনিটের মাথায় ওদের অর্ডার এসে গেল। দুজনে খাওয়া শেষ করে এবার শোয়ার আয়োজন করতে লাগল। দুজনেই যথেষ্ট ক্লান্ত, ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে, বিছানাটা যেন রীতিমত ওদের ডাকছে। কিন্তু শুতে গিয়ে আরেক বিপত্তি, বেশ মোটা প্রমাণ সাইজের ব্ল্যানকেট রাখা আছে, তবে একটাই। সেটাই যদিও স্বাভাবিক, হানিমুন সুইটে দুটো ব্ল্যানকেট কেন থাকবে! আলেখ একটু ভেবে বলল,

আমি আরেকটা ব্ল্যানকেট দিতে বলি?

না, সেটা একটু অড দেখাবে না?

তাহলে?

কুহেলি একটু থেমে বলল,

ব্ল্যানকেট টা বেশ বড়, অসুবিধা হবে না আশা করি।

আলেখ একটু অবাক হল, কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পেল না। কুহেলি ততক্ষণে উঠে ব্ল্যানকেটের তলায় ঢুকে একটা পাশে বেশ জমিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল, নতুন জায়গায় ঘুম না আসার দোষ কোথায় যে হারিয়ে গেল! চোখের পলক দুটো এক করতে যেটুকু দেরী, তারপরেই কুহেলি তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে। আলেখ একটু মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল, ঘুমের কাঠির ছোয়া পেতে ওরও বিশেষ দেরী হল না। সকালে কুহেলির আগে ঘুম ভাঙ্গল, ধীরে ধীরে চোখটা খুলে নিজেকে আলেখের বুকে আবিষ্কার করে প্রায় ছিটকে উঠে বসল। রীতিমত দুহাতে আলেখকে জড়িয়ে শুয়েছিল, ভারী রাগ হল নিজের উপর। এ আবার কেমন অভ্যাস! আরে কোলবালিশ নেই বলে কি … ইশ, কোনও কান্ডজ্ঞান নেই! ভাগ্যিস আলেখ কিছু টের পায়নি। তবে কথাটা মনে হতেই কুহেলির আগের দিনের কথা মনে পড়ল। সেদিনও তো মনে হয়েছিল, আলেখ কিছু বুঝতে পারেনি কিন্তু পরে তো দেখেছিল সে সবটাই টের পেয়েছিল। কুহেলি নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটু ঝুঁকে এসে আলেখের গায়ে আলতো করে ঠেলা দিল। কোনও প্রতিক্রিয়া পেল না, এবার আরেকটু জোরে ঠেলা দিল। তাতে আলেখ সামান্য নড়ে পাশ ফিরে শুলো, কুহেলি নিশ্চিন্ত হয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, আজ তবে সত্যিই কিছু টের পায়নি কুহেলি আস্তে করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। অভ্যাস মত ফ্রেশ হয়ে এসে রুম সার্ভিসে ফোন করে ওদের ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে দিল। আলেখ এখনও ঘুমাচ্ছে, বেশ লাগছে কিন্তু ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে, কত শান্ত সুন্দর। ঘুমন্ত মুখটা দেখলেও যেন মনে হচ্ছে ঠোঁটের কোনে আলতো একটু হাসির ছোয়া যেন লেগেই আছে। কুহেলি একটু এগিয়ে এসে বেডের পাশে রাখা সাইড টেবিলে একটা হাত রেখে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে রইল আলেখের দিকে। মনে একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে, যার সংজ্ঞা বা কার্য কারণ ব্যাখ্যা কোনোটাই কুহেলির জানা নেই। ঠিক কতক্ষন কুহেলি এই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বলা যায় না, হঠাৎ ডোর বেলের শব্দে ঘোর কাটিয়ে উঠে দাড়াল। আলেখেরও ঘুমটা এই বেলের শব্দেই ভেঙে গেল, ঘুম জড়ানো চোখে উঠে সামনে কুহেলিকে দেখে হেসে বলল,

গুড মর্নিং।

গুড মর্নিং, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে দিয়েছি। ব্রেকফাস্ট দিতেই এসেছে বোধহয়, আমি দেখে আসছি।

কুহেলি একরকম পালিয়ে এল, দরজা টা খুলতেই রুম সার্ভিসের স্টাফ হাসি মুখে ওকে গুড মর্নিং উইশ করে টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে দিয়ে গেল। আলেখ ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে, কুহেলি সেদিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, ও যে আলেখের দিকে তাকিয়েছিল সেটা বোধহয় বুঝতে পারেনি। কুহেলি নিজের মনেই ভাবতে বসল,

আচ্ছা, আমি ওভাবে কেন তাকিয়ে ছিলাম? যদি দেখে ফেলত! ইশ, কি যাচ্ছেতাই ব্যাপার হত। কিন্তু আমি তাকিয়ে কেন ছিলাম! কিসের ওই অদ্ভুত টান? ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে এই অদ্ভুত ভালোলাগায় কেন ভরে উঠছিল মনটা!

আলেখের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল।

কি ভাবছ অত মন দিয়ে?

হুম? কই কিছু না, ব্রেকফাস্ট টা দিয়ে গেছে, আমি রেডি করছি তুমি এস।

কুহেলি উঠে গিয়ে দুটো প্লেটে ব্রেকফাস্ট সাজাতে লাগল। আলেখ একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসে বসল। ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেলে আলেখ বলল,

তুমি রেডি হয়ে নাও, আমি ততক্ষণে একটু দেখে নিই আজকে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। কুহেলি ওর ড্রেস নিয়ে পাশের ছোট রুমটায় চলে গেল। ডেনিম ব্লু জিন্স, লাইট পিঙ্ক টপ আর তার উপরে একটা হোয়াইট পুলোভার। চুলগুলো ছেড়েই রাখল, একটা বানি ক্যাপ পরে নিল, গলায় একটা উলেন স্কার্ফ ভালো করে জড়িয়ে নিল, গ্লাভস পরার মত ঠান্ডা এখন নেই। তবে চোখে সানগ্লাসটা মাস্ট, স্টাইলের জন্য নয়, বরফে রোদ পড়লে খালি চোখে তাকানো যায় না। পায়ে পরল নতুন কেনা বুট, আলেখই বলেছিল এটা কিনতে, বরফে সুবিধা হবে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে আলতো একটু লাইনারের ছোয়া, আর পারফিউম তো আছেই, ব্যাস কমপ্লিট। কুহেলি তৈরি হয়ে বেডরুমে এসে দেখল আলেখ একদম তৈরি হয়ে বসে আছে, ফোনে সম্ভবত লিয়ামের সঙ্গে কথা বলছে। কথা শেষ হলে কুহেলি বলল,

তুমি কখন রেডি হলে?

আলেখ মুচকি হেসে বলল,

যখন তুমি রেডি হচ্ছিলে তখন।

কিন্তু তুমি যে বললে, আজকে কোথায় যাওয়া যায় সেটা দেখবে।

হুম, দেখলাম তো। সব দেখে নিয়ে রেডি হয়ে রিসেপশন থেকে লিয়ামের নম্বর নিয়ে ওর সাথে কথাও বলা হয়ে গেছে। লিয়ামই আমাদের এই কদিনের জন্য ড্রাইভার কাম ট্যুরিস্ট গাইড।

সেতো ভালো কথা, কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি এত কিছু করলে কীকরে!

আলেখ একটা দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,

কোথায় তাড়াতাড়ি! পাক্কা একঘন্টা হয়ে গেছে।

কুহেলি আলেখের ইঙ্গিতটা বেশ বুঝতে পারল, ওকে ইচ্ছে করেই রাগানোর জন্য এমনটা করছে সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। কুহেলি কিন্তু রাগল না, বরং একটা মিষ্টি হাসি আলেখের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,

মাত্র এক ঘন্টা! আজকে তো তাহলে বেশ তাড়াতাড়িই রেডি হয়ে গেছি।

আলেখ একটু হেসে বলল,

যাহ, ব্যাপারটা ফ্লপ হয়ে গেল!

কুহেলি শুধু হাসল, আলেখ উঠে ওর ডি এস এল আর টা নিয়ে বলল,

চলো, লিয়াম ওয়েট করছে নীচে।

নীচে যেতে যেতে কুহেলি আলেখকে একটু ভালো করে দেখল, একদম অন্যরকম লাগছে আজকে। ফেডেড ব্লু জিন্স এর সাথে ব্ল্যাক টি শার্ট, তার সাথে ডিপ সী গ্রীন কালারের জ্যাকেট। মাথায় একটা উলেন ক্যাপ, গলায় মাফলার চোখে সানগ্লাস, বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। ওরা নীচে পৌঁছাতেই দেখল লিয়াম হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে, ওদের দেখেই ইটালিয়ানে বলল, ‘বুনজোরনো’ যার অর্থ সুপ্রভাত। কুহেলি না জানলেও আলেখ কিছু কিছুটা জানে, হেসে একটা প্রতিউত্তর দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। লিয়াম ওদের নিয়ে এগোলো ওদের গন্ত্যবের দিকে। এইসময়টা খুব একটা ঠান্ডা না থাকলেও আশেপাশে বরফের অভাব নেই, সারাদিন ধরে নানা পাহাড়, লেক, ব্রিজ ঘুরেও যেন কুহেলির আশ মিটল না। বরফ দেখে তো যেন একদম বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল। খোলা হাতে বরফ নিতে একটু অসুবিধা হলেও সেসবে কোনও পাত্তা না দিয়ে রীতিমত বরফের বল বানিয়ে আলেখের গায়ে ছুড়ে ছুড়ে মারছিল। ওর এই নতুন রূপ টা আলেখের খুব ভালো লাগছিল, ওর প্রাণখোলা হাসিটা দেখে আলেখের মন টাও যেন খুশিতে ভরে উঠছিল। কুহেলির কত ছবি যে তুলেছে আলেখ, তার বোধহয় হিসেব নেই। দুজনের একসঙ্গেরও ছবি আছে প্রচুর, দুজনেই যে কতদিন পর এভাবে প্রাণ খুলে আনন্দ করেছে দুজনেই হয়তো মনে করতে পারবে না। শেষ যখন ওরা ফিরল তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। এত ঘোরাঘুরিতে বেশ ক্লান্ত, খিদেও পেয়েছে জব্বর, লিয়াম ওদের লা সুপিয়েরের সামনে এনে বলল,

এটা জুরিখের বেস্ট রেস্টুরেন্ট, আপনারা ডিনার টা আজ এখানেই করুন।

আলেখ বারবার লিয়াম কেও ওদের সঙ্গে ডিনার করতে বলল কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হল না, দুপুরেও তাই। আলেখ কুহেলি দুজনেই অনেকবার বলা সত্ত্বেও লিয়াম রাজি হয়নি। শেষে ওরা দুজনেই ঢুকল রেস্টুরেন্টে, খিদেটা বেশ জাকিয়ে পেয়েছে। কুহেলি আর আলেখ একটা টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েটার মেনু নিয়ে এল। আলেখ একটু দেখে অর্ডার করে দিল, দুজনে বসে সারাদিনের গল্প করতে লাগল। দুজনেই ভিষন উত্তেজিত, প্রথম দিনেই এত বেশি আনন্দ হয়েছে, আগামী দিনগুলোর জন্যও উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে। দুজনে গল্পে বেশ ভালই মশগুল, হঠাৎ একটা খুব পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে কুহেলি চমকে উঠল। এ কণ্ঠস্বর তার ভিষন চেনা, চোখ বন্ধ করেও চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু এখানে সে আসবে কীকরে! ওর ভাবনার জালের সুতো গুলো ছিন্ন করে সেই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল ওকেই উদ্দেশ্য করে।

কুহু?

কুহেলি কালমাত্র বিলম্ব না করে চকিতে পিছন ফিরল। পাশের সারির একটা টেবিলের পরেই বিস্মিত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছে দেবার্ঘ্য! কুহেলি যেন ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল, একভাবে চেয়ে আছে দেবার্ঘ্যর দিকে। ওকে এখানে দেখবে এটা সে কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি, দেবার্ঘ্যও ভাবেনি এইভাবে হঠাৎ কুহেলিকে এখানে দেখতে পাবে। তাই প্রথম টায় কিছুটা সন্দেহ জড়ানো সুরেই ডেকেছিল, কুহেলি ফিরে তাকাতেই নিশ্চিত হয়ে গেল। উঠে এগিয়ে এল কুহেলির দিকে, হাসি মুখে বলল,

কুহু? তুমি এখানে?

কুহেলিও ওর অবাক ভাবটা কাটিয়ে ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে এনে বলল,

হুম, ঘুরতে। তুমি এখানে?

দেবার্ঘ্য একথার উত্তর না দিয়ে একবার আলেখের দিকে তাকাল। কুহেলির বিয়ের খবর সে শুনেছে, ছবিও চাইলেই দেখতে পারত কিন্তু ইচ্ছে করেই দেখেনি। কারনটা হয়তো খুবই সহজেই অনুমান করা যায়, কুহেলির সঙ্গে আলেখকে দেখে ওর পরিচয় বুঝতে অসুবিধা হল না। আলেখ একটু হেসে কুহেলিকে বলল,

সব কথা কি ওনাকে দাড় করিয়েই বলবে নাকি! বসতে তো বল আগে।

কুহেলি যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে হঠাৎ জেগে উঠল। দেবার্ঘ্যকে বসতে বলে একবার আলেখের দিকে তাকাল, বেশ হাসি খুশিই দেখাচ্ছে। হয়তো এখনও দেবার্ঘ্যর পরিচয় পায়নি সেইজন্যই। দেবার্ঘ্য আলেখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কুহেলিকে বলল,

আলাপ করাবে না?

কুহেলি যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ঠোঁটের কোনের হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,

হুম, মিট মাই হাসবেন্ড মিস্টার আলেখ শর্মা।

আলেখ ওর ডানহাত টা দেবার্ঘ্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

হাই, অ্যাম আলেখ।

দেবার্ঘ্য হেসে ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলল,

হাই, আই অ্যাম দেবার্ঘ্য… দেবার্ঘ্য মিত্র।

নামটা শোনা মাত্র আলেখের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। এতক্ষণ ভাবছিল হয়তো কোনও পুরনো বন্ধু হবে কিন্তু নাম টা শোনার পর….. আলেখ কোনরকমে একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কুহেলির কোনোটাই অগোচর হল না, দেবার্ঘ্য একটু হেসে কুহেলিকে বলল,

সরি কুহু, তোমার বিয়েটা অ্যাটেন্ড করতে পারিনি।

কুহেলি খুব সংক্ষেপে উত্তর দিল,

ইটস ওকে।

সো, হানিমুন?

কথাটা বলার সময় দেবার্ঘ্যর গলাটা ঈষৎ কেপে গেল। যেটা কুহেলির বুঝতে অসুবিধা হল না, এবারও ছোট্ট করেই উত্তর দিল,

হুম।

দেবার্ঘ্যর হাসিটা আরও কিছুটা প্রশস্ত হল। এই হাসির অর্থ কুহেলি জানে, এক ভাবে তাকিয়ে রইল দেবার্ঘ্যর দিকে। গালের টোল টা আজও নজর এড়াল না ওর, সেই মায়া ভরা ঘুম জড়ানো চোখ দুটো, একটুও বদলায়নি। আজও সেখানে ভিড় করেছে অনেক না বলা ভাষাহীন কথারা। খুব ইচ্ছে হল একবার জিজ্ঞেস করতে,
‘তুমি ভালো আছো তো?’
কিন্তু না, পারল না। ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে আকড়ে ধরল ওর সাদা পুলোভারের একটা অংশ। কিছুক্ষণ একটা অসম্ভব নিরবতা বিরাজ করল ওদের মাঝখানে, আলেখ সবটাই বুঝতে পারছিল। কুহেলির মনের খবর বুঝে নিতে ওর অসুবিধা হয় না, ওর মনে এখন প্রবল ঝড় উঠেছে। সব অনুভূতিরা তছনছ হয়ে যাচ্ছে সেই ঝড়ে, পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক করতে আলেখ বলল,

আপনি এখানে? কর্মসূত্রে?

দেবার্ঘ্য যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোতে। আলেখের প্রশ্ন যেন ওকে আরও একবার মনে করিয়ে দিল, সেই দিনগুলো সত্যিই হারিয়ে গেছে, চিরতরে। অলীক ভাবনার স্রোতে গা ভাসানোর থেকে বাস্তবকে মেনে নেওয়াই হয়তো ভাল। একটু হেসে বলল,

ইয়েস, কর্মসূত্রে তো বটেই, তবে আমি এখানে জব করি না। আমাদের কোম্পানির সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে ব্রাঞ্চ রয়েছে, আমি ইউ এসের মূল কোম্পানিতে আছি। এখানে এই কয়েকমাস আগেই একটা নতুন ব্রাঞ্চ ওপেন করা হয়েছে, তাই মাঝে মধ্যেই আসতে হচ্ছে। এইতো আজ এসেছি আবার কালকেই ফিরে যাব। আপনারা কবে এলেন?

দুজনে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আলাপ করতে লাগল, কিন্তু কুহেলি শত চেষ্টা করেও নিজের অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে পারল না। পুরনো স্মৃতির পাতা থেকে সব মুহুর্তেরা যেন জীবন্ত হয়ে ওর মন মস্তিষ্ক জুড়ে নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করছে। না চাইতেও বারবার চোখ দুটো চলে যাচ্ছে দেবার্ঘ্যর দিকে, ঠিক মত খেতেও পারল না। ডিনার সেরে ওরা তিনজন একসঙ্গেই বেরিয়ে এল রেস্তোরা থেকে। আলেখ দেবার্ঘ্যকে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললে সে খুব সহজ ভাবে একটা স্মিত হাসির রেশ এনে বলল,

থ্যাঙ্কস, কিন্তু আমাদের রাস্তা আলাদা। অনেক সময় দুটো রাস্তা কোনও এক জায়গায় হঠাৎ মিলে গেলেও তাদের গন্তব্য আলাদাই থেকে যায়। কিছু দূর একসাথে চলার পর আবার কোনও এক বাকে দুটো পথ আলাদা হয়ে যায়। আসি মিস্টার শর্মা, আবার যদি কোনোদিন আমাদের রাস্তা টা হঠাৎ মিলে যায় সেদিন আবার দেখা হবে। আসি কুহু, ভালো থেকো।

দেবার্ঘ্য কথা গুলো বলে রাস্তা পেরিয়ে হারিয়ে গেল জনসমুদ্রের ভিড়ে। ওর কথাগুলো যেন কুহেলির অন্তর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে গেল, হোটেলে ফেরার পথে কুহেলি ভাবল,

ঠিকই তো বলেছে, আমাদের রাস্তা তো সেই কবেই আলাদা হয়ে গেছে। এটা তো আমার অজানা নয়, সব কিছু পিছনে ফেলেই তো আমি এগিয়েছিলাম। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আর কোনদিনও দুর্বল হব না। তবে আজ কেন? কেন আজ আবার……

ভাবনাটাও যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ওর প্রশ্নের উত্তরের মতই। আলেখ সবটা বুঝতে পারছে, ও জানে এখন কিছুটা সময় ওর প্রয়োজন। কুহেলির লাল হয়ে আসা চোখ দুটো দেখে কষ্ট হলেও আলেখ কোনও কথা বলল না। কুহেলি একবার আলেখের দিকে তাকাল, কত সহজ ভাবে বসে আছে যেন কিছুই হয়নি। হঠাৎ নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল কুহেলির, আলেখ ওর সবটা জেনেই বিয়ে করেছিল ওকে। সে নিজেও ওকে কথা দিয়েছিল কোনোদিন এই সম্পর্কটার অসন্মান করবে না, কোনদিনও ওর বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না। কিন্তু আজ সে ঠিক এই দুটো কাজই করেছে, এখন সে আলেখের বিবাহিতা স্ত্রী। সে কি করে পারল আলেখের পাশে বসে দেবার্ঘ্যর স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে! কীকরে? আলেখের মত একজন মানুষের বিশ্বাসে এভাবে আঘাত হানার আগে একবারও বাঁধল না ওর! কীকরে পারল ওদের এই পবিত্র সম্পর্ক টাকে অসন্মান করতে! নাহ, নিজের কাছেই বড্ড ছোট মনে হচ্ছে আজ। কুহেলি ওদের রুমে পৌঁছেই এক ছুটে বেডরুমের লাগোয়া ছোট রুমটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আলেখ বুঝতে পেরেছিল কুহেলির মনের ঝড় টা ক্রমশই বাড়ছে কিন্তু এভাবে হঠাৎ কুহেলি নিজেকে বন্ধ করে নেবে আশা করেনি। আলেখ ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল সেই রুমের দিকে, ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল দরজায়। এভাবে কুহেলিকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না, দরজায় ক্রমাগত করাঘাতের সঙ্গে আলেখ ডেকে চলল কুহেলিকে।

কুহেলি, কুহেলি লিসেন টু মি। কুহেলি, প্লিজ ওপেন দ্য ডোর কুহেলি। কুহেলি, একবার আমার কথা শোনো কুহেলি, প্লিজ।

কুহেলি তখন দরজায় পিঠ দিয়ে বসে পড়েছে মেঝের উপরে। এতক্ষণের বহুকষ্টে আটকে রাখা উষ্ণ জলের ধারা গুলো যেন বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত বয়ে চলল। আলেখের মনটা অসম্ভব ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, ওর ক্রমাগত করাঘাত আর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একসময় দরজা টা খুলে দিল কুহেলি। আলেখ দ্রুত গতিতে রুমের ভিতরে ঢুকল, কুহেলি দরজার একটা পাশেই বসে ছিল। চোখের জল অব্যাহত, আলেখ হাটু মুড়ে বসল ওর সামনে,

কুহেলি, তুমি কেন কাদছ? প্লিজ ডোন্ট ক্রাই, আমি জানি এগুলো সহজ নয়। কিন্তু তুমি এভাবে ভেঙে পড়তে পারো না।

কুহেলি সজল নয়নে তাকাল আলেখের দিকে, এখনও সে তাকে সান্তনা দিচ্ছে! এত ভাল কেন মানুষটা? ওর মনের অপরাধ বোধটা যেন আরও বেশি করে জেকে বসল। এতক্ষণের নিঃশব্দ কান্নাগুলো এবার সারা ঘরে ধ্বনিত হতে লাগল। কুহেলি কান্না জড়ানো গলায় বলল,

আমি খুব বাজে, খুব বাজে আমি। কেন আমাকে সান্তনা দিচ্ছ! কেন রাগ করছ না আমার ওপর?

আলেখ কুহেলির হাত দুটো ধরে বলল,

কি বলছ এসব কুহেলি? আমি কেন রাগ করব তোমার উপর? তুমি কি করেছ যে তোমার উপর রাগ করব?

কুহেলির কান্নার গতি বাড়ল, হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

কেন রাগ করবে না তুমি? আমি তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি। আমাদের সম্পর্কের অসন্মান করেছি, তাও কেন তুমি রাগ করবে না?

আলেখের মনটা কষ্টে ভরে উঠতে লাগল, কুহেলির প্রতিটা চোখের জল যেন তীরের ফলার মত বিদ্ধ করছে ওর মন। দুহাতে কুহেলির মুখটা ধরে আলেখ বলল,

কে বলেছে তুমি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছ? কে বলেছে তুমি আমাদের সম্পর্ককে অসন্মান করেছ? আমাকে জিজ্ঞেস কর, আমি বলছি তুমি এর কোনোটাই করনি, করতে পারো না। আমি জানি তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে, এটা খুবই স্বাভাবিক কুহেলি। অতীতকে কখনও ভুলে যাওয়া যায় না, তারা স্মৃতি হয়ে থেকে যায় আমাদের জীবনের পুরনো পাতায়। কখনও কখনও তারা ফিরে আসে জীবন্ত হয়ে, ঠিক আজকের মত। তাতে দোষের কিছু নেই কুহেলি, অতীতের স্মৃতি যতক্ষণ আমাদের বর্তমানকে নতুন করে প্রভাবিত না করছে ততক্ষণ তারা কেবল স্মৃতি হয়েই থেকে যায়। আর বিশ্বাস কর কুহেলি তোমার জীবনের একটা ছোট্ট অংশের কিছু স্মৃতি আমাদের বর্তমানে কোনও প্রভাব ফেলেনি, তুমি ফেলতে দাওনি, ট্রাস্ট মি কুহেলি।

কুহেলি একরাশ বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে রইল আলেখের দিকে। কীকরে পারে সব পরিস্থিতিকে এত সহজে স্বাভাবিক করে দিতে! কুহেলির চোখের জল তখনও অবিরাম বয়ে চলেছে, আলেখ আর বেঁধে রাখতে পারল না নিজেকে। কিছুটা ঝুঁকে এসে নিজের কপালটা কুহেলির কপালে আলতো করে ঠেকাল। কুহেলি আলেখের ঘন হয়ে আসা উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারল নিজের মুখমণ্ডলে। গভীর আবেশে বুজে এল ওর চোখ দুটো, আলেখ ধীরে ধীরে ওর আলতো ঠোঁটের ছোয়ায় নোনা জলের তপ্ত বিন্দু গুলো শুষে নিল। কুহেলির অশান্ত মনের ঝড় শান্ত হয়ে আসছে, হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি গুলো যেন আবার জেগে উঠছে। আলেখ এক মুহূর্তের জন্য তাকাল ওর দুই হাতের মধ্যে থাকা কুহেলির মুখটার দিকে। সেই অপ্রতিরোধ আকর্ষণের টান আরও একবার অনুভব করল আলেখ। আজ আর নিজেকে আটকালো না সে, হয়তো সেই দুর্দমনীয় টান কে উপেক্ষা করার মত শক্তি আজ আর অবশিষ্ট নেই। দুর্নিবার সেই আকর্ষণের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিল আলেখ, ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল কুহেলির নরম গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট জোড়ার দিকে। ঈষৎ কম্পমান ঠোঁট দুটো যেন আপন শক্তিতে আলেখকে আকর্ষিত করছে নিজের দিকে। একসময় মুছে গেল মাঝখানের দূরত্ব টুকু, আলেখের ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠল কুহেলি। আলেখ যেন নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে চাইল ওকে, শুষে নিতে চাইল ওর সব কষ্ট। বাইরে গভীর হচ্ছে রাত, প্রগাঢ় হচ্ছে ওদের প্রথম চুম্বন, বাইরের শীতলতার সঙ্গে বাড়ছে ওদের সম্পর্কের উষ্ণতা।

ক্রমশ____________________

আজ আর কিছু বলব না। শুধু অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের। কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here